সোমবার, ৮ নভেম্বর, ২০১০

ভ্রমণ >> ক্যাসিনো! ক্যাসিনো!! : আবিদ ফায়সাল

ক্যাসিনো! ক্যাসিনো!!

আবিদ ফায়সাল

ক্যাসিনো রয়েলের গেটে ঢুকতেই সিকিউরিটির লোকেরা ঘিরে ধরল। পাসপোর্ট দেখাতেই তাঁরা কুর্ণিশ করে ভেতরে নিয়ে চলল। জামাল ভাই আগেই বলেছিলেন, পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে, না হলে বিদেশি বাজিবাজ চিনবে কী করে? মেটাল ডিটেকটরের ছোট তোরণদুয়ার পার হয়ে কাচের দরজা স্পর্শ করতেই একজন Door prize  লেখা একটি কুপন ধরিয়ে দিলেন। দেখি বড় বড় হরফে লেখা : Casino Royale Welcomes you! (Non Nepalese only)    আলো-উপচানো, পুরু কার্পেট বিছানো বিশাল হলরুম। ব্ল্যাকজ্যাক, রুলেত, স্লট মেশিন-সব ধরনের বাজিখেলার উপাদান আছে সুপরিসর স্পেশে; সেই সঙ্গে বাজিবাজদের জন্য বিনামূল্যে পানাহার, ভোজন এবং নাচ-গান উপভোগ করার ব্যবস্থাও আছে। সহযাত্রী ন’জনের মধ্যে সাতজনই বসে পড়লেন গেম খেলতে। কামাল ভাই বিচিত্র দৈহিক কাঠামোর মানবস্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছেন। আমার সতৃষ্ণ নয়নযুগল খুঁজে ফিরছিল পত্রপত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকী। পেয়েও গেলাম কটি : দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট, দ্য হিমালয়ান টাইমস, অন্নপূর্ণা পোস্ট, কান্তিপুর। ক্যাসিনো টাইমস নামে তো একটি ম্যাগাজিনই আছে। যা নিয়মিত বের হয়। সোফায় বসে এগুলো নাড়াচাড়া করতে দেখে ফয়জুল হক ছুটে এলেন। বললেন, পড়া রেখে তাঁর খেলা উপভোগ করতে। আমি মাথা নেড়ে প্রস্তাব কবুল করে তাঁর পাশে গিয়ে একটি চেয়ারে বসলাম। সব-খোয়াবার মন্ত্রে তিনি খেলে যাচ্ছেন। ফল শূন্য, অর্থাৎ পূর্বং। একসময় তাঁর হাত থেকে একটি কয়েন নিয়ে আমি স্লট মেশিনের ছিদ্র পথে প্রবেশ করাতেই দুটি ধাতবমুদ্রা অন্যপথে নির্গত হয়। মন আনন্দে ভরে ওঠে। ভেতরে ভেতরে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়। মেশিনে কয়েন ফেলতে-ফেলতে ফয়জুল হক বললেন, কাউন্টার থেকে কিছু কয়েন সংগ্রহ করে ভাগ্যটা পরীক্ষা করুন। তাঁর কথা শুনে হাসলাম। আমি জুয়ায় জিতে ভাগ্য বদলাতে চাই না। তবু খেলার চেয়ে কৌতূহলই বেশি ছিল। তাই ভেতরের এক ঔৎসুক্য তাড়না আর ফয়জুল হকের অনুরোধের গরজে আমি ভারতীয় একশ রুপির বিনিময়ে কুড়িটি কয়েন সংগ্রহ করে সামনের একটা ফাঁকা মেশিন পেয়ে খেলায় মজলাম। প্রথম এবং দ্বিতীয় কয়েনটায় কিছু হলো না। এক এক করে দুটি কয়েন খুইয়ে মেশিনে তৃতীয় কয়েনটা ফেলে লিভারে টান মারতেই ঝনঝন শব্দ করে ঝকঝকে পঞ্চাশটি কয়েন বের হয়। খুশিতে হুররে বলে উঠলো পাশের রিংকু। ফয়জুল হকও তাঁর চেয়ার ছেড়ে ছুটে এলেন। আমার চাপা আনন্দ ও উত্তেজনা মনের মধ্যে আলোর ঝিলিক মারতে থাকে। হাসিখুশি ধ্বনি শুনে অনেকটা দূর থেকে কাছে এসে জামাল ভাই রসিয়ে বুঝিয়ে বললেন, যদি একটি না ছুড়ে তিনটি একসঙ্গে ছোড়া হতো তাহলে পঞ্চাশটির পরিবর্তে দেড়শটি কয়েন বেরিয়ে আসত। আমি এবার বেপরোয়া রসিকতা নিয়ে কয়েন ফেলছি। কখনও দু-একটি পাচ্ছি। কখনও পাচ্ছি না। এভাবে হারতে হারতে জিতে যাচ্ছি, আবার জিততে জিততে হেরে যাচ্ছি। একসময় ঝাড়া হাত-পা। আমি আর নতুন করে স্লট মেশিনের গর্ভে একটি কয়েনও ছুঁড়তে রাজি না। কামাল আহমদের মতো সংযমকে অহংকার মনে করলাম। স্লট মেশিন ছেড়ে প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে আমাদের সারিতে দাঁড়ালেন ইকরামুল করিম মজুমদার, টি এইচ এম জাহাঙ্গীর, দিলু মামা ও তাঁর ছোট ভাই রিংকু। জামাল, ফয়জুল ও ফরিদী খেলে যাচ্ছেন শোচনীয় উন্মাদনা নিয়ে।
রাত ন’টা বাজতেই শুরু হলো ডান্স। হিন্দি ও নেপালি গানের তালে তালে জোড়ায় জোড়ায় নাচ, একক নাচ। কামাল ভাই আগেভাগেই সামনের সিট দখল করে নিলেন। যত কাছে থেকে দেখা যায়, ততই যেন চোখের স্ফুর্তি, মনের তৃপ্তি। সামনে সংরক্ষিত আসন-তাই একজন বিনয়ীগোছের সুদর্শনা পরিচারিকা হাসিমুখে এসে কামাল আহমদকে অন্য সিটে বসার অনুরোধ করেন। এবং রকমারি পানীয় টেবিলে রেখে চলে যান। নানা দিক-দেশ থেকে আসা ঘরের প্রায় অর্ধেক মানুষজন নাচ দেখতে চলে এলেন। 
এক ফোঁটা আবরণ নিয়ে নেপালি ললনা তাঁর ভুবনমোহনীরূপ প্রদর্শন করছেন। যৌনতাসর্বস্ব ঢেলে দেওয়া দেখানেপনা নৃত্যকলার উৎকট আতিশয্য দেখে নর্তকির প্রেমের সুরা গিলতে গিলতে এক শিখ ধনকুবের উদার মাতাল হয়ে তাঁর পাঁচ আঙুলে সাজিয়ে রাখা টাকার তোড়া ছুড়ে দিলেন। শিখদের দিল দরিয়া হয় নাকি নেশায়। রোমান্টিক ইঙ্গিত করে জাঁহাবাজ নাচুনিও তাঁর কাছে এসে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে ঠোঁট মিলান-বলিউডি ধুম-ধাড়াক্কা গানে। সিনেমার দর্শকদের মতো সবাই বিমুগ্ধ হয়ে দেখছেন। মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক কোনও রাজকুমারী কিংবা রানি নৃশংস আনন্দে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মডেল হচ্ছেন আর বিশ্ববিখ্যাত শিল্পিরা ক্যানভাসে জীবন্ত করে তুলছেন। এই দৃশ্য দেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুসরণেই বলতে হয় : ‘আমি জন্ম-রোমান্টিক, নারীদের খানিকটা কল্পনার রহস্যে মুড়ে রাখতে চাই। এ রকম প্রকাশ্য নগ্নতা আমার অরুচিকর লাগে।’ তবে মেয়েগুলোকে দেখে আমার মায়া লাগল। উপহারের টাকাগুলো তারা টিকমতো পাবে তো? আমি শিল্পীর ক্যানভাস এবং সিনেমা-উপন্যাসে এঁদের অমরতা কামনা করে ক্যাসিনো-উন্মাদ ফরিদীর কাছে চলে আসি। ও তখন স্লট মেশিনের ফুটো দিয়ে নেশার উচ্ছ্বাসে সবেধন নীলমণি ছুঁড়ছে। দেখেই দাঁড়িয়ে গেল, হয়ত আমার মনের অবস্থা আঁচ করে ফেলেছে। বলল, চলেন আন্নায়। ওখানেই ডিনার হবে। জামাল ও ফয়জুল হক ছাড়া সবাইকে একই কথা বলে ফরিদী।
পায়ে হাঁটা দশ মিনিটের পথ মাড়িয়ে মনে হলো, যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। ভেবেছিলাম আন্না কোনও চায়নিজ রেস্তোরাঁ হবে, এসে দেখি-ক্যাসিনো এ-টিও! পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই পর্যটকদের জন্য কিছু না-কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। নেপালের বিনোদন ও আমোদপ্রমোদের প্রধান আকর্ষণ এই ক্যাসিনো। এমন পর্যটকও পাওয়া যাবে যারা বছরে একাধিকবার শুধু ক্যাসিনোর অন্ধ আকর্ষণে এখানে আসে। চারটি ক্যাসিনোই কাঠমান্ডুর বড় চার হোটেলে জায়গা নিয়েছে। দরবার মার্গে অবস্থিত যে পাঁচ তারকা হোটেল ‘ইয়াক অ্যান্ড ইয়েতি’ তাতে রয়েছে ক্যাসিনো রয়েল। এছাড়া সল্টি হোটেলে ক্যাসিনো নেশান, এভারেস্ট হোটেলে ক্যাসিনো বানেশ্বর এবং ক্যাসিনো আন্না রয়েছে কাঠমান্ডু শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অন্নপূর্ণা হোটেলে।
নিরাপত্তারক্ষীদের নিশ্ছিদ্রব্যূহ ভেদ করে কাচের দরজা ঠেলে ক্যাসিনো আন্নার ভেতরে ঢুকতেই মনপ্রাণ চনমন করে ওঠা একটা চেনা সুরের গান কানে ভেসে এলো। তবে গানের কথা বোঝা যাচ্ছে না। এখানেও গিজগিজ করছে বিদেশি নারীপুরুষ। চলছে নানান খেলা। কারও কারও হাতে রঙিন পানীয়। মৃদু কথাবার্তা ছাপিয়ে নানান জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের কর্নসার্টেও চেনা সুর মনে হলো। সবাইকে তিন তলার সিঁড়ি দেখিয়ে ফরিদী বলল, ওপরে খাবার সাজানো আছে, যার যা খুশি খেতে পারবেন। আমি একটু পরে আসছি। ক্যাসিনো রয়েলেও মঞ্চের পাশে খাবারের মস্ত আয়োজন দেখেছি, কিন্তু খুব কাছাকাছি হওয়ায় নাচ চলাকালীন ভোজন-পর্বটা দৃষ্টিকটু দেখাবে। হয়ত এ-জন্যই ফরিদী আমাদের আন্নায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু তার খাবারের চেয়ে খেলার নেশাই বেশি। আর ক্যাসিনোর টানেই সে বার বার নেপাল ফিরে আসে।
আমরা ভিড় বিস্তর পার হয়ে তিন তলার সিঁড়িতে পা-রাখতেই শুনলাম সেই আবেশধরানো গান : ‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা।’ দ্রুত পা চালিয়ে ওপরে উঠে দেখি-বিশাল হলরুম। মধ্যে সিঁড়ি, দুপাশে দেয়াল ঘেঁষা চেয়ার-টেবিল। এক পাশে উঁচু মঞ্চ। মঞ্চের সামনে সোফা-দর্শকদের বসার জায়গা। সিঁড়ির পেছনে গণখাবারের এলাহি ব্যবস্থা। কেউ কেউ নিজ হাতে খাবার নিয়ে চেয়ার-টেবিলে বসে খেতে খেতে লাইভ সংগীত শুনছেন। চেনাসুর, চেনাগান শুনে কী যে আনন্দ হলো। দর্শক সারিতে বসে পড়লাম আমি। আমার দেখাদেখি অন্যরাও বসে পড়লেন। আমরা আবিষ্ট হলাম চেনাগানের সুরলহরিতে। মনে হলো সারা রাত জেগে থেকে গজল শুনি। ভিনদেশে রবীন্দ্রসংগীত শুনে ভীষণ তন্ময় হয়ে পড়লাম। আধুনিক বাঙালির নির্মাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি.) কেবল বাংলা ভাষা বা বাঙালির নন, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম জনমনজয়ী কবি, নেপালে এসেও আমরা তার আলামত উপলব্ধি করলাম।
হিন্দি জবানে রবীন্দ্রসংগীত শেষ হওয়ার পর শুরু হলো জগজিৎ সিং, পঙ্কজ উদাসের গাওয়া বিখ্যাত সব গজল। আদনান সামির ‘পেয়ারা পেয়ারা জগৎ কি হায়’ অপরিচিত শিল্পীর কণ্ঠে ভালোই লাগছিল। রাত বারোটায় সাঙ্গ হলো সংগীত আসর।
রসনা-রঞ্জক খাবার সাজানো আছে-যার দাম সাধারণ মানুষের ছোঁয়ার বাইরে। দেদার খিদা মেটাতে বেশ জম্পেশ করেই আমরা এই উপাদেয় খাবার খেলাম। এবার হোটেলে ফেরার পালা। আমরা বেরিয়ে পড়লাম নগ্নপুষ্পঅধ্যুষিত পথে। পথে পথে জেগে আছে ফুলদল দৃষ্টিকে কামুক করে। তাকিয়ে দেখতে নেই এই ভয়ংকর ফুল।
১৫ জুন ২০০৯
হোটেল হলি লজ, থামিল, কাঠমান্ডু

>> পথিক ১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন