শূন্যতার সহযাত্রী
নাজমুল হাসান
দত্তপাড়া বাজারের মুখর পরিবেশ আর উপচেপড়া ভিড়ে রহিমুদ্দির মনোযোগ যখন বাংলা সিনেমার প্রয়োজনের অধিক মেদভূড়িসমৃদ্ধ নায়িকার লম্ফঝম্ফ দেখায় ব্যস্ত, তখন বাইরে থেকে তার নাম ধরে অত্যন্ত ঝাঁঝালো গলায় হারাধন ডাক দেয় - এই রহিমুদ্দি...রহিমুদ্দি... বাইরে আয়। তুর সাথে কতা আছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও রহিমুদ্দি বের হয়ে তাড়াহুড়ার স্বরে বলে - কী কবু ক’, সিনেমা দেকপো, ম্যালা দিন পর আয়েশ করে বসিছি।
হারাধন নিবিষ্ট মনে কিছু একটা ভাবলো, তারপর গলার স্বর কিছুটা মোলায়েম করে বললো - তুর সাথে পারসুনাল কতা আছে, একুনি কওয়া দরকার। তুরও এতে লাভ হবি।
লাভের কথা শুনেই চার-পাঁচ দিন শেভ না করা মুখে রহিমুদ্দি টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের ন্যায় হাসি ছড়িয়ে বললো - ক’ ভাই লাভটা কী?
রহিমুদ্দির কথা শেষ হতেই আশপাশে সাবধানী পলক ফেলে হারাধন তার মুখ রহিমুদ্দির কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেজ্জএটি কওয়া যাবিনে। কল্যাম না পারসুনাল কতা। চল শান্ত জায়গা দেইখা কোথাও গিয়া বসি।
হারাধনের কথায় সম্মতি দিয়ে প্রায় পনেরো মিনিট হেঁটে দু’জন বিসিকের উত্তর প্রান্তে নির্জন জায়গায় গিয়ে বসল। হারাধন পকেট থেকে বিড়ি বের করে নিজে একটা ধরিয়ে রহিমুদ্দির হাতে বিড়িসমেত দেয়াশলাই দিলো। বিড়ি ধরাতে ধরাতে রহিমুদ্দি তাগাদার স্বরে বলে-ক’, কী কবু?
আমতা আমতা স্বরে হারাধন বলেজ্জনা, মানে...বলিছিনু কী...
হারাধনের আড়ষ্টতা দেখে রহিমুদ্দি ধমকের স্বরে বলে - এতো মানে-মানের কী আছে? আরে শালা, আমরা হলাম ন্যাংটাকালের বন্ধু। আমাক কতে এত প্যাঁচাচ্ছু ক্যা।
বিড়িতে জোড়ে দম দিয়ে হারাধন এক রাশ ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দিতে দিতে বললোজ্জতুর তো অনেকগুলো খানেআলা, দুই বেলা- দুই মুঠো ভাত জুটাতে পারিস না। আর আমার মা’টা অসুখে ভুগিচ্ছে। টেকা পাই না চিকিৎসা করাবার। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো হারাধন। তারপর আবার বলতে থাকলোজ্জএকটা দান মারতে পারলে...
কথাটার অর্থ বুঝলো না রহিমুদ্দি, তাই সে হারাধনকে জিজ্ঞেস করলো - দান? কীসের দান?
হারাধন কিছুটা চালাকির ঢঙে বললো - আছে, তুই আমার সাথে থাকবু কিনা ক’?
দু’জন মিলে অনেক শলাপরামর্শ করলো গভীর রাত অবধি।
সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন হারাধন আর রহিমুদ্দি বেরিয়ে পড়ে হরিপুরের উদ্দেশ্যে। বড় মাঠটা পেরিয়ে বহু বছরের পুরনো পাঁকুড় গাছের নিচে চুপিসারে নিজেদের মধ্যে আরো কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেয়। তারপর অত্যন্ত সন্তর্পণে তারা একটি বাড়িতে প্রবেশ করে। রহিমুদ্দির বুকের স্পন্দন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু সে তা হারাধনকে বুঝতে দেয় না। গলাটা তার বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে। পথে আসতে আসতে হারাধন তাকে অনেক অভয় দিয়েছে। বাড়ির উঠোনেই ভ্যানগাড়িটা পরিত্যক্ত চেইন দিয়ে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। হারাধন চারদিক পরখ করে দেখল। রাতের নির্জনতা ছাপিয়ে পৃথিবীর মানুষগুলো অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। হারাধনের ইশারা পেয়ে রহিমুদ্দি হাতে রাখা হ্যাক-সো ব্লেড দিয়ে চেইন কাটতে থাকে। প্রায় পনেরো মিনিট খরচ হয় তার কাজ সমাধা করতে। উৎফুল্ল হারাধন এসে ভ্যানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আর রহিমুদ্দি আগে আগে চলতে থাকে। একটু তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ভ্যানটা পাশে রাখা পাটকাঠির সাথে সজোরে ধাক্কা খায়। তখনই কোত্থেকে যেনো আচমকা কেউ বলে উঠেজ্জওই কে রে ওইখানে? শব্দটা রহিমুদ্দির কানে যেতেই সে ভোঁ দৌড় দেয়। বেশ কিছুদুর দৌড়ে এসে রহিমুদ্দি ফিরে দ্যাখে হারাধন নেই। কিছু না ভেবেই সে হারাধনের উদ্দেশ্য পেছনে ফিরে গেলো। একটু এগোতেই সমস্বরে শব্দ এলো ওই যে আরেকটা চোর, ধর...ধর...। ধর শালাক...মার শালাক...।
রহিমুদ্দি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই তিন-চারজন তাগড়া জোয়ান তাকে ধরে ফেলে।
পরদিন তাদের দেখা গেলো দত্তপাড়া খাজা এন্টারপ্রাইজের সামনে নারকেল গাছের সাথে মোটা রশি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায়। তাদের ঘিরে রয়েছে ছেলেবুড়োসহ জনা পঞ্চাশেক উৎসুক লোক। চার-পাঁচজন উঠতি বয়সের ছেলে হাতে লাঠিসোটা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে একজন ভিড় ঠেলে আগে হারাধন, পরে রহিমুদ্দির হাতে পায়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ দুজনেই একসাথে কঁকিয়ে উঠলো। একজন মুরব্বি ছেলেটাকে নিবৃত্ত করার জন্য বলে উঠলোজ্জওরে মানিক, অতো মারিস না, মরি গেলে শেষে বিপদ হবি।
মানিক প্রতিবাদী গলায় বলেজ্জবিপদ! কীসের বিপদ? চোর মারলে কীসের বিপদ?
জনতার উপচেপড়া ভিড় সামাল দিতে দু’ চোর যাদের জিম্মায় রয়েছে তারা বেশ হিমশিম খেয়ে গেলো। এর মধ্যে আবার জনতা আচমকা ফুঁসে উঠলো। জিম্মাদারদের একজন আদেশ দিলো, দু’ চোরকে বাবুর বাপের সো মিলের কাছে নিয়ে যেতে। ওই জায়গাটা বেশ ফাঁকা। তার আদেশানুসারে তা-ই করা হলো। ক্রমেই বেলা বাড়তে থাকলো।
এরই ফাঁকে একজন দয়াপরাবশ হয়ে দুটি বিস্কুট এনে রহিমুদ্দি ও হারাধনের হাতে ধরিয়ে দিলে রহিমুদ্দি গোগ্রাসে তা খেয়ে নিলো। হারাধন বিস্কুট হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। কিছুক্ষণ পড়ে সবার মাঝে গুঞ্জন উঠলো, কেউ কেউ নিচু গলায় বলে উঠলোজ্জএই চেয়ারম্যান আসতিছে, সইরা দাঁড়া।
মধ্যবয়সী আজাহার চেয়ারম্যান দু’জন রক্ষীসহ ঘটনাস্থলে হাজির হলে তাকে দেখেই প্রথমে হারাধন, তার দেখাদেখি রহিমুদ্দি পায়ে উপুড় হয়ে কান্নাভেজা গলায় নিজেদের ক্ষমার জন্য আর্জি পেশ করে। রহিমুদ্দি এই ইউনিয়নের লোক। চেয়ারম্যান তাকে চেনে। কিন্তু হারাধন অপরিচিত মুখ। চেয়ারম্যান মুখ বিকৃত করে সবাইকে শুনিয়ে বললোজ্জএই শালার ব্যাটা রহিমুদ্দি, ওক কাজ দিছিনু, শালা করলো না। হারামজাদা...। বলেই রহিমুদ্দির গালে পরপর কয়েকটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো। তারপর দৃষ্টি পড়লো হারাধনের উপর। হারাধনের নিচু মাথার চুল ধরে টেনে তুলে চেয়ারম্যান বললোজ্জএই তুর বাড়ি কোন গাঁ? প্রশ্নের জবাবে হারাধন অস্ফুট স্বরে জানালো কাঞ্চননগর।
জ্জকদ্দিন ধরে চুরি করিস। এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না হারাধন। হঠাৎ তার মুখ ফসকে বেড়িয়ে যাওয়া কথায় জানা গেলো, সে নিশ্চিন্তিপুরের প্রবাল চাটুয্যের মাসতুতো ভাই। প্রবাল চাটুয্যেকে উপস্থিত প্রায় সকলেরই চেনা। দু’ গ্রাম পরে নিশ্চিন্তপুরের বাসিন্দা প্রবাল চাটুয্যেকে এ গাঁয়ের লোকেরাও সমীহ করে চলে।
খবর পৌঁছে গেলো নিশ্চিন্তিপুরে, প্রবাল চাটুয্যের কাছে। কিছুক্ষণ পর প্রবাল চাটুয্যে মোটর সাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হলে তাকে দেখেই চেয়ারম্যান কিছুটা অপ্রস্তুত সুরে বললোÑ দেখো তো বাপু, এ নাকি তোমার মাসতুতো ভাই? ফ্যাকড়ায় পড়নু...
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ক্রোধে অগ্নিবর্ণ ধারণ করে প্রবাল চাটুয্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো হারাধনের উপর। তার চোখে মুখে চড় থাপ্পর দিতে দিতে চাটুয্যে বলেজ্জএই শালা আমি কবে তোর মাসতুতো ভাই ছিলাম? শালা চোর। কাঁদলো না হারাধন। শুধু নিঃশব্দে মারগুলো হজম করলো। তার মুখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়লে জনতা বেশ উল্লাস বোধ করলো! এর মধ্যে জনতা বেশ কয়েক দফা ফুঁসে উঠলো। চেয়ারম্যানের ধমকে সবাই নিজেদের সংযত করলো। এ সময় চেয়ারম্যানকে বেশ চিন্তিত দেখা গেলো। থানায় ফোন করার কথা তার মুখে বার কয়েক শোনা গেলো। এতে বাঁধ সাধলো মুরুব্বী টাইপের কয়েকজন লোক। তাদের মুখে ক্ষমার কথা উচ্চারিত হলো। জনতাও এতে সায় দিলো। ফের যদি তাদের দ্বারা চুরি সংঘটিত হয় তবে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে-এই শর্তে ওদের ছেড়ে দেওয়া হলো।
তখন সূর্য পশ্চিম দিকে রক্তিম বর্ণ ধারণ করে প্রস্থানের জন্য অপেক্ষমাণ। হারাধন আর রহিমুদ্দিকে ছেড়ে দিতেই দুজন দুই দিকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে জনতার অগ্নিদৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। খানিক পর রহিমুদ্দির পথ ফুরোলেও হারাধন হাঁটতে থাকে কাঞ্চননগরের দিকে। পথে নিশ্চিন্তিপুরে ঢুকার মুখে হারাধনের সাথে চোখাচোখি হয় প্রবাল চাটুয্যের। চোখ নামিয়ে ফেলে দু’জনেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন