বুধবার, ১০ নভেম্বর, ২০১০

প্রবন্ধ >> গাটু, গাটুগান ও গাটুনাচ : মোহাম্মদ আবদুল হাই

গাটু, গাটুগান ও গাটুনাচ

মোহাম্মদ আবদুল হাই

লোক সংস্কৃতির এক প্রাণবন্ত ধারা হচ্ছে লোক সাহিত্য। কোনো নির্দিষ্ট ভৌগলিক পরিমণ্ডলে বসবাসরত একটি জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য হচ্ছে লোক সাহিত্যের বুনিয়াদ। মৌখিক ধারার এ সাহিত্য সাধারণত, অরজ্ঞানহীন সমাজে স্মৃতি ও শ্রুতির মাধ্যমে লালিত পালিত হয়। মূলে ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও সমষ্টির চর্চায় পুষ্ট হয়ে তা পরিপক্কতা লাভ করে। লোক সাহিত্য এজন্য জনগোষ্ঠীর আবেগ, ঐতিহ্য, চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে শিল্প সৌন্দর্যের মাধ্যমে রস ও  আনন্দদান করে। কোনো জাতির আত্মার নিনাদ লোক সাহিত্যের মধ্যে শোনা যায়। বাংলা লোক সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্যে এরকম একটি সমৃদ্ধ উপাদান হচ্ছে গাটুগান ও গাটু নাচ।
বাংলা লোকসাহিত্য গবেষকদের প্রায় সবাই গাটু গান ও গাটু নাচ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, ড. ওয়াকিল আহমদ, আবদুল হাফিজ, অধ্যাপক আসদ্দর আলী প্রমুখ লোক সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে গাটু গান বা গাটু নাচ কিংবা উভয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তবে এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি, বিস্তৃত ও অনুসন্ধানী আলোচনা করেছেন মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী। ‘লোকসাহিত্যে গাডু গান’ শীর্ষক তথ্যবহুল এ লেখায় গাটু গান ও গাটু নাচের উৎপত্তির পাশাপাশি অনেকগুলো গাটু গান বিবৃত করা হয়েছে। মনে করা হয় যে, এ লেখনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই পরবর্তীতে গবেষকগণ গাটু গান ও গাটু নাচের প্রতি উৎসাহী হন এবং তাকে প্রায় অবিকৃতভাবে অনুসরণ করেছেন। গাটু গান ও গাটু গান নিয়ে রচিত লেখাগুলো পড়লেই এর সত্যতা পাওয়া যায়। বিশেষ করে, গাটু গানের উৎপত্তি সংক্রান্ত আলোচনায় তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। কোনো গবেষকই সিরাজুদ্দিন কাসিমপুরীর বক্তব্যের সত্যাসত্য নির্ণয়ের চেষ্টা করেননি। এমনকি কোনো ভিন্নমতও তাদের লেখনীতে পাওয়া যায় না। তাই সিরাজুদ্দিন কাসিমপুরীর মতামতই প্রশ্নাতীতভাবে গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। গাটু গান ও গাটু নাচ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা সকল লোকসাহিত্য গবেষকদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে যে, তাদের লেখায় গাটু গান বা গাটু নাচ কিংবা উভয়টির উপর গুরুত্বারোপ করলেও ‘গাটু’ ব্যাপারটি উপেক্ষিত থেকে গেছে। বর্তমান আলোচনায় গাটু গান ও গাটু নাচের পাশাপাশি ‘গাটু’ বিষয়টির ব্যাপারে আলোকপাতের প্রচেষ্টা থাকবে। পাশাপাশি গাটু গানের উৎপত্তি বিষয়ক গতানুগতিক মতের ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশের চেষ্টা করা হবে।
‘গাটু’ শব্দটির উদ্ভবের ইতিহাস অস্পষ্ট। শব্দটি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। কোথাও ‘গাঁডু’, ‘গাডু’ আবার কোথাও উচ্চারিত হয় ‘ঘাঁটু’ ‘ঘাটু’ বা ‘গাটু’। পশ্চিমা কুলিদের মধ্যে উচ্চারিত হয় ‘গান্টু’। এটি একটি আঞ্চলিক শব্দ। এ শব্দের মূল বিচার করলে দুটি শব্দ পাওয়া যায় - ‘গান’ আর ‘ঘাট’। গান+টু>গান্টু>গাটু; আর ঘাট+উ>ঘাটু। বর্ষার দিগন্তব্যাপী হাওড়ের কূলে নৌকার পাতাটনের উপর গাটু গানের আসর বসার পর তা ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াতো বলে গানের বালককে গাটু এবং গানগুলোকে গাটু গান বলা হতো বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে সিরাজুদ্দিন কাসিমপুরী বলেন, ‘‘গান্টু’ নামে বালকদের নৃত্য সম্বলিত একপ্রকার গান বৃন্দাবন মথুরা থেকে গঙ্গার তীর ধরে রাজমহল পর্যন্ত প্রচলিত ছিলো; সে বিচারে গানগুলোর নাম ‘গাটু’ হওয়াই স্বাভাবিক।’ আমরা এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে সোজা-সাপটা ‘গাটু’ শব্দটি গ্রহণ করলাম।
লোক সাহিত্যের অন্যান্য উপাদানের মতো বাংলার সকল অঞ্চলে গাটু গান ও গাটু নাচের প্রচলন ছিলো না। ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনেকাংশ, ত্রিপুরার কিছু অংশ এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এর প্রচলন ছিলো বলে গবেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। উপরোল্লিখিত অঞ্চলের মধ্যে আবার যেসব এলাকা তুলনামূলকভাবে পশ্চাৎপদ, অনগ্রসর, ভৌগলিকভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম সেসব জনপদে এর বেশি প্রচলন ছিলো। জনসাধারণের মধ্যে গ্রামের কৃষক ও দিনমজুর শ্রেণীই ছিলো গাটুর প্রধান শৌখিন। অবশ্য সম্পন্ন পরিবারের বিশিষ্ট অনেক লোকও গাটু’র মোহে পড়তো এবং পৃষ্ঠপোষকতা দান করতো। ধর্মের দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, গাটু গান ও গাটু নাচের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় সবাই মুসলমান। কঠোর রক্ষণশীলতা, গতিহীনতা, শিক্ষার অভাব অপর্যাপ্ত বিনোদন ব্যবস্থা ছিলো গাটু’র প্রতিপালক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিশ্বায়ন নামের সর্বব্যাপী দৈত্যের হাত ধরে আসা অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার বিস্তার, বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রেডিও, টেলিভিশনসহ অন্যান্য মাধ্যমের সহজলভ্যতা; কঠোর, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারণে বিংশ শতকের সর্বশেষ দশকে গাটু গান ও গাটু নাচের প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি হারিয়ে যায়। যদিও বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে ও লোকচক্ষুর অন্তরালে গ্রামীণ কিছু অঞ্চলে এর সন্ধান পাওয়া যায়।
‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ গ্রন্থে ‘গাটু’ সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘বিশেষ ধরনের পেশাদার গাইয়ে ও নাচিয়ে ছেলে’। সাধারণভাবে বলা যায়, ‘গাটু’ হচ্ছে এমন একজন বালক যাকে দিয়ে বিশেষ ধরনের নৃত্য-সম্বলিত গান গাওয়ানো হতো। বাহ্যিকভাবে ‘গাটু’র এরকম সংজ্ঞাই প্রযোজ্য। কিন্তু ব্যাপারটি এতো সরল নয়। আমরা যদি আরেকটু গভীরে, অন্দরমহলে প্রবেশ করি তবে এরকম সাধাসিদে সংজ্ঞা নিতান্তই হাস্যকর মনে হবে। গাটু’র অন্তর্নিহিত বিষয়াদি জানার জন্য আমরা কয়েকটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দিই। আমরা জানতে চেষ্টা করেছি- ‘গাটু’ কে রাখতো, কেনো রাখতো কী ধরনের বালক গাটু হিসেবে নির্বাচিত হতো, গাটু ছেলের সঙ্গে কর্মের দিক দিয়ে প্রাধান্য পেতো কী - ইত্যাদি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে - গাটু’র রমরমা অবস্থাটির বিলুপ্তি ঘটে আজ থেকে মাত্র এক দশক আগে। বিক্ষিপ্ত ও লোক সমাজের অগোচর এখনো কিছু স্থানে অদ্যবধিও এর প্রচলন রয়েছে। সেদিনের সে গাটু বালকেরা আজ যৌবনের কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত; আর পৃষ্ঠপোষক ও শোখিনরা জীবনের অস্তায়মান দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছেন। সে রকম তিনজন যুবক (যারা শৈশব ও কৈশোরের দুরন্ত সময় গাটু হিসেবে অতিক্রান্ত করেছে) ব্যাপক খোঁজ করে পাওয়া গেছে। ব্যাপক অনুসন্ধানে চারজন গাটু গান, গাটু নাচ সর্বোপরি গাটুর প্রতিপালক, পৃষ্ঠপোষক ও সমঝদার পঞ্চাশ/ষাটোর্ধ্ব বয়সী লোক পাওয়া গেছে যারা অকপটে বিনিময় করেছেন তাদের জীবনের ফেলে আসা দিনের মূল্যবান অভিজ্ঞতা।
মাত্র এক দশক আগেও গাটু রাখা আর গাটু হওয়া যেখানে বিবেচিত হতো মর্যাদা আর বীরত্বের ব্যাপার হিসেবে, আজ তা বিবেচিত হচ্ছে লজ্জা, কলঙ্ক ও কুসংস্কার হিসেবে। যে বালক কোমরের হেলনিতে উন্মাদ করে তুলতো কঠিন মনের মানুষদের; নৃত্য ও গানের অপরূপ যাদুতে সম্মোহিত করতো তরুণ আর যুবকদের - সেদিনের সে বালকও আজ সঙ্কোচবোধ করে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান যৌবনকালের সবটুকুই যে কাটিয়েছে গাটুর পেছনে, বাহাদুর সে যুবকটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেও নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। মানবজীবনের এও এক অদ্ভুত দিক। নানাবিধ কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করে সেসব মানুষদের সাথে অন্তরঙ্গ ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা হয়। এভাবে তাদের জবানে গাটু জীবনের খুঁটিনাটি নানা দিক সম্পর্কে অকপট স্বীকারোক্তির মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়।
যে ‘গাটু’ বালকের প্রতিপালক, শোখিন, রক্ষাকর্তা - সর্বোপরি মালিক ছিলো সমাজে তাকে ‘খলিফা’ ডাকা হতো। এ বিখ্যাত রকম একজন ‘খলিফা’ ছিলেন - সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সেলগ্রামের আবদুল করিম। তিনি জীবনে ১৬টি ‘গাটু’ রেখেছিলেন। সত্তরোর্ধ্ব সে প্রবীণ ব্যক্তির অকপট ও সরল স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে ‘গাটু’ সম্পর্কিত অনেক অজানা অধ্যায়। তার মতে, ‘গাটু’ ছিলো মূলত একটা নেশার নাম। এ ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করতো। নেশাখোর যেমন নেশার টানে বুঁদ হয়ে যায়; গাটু ব্যাপারটিও সেরকম।
‘গাটু’ বালক সাধারণত, দূরান্তের কোনো স্থান থেকে ধরে আনা হতো। পছন্দ হলে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় ধরে আনা হতো। ‘গাটু’ হিসেবে সে ছেলেকেই পছন্দ করা হতো, যে দেখতে সুন্দর আকর্ষণীয়। শারীরিক নিখুঁততার দিকেও নজর দেওয়া হতো। মিথ্যা প্রলোভন কিংবা চাকরির প্রলোভন দিয়ে ফুঁসলিয়ে আনা হতো। আনার পর আদর যত্ন সোহাগ আর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হতো জীবন। সুন্দর সুন্দর দামি পোশাক, সুস্বাদু খাবার আর সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রী গাটু’কে ভুলিয়ে দিতো ফেলে আসা জীবনের কথা। এক সময় সে পোষ মানা পাখির মতো ‘খলিফা’র জীবনের সাথে জড়িয়ে যেতো। গাটু বালক ‘খলিফা’কে মামা নামে সম্বোধন করতো। বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ মাঝে মাঝে সমবয়সী প্রিয়জনদের কাছে ‘খলিফা’ ‘গাটু’কে ‘নাইওর’ দিতো। অন্যান্যরাও তাদের ‘গাটু’কে অন্য ‘খলিফার কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘নাইওর’ দিতো। আপন স্ত্রী-সন্তানের চেয়ে অগ্রাধিকারের দিক থেকে ‘গাটু’ একটুও কম ছিলো না। ক্ষেত্র বিশেষে ‘গাটু’ এগিয়েও ছিলো। ‘গাটু’কে এরপর বিশেষ ধরনের নাচ ও গানের তালিম দেওয়া হতো। সাধারণত, ‘খলিফা’রাই এ কাজটি করতো। দাড়ি, গোঁফ আর ‘Pubic Hair’ গজানোর সাথে সাথে ‘গাটু’কে সসম্মানে বিদায় করা হতো। অনেককে আর্থিক পুনর্বাসনও করা হতো। এ মতের সাথে অন্য দু’জন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিখ্যাত ‘খলিফা’ একমত পোষণ করেছেন। গাটুদের সাথে যৌন সঙ্গম যে মূখ্য ছিলো এ ব্যাপারেও তারা একমত পোষণ করেন।
সিলেট-তামাবিল সড়কে ট্রাক চালক হিসেবে কর্মরত আছেন করিম ও ফারুক। দু’জনেই এক সময় ছিলেন নামকরা ‘গাটু’। বর্তমানে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত মুদি দোকানদার হচ্ছেন মদচ্ছির। তিনিও শৈশব ও কৈশোর অতিক্রান্ত করেছেন ‘গাটু’ হিসেবে। সবাই-ই বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায় - প্রত্যেককে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। অভাবের তাড়না আর মা-বাবার নির্যাতনে এদের দু’জন চাঁদনিঘাটে ও অন্যজন কালিঘাটে নামকাওয়াস্তে মজুরিতে দিন মজুরের কাজ করতো। রাতে ঘুমাতো ব্রিজের নিচে। একদিন একজন ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যায়। তারপর শুধুই আদর সোহাগ আর সুখ-যা তারা জন্মের পরও পায়নি। মাস শেষে টাকাও দেওয়া হতো। কিন্তু কাজের কথা বললে এড়িয়ে যাওয়া হতো। এভাবে এক সময় তারাও নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
কী করা হতো তোমার সঙ্গে - জানতে চাইলে ফারুক প্রথমত ইতস্তত করলেও পরবর্তীতে বলেন, মূলত, আমার সাথে মামা যৌনকর্মই করতো। এমন সব বিচিত্র কৌশলে -যা সে জীবনেও কল্পনা করেনি। তার মতে, আমার মামার স্ত্রী ছিলো অত্যন্ত সুন্দর। কিন্তু একদিনও আমি মামাকে স্ত্রীর কাছে যেতে দেখিনি। একই বিছানায় আমরা সবাই মাঝে মাঝে থাকতাম। মামা আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। অন্য মামারাও ‘নাইওর’ নিয়ে একই কাজ করতেন। তাদের ধ্যান জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বদা আমিই থাকতাম। যৌন সঙ্গমের সুনির্দিষ্ট ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে করিম বলেন, আসলে মাঝে ‘Sodomy’ করা হতো। ‘Oral Sex’ও কম হতো না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবলম্বন করা হতো অন্য প্রকার কৌশল। ব্যাপারটি তিনি বিস্তারিত বললেও এ সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে। যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে উপরোক্ত তিনজনই প্রায় একই মত প্রকাশ করেছেন। বর্তমানেও যে ‘গাটু’ প্রথা বিচ্ছিন্নভাবে প্রচলিত আছে তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাপক অনুসন্ধানে এ রকম এক ‘গাটু’র সন্ধান পাওয়া গেছে। তার নাম হচ্ছে বুলবুল (১৩)। সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার হাখরপুর গর্দনা গ্রামের বুলবুল বর্তমানে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে ‘গাটু’ হিসেবে দিনাতিপাত করছে।
দেখা যাচ্ছে ‘গাটু’ ব্যাপারটির সাথে যৌন সম্পর্কের দিকটিই মূখ্য। বিশেষ করে সমকামিতার ব্যাপারটি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাতের প্রয়োজন আছে। এটি ‘গাটু’র উৎপত্তি সংক্রান্ত আলোচনায় সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।
ইংরেজি ‘Homosexuality’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে সমকামিতা। সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার যৌন প্রবৃত্তিকে সমকামিতা বলা হয়। আর যারা সমলিঙ্গের প্রতি এ রকম আকর্ষণ বোধ করেন তাদের বলা হয় সমকামী। আরবিতে সমকামীকে ‘Mukhanalth’ বলা হয়। প্রাচীনকালে সমকামীদের বোঝাতে ‘পরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। কেউ কেউ সমকামীতাকে আরেকটু শালীন রূপ দিতে সমপ্রেম শব্দটির প্রচলন ঘটাতে চান। সমকামিতার ইতিহাস মানুষের যৌন ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাচীন শিকারী-সংগ্রাহক সমাজ থেকে শুরু করে আজকের শিল্প সমাজ পর্যন্ত তা বিস্তৃত। বিভিন্ন সমাজে তার রূপ ছিলো বিভিন্ন। কখনো তা প্রকাশিত হয়েছে, সমাজচক্ষুর ভয়ে তা আবার চর্চিত হয়েছে অগোচরে। প্রাচীন রোম, গ্রীস থেকে শুরু করে আজকের সভ্যতার প্রত্যেক স্তরে সমকামিতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে বর্তমানে একে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনও চলছে।
কোরআন, বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টে লুত (আ.) নবীর জাতির মধ্যে সমকামীতার উল্লেখ পাওয়া যায়। সমকামীতার শাস্তিস্বরূপ বসবাসস্থলসহ পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে বিবরণ আছে। ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতো মুসলমান সমাজেও তা লোকচক্ষুর অন্তরালে ও বিচ্ছিন্নভাবে চর্চার প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। খলিফা আল মু’তাসিমের শাসনকালে চালুকৃত ‘Ghilman’দের কথা বলা যায় - যা ভারতীয় উপমহাদেশেও প্রচলিত হয়। যদিও ‘Ghilman’রা বাহ্যিকভাবে দাস সৈন্য ছিলো; তারপরও তাদেরকে যৌন কাজে লিপ্ত করা হতো। হেরেম প্রহরার জন্য ‘Eunuch’দের (খোজা) কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিখ্যাত শাসক মাহমুদ গজনভীর সুদর্শন বালকপ্রেমের কথা ও আয়াজের ঘটনা ইতিহাসে সুবিদিত।
বাংলার রক্ষণশীল সমাজেও সুদর্শন বালকপ্রীতির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলো। কঠোর রক্ষণশীল সে সমাজে পরনারী দর্শন চরম পাপ ও বিনোদনের সুযোগ ছিলো সীমিত। এমন বৃদ্ধ ও স্থবির সমাজের যুবকেরা যে যৌন প্রবৃত্তি নিবারণ ও বৈচিত্রতার জন্য সামাজিকভাবে অনেকটা সহনীয়  - সুদর্শন ও আকর্ষণীয় বালকদের প্রতি ঝুঁকতে পারে তা অস্বাভাবিক নয়। পাশ্চাত্যেও এ রকম শিশু থেকে যৌন আনন্দলাভের কৌশল চালু আছে। যাকে ‘Pedophilia’ বলা হয়। কিন্তু বাংলার যুবকরা ধরে আনা সুন্দর বালকদের সাথে যা করতো তার নাম হচ্ছে ‘Thighing’। যৌন কর্মের এ কৌশলটি হচ্ছে ‘The child’s legs are pressed together and the abuser inserts his penis between thighs of the little boy or girl.’ ‘গাটু’ ছেলেদের জবানি ও ‘খলিফা’দের স্বীকারোক্তিতে ব্যাপারটি পুরোপুরি মিলে যায়।
‘গাটু’ গানের উৎপত্তি সম্পর্কে সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরী বলেছেন, ‘ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে শ্রীহট্টের আজমিরীগঞ্জ নিবাসী জনৈক আচার্য্য রাধাভাবের নানা লীলাখেলার মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকতেন। ক্রমে তার শিষ্য সংখ্যা বাড়তে লাগলো - নিম্নশ্রেণীর বহু বালকও তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো। এই ছেলেদের রাধিকাভাব সম্পন্ন উক্ত আচার্যের সখী সাজানো হতো এবং তারা নীরবে নেচে রাধার বিরহের বিভিন্ন অবস্থা প্রকাশ করতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিরহ সঙ্গীতের সমন্বয়ে গড়ে উঠে ‘গাঁডু’ গান।’ সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরীর এ মতের সত্যাসত্য নিরূপণের জন্য আজমিরীগঞ্জের প্রবীণ, অভিজ্ঞ, গাটু গানের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজন ব্যক্তির সাথে কথা হয়। তাদের কেউ-ই সে বৈষ্ণব আচার্যের কোনো সন্ধান দিতে পারেননি। আজমিরীগঞ্জই যে গাটু গানের উৎপত্তিস্থল - এ ব্যাপারটিও তাদের অজানা। সম্ভবত, জনশ্রুতি বা কোনো কল্পনাপ্রবণ ব্যক্তির বর্ণনা দ্বারা সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরী প্রভাবিত হয়েছিলেন। লোক সাহিত্যের অনেক উপাদানের মূলে ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব যে ছিলো - তা অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু গাটু গানের উৎপত্তির ব্যাপারটি যেভাবে সরলভাবে বিবৃত হয়েছে - প্রকৃতপক্ষে তা তথ্যভিত্তিক ও যুক্তিসঙ্গত নয় বলে আমরা মনে করি। কঠোর রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে যৌবপ্রবৃত্তি নিবারণের জন্য সুদর্শন ও আকর্ষণীয় ‘গাটু’ বালক রাখার যে প্রচলন ছিলো; কালক্রমে এ ছেলেকে দিয়ে আরো বিনোদন ও আনন্দ উপভোগ করার জন্য গান ও নাচের ব্যাপারটি যুক্ত হয়েছে বলে আমরা মনে করি। লঘু রঙ্গরসের আলকাপ গানের সাথে ছোকড়া নাচের যে প্রচলন পশ্চিবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদহ জেলায় চালু ছিলো - সেটিই এতদঞ্চলে গাটু গান ও গাটু নাচ রূপে ব্যক্ত হয় বলে আমাদের বিশ্বাস। সিলেটের বিথঙ্গলের জগন্মোহন প্রবর্তিত ‘কিশোরীভজন’ নামে বৈষ্ণব উপ সম্প্রদায়ের ভজন ও নাচের প্রভাব এক্ষেত্রে থাকতে পারে। ষোড়শ শতকে আজমিরীগঞ্জে ‘গাটু’ ছেলেদের  আনুষ্ঠানিকভাবে হয়তো প্রথম ‘ছোকড়া নাচ’ অথবা ‘কিশোরীভজন’র ব্যাপারটি ভিন্ন ঢঙে পরিবেশিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ‘গাটু’র পুরো ব্যাপারটি আরো পুরনো। বলা যায়, বিকৃত কিংবা অস্বাভাবিক যৌনরুচির সর্বজনীন কৌশল ‘সমকামীতা’র স্থানীয় রূপ হচ্ছে ‘গাটু’ - যার সাথে পরবর্তীতে গান ও নাচ যুক্ত হয়। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে - গাটুর সমঝদার ও প্রতিপালক লোকেরা যদি সমকামী বিশেষত Gay হয়, তাহলে এরা বিপরীত লিঙ্গের অধিকারীকে বিয়ে করে ঘর সংসার করে কীভাবে? তাদের কাউকেই তো চিরকুমার জীবন যাপন করতে দেখা যায়নি।  এক্ষেত্রে বলা যায়, সমকামীতাকে নিরুৎসাহিত করে বিসমকামীতাকে উৎসাহিত করার সামাজিক একটা চাপ সর্বদাই থেকে যায়। অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ রক্ষণশীল সমাজে এই চাপ আরো প্রবল। ফলে দেখা গেছে, সমাজের চাপে পড়ে একজন সমকামী ব্যক্তি বিসমকামী হয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্ত্রী বা স্বামী বাচ্চা নিয়ে সংসার করছেন। এদের বলা হয় নিভৃত সমকামী (Closet Gay)। আমাদের আলোচ্য গাটু সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা মূলত, নিভৃত সমকামী (Closet Gay) বৈ কিছু নয়। 
‘গাটু নাচ’ হচ্ছে মেয়ের সাজে ছেলের নাচ। এটি বাংলার আঞ্চলিক নাচ। মূলত, নাচের জন্যই রচিত হতো বিশেষ গান। লোকনৃত্যের মধ্যে একমাত্র গাটু নাচেই গানের ভাবার্থ ধরে নাচের ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলা হয়। গাটু গান আধুনিক অপেরার মতো অভিনয়মুখী। অপেরার নেপথ্যের গানের ভাবকে সুবিন্যস্ত অঙ্গভঙ্গি দ্বারা ব্যক্ত করা হয়। এ ধরনের গ্রামীণ সংস্করণ গাটু নাচ। গানের বিষয়, কণ্ঠের সুর, বাদ্যের তাল-সঙ্কেত অনুযায়ী গাটু অঙ্গ প্রতঙ্গের বাহ্যিক কলা-কৌশল দ্বারা নৃত্যাভিনয় করতে থাকে। গানের ভাবও তাল বাদ্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার নৃত্যভঙ্গিমাও পরিবর্তিত হয়। এরূপ একটি দীর্ঘ পালাকে সারা রাত ধরে ঘাটু নৃত্যমূর্তি দান করে। ঘাটু নাচের আসরে ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো উপলক্ষ নেই; লোক মনোরঞ্জনের নিমিত্তই এর আয়োজন করা হতো। গাটু নাচের দলগুলো অধিকাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের; দর্শক ও মুসলমান জন-সাধারণ। পরপুরুষ দর্শনমাত্র যেখানে কঠোর পাপের শাস্ত্রীয় বিধান রয়েছে সেখানে লোক মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে রমণীর নাচের অংশগ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিলো । সমাজের জনগণের চাহিদা পূরণের জন্য বালকের দ্বারাই তাই রমণীয় বেশ-বাশে সাজিয়ে ছেলেকে নাচানো হতো।
গাটু গান হচ্ছে গাটু ছেলের গান। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গাটু নাচের জন্যই গাটু গান রচিত হয়। রাধার বিরহই হচ্ছে গাটু গানের প্রধান উপজীব্য। গানগুলো সংক্ষিপ্ত দুইপদী বা তিনপদী। গায়কেরা এগুলোকে দুহারী বা তিহারী বলে থাকেন। চম্পক আঙ্গুলি সঞ্চালন করে নৃত্যের ভঙ্গিমায় বর্ষা মেদুর প্রকৃতির পটভূমিতে গাটু বালকদের বিরহসুর শ্রোতাদের উন্মাদ করে তুলতো। অনেক সময় সমঝদাররা আসর করে বসে পালাক্রমে গান গেয়ে থাকে। এ সময় ‘গাটু ছোকরা’ নীরব অঙ্গভঙ্গি সহকারে নেচে গীত সংগীতে ভাবের অভিব্যক্ত প্রকাশ করে থাকে। গাটুর গানের মধ্যে নৃত্যসম্বলিত গীত, খেয়াল আর অঙ্গভঙ্গি দ্বারা ভাব প্রকাশক সমগানই প্রসিদ্ধ। সমগানের রাগিনী বড়ই করুণ, মধুর ও হৃদয়গ্রাহী। সমগানের প্রত্যেকটি কথা ফেটে যেনো বিরহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। গাটু গানের যন্ত্র হিসেবে ঢোল, করতাল, মন্দিরা, বেহারা প্রভৃতির প্রচলন ছিলো। গাটু গান সমসাময়িক বিষয়বস্তু ও ভাব সম্ভার নিয়েও রচিত হতো।

এক.
বাড়ীত দিওনা ও মামুজি বাড়ীত দিও না
হেনগামের মামু যারা
চউখে দেখি লাল
চঙল মারি ধইরা আইনলা
ছ’মাসের ছাবাল (শিশু)।
মামুজি বাড়ীত দিওনা
আমি যে তোমার
তুমি যে আমার
তুমি বিনেও মামুজি দুনিয়া অন্ধকার।
বাড়ীত দিওনা ও মামুজি বাড়ীত দিও না
গাঙে কাইটা ভাসাই দেও মামু
বাড়ীত দিওনা ॥

দুই.
আজ নিশী স্বপনের কথা
বুঝতাম পারি না
বাজারে চইলাসো মামু
ফিরে আইলেনা।
বাড়ির কান্দাত (কাছে) বাজার ছিল যাইতে পারিনা।
উত্তর বাড়ীর কালা গুণ্ডা কয় মনের কথা
দরবস্ত বাজারের সিগারেট খাইতে দিলনা।

তিন.
কেঁদে কেঁদে কেঁদে মরি
কেউ নাই আমার দরদী,
রূপ তোমার মনধারা
সোনার অঙ্গ হইলো সারা
দুই নয়নে নদী-নালা
অভাগিনীর জোরে মরি।

চার.
কেনেরে ফুল রক্ত জবা জলে ভাস কি জন্য?
চার কোণে চার সন্দুক আছে কন্যার ঘরে সন্তান হইলে
পিতা ডাকবো কারে
ছগ তুই আশা দিয়া কোন আশা কোন বলনা
পথে ঘাটে দিয়া আশা পরারে দিয়াছো যখন
আমারে কর মানা আশা
পিরিতি সকলে জানেনা
হায়রে মন আমার পিরিত গাছের ফল
শুধু ডাব নারিকেলের জল
এরু (এটুকু) খাইয়া সোনা বন্দের মন হয় পাগল
আয়না চোখে কাজল দিয়া রং মহলে চাইতেছি
রং মহলের বাবু যারা
ঝিলমিল মশর ফারা (ছেঁড়া)
টানাটানি করই নারে
গাটু আমার পুরানা ॥

পাঁচ.
ফুল মতি মিনরাই, প্রেমের ডোরে বানছে তরে
কাল সকালে যদি নাগাল পাই’
গেছোগো রাই তোর মন্দিরে
কেন রাই দেখা দিলে
মনের আগুন দ্বিগুণ জ্বালাইলে।

ছয়.
বড় ইশকেরই পাগলরে বন্ধু
পাগল করিলে
তোমায় যদি পাইতামরে বন্ধু
মনের দুঃখ খুলিয়া কইতাম,
তোমারে পাইলেরে বন্ধু।

সাত.
নিশি ফুলের গুমেল ছই
নিমুখ ইয়া যাইতে এখন আইছো প্রেম বাড়াইতে
প্রেমযান না অখালায় চান
কালিযান কান্দাইতে॥

আট.
আমার ভাঙ্গা নায় যে বাইতে পারে
তারি বলি নাইয়া
উজান গাঙ্গের সুজন নাইয়া
বালু চরে নাও লাগাইয়া ডাকে রসের বাইয়া
এদেশের চল্ না (রীতি) যত নানি বড় নানা ছোট
নানা হয়রে গাঙ্গের পানি নানি
লয়রে মজার গান, লম্বা চুলের বরমসিল
ময়মনসিংহ জেলায়।

নয়.
দেশের ছোকড়ি দেশে আয় কত গুন্ডার মন মজায়
তরে লইয়া মামলা চলে বিচার হয় হাই কোটেতে
ময়মনসিংহ জেলায়।
পাকি আম পাকি জাম এলেকির পরে
আজ তোমারে লইয়া যাইবো মধু খাওয়াতে
গহিনও জঙ্গলার মাঝে আছে ময়দান
বিছানা বিছাইয়ারে ময়নায়
যৌবন করল দান।

দশ.
বাইরে অবিজিল শাড়ী সোনায় বরণ শরীরে
আমার রূপের শরীরলে গামছা
তোমার গামছা কান বিছাইয়া, শামরে
ও শাম পুরায় মনের বাসনা।
এগারো.
হালকা ধুত্তি কোমর ধান সুন্দরীগো যৌবন কর দান
তোমার  ঠোঁট দেখা যায়
লামার ছকিনা গাঁজায় টান
সুন্দরীগো যৌবন কইরা যায় দান।

বারো.
নদীয়ার কিনারে বাঁশি বাজাইছ নারে কালার চান
শুনিয়া কালার বাঁশির টান বাইরম বাইরম করে,
আমার হাতের বাজুর বাইন্দার
শোনতাম কালার বাঁশির নাম।

তেরো.
মধু মালা গো সখি তরে যদি পাই
কতই নদী কতই সাগর পারি দিয়ে যাই
মালা তরে যদি পাই।
তোর মতো সুন্দরী পাইলে বুকে বুক মিলাই
মালা তোরে যদি পাই .... ।

চৌদ্দ.
সালামও জানাইলাম সালাম।
সিলট জিলায় বসত বাড়ী
জৈন্তাপুর থানা পোস্ট অফিস দরবস্ত বাজার।
শিলং লানির পশ্চিম দ্বারে ডাউয়া গেরাম।
উস্তাদের নাম নূরুল হক
মামা, সভায় জানাইলাম।
এত রাত্রের পরের গাজন সাজাই আনি
তোলা গাউটার (গ্রামের) মাথায় তুলে
দাওরে সকল ফুলের নমুনা।
বন্ধনা যে করি গো শাম মায়ের বংকো
ব্যাপারি কোন উস্তাদের চরণ
শিরে করি বন্ধন।
কৈলাশেতে গিয়ে আমরা
শির বন্ধন করিগো ॥
তোর মন যদি এত ছিলো
হাঁরে কালার ছান।
আজই আমারে আইনা দেরে
আসমানের চান।
মন্দিরারই উননু ঝুননুর
বেহালার লম্বা টান
ঢোলকেরই আগলা টুকা
উত্তাইলো পরান।

পনেরো.
কেন গো মা তুমি
পাগলীর বেশে
জবা রক্ত ফুল গাঁথিয়া
দিলাগো মা তোর শরীরে
আজি বিহনে ছাড়লাম গো মা
পাগলীর বেশে।
শাম, তোমায় করি মানা
ভাঙ্গা ঘর ছুঁইওনা
ভাঙ্গা ঘরে নেরার (খড়কুটো) ছানি
টপ টপ পাইয়া পড়ে পানি
বালিশ ভিজলে যেমন তেমন
তোশক ভিজলে ছাড়বো না।

ষোলো.
গেলগো পিরিতের নেশা
ও যুবতী জল ভরবো না
ভরবো আর ভরবোনা ইন্দুস্তানী।
আর যাবোনা গাটু’র গানে
যদি বাঁচি
নাচো নাচো ও সুন্দরী
যতন করিয়া,
হাতে তোমার বান্ধা ঘড়ি
ঘড়ি পিছে লেখা আছে
ঐখানে তুই নাচতে হবে
তুমি যাওরে তরু দলে
আমি আসবো সন্ধ্যা পরে।

সতেরো.
নাছন কর সুন্দর পিয়ারী
আউলাইয়া মাথার কেশ।
নাছিয়ে নাছিয়ে দুই আংকিটারিয়ে
নিষেধ করি মামা
কমর ভাঙ্গা নানা দেশ।
আজই আমায় ছুঁইওনা,
একদিন দুইদিন তিন দিন
যে ব্যামার (রোগ) হইয়াছে রে শ্যাম
চান্দ মাসের লাঞ্ছনা
যে ব্যামার হইয়াছে নিদি
তোমারই শরীরের মাঝে
ঢাকা থাকি আনলাম ডাক্তার
রোগী ধরি দেখবে ডাক্তার
ব্যামার আমার পেটের তলায়।

আঠারো.
কালায়নিল কুল মান
কালার জাত ও বেঈমান,
কালা আমার শালা
নাইরে বুঝি জ্ঞান
এমন করি আইছে কালা
নিতো কুলমান ।
সখি, আর কত জ্বালা সইবো
অভোলার পানে
সারা নিশি ঘুরে মরি
প্রেমের অনলে
ঘুরে ঘুরে আওরে পাখি
আকাশ ভুবনে .... ।

ঊনিশ.
সবারই মাঝে সালাম জানাই আমি অধমে
সালাম জানাই আমি অধমে, সালাম জানাই
আমি অধমে।
সালাম পরে আলেক (উত্তর) লইলাম তার পাশে বন্দনা গাইলাম
তার পাশে তার বইবার জায়গা চাই
সবারই মাঝে,
সালাম জানাই আমি অধমে।

বিশ.
ললিত গো কৃষ্ণ সাজাও
মনের বাঞ্চা পুরাইতে আসিবেন গোলকবিহারী
ফুলের রত্ম সিংহাসনে,
বইসে রইলাম রাই কো কুঞ্জে
আসবে বৈলে আশায় আশায়’
হোইলাম নিশি
প্রাণ সখিরে আইলোনা পোড়া বিদেশী
কোন না কামিনী সনে কাটা এদিন রাতিয়া
পিউয়া আরে দহে মোরা ছাতিয়া॥

একুশ.
কি হেরিলাম যমুনায় আসিয়া গো সজনী
বনমালী তরুয়া মূলে।
যাইতে যমুনার জলে
সেই কালা কদম তলে
ও রূপ চাইতে কলসী নিল স্রোতে।

বাইশ.
দেখবে ইংরেজ লোকে কি কল কৈরাছে?
সাত সাগর পাড়ি দিয়া রাজ্য পাতাইছে
জঙ্গল কাইট্যা সড়ক দিছে
সেই সড়কে তার বসাইছে
দিনের খবর ঘড়িত্ আইনাছে ॥
 
>> পথিক ১৮

1 টি মন্তব্য:

  1. গাটু গান, ঘাটু নাচ সম্পর্কে জানতে পারলাম।
    বিশ নাম্বার গানে 'পিউয়া' শব্দের উল্লেখ আছে। 'পিউয়া' শব্দের অর্থ কি?????

    উত্তরমুছুন