শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ভিনদেশী সাহিত্য >> আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি : নেলিদা পিনন (লায়লা ফেরদৌস ইতু)

আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি :

মূল : নেলিদা পিনন ।। ভাষা বদল :লায়লা ফেরদৌস ইতু

আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি। সকালে জেগে উঠার পর থেকে রাতে ঘুমিয়ে অচেতন হবার আগ পর্যন্তই আমি তাকে ভীষণ রকম ভালোবাসি। যখন সে জেগে উঠেনি তখনই আমি তার জন্যে কফি বানিয়ে রাখি। সে ঘুম থেকে উঠে হাই তোলে। রাতে ভালোভাবে ঘুম হয় না বলে সে সব সময়ই ক্লান্ত একটা ভাব নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। তারপরে সে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করে। নিজেকে মার্জিতভাবে উপস্থাপনের বিষয়ে সে সব সময়ই ভীষণরকম সচেতন। এদিকে তার কফিটা ঠা-া হয়ে যাবে ভেবে আমি তার দরজায় মৃদু নক করতে থাকি। সে তখন রাগে ফুঁসতে থাকে আর আমি বেদনায় নীল হতে থাকি। আসলে আমি চাই না ঘুম থেকে উঠার পরই একটা ঠা-া তরল গলাধঃকরণের প্রচেষ্টার মাঝে তার দিনের প্রারম্ভটা গুলিয়ে যাক, যে তরল প্রচেষ্টায় সপ্তাহে দু’বার সে আমাকে গলাধঃকরণ করে। 
তারপরে আমি তার টাইয়ের গিঁটটা ঠিক মতো বেঁধে দিই আর সে তাতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। কারণ আমি তো তার জীবনের কোনো অংশ ঠিক করতেই তাকে সাহায্য করতে পারি না। আমি অবশ্য হাসিমুখেই তার সব অভিযোগ বা অসন্তোষ এড়িয়ে যাই যাতে করে সে একটা নিরুদ্বিগ্ন মন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। পুরুষরা কাজে যাবার সময় তাদেরকে কখনও চটাতে নেই। কারণ সে বেচারা তো বাইরে গিয়ে বিরূপ পৃথিবীর মুখোমুখি হবে আর সবার জন্যে গরম ও জীবন রক্ষাকারী রুটির সংস্থান করবে।
ও বলে যে, আমার চাওয়া নাকি খুব বেশি আর আমি সব সময়ই ঘরে হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে থাকি, আমার পৃথিবীটা কেবল কাঁচাবাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর তাই সব কিছুতেই আমার এতো বেশি অসন্তোষ। আর সে সব সময় ছোটো ছোটো প্রচেষ্টায় এক বৃহৎ দালান নির্মাণে ব্যস্ত। তার বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে পরিচিতরা সবাই কিন্তু তার প্রশংসা করে, যেহেতু সে ভীষণ কর্মঠ আর উদ্যোগী। তারা অবশ্য আমারও প্রশংসা করে। কারণ আমি এমন একজন মানুষের সেবা করি যে শুধু আমাদের উন্নতিতেই নয়, বরং জাতীয় উন্নতিতেও অবদান রাখছে। পক্ষান্তরে আমার স্বামী যেহেতু নিশ্চিত যে আমি তাকে ভালোবাসবোই, তাই সে গলা উঁচু করে আমাকে শাসাতে পারে। সে সব সময়ই বলে যে সারাটা বছর সে প্রাণান্ত পরিশ্রমে যা কিছু উপার্জন করে তা নাকি ঘরে বসে বসে কেবল আমি উপভোগ করি এবং আমি কিছুই করি না। 
যখন আমি আমার বিয়ের আগেকার জীবনের সেই শ্রমজীবী দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে তাকে অনুরোধ করি তখন সে এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেনো আমি এমন কিছু ইঙ্গিত করছি যা আমাদের এই সুন্দর জীবন-যাপন পদ্ধতির প্রতি অবমাননাজনক। 
‘এই মহিলা, তুমি আর কী চাও? এটাই কি তোমার জন্যে যথেষ্ট নয়, যে তুমি আমাদের যৌথ মালিকানার সম্পত্তির অধিকারী? তুমি কি সাধারণ শ্রমজীবী কাজে নেমে আমার মান-সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিতে চাও?’ সে সব সময় বলে আমি তার ভবিষ্যতেরও অংশ। অবশ্য সেই ভবিষ্যত গড়ে তোলার অধিকার কেবল তারই আছে এবং আমি লক্ষ্য করেছি যে আমার প্রতি তার যে উদারতা সেটা কেবল একজন রক্ষিতার প্রতি উদারতার সমার্থক হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। 
একদিন আমরা আমাদের সব বন্ধু-বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। সেদিন সে বলেছিলো, ‘আমার সন্তান কেবল আমারই। এমনকি আমার নারীকেও কেবল আমারই হতে হবে। নারী কখনোই তার নিজের অধিকার নিজে পেতে পারে না।’ আমি কোনোদিন আমার হতে পারি না এই বোধটুকু সেদিনই আমার সমস্ত কল্পনাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো জ্জ যেই কল্পনার মাঝে আমি সারাটা দিন নিমগ্ন থাকতাম। এই মানুষটি নিজের জীবনের স্বাদ নিজে গ্রহণ করে আর আমার হাত বেঁধে রাখতে চায় যাতে করে আমার হাতও কোনোদিন আমার ত্বকের কোমলতাকে অনুভব করতে না পারে। 
হঠাৎ করেই আমার মনে হয় যে আমার ঘরের আয়নাটা আমার পরাজয়ের প্রতীক। এই আয়নাটা আমাকে সে এনে দিয়েছিলো যাতে করে আমাকে সুন্দর দেখানোর মতো করে আমি সেজেগুজে তার স্পর্শের অপেক্ষায় থাকতে পারি। ‘তুমি কি বিশ্বাস করো না যে আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। সে তখন সারা বিশ্ব বিষয়ে ওয়াকিবহাল হবার জন্যে পত্রিকা পড়ছিলো আর আমি মেঝে ঝাড়– দিচ্ছিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল : ‘যখন সারা দেশের লোক কী করে জাতিকে আরো উন্নতির দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে নেওয়া যায় সে সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, তখন তুমি কি আশা করো যে আমি এখানে তোমার সঙ্গে বসে বসে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে আলাপ করবো?’ আমি  বললাম : ‘আচ্ছা, আমরা প্রেম নিয়ে আলাপ এখন নাইবা করলাম, হয়তো সেটা এখন আসবাবপত্রের পেছনে পড়ে থাকার জিনিস। কিন্তু আমি যদি বিবেচনা করি যে আমার ভবিষ্যত আসলে রাতের ডিনার শেষে নেওয়া একটা ডেজার্টের চেয়ে বেশি কিছু নয়, তাহলে সেটা কেমন হবে?’
সে আমার দিকে তাকিয়ে কেবল সিগারেটে বড় করে একটা টান দিলো আর আমি বুঝতে পারলাম আমি নিশ্চয়ই তাকে বিরক্ত করে ফেলেছি। আমার লজ্জা লুকোতে আমি তার জন্যে কফি বানিয়ে সাথে একটা চকলেট কেক নিয়ে আসলাম। সে তখন আমাকে সাহায্য করলো এবং সারা মাসের খরচ নিয়ে আমার সাথে আলোচনায় বসলো। আর তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, সে আমাকে ভালোবাসে এটা বোঝানোর জন্যে কোনো শব্দ প্রতিমা দরকারি নয়। কেবল আমার জন্যে তার ব্যস্ত সময় থেকে কয়েক মিনিট ব্যয় করাই যথেষ্ট। 
আমি তো আসলে আমাদের এই সুন্দর সাজানো বসার ঘরে একটা টবে লাগানো সুন্দর গাছ। সে গাছে চড়লেই আমার স্বামী কাক্সিক্ষত ফলের নাগাল পাবে, গাছের বাকলে আদর করতেও পারবে আর দরকার মতো এর ডাল-পালাগুলো ছেঁটে দেবে। এই তো যথার্থ দাম্পত্য। মেয়েদের যে কেনো এতো সহজ বিষয় বুঝতে এতো বেশি সময় লাগে?
আমার বিয়ের দিন আমাকে আমার বাবা বলেছিলেন : ‘কেউ যদি কেবল নিজের জন্যে বাঁচতে চায়, তখনই সে বুড়িয়ে আয়। কিন্তু তুমি যেহেতু স্বামীর জন্যে বেঁচে থাকবে তাই সময়ের কালো থাবা কখনও তোমাকে স্পর্শ করবে না।’ আমি অবশ্য তখনও বুঝিনি Ñ যে ঢাল আমাকে সারা পৃথিবী থেকে আড়াল করে রাখবে কীভাবে আমি তার হৃদয়ের সাথে অন্তর্লীন হব? আমি জানি নারীর আত্মার প্রকাশ ঘটে কেবলমাত্র শয্যায়, যেখানে তার লিঙ্গভিন্নতা পুরুষের দ্বারাই অভিষিক্ত হয়ে ওঠে। এভাবে আমি শিখতে আরম্ভ করলাম আমার যে বিবেক আমার সুখবোধের সাথে জড়িত তার একমাত্র কর্তব্য স্বামীর সেবা করা। সুতরাং স্বভাবের সকল বাহুল্য ছেঁটে ফেলাই আমার জন্যে উচিত কর্তব্য। 
আমি এখন নিজেকে একজন যোদ্ধা মনে করি। আমি সব সময় আমার স্বামীর জন্যে যেকোনো রকম অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং যেকোনো সময়ই এমন এক চেহারা ধারণে প্রস্তুত যে চেহারা আমার নয়। আমার বাবা বলতেন, ‘জীবনের সকল রহস্য কেবল একজনের জন্যে সংরক্ষিত করে রাখার চাইতে রোমাঞ্চকর একটা মেয়ের জীবনে আর কী হতে পারে?’ প্রতিটি মেয়ের জীবনেই পিতৃশিক্ষা সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো আজ আমি দোকানের শোকেস, বিভিন্ন জিনিস, প্রীতিভাজন মানুষজন, আমার স্বামীর গর্ব এবং তাঁর বাড়ির প্রতিটি জিনিসের ভেতরে এমন চূড়ান্তভাবে প্রোথিত। 
আমার সকল স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা একেবারেই অর্থহীন। এগুলো আমার স্বামীর জন্যে নিশ্চয়ই সম্মান হানিকর। আমার কৃতকর্মের জন্যে মনে মনে আমি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আর সেও আমার প্রাত্যহিক সুখী জীবনের কাছে এইভাবে আত্মসমর্পণকে অভিনন্দন জানায়। আমি কখনওই আমার মনের ভেতরে বয়ে চলা ভাবনাগুলো তার কাছে প্রকাশ করতে পারবো না। আমি কোনোদিনই কোনো অভিযোগ জানাতে পারি না। কিন্তু আমি যখন আয়নায় কপালে ভাঁজ পড়া একজনকে দেখতে পাই, মনে হয় যেনো সেটা আমি নই। কারণ আমি তো অন্য রকম দেখতে হতে চেয়েছিলাম। আমার স্বামী আয়নার ভাষ্যের বিরোধিতা করে, যেহেতু আমাকে সুন্দর দেখানোর জন্যই সে এটা একদিন কিনে এনেছিলো। 
আসলে সে কিন্তু খুব সহানুভূতিশীলও। সে কোনোদিনই আমার জন্মদিনে আমাকে শুভেচ্ছা জানায় না কিংবা সেই দিনটিকে বিশেষভাবে পালনও করে না। সে চায় না আমি আমার বয়স কতো হলো সেটা মনে রাখি। সে আমার দেহ সম্পর্কে কথাবার্তা বলা এড়িয়ে যায়। দিনে দিনে আমি কিছুটা মোটা হয়েছি। আগের মতো আমি আর সাজতেও পারি না। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় আমার স্বামী দরজার কড়া নাড়ে। সে জানে যে দরজার এপারে আমি তার জন্যে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করে থাকবো। আর যখন টিভিতে কোনো যৌবনবতী শরীর দেখানো হয় তখন সে পত্রিকার আড়ালে মুখ ঢেকে রাখে যেনো সারা পৃথিবীতে কেবল আমাদেরই অস্তিত্ব আছে। আমি তো এ জন্যেও তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। 
আমার সাথে তার মিলিত হবার প্রতিটি প্রচেষ্টার জন্যে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। যদিও পরম অনিচ্ছায়, তবু আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্যে আমার নিজের ভেতরে সংগ্রাম করে যাই, কারণ কোনো এক বিচিত্র মুখ, কোনো একজন অপরিচিত মানুষের ছবি মিলনের সময় আমাকে ভীষণভাবে দুলিয়ে দেয়, আমি সেই মুখটা কোনোদিনই দেখতে চাই না। তারপর আমি অনুভব করি যে আমার মুখটাও বিশুষ্ক। আসলে গত রাতে খাওয়া পাউরুটির স্বাদের জন্যেই আমার মুখটা এতো বিশুষ্ক লাগছে। আর আমি জানি যে, এই পাউরুটিই আমাকে পুষ্টি জোগাবে। একটা পাউরুটি আমি আর আমার স্বামী বিয়ের পরদিন থেকেই ভাগাভাগি করে কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই খেয়ে চলেছি, সে ধারাবাহিকতা নিশ্চয়ই প্রেম দ্বারা পরিমার্জিত এবং যে অনুষ্ঠানে আমাদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো তার পবিত্রতা দ্বারা আবদ্ধ। আর হ্যাঁ, সব কিছুর পরও নিশ্চয়ই আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি।
 ....................................................................................................... 
[নেলিদা পিনন (Nelida Pinon) ১৯৩৭ সালের ৩ মে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে জন্মগ্রহণ করেন। নারীবাদী রচনায় দেহজ বর্ণনাকে বিমূর্তভাবে উপস্থাপনের জন্যে তাঁর খ্যাতি যথেষ্ট। তাঁর রচনা ইংরেজি, ফরাসি ও পোলিশ ভাষায় অনূদিত হয়ে তাকে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তার ‘আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি’ গল্পটি লঘুরস, মননশীলতা, ইঙ্গিতময় বর্ণনায় উজ্জ্বল। - অনুবাদক]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন