ঘূর্ণি
অমল কর
ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ শব্দে চলছে গরুর গাড়ি। মেঠো পথ। গাড়িটাও বুড়ো। শব্দ তো নয়, যেন ককানি। কৃশকায় হাড় জিরজিরে বলদ দুটোরও হাঁফ ধরে গেছে। অনেকক্ষণ দানা পানি পড়েনি। চোখ করুণ, গাল বেয়ে অবিশ্রান্ত লালা চুঁইয়ে পড়ছে।
ধূমল ধুলোর মেঘের ভেতর সম্রাট বরাট স্ত্রী শতাব্দীকে নিয়ে নামলো গাড়ি থেকে। বোঝা হাল্কা হওয়ায় খানিক স্বস্তি জোড়া বলদের।
পাহাড়ে ঘেরা সবুজ আস্তরণে ঢাকা ছোট্ট শহর। ক্লান্তিকর একঘেয়ে গাড়ি চড়ে বিরক্তি নিয়ে শহরের আদালতকক্ষে ঢুকে আদব কায়দা ভুলে বিচারকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডাকাবুকো মেয়ের মতো শতাব্দী ঝলসে উঠলো, ‘হুজুর, আমরা ডিভোর্স চাই।’ ঝাউবনের ভেতর থেকে যেন একাট সোঁ সোঁ আর্ত বাতাস বয়ে এলো।
শতাব্দীর কথা শুনে সম্রাট বরাটের বুকের ভেতর কেমন যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠলো। কি এক অব্যক্ত ব্যথায় গুমরে উঠছে সমস্ত মন, শরীর। সে-ব্যথা গোপন রেখে সম্রাটও ততোধিক দৃঢ়তায় বললো, ‘হ্যাঁ, বিবাহ বিচ্ছেদ। আজই। এক্ষুণি।’ বিচারকের পেছনের দেওয়ালে একটা আরশোলাকে একটা টিকটিকি গিলে ফেললো। দেখলো করুণভাবে শতাব্দী। মুখটা পাণ্ডুর হয়ে গেলো। সম্রাটের কথায়, নাকি টিকটিকি-আরশোলার কাণ্ডে - বুঝতে পারা গেলো না।
সম্রাট আরও বললো, ‘হুজুর, এভাবে আমরা আর থাকতে পারি না। এ-এক দুর্বিষহ ব্যাপার। নিঃসঙ্গ পাহাড়ি জায়গাতেও ওকে আমি সইতে পারছি না। ওঃ, হরিবল। বন-বেড়ালের মতো সারাক্ষণ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ আর হুঁতোম প্যাঁচার মতো গোমড়া মুখ, অসহ্য।’
শতাব্দীর পাল্টা অভিযোগ। যেন ঠোঁটের ডগায় তৈরি উত্তর। ‘অবশ্যি লোকটা যদি অপদার্থই হয়। মদো মাতালের সাথে দোস্তি করে মদ গিলে চুর হয়ে থাকে, বিছানায় বমি ওগড়ায়, কুম্ভকর্ণের মতো বেসুরো নাক ডাকে আর বাজে মার্কা হাড়হাভাতে কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়...’
‘আর মহিলাটি যদি দিবানিদ্রা দেয়, গল্পের বই পড়ে রান্না পোড়ায়, আচার খায়, পোষা কুকুরের গায়ে গরম জল ঢেলে দেয় আর রান্নাঘরে ঢুকে এটা নেই-ওটা নেই-সেটা নেই বলে চৌপরদিন অভিযোগের পাহাড় গড়ে তোলে, তাহলে...’
‘আর লোকটা যদি এখানে ওখানে সেখানে এর ওর তার সাথে অকারণে শ্লীল-অশ্লীল কথা বলে বদনাম কুড়োয়, তখন তার সাথে এক দণ্ডও থাকা...’
‘অর্ডার! অর্ডার!’ জাস্টিস অব পীস্ ইন্দ্রনীল ডাইসন আইনের বই ঘেঁটে অনেক কসরতের পর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘যদিও এ-আদালতকে আইনগতভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনও নির্দেশ দেওয়া নেই, তথাপি ন্যায়নীতি সংবিধান এবং গোল্ডেন রুলের ... ধারা অনুসারে জাস্টিস অব পীস্ পুরুষ এবং নারীর বিয়ের গাঁটছড়া যেমন বেঁধে দিতে পারেন, তেমনি ... উপধারানুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদও করাবার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। এবং’ চশমাটা উপরে তুলে পিট পিট চোখে বিপর্যস্ত নারী পুরুষকে দেখে নিয়ে বললেন ‘সুপ্রীম কোর্টেও তা আইনত গ্রাহ্য। এ-ব্যাপারে আদালতের দক্ষিণা স্ট্যাম্প খরচ, মুহুরীর পারিশ্রমিক এবং টাইপ খরচসহ দিতে হবে একুনে ... টাকা।’
সম্রাট অসহায়ের মতো টাকা গুনে দেয়। শারীরিক কসরত এবং মানসিক পরিশ্রম করে হুকুমনামা লিখলেন মি. ডাইসন -
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ শব্দে চলছে গরুর গাড়ি। মেঠো পথ। গাড়িটাও বুড়ো। শব্দ তো নয়, যেন ককানি। কৃশকায় হাড় জিরজিরে বলদ দুটোরও হাঁফ ধরে গেছে। অনেকক্ষণ দানা পানি পড়েনি। চোখ করুণ, গাল বেয়ে অবিশ্রান্ত লালা চুঁইয়ে পড়ছে।
ধূমল ধুলোর মেঘের ভেতর সম্রাট বরাট স্ত্রী শতাব্দীকে নিয়ে নামলো গাড়ি থেকে। বোঝা হাল্কা হওয়ায় খানিক স্বস্তি জোড়া বলদের।
পাহাড়ে ঘেরা সবুজ আস্তরণে ঢাকা ছোট্ট শহর। ক্লান্তিকর একঘেয়ে গাড়ি চড়ে বিরক্তি নিয়ে শহরের আদালতকক্ষে ঢুকে আদব কায়দা ভুলে বিচারকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডাকাবুকো মেয়ের মতো শতাব্দী ঝলসে উঠলো, ‘হুজুর, আমরা ডিভোর্স চাই।’ ঝাউবনের ভেতর থেকে যেন একাট সোঁ সোঁ আর্ত বাতাস বয়ে এলো।
শতাব্দীর কথা শুনে সম্রাট বরাটের বুকের ভেতর কেমন যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠলো। কি এক অব্যক্ত ব্যথায় গুমরে উঠছে সমস্ত মন, শরীর। সে-ব্যথা গোপন রেখে সম্রাটও ততোধিক দৃঢ়তায় বললো, ‘হ্যাঁ, বিবাহ বিচ্ছেদ। আজই। এক্ষুণি।’ বিচারকের পেছনের দেওয়ালে একটা আরশোলাকে একটা টিকটিকি গিলে ফেললো। দেখলো করুণভাবে শতাব্দী। মুখটা পাণ্ডুর হয়ে গেলো। সম্রাটের কথায়, নাকি টিকটিকি-আরশোলার কাণ্ডে - বুঝতে পারা গেলো না।
সম্রাট আরও বললো, ‘হুজুর, এভাবে আমরা আর থাকতে পারি না। এ-এক দুর্বিষহ ব্যাপার। নিঃসঙ্গ পাহাড়ি জায়গাতেও ওকে আমি সইতে পারছি না। ওঃ, হরিবল। বন-বেড়ালের মতো সারাক্ষণ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ আর হুঁতোম প্যাঁচার মতো গোমড়া মুখ, অসহ্য।’
শতাব্দীর পাল্টা অভিযোগ। যেন ঠোঁটের ডগায় তৈরি উত্তর। ‘অবশ্যি লোকটা যদি অপদার্থই হয়। মদো মাতালের সাথে দোস্তি করে মদ গিলে চুর হয়ে থাকে, বিছানায় বমি ওগড়ায়, কুম্ভকর্ণের মতো বেসুরো নাক ডাকে আর বাজে মার্কা হাড়হাভাতে কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়...’
‘আর মহিলাটি যদি দিবানিদ্রা দেয়, গল্পের বই পড়ে রান্না পোড়ায়, আচার খায়, পোষা কুকুরের গায়ে গরম জল ঢেলে দেয় আর রান্নাঘরে ঢুকে এটা নেই-ওটা নেই-সেটা নেই বলে চৌপরদিন অভিযোগের পাহাড় গড়ে তোলে, তাহলে...’
‘আর লোকটা যদি এখানে ওখানে সেখানে এর ওর তার সাথে অকারণে শ্লীল-অশ্লীল কথা বলে বদনাম কুড়োয়, তখন তার সাথে এক দণ্ডও থাকা...’
‘অর্ডার! অর্ডার!’ জাস্টিস অব পীস্ ইন্দ্রনীল ডাইসন আইনের বই ঘেঁটে অনেক কসরতের পর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘যদিও এ-আদালতকে আইনগতভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনও নির্দেশ দেওয়া নেই, তথাপি ন্যায়নীতি সংবিধান এবং গোল্ডেন রুলের ... ধারা অনুসারে জাস্টিস অব পীস্ পুরুষ এবং নারীর বিয়ের গাঁটছড়া যেমন বেঁধে দিতে পারেন, তেমনি ... উপধারানুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদও করাবার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। এবং’ চশমাটা উপরে তুলে পিট পিট চোখে বিপর্যস্ত নারী পুরুষকে দেখে নিয়ে বললেন ‘সুপ্রীম কোর্টেও তা আইনত গ্রাহ্য। এ-ব্যাপারে আদালতের দক্ষিণা স্ট্যাম্প খরচ, মুহুরীর পারিশ্রমিক এবং টাইপ খরচসহ দিতে হবে একুনে ... টাকা।’
সম্রাট অসহায়ের মতো টাকা গুনে দেয়। শারীরিক কসরত এবং মানসিক পরিশ্রম করে হুকুমনামা লিখলেন মি. ডাইসন -
‘এতদ্বারা দেশের আইন মোতাবেক সকলকে অবহিত করা হচ্ছে যে, সম্রাট বরাট এবং শতাব্দী বরাট সশরীরে আদালতে উপস্থিত হয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে বিনা প্ররোচনায় এই অঙ্গীকার করছেন যে, একের পছন্দ অপরের অপছন্দ হওয়ায় তারা এক ঘরে থাকবেন না, এক বিছানায় শোবেন না, একে অপরকে মেনে চলবেন না, একে অপরের দায় বহন করবেন না, একে অপরকে ভালোবাসবেন না, স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকবেন না এবং এ রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা, শান্তি ও মর্যাদা রক্ষা করে বিবাহ-বিচ্ছেদের এ-হুকুমনামা মেনে চলবেন।’ স্বাক্ষর - ইন্দ্রনীল ডাইসন। জাস্টিস অব পীস্। ... রাজ্য।
সই করলো আদালত রেজিস্ট্রারে সম্রাট। দূরে কোথায় কড়্ কড়্ কড়াৎ বজ্রপাত হলো। দু’ জোড়া চোখে দৃষ্টি বিনিময়ের পর জাস্টিস কড়া চোখে তাকিয়ে শতাব্দীর দিকে রেজিস্ট্রারে সইয়ের ইশারা করলেন। শতাব্দী সই করলো। আদালতের পাশের চওড়া রাস্তা ত্বরিতে দমকলের গাড়ি ছুটে গেলো ঘণ্টা বাজিয়ে। জাকির হোসেনের তবলার বোল সম্রাটের বুকে। সুধা চন্দ্রনের নাচের দাপাদাপি শতাব্দীর হৃদপিণ্ডে।
সব শেষ হয়ে গেলো। দশ বছরের একসাথে থাকা-শোওয়া-বসা-আদর-সোহাগ-অনুযোগ-তম্বি এক লহমায় শেষ। বিবাহ জীবনের ইতি। কত উচ্ছ্বাস, কত আনন্দ, কত বিতর্ক। কিন্তু আজ! ঝাড়া হাত-পা। নেই কোন দায়, নেই দায়িত্ব, নেই রুটিনমাফিক চলাফেরা, নেই নিয়মের বালাই। একটা সই দু’জনের মাঝে দুস্তর ব্যবধান গড়ে দিলো। বেহিসেবি একটা সিদ্ধান্তে সব হিসেব ওলোট-পালোট। হঠাৎ যৌবন দুপুরটা যেন ঝুপ করে বুড়িয়ে সাঁঝ হয়ে গেলো।
বিষণ্নভাবে শতাব্দী বসে। এখন তো কোন সম্পর্ক নেই। তবুও সম্রাট নিতান্ত ভদ্রতাবশত জানতে চাইলো, ‘তুমি কি তোমার মা’র কাছে যাবে?’ কোন পরিচিতাকে মামুলি প্রশ্নের মতো শোনালো সম্রাটের কথা।
কোন অচেনা পুরুষ অনধিকার চর্চা করছে মনে হলো শতাব্দীর। মুখে শান্ত ভাব বজায় রেখে সসঙ্কোচে শতাব্দী বললো, যেন কান্নার শব্দ ‘হ্যাঁ। কিন্তু পথ তো অনেক। ভাড়া তো লাগবে! তোমার কাছে টাকা হবে?’
সম্রাট টাকা এগিয়ে দিলো। হাতটা কি একটু কেঁপে উঠলো সম্রাটের! শতাব্দী হয়তো ভুল দেখেছে। বললো, ‘মা হয়তো অনাদর করবেন না। কিংবা কষ্ট পাবেন। কিন্তু উপায় কি, আমার তো আর কোথাও যাবার নেই!’
‘অতোটা পথ যাবে, খিদে পাবে না? খাবে কিছু?’ সম্রাটের গলা ভেজা।
অনেক খেয়েছি তোমার পয়সায়। কিন্তু আর নয়। থাক ওসব। শোনো, এখন আর বেশি মদ খেয়ো না। তাছাড়া আমি যখন নেই, মদ বেশি খাবার দরকার কি? তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। ঘড়িতে সময়মতো চাবি দিও। তোমার জন্যে রুটি-তড়কা রাখা আছে, খেয়ে নিও। ভালো থেকো।’ অভিভাবিকার মতো শতাব্দী বললো, যেন কিছুদিনের জন্য বিদেশ বিভুঁই পাড়ি দিচ্ছে।
‘এখন এসব কথার কোনো মানে আছে? ক্ষেপে গিয়ে ডিভোর্স চাইলে। এসব শুনতে ভালো লাগছে না।’ অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে সম্রাট বললো। শেষের দিকে সম্রাটের গলাটা কেমন যেন করুণ শোনালো। নাকি শতাব্দী ভুল শুনলো?
আমি না হয় রাগের মাথায় ডিভোর্স চেয়েছি। কই, তুমি তো নিষেধ করোনি একবারও। খালি আমার দোষ খুঁজলে। তুমি চাওনি ডিভোর্স?’ শতাব্দীর চোখে জল।
‘তুমি তো থাকতে চাওনি।’ অনুযোগ করে সম্রাট। ‘এখন কে রান্না করে দেবে, কেই বা বমি পরিষ্কার করবে, কেই বা বুড়ো ঘড়িটায় দম দেবে, কেই বা...’
‘থামো। যে থাকে না তার স্মৃতিও থাকে না। কেটে যাবে দিন। সয়ে যাবে সব। সময় সব ত ধুয়ে দেয়। ঝরা পাতার জন্য গাছের শোক করলে চলে নাকি!’ শতাব্দী উদাস, যেন দার্শনিক।
টাইটানিক ডুবছে। সম্রাট তবু বলে, ‘তুমি তো নেই। কুকুরগুলো এখন আর কাউকে বিরক্ত করবে না।’ খানিক নিস্তব্ধতা।
‘মা’র ওখানে গলগ্রহ হয়ে দিবানিদ্রা তো দূর অস্ত। খেতে পেলেই বর্তে যাবো। আবার আচার? পাগল না পান্তাবুড়ি?’ শতাব্দী আপন মনে বিড়বিড় করে।’
‘সংসারের সব ঝক্কিই তো পোয়াতে হবে আমাকে। কাজেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেই হবে। মদ খেলে আর চলবে না। আর তখনই ষণ্ডামার্কা গুণ্ডাগুলোকে এড়িয়ে চলা যাবে।’ সম্রাট যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে। বোঝাপড়া করছে নিজের সাথে।
‘অভিযোগ তুলবার কোনো অধিকার মা’র ওখানে নেই। মুখ গোমড়াও করতে হবে না। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচই বা করবো কার সাথে, কোন স্পর্ধায়?’ শতাব্দী ভেঙে পড়ছে। চোখের নদীতে কুলু কুলু, থই থই। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে প্রসঙ্গ বদলায় শতাব্দী। - ‘আচ্ছা চলি। বেলা হয়। যেতে হবে বহু দূর।’ বাইরে মেঘ, ভেতরেও।
সম্রাট শতাব্দীর ভেঙে পড়া নজর করে। তার বুকে ঝোড়ো হাওয়া, দামাল মাতাল করছে। শক্ত হলো সম্রাট। শেষ শর ছুঁড়ে দিলো সম্রাট, ‘আমায় একা ফেলে নাইবা গেলে শতু।’ বলেই সম্রাট চমকে উঠলো। আরক্ত হলো। কিন্তু হাতের তাস মেঝেতে। দূরে দেখলো ডানাভাঙা বাবুই পাখি তালগাছে হাওয়ার সাথে লড়ে বাসা বুনছে। সম্বিৎ ফিরে এলেই শতাব্দীর দিকে হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে দিলো সম্রাট।
তীব্র স্রোতের মুখে ভেসে যাওয়া খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো সম্রাটের হাত শক্ত করে ধরলো শতাব্দী। সমর্পণের। দূরে শোনা গেলো শঙ্খধ্বনি। কোনো উৎসবের?
বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে জাস্টিস অব পীস্ ইন্দ্রনীল ডাইসন ধমকে উঠলেন, ‘আপনারা আদালত অবমাননা করছেন। এখন আপনারা স্বামী-স্ত্রী নন।’ সম্রাট শতাব্দী চুপসে গেলো বেলুনের মতো। কেঁদে ফেললো শতাব্দী। সম্রাট নির্বাক।
মি. ডাইসন কি ভেবে আবার বললেন, ‘অবশ্যি এ-রাজ্যের আইন অনুযায়ী আপনাদের পুনর্বার বিয়ে দেবার এক্তিয়ার আদালতের রয়েছে। খরচ ... টাকা।’
বত্রিশের শতাব্দী তেইশের যুবতীর মতো আনন্দে ঝর্ণা হাসি হেসে গাড়ি ভাড়া বাবদ সম্রাটের দেওয়া টাকার নোট লম্বা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলো। আদালতের রেজিস্ট্রারে পরষ্পর সই করলো। সাক্ষী থাকলো আদালত।
নতুন বর-কনে বনের পাশ দিয়ে গরুর গাড়িতে আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ঘর বাঁধতে এগিয়ে চললো।
ছোপ ছোপ দাগ লাল মোরগটা বোকার মতো ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দ করে করতে করতে ঐ পথের দিকে তাকিয়ে হেলে দুলে সদর রাস্তাটা পার হয়ে গেলো।
(ও হেনরি’র গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
সই করলো আদালত রেজিস্ট্রারে সম্রাট। দূরে কোথায় কড়্ কড়্ কড়াৎ বজ্রপাত হলো। দু’ জোড়া চোখে দৃষ্টি বিনিময়ের পর জাস্টিস কড়া চোখে তাকিয়ে শতাব্দীর দিকে রেজিস্ট্রারে সইয়ের ইশারা করলেন। শতাব্দী সই করলো। আদালতের পাশের চওড়া রাস্তা ত্বরিতে দমকলের গাড়ি ছুটে গেলো ঘণ্টা বাজিয়ে। জাকির হোসেনের তবলার বোল সম্রাটের বুকে। সুধা চন্দ্রনের নাচের দাপাদাপি শতাব্দীর হৃদপিণ্ডে।
সব শেষ হয়ে গেলো। দশ বছরের একসাথে থাকা-শোওয়া-বসা-আদর-সোহাগ-অনুযোগ-তম্বি এক লহমায় শেষ। বিবাহ জীবনের ইতি। কত উচ্ছ্বাস, কত আনন্দ, কত বিতর্ক। কিন্তু আজ! ঝাড়া হাত-পা। নেই কোন দায়, নেই দায়িত্ব, নেই রুটিনমাফিক চলাফেরা, নেই নিয়মের বালাই। একটা সই দু’জনের মাঝে দুস্তর ব্যবধান গড়ে দিলো। বেহিসেবি একটা সিদ্ধান্তে সব হিসেব ওলোট-পালোট। হঠাৎ যৌবন দুপুরটা যেন ঝুপ করে বুড়িয়ে সাঁঝ হয়ে গেলো।
বিষণ্নভাবে শতাব্দী বসে। এখন তো কোন সম্পর্ক নেই। তবুও সম্রাট নিতান্ত ভদ্রতাবশত জানতে চাইলো, ‘তুমি কি তোমার মা’র কাছে যাবে?’ কোন পরিচিতাকে মামুলি প্রশ্নের মতো শোনালো সম্রাটের কথা।
কোন অচেনা পুরুষ অনধিকার চর্চা করছে মনে হলো শতাব্দীর। মুখে শান্ত ভাব বজায় রেখে সসঙ্কোচে শতাব্দী বললো, যেন কান্নার শব্দ ‘হ্যাঁ। কিন্তু পথ তো অনেক। ভাড়া তো লাগবে! তোমার কাছে টাকা হবে?’
সম্রাট টাকা এগিয়ে দিলো। হাতটা কি একটু কেঁপে উঠলো সম্রাটের! শতাব্দী হয়তো ভুল দেখেছে। বললো, ‘মা হয়তো অনাদর করবেন না। কিংবা কষ্ট পাবেন। কিন্তু উপায় কি, আমার তো আর কোথাও যাবার নেই!’
‘অতোটা পথ যাবে, খিদে পাবে না? খাবে কিছু?’ সম্রাটের গলা ভেজা।
অনেক খেয়েছি তোমার পয়সায়। কিন্তু আর নয়। থাক ওসব। শোনো, এখন আর বেশি মদ খেয়ো না। তাছাড়া আমি যখন নেই, মদ বেশি খাবার দরকার কি? তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। ঘড়িতে সময়মতো চাবি দিও। তোমার জন্যে রুটি-তড়কা রাখা আছে, খেয়ে নিও। ভালো থেকো।’ অভিভাবিকার মতো শতাব্দী বললো, যেন কিছুদিনের জন্য বিদেশ বিভুঁই পাড়ি দিচ্ছে।
‘এখন এসব কথার কোনো মানে আছে? ক্ষেপে গিয়ে ডিভোর্স চাইলে। এসব শুনতে ভালো লাগছে না।’ অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে সম্রাট বললো। শেষের দিকে সম্রাটের গলাটা কেমন যেন করুণ শোনালো। নাকি শতাব্দী ভুল শুনলো?
আমি না হয় রাগের মাথায় ডিভোর্স চেয়েছি। কই, তুমি তো নিষেধ করোনি একবারও। খালি আমার দোষ খুঁজলে। তুমি চাওনি ডিভোর্স?’ শতাব্দীর চোখে জল।
‘তুমি তো থাকতে চাওনি।’ অনুযোগ করে সম্রাট। ‘এখন কে রান্না করে দেবে, কেই বা বমি পরিষ্কার করবে, কেই বা বুড়ো ঘড়িটায় দম দেবে, কেই বা...’
‘থামো। যে থাকে না তার স্মৃতিও থাকে না। কেটে যাবে দিন। সয়ে যাবে সব। সময় সব ত ধুয়ে দেয়। ঝরা পাতার জন্য গাছের শোক করলে চলে নাকি!’ শতাব্দী উদাস, যেন দার্শনিক।
টাইটানিক ডুবছে। সম্রাট তবু বলে, ‘তুমি তো নেই। কুকুরগুলো এখন আর কাউকে বিরক্ত করবে না।’ খানিক নিস্তব্ধতা।
‘মা’র ওখানে গলগ্রহ হয়ে দিবানিদ্রা তো দূর অস্ত। খেতে পেলেই বর্তে যাবো। আবার আচার? পাগল না পান্তাবুড়ি?’ শতাব্দী আপন মনে বিড়বিড় করে।’
‘সংসারের সব ঝক্কিই তো পোয়াতে হবে আমাকে। কাজেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেই হবে। মদ খেলে আর চলবে না। আর তখনই ষণ্ডামার্কা গুণ্ডাগুলোকে এড়িয়ে চলা যাবে।’ সম্রাট যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে। বোঝাপড়া করছে নিজের সাথে।
‘অভিযোগ তুলবার কোনো অধিকার মা’র ওখানে নেই। মুখ গোমড়াও করতে হবে না। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচই বা করবো কার সাথে, কোন স্পর্ধায়?’ শতাব্দী ভেঙে পড়ছে। চোখের নদীতে কুলু কুলু, থই থই। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে প্রসঙ্গ বদলায় শতাব্দী। - ‘আচ্ছা চলি। বেলা হয়। যেতে হবে বহু দূর।’ বাইরে মেঘ, ভেতরেও।
সম্রাট শতাব্দীর ভেঙে পড়া নজর করে। তার বুকে ঝোড়ো হাওয়া, দামাল মাতাল করছে। শক্ত হলো সম্রাট। শেষ শর ছুঁড়ে দিলো সম্রাট, ‘আমায় একা ফেলে নাইবা গেলে শতু।’ বলেই সম্রাট চমকে উঠলো। আরক্ত হলো। কিন্তু হাতের তাস মেঝেতে। দূরে দেখলো ডানাভাঙা বাবুই পাখি তালগাছে হাওয়ার সাথে লড়ে বাসা বুনছে। সম্বিৎ ফিরে এলেই শতাব্দীর দিকে হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে দিলো সম্রাট।
তীব্র স্রোতের মুখে ভেসে যাওয়া খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো সম্রাটের হাত শক্ত করে ধরলো শতাব্দী। সমর্পণের। দূরে শোনা গেলো শঙ্খধ্বনি। কোনো উৎসবের?
বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে জাস্টিস অব পীস্ ইন্দ্রনীল ডাইসন ধমকে উঠলেন, ‘আপনারা আদালত অবমাননা করছেন। এখন আপনারা স্বামী-স্ত্রী নন।’ সম্রাট শতাব্দী চুপসে গেলো বেলুনের মতো। কেঁদে ফেললো শতাব্দী। সম্রাট নির্বাক।
মি. ডাইসন কি ভেবে আবার বললেন, ‘অবশ্যি এ-রাজ্যের আইন অনুযায়ী আপনাদের পুনর্বার বিয়ে দেবার এক্তিয়ার আদালতের রয়েছে। খরচ ... টাকা।’
বত্রিশের শতাব্দী তেইশের যুবতীর মতো আনন্দে ঝর্ণা হাসি হেসে গাড়ি ভাড়া বাবদ সম্রাটের দেওয়া টাকার নোট লম্বা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলো। আদালতের রেজিস্ট্রারে পরষ্পর সই করলো। সাক্ষী থাকলো আদালত।
নতুন বর-কনে বনের পাশ দিয়ে গরুর গাড়িতে আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ঘর বাঁধতে এগিয়ে চললো।
ছোপ ছোপ দাগ লাল মোরগটা বোকার মতো ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দ করে করতে করতে ঐ পথের দিকে তাকিয়ে হেলে দুলে সদর রাস্তাটা পার হয়ে গেলো।
(ও হেনরি’র গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
>> পথিক ১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন