রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১০

বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১০

ভিনদেশী সাহিত্য >> আকাশে চারটি তারা : আহমাদ নদীম কাসমী (ফায়যুর রাহমান)

আকাশে চারটি তারা

আহমাদ নদীম কাসমী (ফায়যুর রাহমান)

ঘর থেকে মসজিদে যাওয়া-আসা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিলো না মিয়া হানিফের। তার বাড়িতে একটি মাত্র ঘর। ঘরটিও বেশ লম্বা। পুরো ঘরে দরোজা একটাই। মাঝখানে। ছাদে গোলাকৃতির একটি ছিদ্র, যেনো ম্যানহোল। বর্ষাকালে মিয়া হানিফ এই ছিদ্রটি পাকা মাটির ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় ভাষায় এই ছিদ্রকে বলে ‘মুখা’। দরোজা যখন বন্ধ থাকে, তখন বাইরের জগতের সঙ্গে মিয়া হানিফের যোগাযোগের মাধ্যম ওই ছিদ্রই। দিনের বেলায় ওই ছিদ্র দিয়ে আলো-বাতাস আসে। রাতের বেলা মিয়া হানিফ শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকায়, তারা খোঁজে ওই ছিদ্র দিয়ে। তার ধারণা, ছোট্ট এই ঘরে একাকি বসবাস করলেও সে আসলে একা নয়। আকাশের তারাগুলো তার বন্ধু। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের প্রতি সে ভয়াবহ বিরক্ত, কারণ বৃষ্টির জন্য এ সময়টাতে ছাদের ছিদ্রটি ঢেকে রাখতে হয়। যখন তার তারা দেখার তেষ্টা জাগে খুব, তখন ঢাকনাটি সরিয়ে দেখে, আকাশের তারাগুলো মেঘে মেঘে ঢেকে আছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সে নিমগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওই ছিদ্র দিয়ে কোনো তারা দেখতে না পেলে সে অস্থির হয়ে পড়ে। তখন খাটখানা এদিক-ওদিক সরিয়ে শোয়। শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তারা খোঁজে। অনেক চেষ্টার পর ছোট্ট একটি তারা যখন তার দৃষ্টিগোচর হয়, খুশিতে আত্মহারা হয় সে। যেনো স্রষ্টার সাক্ষাৎ পেয়েছে। তখন মনে মনে বলে, ‘বন্ধু তোমাকে দেখার জন্য সারাটা আকাশ ঘুরে এলাম, আঁতিপাতি করে খুঁজেও তোমাকে পেলাম না। এবার যখন পেলাম, তবে আর পালিয়ে যেও না, আমি তোমাকে প্রাণভরে দেখবো, নয়তো আমার ঘুম আসবে না।
ঘরের মাঝখানে একটি তাক। ওখানে সে গম রাখে। কয়েক বিঘা জমি আছে মিয়া হানিফের। বর্গা চাষিরা বছর শেষে তার পাওনা গম বাড়িতে পৌঁছে দেয়। গম ছাড়াও তাকের ওপর সে রাখে পানির একটি হাতলবিহীন পানপাত্র। আর একটা মাটির প্রদীপ। প্রদীপের সলতেটা সারাক্ষণই কেরোসিনে ডুবে থাকে। মিয়া হানিফ এশার নামাজের পর ঘরে ফিরে প্রদীপটা জ্বালায়। তারপর দরোজা বন্ধ করে খাটে বসে সুরেলা কণ্ঠে কুরানের শেষ পারার পনেরটি সুরা পড়তে থাকে। এই সুরাগুলো সে নামাজেও পড়ে। নামাজ ছাড়াও ঘরে বসে বারবার পড়ে। মাথা দুলাতে দুলাতে পড়ে। এক সময় দেয়ালের খুঁটিতে ঝোলানো তসবি নিয়ে বিড় বিড় করে কালেমা তৈয়ব আওড়ায়। ক্লান্ত হলে খাটে শুয়ে পড়ে, আর ছাদের ছিদ্র দিয়ে আকাশের নক্ষত্র খোঁজে। হঠাৎ যখন একটি নক্ষত্র তার চোখে পড়ে, সে এতোই খুশি হয় যেনো স্রষ্টার দর্শন পেয়েছে।
কৈশোরে মিয়া হানিফ মাদরাসায় আট কেলাশ পর্যন্ত পড়েছে। কুরানও মুখস্থ করেছে। যৌবনে তার বিয়ে হয়েছিলো। এক বছর পর সন্তান প্রসবের সময় স্ত্রীর মৃত্যু হয়। নবজাতকও হয় মৃত। এই ঘটনার পর পৃথিবীর উপর থেকে মন উঠে যায় মিয়া হানিফের। সবকিছু ছেড়ে দেয় সে। শুধু আল্লাহর সাথে সংযোগ রক্ষায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তার আত্মীয়-স্বজনরা এলাকার বিখ্যাত পীরের কাছে তাকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তাদের ধারণা, পীরের কাছে মুরিদ হলে তার জীবনে একটা গতি আসবে। নিজেকে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু মিয়া হানিফ রাজি হয় না। বলে, আমার পীর রাসূলুল্লাহ। তিনি সবচে’ বড় পীর, দুনিয়ার পীরেরা  আমার রসুলের উপর নির্ভরশীল, তিনিই আমাকে মাওলার কাছে পৌঁছে দেবেন।
এক পৌষ মাসে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিলো। এক নাগাড়ে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই, ছাড়বার নাম নেই। ছাদের ফাঁক ফোকর চুঁইয়ে বৃষ্টির পানি ঘরের মেঝেতে পড়ছিলো। ঘরের যেখানেই বৃষ্টির পানি পড়ে, মিয়া হানিফ সেখানেই বাসন-কোসন, পেয়ালা-পাতিল বসিয়ে দেয়, যাতে পানির ফোঁটায় মেঝেতে গর্ত সৃষ্টি না হয়। এ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে টপটপ করে যখন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, তখন বৃষ্টির ফোঁটাকে মিয়া হানিফের মনে হয় মধুর শব্দ। একেকটা পাত্রে পানির ফোঁটার শব্দ হচ্ছে একেক রকম, আর সব ক’টি শব্দ মিলে সৃষ্টি হচ্ছে জলতরঙ্গের মতো সুর। মিয়া হানিফ এই শব্দ শুনে মুচকি মুচকি হাসে। সে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানায় তার উপর দয়া করার জন্য। কারণ, ছাদ থেকে ঘরের সবখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, কিন্তু কী আশ্চর্য, তার খাটখানা অক্ষত। এক ফোঁটা পানিও তার বিছানায় পড়েনি। সে এ জন্য আনন্দিত। ভাবে, সৃষ্টিকর্তা তার অনুগত বান্দাকে নিশ্চয়ই দেখছেন, সে ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে ঘর ছাড়া কোথাও যায় না, সবসময় তার জিকিরে ব্যস্ত থাকে। নিশ্চয়ই তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে তার অনুগত বান্দা ভোরের আযান পর্যন্ত ঘুমোয়, সেটা যেনো বৃষ্টি থেকে অক্ষত থাকে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
মধ্য রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে তার ঘুম ভাঙে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। তার মনে হয় রোজ কেয়ামত এসে গেছে। সে কালেমা তৈয়ব পড়তে থাকে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিজলির আলো ঘরে আসছে খানিকটা। সে খাট থেকে নেমে তাকের উপর রাখা বাতিটা খুঁজতে যায়। ঘরের মাঝখানের খুঁটিটা পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে দেখে সবকিছু ভিজে একাকার। ঘরের ভিতরে বৃষ্টির ধারা এলো কী করে - মিয়া হানিফ ভেবে পায় না। আবার বিদ্যুৎ চমকালে দেখলো ছাদের অর্ধেকটা ভেঙে পড়েছে। সে বিড়বিড় করে বলে, মাওলা, তুমি এ কী করলে? তোমার নতজানু বান্দার সাথেও একই ব্যবহার করলে, যা অন্যদের ব্যাপারে মানায়!
সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে খাটে গিয়ে বসে। ভয়ে কাঁপছিলো সে। এবার বলে, মাওলা আমার, খামাখাই তোমাকে অভিযুক্ত করলাম, তোমার দেওয়া বৃষ্টিতে ছাদের একাংশ ভেঙেছে তো কী হয়েছে, অন্য অংশ তো এখনো অক্ষত, যার নিচে তোমার অনুগত বান্দা শুয়ে আছে। তুমি মানুষকে দেখিয়েছো, পুরো ছাদ ভাঙার দরকার নেই, পৃথিবীর বুকে এখনো অনুগত বান্দারা আছে, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নও তো আছে। তোমার প্রিয় বান্দাকে তাই নিরাপদে রেখেছো। তোমার রহস্য কি সবাই বুঝতে পারে?
দূর থেকে ভোরের আযান ভেসে আসে। মসজিদ তেমন দূরে না। তবু প্রবল বৃষ্টির কারণে আযানের ধ্বনি ভালোমতো শোনা যাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো, বহুদূর থেকে আযানের সুর আসছে। আযান শেষ হলে মিয়া হানিফ দোয়া পড়লো। তারপর গায়ে চাদর দিয়ে বৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছাতা নিয়ে বের হলো। দরোজায় তালা লাগাতে গিয়ে তার মনে হলো, ছাদ যেখানে ভেঙে পড়েছে, সেখানে তালা লাগানোর দরকার কী। তবু সে তালা লাগালো। গলিতে পানি জমেছে। সে পানি ভেঙে মসজিদে গিয়ে ছাতাটা এক পাশে রেখে দেয়। মসজিদের টেপে অজু করে। জামাতে শামিল হয়। নামাজের পর ইমাম সাহেব দোয়া করেন, ‘ইয়া এলাহি, আমাদের রক্ষা করো, আমরা গরীব, আমাদের বাড়িঘর কাঁচা, বৃষ্টির পানি আমাদের বাড়িঘর গিলে খাচ্ছে, এবার বৃষ্টি থামাও হে খোদা’।
মিয়া হানিফ বেশ শব্দ করে বলে, আমিন। তার শব্দে মসজিদে গুঞ্জন সৃষ্টি করে। ইমাম সাহেব ও মুসল্লিরা তার দিকে তাকায়। দোয়ার পুনরাবৃত্তি চলে, ‘বৃষ্টি থামাও’।
মিয়া হানিফ এবার গর্জে উঠে - আমিন।
‘বৃষ্টি থামাও’।
মিয়া হানিফের জোর গলা - আমিন।
সমবেত মুসল্লিরা মিয়া হানিফের দিকে তাকায়। তারা হয়তো ভাবে, স্বল্পভাষী এই লোকটার কী হলো আজ। তার আমিন উচ্চারণের শব্দ যেনো মসজিদের ছাদ পেরিয়ে ওপাশে চলে যাচ্ছিলো। দোয়ার পর ইমাম সাহেব বললেন, দোয়ায় আমিন বলা বিধিসম্মত, কিন্তু এতো জোরে বলার কী দরকার ছিলো।
মিয়া হানিফ বলে, মৌলভী সাহেব, এটা আমার মাওলার কারবার। তারপর সে বিড় বিড় করে বলে, হে প্রভো, হে খোদা, একি তোমার খেলা! উপস্থিত মুসল্লিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মিয়া হানিফ ভেজা চাদর গায়ে দিয়ে ছাতা নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়। সূর্যোদয় হয়েছে কিন্তু আবছা অন্ধকার এখনো লেগে আছে। আকাশে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। টপ টপাটপ বৃষ্টি পড়ছে। মিয়া হানিফ গলির হাঁটু পানি ভেঙে যেই ঘরের দুয়ারে এলো, অমনি মুষলধারে বৃষ্টি শুরু। সে তালা খোলার জন্য হাত বাড়াতেই বিকট গর্জন শুনে পিছু হটে। বিস্ফোরিত চোখে দেখে ঘরের বাকি অর্ধেক ছাদও ধ্বসে পড়ছে।
তালা খুলে দরোজায় ধাক্কা দিয়ে হানিফ দেখলো, খৃলছে না। কারণ, ছাদের বাকি অংশ ভেঙে পড়ে দরোজা খোলার পথটি বন্ধ হয়ে গেছে। সে অস্থির হয়ে ওঠে। ভেঙে পড়া ছাদের অংশ নিজের চোখে দেখতে চায়। বিকট শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়েছিলো। তারা সকলে বন্ধ দরোজায় হাত লাগায়। সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে কিছুটা ফাঁক হয় দরোজাটি। মিয়া হানিফ আধ-খোলা দরোজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। তারপর মুচকি হেসে পেছন ফিরে তাকায়, বলে, ‘শক্তিমান প্রভু, তোমার তুলনা হয় না। তোমার কুদরত বুঝা দায়। এই ঘটনা যদি তোমার ইচ্ছায় হয়ে থাকে, তবে তাই হোক।
লোকজন সবাই চলে যায়। সে তালাটি একদিকে ছুঁড়ে মারে। মসজিদে রওয়ানা হয়। সে যখন মসজিদের নিকট পৌঁছে তখন বিদ্যুৎ চমকায় আর মেঘের গর্জনে আকাশটা কেঁপে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার খুব রাগ হচ্ছে বুঝি এই বান্দার ওপর, প্রভো? তার একমাত্র ভরসা তুমি। তোমার দেওয়া বৃষ্টিতে তার ঘরের ছাদ ধ্বসে পড়েছে, এখন আবার মেঘের গর্জন কেনো? আমার উপর শুধু বজ্রপাত হওয়া বাকি, সেটাও করতে চাও? হে মেঘ এসো, বজ্রপাত করো’। সে রেগে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
সে যখন মসজিদে প্রবেশ করে, তখন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে জবুথবু অবস্থা। শীতে কাঁপছিলো। মিম্বরের কাছে মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। ‘প্রভু, আমি রাগের মাথায় এসব কথা বলেছি, ক্ষমা করো, এই নতজানু বান্দাকে ক্ষমা করো’।
আশপাশের কয়েকজন এসে মিয়া হানিফকে সান্ত্বনা দেয়। মিয়া হানিফের কান্না থামে না। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়। কিছুক্ষণ পরপর বাড়িঘরের দেয়াল ধ্বসে পড়ার শব্দ শোনা যায়। সেই শব্দে মিয়া হানিফ চমকে ওঠে। তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ‘কাঁচা ঘরবাড়ি সব ধ্বসে পড়ছে, আর পাকা বাড়িগুলো অক্ষত। তোমার লীলা বুঝা দায় হে প্রভু’- মিয়া হানিফ বলে।
মাগরিবের নামাজের পর সবাই হতবাক। আকাশ পরিস্কার। মেঘের রেশটুকুও নেই। ভরা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো আর আকাশের তারা ঝলমল করছে। ইমাম সাহেব ও মুসল্লিরা তাকে মসজিদের হুজরায় নিয়ে আসে। একজন তার জন্য বিছানাপাতির ব্যবস্থা করে।
ইমাম সাহেব দরদ নিয়ে বলেন, মিয়া হানিফ, তুমি আল্লাহওয়ালা লোক, মসজিদের হুজরায় থাকার অধিকার তোমার রয়েছে। এখন থেকে তুমি এখানেই থাকবে। হানিফ বলে, ঠিক আছে মৌলভী সাহেব, আমার বাড়ির ছাদ ভেঙেছে তো কী হয়েছে, প্রভুর ঘর মসজিদ তো আছে। আমার প্রভু অবশ্যই আমাকে আশ্রয় দেবেন।
এশার নামাজের পর মসজিদ শূন্য হয়ে যায়। মিয়া হানিফ হুজরায় যায়। মেঝেতে বিছানা পেতে কুরানের শেষ পারার পনেরোটি সুরা পড়তে থাকে। ক্লান্ত হয়ে সে বিছানায় যায়। শুয়ে পড়ে। হঠাৎ বিছানা থেকে হকচকিয়ে উঠে বসে। অন্ধকার হুজরার মধ্যে ঘোরাঘুরি করে আর ছাদের চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। হতাশ হয়ে সে হুজরার দরোজা খুলে বাইরে আসে। সে জানে, মসজিদের এক কোণে একজন খাদেম থাকে। মিয়া হানিফ তার দরোজায় কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে খাদেম বলে, কে?
‘আমি হানিফ, প্রভুর বান্দা।’
খাদেম বাইরে এসে হানিফের হাত ধরে বলে, কী খবর মিয়াজী, আপনি তো হুজরায় ছিলেন, না’?
‘হ্যাঁ ভাই ছিলাম। আপনার কাছে জানতে এসেছি, হুজরায় কি কোনো ছিদ্র নেই’?
‘আছে, কিন্তু বৃষ্টির জন্য তো সেটি এখন ঢেকে দেয়া হয়েছে।
‘বৃষ্টি তো ভাই থেমে গেছে। ঢাকনাটি এখনই খুলে দেয়া উচিত।’
‘ঠিক আছে, খুলে দেবো। কাল ভোরে উঠে এটিই হবে আমার প্রথম কাজ।
হানিফ আপত্তি জানায়, বলে, ‘না ভাই ছাদে গিয়ে এখনই ঢাকনাটি সরিয়ে দাও, আমার প্রভুর সাথে আলাপ আছে।’
খাদেম নিশ্চুপ। মিয়া হানিফের কথায় সে খানিকটা ভীত। তবু সে ছাদে গিয়ে ঢাকনা সরিয়ে দেয়। হানিফ তাকে প্রাণভরে দোয়া করে, ‘আমার প্রভু তোমাকে সুখে রাখুক।’
হুজরায় এসে হানিফ ছিদ্র দিয়ে থাকিয়ে থাকে। হঠাৎ আকাশে চারটি তারা চোখে পড়ে তার। সে আনন্দিত হয়। নীরবে হাসে। ‘এক সঙ্গে চারটি তারা। প্রভু আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছো। কখনো অকৃতজ্ঞ হয়েছি আমি। আমি তোমার নতজানু বান্দা, সারা জীবন একটি তারা দেখেই কষ্ট ভুলে থাকি’। 

[উর্দু সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক আহমদ নাদীম কাসমী একাধারে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক। পাকিস্তানের খোশাব জেলার পার্বত্য গ্রাম আঙ্গায় ১৯১৬ সালের ২০ নভেম্বর তার জন্ম। পাঞ্জাব বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। সরকারি চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। উর্দু সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘ফনুন’ সম্পাদনা করেন দীর্ঘ ৫০ বছর। দৈনিক ইমরোজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। প্রভাবশালী দৈনিক জং পত্রিকায় দীর্ঘদিন ‘রেওয়ান-দেওয়ান’ শিরোনামে সমকালীন বিষয়ে কলাম লিখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৫০ টিরও বেশি। সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৮ সালে লাভ করেন রাষ্ট্রপতি পদক, পাকিস্তান একাডেমি থেকে পান আজীবন সম্মাননা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘সিতারায়ে ইমতিয়াজেও ভূষিত হন। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ফুল, তাহযিবই নিসওয়ান, আদাব-ই- লাতিফ, সাভেরা ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, চৌপল, সানাতা, কাপাস কা ফুল, গারসে গার তক ইত্যাদি। তার মেয়ে ড. নাহিদ কাসমী ও ছেলে নোমান কাসমী। শক্তিমান এই লেখক ২০০৬ এর ১০ জুলাই ইন্তেকাল করেন।
গল্পটি মাসিক উর্দু ডাইজেস্ট থেকে অনূদিত -অনুবাদক]

>> পথিক ১৮

ভিনদেশী সাহিত্য >> সম্পর্ক : সালমান রুশদী (লায়লা ফেরদৌস ইতু)

সম্পর্ক

সালমান রুশদী (লায়লা ফেরদৌস ইতু)

প্রফেসর মালিক সোলাঙ্কার তৈরি করা পুতুলগুলো, তার সেই প্রথম দিককার চরিত্রগুলো অবয়ব পেতো ছোট ছোট কাঠের টুকরো, কাপড় আর তুলা দিয়ে। বিভিন্ন রং দিয়ে এসব চরিত্রের চেহারা ফুটিয়ে তোলা হতো, সেসব চেহারায় আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ইঙ্গিতও থাকতো। এরপর এসব চরিত্ররা তাদের এই ক্ষুদ্র শরীর আর চেহারা ছাড়িয়ে বিশাল রূপ ধারণ করার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁর সন্তানদেরকে তিনি মাটি দিয়ে গড়ে তুলবেন। কারণ- ঈশ্বর, যিনি আসলে কোথাও নেই, তিনিও  তাঁর সন্তানদেরকে গড়েছেন মাটি দিয়ে। অথচ এখানে তাঁর কৌতুক শেষ করেননি। মানুষ তাঁর কল্পনার অংশ, অথচ মানুষের জীবন ভীষণরকম বাস্তব। এখানে কল্পনার কোনো স্থান তিনি রাখেননি।
যাই হোক, এসব পুতুলগুলো তাঁর জন্য ছিলো বাস্তব। তিনি এদেরকে তৈরি করতেন, এদের ইতিহাস জানতেন, এদের বেঁচে থাকা দেখতে পছন্দ করতেন এবং এদেরকে ভালোবাসতেন। এদের মনস্তত্ব এবং ইতিহাস নিয়েই তাঁর ভাবনা আবর্তিত হতো অথচ বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো শুধু তিনি পুতুলই খেলছেন। এ সমস্ত পুতুলের মধ্যে একটা পুতুলকে তিনি খুব বেশি ভালোবাসতেন, তার নাম তিনি রেখেছিলেন ‘লিটল ব্রেইন’। লিটল ব্রেইন পুতুল থেকে পাপেট, পাপেট থেকে কার্টুন, কার্টুন থেকে দর্শকদের প্রিয় মুখে পরিণত হয়। তিনি অনুভব করতেন ‘লিটল ব্রেইন’ তাঁকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি কি তাহলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন টাইপের কিছু একটা জন্ম দিয়েছিলেন? তাঁর নিজের ধ্বংসের সূত্রপাত কি তাহলে তাঁর ভালোবাসার সন্তান ‘লিটল ব্রেইন’ই করেছিলো?
মালিক সোলাঙ্কা কোনো দিনই ভাববিলাসী ছিলেন না, বরং ভীষণরকম মেধাবী ছিলেন। ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক, পুতুল তৈরি করাটা ছিলো তাঁর শখ। হঠাৎ একদিন তিনি তাঁর নিজের মাঝে এক অদম্য উন্মাদনা অনুভব করেন, অনুভব  করেন তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। তিনি গভীর রাতে স্ত্রী-ছেলেকে খুন করতে তাদের রূমে ঢুকে পড়েন। ভাগ্যিস, ওরা সেটা দেখতে পায়নি। ডাক্তার রায় দেয়, তাঁর মাঝে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সুতরাং, তিনি স্ত্রী-সন্তানকে ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে আসেন। কারণ, আমেরিকা সব সময়ই স্বর্গস্বরূপ, এর অর্থ আর ক্ষমতার স্রোত সব রকম আক্রোশ ভুলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
‘ফিউরি’ চার অরের একটি চমৎকার শব্দ। অভিধানে এর অর্থ লেখা হয়েছে, অসহ্য ক্রোধ, অদম্য উন্মাদনা, মারাত্মক আক্রোশ কিংবা অপ্রতিরোধ্য পাগলামি। আর পুরাণ বলছে, মানব সভ্যতার সূচনা কালে ইউরেনাস, যার অর্থ আকাশ, তিনি পাহাড়ের উপর থেকে পৃথিবী মাতার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকালে সেই দৃষ্টি বৃষ্টিরূপে ঝরে পড়েছিলো । তাতে পৃথিবী মাতা গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং তার গর্ভ থেকে তখন মানুষ, গাছ-পালা, জীব-জন্তু সব বেরিয়ে আসে।  আর তার শরীরের উঁচু-নিচু খাঁজগুলো বৃষ্টিতে পরিপূর্ণ হয়ে গড়ে ওঠে নদী-সাগর আর বিভিন্ন জলাশয়।
পৃথিবী মাতার সন্তানদের মাঝে সাইকোপস ছিলো খুবই দুষ্টু। এ কারণে ইউরেনাস তাকে পাতালপুরীতে আটকে রেখেছিলেন। এতে পৃথিবী মাতা নিজেও খুব মনঃক্ষুণ্ন হন এবং অন্য সন্তানদেরকে তাদের বাবার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন। এসব বিদ্রোহী সন্তানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলো ক্রোনাস, তার অস্ত্র ছিলো একটি ছোট কাস্তে। সব বিদ্রোহী সন্তানরা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় আটক করে এবং ক্রোনাস তার সেই কাস্তে দিয়ে বাবার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে, যাতে আর কখনো ইউরেনাস তার বংশ বিস্তার করতে না পারে। সে সময় ইউরেনাস এর তস্থান থেকে ঝরে পড়া রক্ত পৃথিবী মাতার উপর পড়তেই তিনি গর্ভ ধারণ করেন এবং ইলেকটো, থিসিফোন, মেগেরা নামে তিন অতি প্রতিহিংসাপরায়ণ দেবীর জন্ম দেন। এদের কাজ হলো ভীষণ রকম উন্মাদ হয়ে অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়া। এদেরকে একত্রে ‘ফিউরি’ ডাকা হয়।
সুতরাং, যার উপর ফিউরি ভর করে সে হয়ে পড়ে অযৌক্তিক রকম উন্মাদ, অদম্য এক অস্থিরতা তাকে কুরেকুরে খায়। প্রফেসর মালিক সোলাঙ্কার উপরও এখন ফিউরি ভর করেছে। সিজোফ্রেনিয়া আবার কী? আর তার সন্তান ‘লিটল ব্রেইন’ও কি তার সুস্থ মন- মানসিকতা সম্পন্ন পিতার স্বাভাবিক সত্তার হত্যার প্রতিশোধ নেবে? নতুবা সে কেনো মনুষ্য শরীর ধারণ করে এই মিলা নামের মেয়েটির মাধ্যমে তার জীবনের সাথে যুক্ত হলো?
প্রফেসর তার ‘লিটল ব্রেইন’কে গড়ে তুলেছিলেন ঠিক একটি কন্যা সন্তানকে গড়ে তোলার মতো করে। এদিকে মিলাও এমন এক কন্যা সন্তান, যার বাবা ছিলেন একজন কবি। তিনি বসবাস করতেন কল্পনার জগতে এবং সেই জগতে মিলাই ছিলো তার একমাত্র সঙ্গী ও সহকারী। হয়ত এ কারণেই মিলা এতো সহজে তার মাঝে ‘লিটল ব্রেইন’কে ধারণ করতে পেরেছিলো ।
এদিকে প্রফেসর মালিক সোলাঙ্কা, যার ভেতরে এক অসম্ভব অস্থিরতা, যিনি জানেন না তাঁকে কী করতে হবে কিংবা তিনি আসলে ঠিক কী করছেন। তিনি শুধু বুঝতে পেরেছিলেন যে বেঁচে থাকার জন্যই কেবল তাঁর একটা অবলম্বন দরকার। কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে নিজের জীবনটুকু যাপন করে যাবার জন্য তার একজন বিশ্বাসযোগ্য সহযাত্রী দরকার। নিজের বোধকে প্রকাশের মাধ্যমে দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাঁর একজন সঙ্গী দরকার । তিনি কি তাহলে মিলাকে আঁকড়ে ধরবেন না? এক অসহায় পিতা কি তার অস্তিত্বের জন্য কন্যার মুখাপেক্ষী নয়?
‘আপনার চোখগুলো আমার বাবার চোখের মতো’ পরিচয়ের পরপরই  মিলার এই উক্তি তাঁকে প্রশান্তি দেয়। তিনি ভাবতে পারেন যে, মেয়েটা তার মাঝে মৃত বাবার ছায়া খুঁজে পাচ্ছে, পিতৃহীন এক সন্তান তাঁর মাঝে হারানো পিতৃত্বের স্বাদ অনুসন্ধান করছে। সম্পর্কটা এর বেশি কিছু নয়।
তিনি এখন বৃদ্ধ। মিলা তাকে সুরক্ষা দেবে, তাকে এক অলৌকিক পিতৃত্বের স্বাদ দেবে, কোনো দিন অনুভব করতে না পারা আনন্দের অধিকারী করবে। এর বেশি কিছু কি তাঁর প্রত্যাশা ছিলো? না কি থাকা উচিত? কিন্তু মিলার হাসিতে যদি কন্যাসুলভ আবেগের চেয়ে বেশি কিছু প্রকট হয়ে ওঠে তাহলে তিনি কী করবেন? বিশাল এ পৃথিবীতে তো তাঁর কোথাও কিছু পাওয়ার নেই, কিছু চাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। অথচ মিলা তাঁকে যা দিচ্ছে তা তো তিনি ফেলতেও পারছেন না, কিংবা তিনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যে তিনি এই বিষয়টা চান না। তাহলে কি তিনিও ভেতরে ভেতরে এই বিষয়টার জন্য, ঐ অজানা শিহরণের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে  উঠেছিলেন?
‘প্রফেসর, আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। মনে হয় যেনো আমার বাবার সাথে কথা বলছি। আপনারও যখনই কথা বলতে ইচ্ছা করবে আমাকে ডাকবেন।’ এভাবেই এক বৃষ্টিঝরা বিকেলে নিস্তব্ধ এক আধো অন্ধকার কামরায় তাদের বাবা-মেয়ে খেলার সূত্রপাত হয়েছিলো । মিলা ছিলো একটা জীবন্ত পুতুল, একটা কথা বলতে পারা ‘লিটল ব্রেইন’। তিনি পুতুল নিয়ে খেলতে আনন্দ পেতেন, এর ভাবনার সাথে একাত্ম হতে পারতেন, এর আচার-আচরণ দেখে সুখী হতেন। একে কি পাপ বলা যাবে?
মিলা সব সময় তাঁর কোলে মাথা রেখে বসে থাকতো। তার বুক তখন তাঁর পায়ের সাথে লেগে থাকতো। তিনি তাই তাঁর পায়ের উপর একটা বালিশ রেখে দিতেন। কারণ একটা পরিণত নারী শরীরের স্পর্শে তাঁর দেহে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটা তাঁর কন্যা বুঝে ফেলুক সেটা তিনি চাইতেন না। কন্যাও সেটা বুঝত না, তাই তাঁর পায়ের ওপর তার বুকের চাপ বাড়তে শুরু করেছিলো ।
একদিন চুপিসারে তাঁর শার্টের বোতাম খুলে মিলার ঠোঁট ঢুকে পড়ে তাঁর হাহাকার ভরা পাঁজরের কাছে। বাইরে তখন দিনের আলো ফিকে হয়ে গুটিগুটি পায়ে সন্ধ্যা নামছে আর ঘরের ভেতর এক অপার্থিব কন্যা সন্তান অনাবৃত করছে তার পিতার গোপন করে রাখা বেদনার জগত, শুষে নিচ্ছে পিতার ভেতরে প্রবহমান সেই কষ্টের জলপ্রপাত। অথচ তাদের মাঝে তখন কোনো রকম বাক্য বিনিময় হচ্ছিলো না, সেটা অবশ্য হয়নি কোনো দিনই। ভাষা আসলেই একটি অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ মাধ্যম। কেউই ভাষার সাহায্যে সত্যিকার অর্থে কোনো কাজ করতে পারে না। আবার ছোট-বড় সবারই খেলার জন্য একটি পুতুল প্রয়োজন।
মিলা জিহ্বা দিয়ে প্রফেসরের বুক ছুঁয়ে বলেছিলো, ‘আপনি সময় নিন। তাড়া-হুড়ো       করার কী দরকার? আমি কোথাও পালাচ্ছি না। কিংবা কেউ এসে আমাদেরকে মাঝ পথে থামিয়েও দেবে না। আমি তো আপনারই হাতে গড়া পুতুল। আপনি শুধু মনে রাখুন কীভাবে খেলতে হয়।’
মিলা বাস্তবে ছিলো একটা মাকড়সা, যার শক্ত জালে পতঙ্গের মতো আমাদের এই বিজ্ঞ ইতিহাসের প্রফেসর ফেঁসে যাচ্ছিলেন। ‘আমি আর আমার বাবা সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, এক সাথে, এক হয়ে।’ তো, আজ কি প্রফেসরের সাথে তার এক হবার পালা? মৃত বাবার ভূমিকায় প্রফেসরের স্থলাভিষেক কি নিয়তি? তাঁর ঝরে পড়া অশ্রু শুষে নেয়ার কাজটা যে মেয়ে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে তাকে কি কন্যা ছাড়া আর কিছু ভাবা যায়? কন্যারা কি এভাবেই তাদের বাবাদের ভালোবাসা না পাবার যন্ত্রণাময় ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেয়?
আচ্ছা, মিলার বাবাও কি তাঁর মতো অনাবিষ্কৃত পৃথিবী আবিষ্কারের পাপ করেছিলেন? এভাবেই কি মানুষের কাছে গচ্ছিত স্বচ্ছ আত্মাগুলো নরকের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে?
‘না, আগেও কিছু ঘটেনি, আর এখনও কিছু ঘটছে না।’ মিলার একথা শুনে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন এ কারণে যে, তাঁর কোনো জৈবিক কন্যা সন্তান নেই। মিলা তাঁর কন্যা নয়, শুধু কন্যার মতো। তিনি এই মেয়ের প্রেমিক নন, কিন্তু প্রেমিকের মতো। তাদের সম্পর্কটা যৌনতা ভিত্তিক নয়, আবার যৌনতামুক্ত বলে বুকে হাত রেখে দাবিও করা যাবে না। এ সম্পর্ক পাপের নয়, আবার পুরোপুরি নিষ্পাপও নয়। তাঁদের মাঝে কোথাও কোনো আড়াল নেই। সম্পূর্ণ সততার উপর প্রতিষ্ঠিত এ সম্পর্কের পরিণতিই বা কী? এও কি তাহলে শুধু ফিউরির অভিশাপ?
প্রফেসর কি স্বীকার করবেন? তিনি নিজেই কি বুঝতে পারছেন কী ঘটছে, কেনো ঘটছে? যেদিন মিলা তাঁর ঘাড়ের ওপর ঠোঁট রেখে সমস্ত বেদনা, জীবনব্যপী তাড়া করা অভিশাপ, কষ্টের উচ্চারণ শুষে নিচ্ছিলো, তখন তাঁর মনে হচ্ছিলো যেনো এই মেয়েই সেই ফিউরি, যে নিতান্ত প্রতিহিংসাবশত তাঁর অস্থির ভাবে ফুটন্ত রক্ত পান করছে। অথচ কী অদ্ভুত, ঠিক তখনই তিনি তাঁর অভ্যস্ত সেই পুরনো খেলার নিয়মটা মনে করতে পারলেন। ‘আপনার ভেতর এতোদিন ধরে যে জিনিসটা অপেক্ষা করছে, মুক্তির আশায় প্রহর গুনছে, যার চাপে আপনি নিজেও এতোটাই জর্জরিত, তাকে আজই কাজে লাগান। আপনি লিটল ব্রেইনের জন্মদাতা, আপনি এটা পারবেন। হ্যাঁ, এভাবেই আপনি নির্ভার হোন।’
সেদিন থেকে প্রফেসর অনুভব করতে শুরু করেছেন অন্য এক উন্মাদনা। তাঁর ভেতরে সেদিনই গড়ে উঠেছে অন্য এক পৃথিবী, অন্য এক কল্পনার মোহাচ্ছন্ন মায়াজাল। মিলার কাছে তিনি কৃতজ্ঞ, কারণ এই অপার্থিব কন্যাটি তাকেও এক অপার্থিব আনন্দের শিক্ষা দিয়েছে। তাঁকে দিয়েছে বর্ণনার অতীত নতুন এক সম্পর্কের স্বাদ, নতুন রকম শ্বাসকষ্টের অভিজ্ঞতা, নতুন প্রকরণের সিজোফ্রেনিয়ার দুর্ভোগ। পৃথিবীতে তো কতো নাম না জানা সম্পর্কই গড়ে ওঠে, কতো অদ্ভুত অবস্থানে মানুষ নিজেকে মানিয়ে নেয়। কিন্তু নিজের মনে সততা থাকলে কোনো সম্পর্কই পাপ নয়। সেই সম্পর্কের কোনো নাম নাইবা দেয়া গেলো.....

[সালমান রুশদী ১৯৪৭ সালের ১৯ জুন ভারতের মুম্বাই (বোম্বে) নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরে তিনি সপরিবারে ইংল্যান্ডে স্থানান্তরিত হন এবং রাগবি স্কুল ও কিংস কলেজে শিক্ষা জীবন কাটান। বর্তমানে তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। এছাড়াও তিনি বর্তমানে ‘রয়াল সোসাইটি অব লিটারেচার’ এর ফেলো এবং ‘পেন আমেরিকা’ সেন্টারের সভাপতি ও ‘কমান্ডার ডি আর্ট অ্যান্ড ডি লেটার’ এর সদস্য।
সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর প্রথম সৃষ্টি Grimus. ১৯৯৩ সালে ‘Midnight’s Children’ এর জন্য তিনি বুকার পুরস্কার পান। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য জীবনের তুলনা, রূপকথা, ইতিহাস, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব, সমকাল সব মিলিয়ে তাঁর উপন্যাস এক জাদু-বাস্তবতার অনুভূতি দান করে।
Fury’ উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে ‘ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স’কে অবলম্বন করে। একদিকে কন্যা সন্তানের জন্য স্নেহের টান, অন্যদিকে মানুষ হিসেবে শুধু নারী আর পুরুষ হিসেবে জীবনের অর্থ খোঁজা, এই রকম মানসিক টানা-পোড়েনের চিত্রই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। -অনুবাদক]


>> পথিক ১৮

গল্প >> পূর্ণতার পিঠে : অনন্ত নিগার

পূর্ণতার পিঠে

অনন্ত নিগার

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও খ্যাতিমান বিজ্ঞানী শওকত হোসেন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপর যার তৈরি কিছু থিসিস পেপার আমেরিকান কয়েকটি নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিলো এবং চারটি মৌলিক বলের মধ্যে তিনটি মৌলিক বলকে একত্রীভূত করার সম্ভাব্য তত্ত্ব যিনি তৈরি করেছিলেন, তিনি কেন তাঁর জীবনের অবশিষ্টাংশটুকু মাতৃভূমি বাংলাদেশের একটি অজপাড়া গ্রাম রসূলপুরে কাটিয়েছিলেন, তা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। সে যাই হোক, জীবনের একেবারে অন্তিম পর্যায়ে এসে অস্ত যাবার আগ মুহুর্তে শওকত সাহেব তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে যে নিজস্ব ভাবধারায় জীবনের প্রবাহমান বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো লিখে রেখেছিলেন তারই উল্লেখযোগ্য শেষাংশটুকু নিচে পেশ করা হলো:
‘.... অতঃপর আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, য়্যূরোপের চাকচিক্য আর গতিময় জীবন কিংবা যান্ত্রিক জীবন আমাকে উদ্বেলিত করিতে পারে নাই। টগবগে যৌবনে যে দুর্বার প্রেরণা আর উদ্দীপনা নিয়া শহরে পদার্পন করিয়াছিলাম, শহরে থাকাবস্থায়ই অনুধাবন করিয়াছিলাম উহা ক্রমশঃ স্থিমিত হইয়া আসিতেছে। অতঃপর প্রথম শ্রেণীতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করিয়া যখন জ্ঞানের পরিধি বাড়াইবার নিমিত্তে উচ্চতর ডিগ্রী লইবার তাগিদে বিলেতে পাড়ি জমাইয়াছিলাম, প্রথমতঃ বিলেতের চাকচিক্যের মোহ আমাকে কিছুটা আবেশিত করিয়া রাখিলেও আস্তে আস্তে তাহা উবিয়া গেল। গবেষণা সম্পন্ন করিয়া বিগত কয়েক বছর ধরিয়াই দেশ মাতৃকার প্রতি, আমার জন্মস্থান রসূলপুরের প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিলাম তাহাই আমাকে শেষ পর্যন্ত জন্মভূমিতে সজোরে লইয়া আসিল।
য়্যূরোপের যে চাকচিক্যময় জীবন তাহা খুবই আকর্ষণীয়, তাহা যে কোন টগবগে যৌবনের অধিকারীকে মোহান্বিত করিয়া রাখিবে। কিন্তু আমি থাকিতে পারিলাম না, কারণ য়্যুরোপের ঐ যান্ত্রিক জীবন ক্রমশঃ আমাকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিতেছিলো । মানুষগুলো যেভাবে যন্ত্রের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িতেছে, তাহা খুবই আশংকাজনক। মানুষ যতোই যন্ত্রনির্ভর হইবে, ততই তাহার মধ্য হইতে শারীরিক ও স্বাভাবিক ক্ষমতা লোপ পাইতে থাকিবে।
যন্ত্র কী? যন্ত্র হইতেছে এমন একটি কৃত্রিম বস্তু, যাহা প্রকৃতির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রকৃতির সহিত পাল্লা দিবার প্রয়াস পায়। কিন্তু ইহা খুবই সুস্পষ্ট যে, প্রকৃতির সহিত যাহা পাল্লা দিতে চেষ্টা করিবে কিংবা যাহা প্রকৃতির সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হইবে, প্রকৃতি উহাকে ক্রমশঃ ধ্বংস করিয়া ফেলিবে। তদুপরি, মানুষ যতোই দিন দিন যান্ত্রিক হইয়া উঠিবে, প্রকৃতি ততই মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলিয়া দিবে। তাই বর্তমান প্রজন্মকে শারীরিকভাবে ক্রমশঃ দুর্বল বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে।
মানুষ তাহার সমস্যার মোকাবিলায় কিংবা চাহিদা মিটাইবার তাগিদে যন্ত্র তৈয়ার করিতেছে। চাহিদা কে তৈয়ার করিতেছে? প্রকৃতি করিতেছে। তাহা হইলে প্রশ্ন উত্থিত হইবে, সৃষ্টির পরিকল্পনা কী?
আমি আমার পিতৃভূমিতে আসিয়া, এ যাবত পৃথিবীর সবচাইতে আধ্যাত্মিক ও খ্যাতিমান গ্রন্থ কোরান নিয়া বেশ মনোযোগ সহকারে পড়াশুনা করিয়াছি। উহা পড়িয়া অনুধাবন করিলাম, ‘আসমাউল হুসনা’ কিংবা স্রষ্টার সুন্দর নাম অথবা গুণসমূহের মধ্যে ‘কামেল’ গুণটি স্রষ্টার মধ্যে আছে। অর্থাৎ স্রষ্টা পরিপূর্ণ; কামেল ছাড়া বাকী আটানব্বইটি গুণ মানুষের মধ্যে আছে। এতে অনুধাবন করা যায় মানুষ সব গুণাবলীর অধিকারী কিন্তু মানুষ পূর্ণ হইতে পারিবে না। মানুষ যতই পূর্ণতার দিকে যাইতে থাকিবে, ধ্বংসও ক্রমশঃ তাহার দিকে ধাবিয়া আসিবে।
আমি এইসব লইয়া ভাবিতে চাহি না। ভাবিতে চাহি না যন্ত্রকে লইয়া। আমি মাটির মানুষ। উদ্ভিদ যেমন ভূমি উদগীরণ করিয়া সবুজ হইয়া বাহির হয় আমিও তেমনি মাটি ভেদ করিয়া সবুজের ন্যায় মাথা উঁচাইবার চাই। আমি চাই নরম একটি জীবন, সরল একটি জীবন, যে জীবন মাটির ন্যায় মৌলিক।’
ঘটনার প্রায় দুই শ' বছর পরে যখন স্থানীয় জনপ্রিয় একটি আর্কাইভ থেকে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক শওকত হোসেনের ডায়েরী উদ্ধার হলো, তখন বিজ্ঞানী মহলে বেশ সাড়া পড়ল এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো শওকত সাহেবের ডায়েরীতে তাঁর গ্রামের যে বর্ণনা দেয়া আছে সে অনুসারে চতুর্মাত্রিকের বদলে ত্রিমাত্রিক একটি ভার্চুয়াল গ্রামের ভিডিও চিত্র তৈরি হবে এবং কয়েক মিনিটের সেই ভিডিও চিত্র ছোট শিশুদেরকে স্থানীয় বিজ্ঞানাগারে প্রদর্শিত করা হবে।
ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে চলতি প্রজন্মের কম্পিউটার দ্বারা মাত্র কয়েক ঘন্টায় ভার্চুয়াল গ্রামের অ্যানিমেশন তৈরি হলো।
পরদিন বিকেলে স্থানীয় বিজ্ঞানাগারে সুপার প্রজেক্টরের সাহায্যে প্রদর্শনীর আয়োজন হলো। ছোট ছোট শিশুরা এলো। এদের প্রায় সবারই চোখে মাইনাস লেন্স বসানো। অনেকে শ্বাসকষ্টের রোগী, তাই শরীরের সাথে লাগোয়া ছোট সিলিন্ডারের সাহায্যে শ্বাস ফেলছে। অনেকেই বিকলাঙ্গ ও শারীরিক প্রতিবন্ধি, তাই এদের সাথেই রয়েছে ছোট বোতল ভর্তি ভিটামিন সিরাপ। আবার বাকশক্তিহীন অনেকের মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নিউরো রিডিং কম্পিউটার।
অপারেটর রোবট এসে প্রথমে হালকা নির্ধারিত লেকচার দিল। অতঃপর  সময়মতো প্রজেক্টর চালু করলো। ছোট ছোট শিশুরা গ্রামের গল্পই কেবল শুনেছিলো । পর্দায় ভার্চুয়াল গ্রাম তারা হাঁ করে দেখতে লাগল। তারা দেখতে লাগল গাছ, ধানক্ষেত, খড়ের গাদা, বাঁশের সাঁকো, দেখতে লাগল গরুর পাল, ভেড়ার পাল, মুরগী আর হাঁসের ছানা, তারা দেখতে লাগল, আকাশের নীল আর নীল, বিকেলের টলটলে নদী আর সূর্যাস্ত, গহীন অরণ্যে ঘেরা সবুজ আর সবুজ, তারা দেখতে লাগল শওকত হোসেনের সেই রসূলপুর।
প্রদর্শনী শেষে অপারেটর রোবট ঘোষণা করলো শওকত সাহেব তাঁর ডায়েরীতে হাস্যকর একটি উদ্বৃতি দিয়েছিলেন তা হলো, মানুষ পূর্ণতা অর্জন করলেই ক্রমশঃ ধ্বংস হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, আর কয়েকদিন পরেই, হয়তো আজই মানুষ চারটি মৌলিক বলকে একত্রীভূত করে মহাবিশ্বের উৎপত্তির কারণ জেনে যাবে। ঘোষণা শেষ হবার আগ মুহূর্তেই হঠাৎ দূরবর্তী কোনো স্থান থেকে প্রচন্ড শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা গেলো। সবাই হতবিহবল হয়ে আশেপাশে তাকালো কিন্তু ঠিক বুঝা গেলো না কোথা থেকে শব্দের উৎপত্তি। হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী  সবেগে দোলে উঠল। ক্রমেই ভয়ানকভাবে বাড়তে থাকে সে দোলুনি।

>> পথিক ১৮

গল্প >> চোর : মাখরাজ খান








চোর

মাখরাজ খান

আমার একটা মজ্জাগত অভ্যাস আছে। তা হলো আমি পেট পুরে খাই আর শুলেই মরার মতো ঘুমিয়ে পড়ি। এজন্য লেখাপড়াও করতে পারিনি। চেহারা মোটামুটি চলনসই বলে বিনে পুঁজির ব্যবসা ‘শো ম্যান’ বিজনেসে নেমেছিলাম। সার্কাসের ক্লাউন - এখন আমি পেশাদার ‘শো ম্যান’। বিভিন্ন সময়ে আমাকে দামি এবং চটকদার পোশাক পরতে হয়। রাস্তায় বেরোলেই লোকজন আমার দিকে চেয়ে থাকে - এ গর্ব আমার বরাবরই।
শীতকালে সাধারণত, ইটালিয়ান মার্কেট থেকে কেনা জ্যাকেট পরতে হয়। এ জঞ্জাল অবশ্য আমার ভালো লাগে না। তবু ইমেজ ধরে রাখার জন্য রাজহাঁস সেজে রাস্তায় বেরোতে হয়। চোর বোধহয় আমার এই  অদ্ভুত চটকদার পোশাক দেখেই পিছু নিয়েছিলো। এই পোশাক তার চোখ ঝলসে দিয়েছিলো। চোর মনে করেছিলো, আমি কোনো রাজ্যহারা মোঘল সম্রাটের বংশধর। কালের করাল গতিতে সিংহাসন হারিয়েছি; কিন্তু বিত্তহীন হইনি। আর বিত্তবান লোক ছাড়া আর কে এই দুর্দিনে পালকের জ্যাকেট, চিত্রল ওভার কোট আর চামড়ার ক্যাপ পরতে পারেন? কিন্তু তার হয়তো জানা ছিলো না যে, আমি এক কক্ষ বিশিষ্ট একটি দালানে বাস করি। আমার ঘরে আসবাবপত্র তো দূরের কথা, চোর পেটাবার জন্য একটা লাঠিও নেই। একটা ক্যাম্প খাটের উপর মাদুর বিছিয়ে লেপ কম্বল ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পড়ে থাকি। শীতের সময় আমরা সমস্ত পরিধেয় গায়ে জড়িয়ে নিই। আমার স্ত্রী তার শাড়ি, ট্রাউজার আর গাউন পেঁচিয়ে শুয়ে পড়ে।
রাতে আমাদের এই অবস্থা দেখলে নিশ্চয় মহাশূন্য যাত্রী বলে ভুল করবেন আপনারা। কিন্তু তবু ভীষণ শীত লাগে। স্ত্রীর মোজাও ছিঁড়ে গেছে কয়েক দিন আগে, কী যে কষ্টে আছি!
এভাবে যখন কষ্টেশিষ্টে দিন কাটাচ্ছি, সেই শনিগ্রস্ত সময়েই এক রাত্রিতে আমার ঘরে চোর ঢুকলো। শুলেই ঘুমিয়ে পড়ি বলে প্রথমে বুঝতে পারিনি। সবেমাত্র আমি ঘরের দক্ষিণ পাশে খাটটা এনে শোবার আয়োজন করছি। তখনি বুঝতে পারলাম যে ঘরে চোর ঢুকেছে। খাটটাকে অবশ্য সরানোর প্রয়োজন হতো না, যদি কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি না হতো। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে ঠিক খাটের উপর। তাই খাটটা সরানোর প্রয়োজন ছিলো। আমার স্ত্রী এমন কুম্ভকর্ণ যে, তাকেসুদ্ধ খাটটা কয়েক হাত টেনে আনার পরও নাক ঢাকতে লাগলো। আমি চোর ঘরে আছে জেনে তাড়াতাড়ি স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম চোরকে ধরতে গেলে সে আঘাত করে রক্তাক্ত ছুরি ফেলে পালিয়ে যাবে।
কেনো ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিতে যাবো আমি? শুয়ে পড়ার একটু পরে সে আমার গায়ের কাপড় ধরে টানাটানি করতে লাগলো। গা থেকে অবশ্য খুলতে পারলো না কিছুই। কারণ শোবার সময় কাপড়গুলো ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে শুয়েছিলাম। আমার জুতা ছিলো মাথার নিচে। বালিশ না থাকার দরুণ জুতা মাথার নিচে রেখেই ঘুমাতাম আমি। সেই জুতা ধরে কয়েকবার টানাটানি করলো সে; কিন্তু নিতে পারলো না।
এরপর ঘরের উত্তর কোণের দিকে সে পা টিপে টিপে যেতে লাগলো। ওখানে আমি চালের ভাণ্ড রেখেছিলাম - এই একটিমাত্র জিনিস যা আমার বিছানার বাইরে রেখেছিলাম। চোর ভাণ্ডের কাছে গিয়ে দু’ হাতে ধরে কয়েকবার উঠাতে চেষ্টা করলো; কিন্তু পারলো না। আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে চল্লিশ কেজি চাল ধারে কিনেছিলাম। পাত্রে রাখার পর এর ওজন হয়েছে এক শ’ কেজি। কারণ চিনেমাটির দশাসই পাত্রটির ওজনই ষাট কেজি। আমি ভাবলাম এক শ’ কেজির পাত্র তার পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর যদি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে নিয়েও যায়, এত রাতে রাস্তার মধ্যে পুলিশের হাতে নির্ঘাত অ্যারেস্ট হতে হবে।
আমাদের দেশের চোরদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে, তারা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় খালি হাতে বের হয় না। তাদের ধারণা, খালি হাতে বেরোলে ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। খালি হাতেই ফিরতে হবে। আমি মনে করলাম নিদেন পক্ষে সে একটা তোয়ালে নিয়ে এসেছে এবং তাতে করেই হয়তো কয়েক কেজি চাল নিয়ে যাবে। সে যে একটা নকশা করা চটকদার কুমিল্লার চাদর গায়ে দিয়ে এসেছিলো তা আমার ভাঙা জানালা দিয়ে তার গায়ের উপর আলো পড়া সত্ত্বেও লক্ষ করিনি।
চোর চালের ভাণ্ড’র কাছে গেলো। এবং কোমরে হাত দিয়ে সিনেমার ভিলেনের মতো কী যেনো ভাবলো কিছুক্ষণ। চোরেরা সাংঘাতিক নিষ্ঠুর! ঐ সময় কিছু বললে-আমাকে কুপিয়ে কাবাব বানিয়ে ফেলবে ভেবে চুপ করে রইলাম। চোর মেঝেতে তার নকশাদার চাদরটি বিছিয়ে দিলো, আমি ভাবলাম এই একটা বিরাট সুযোগ। এই সুযোগ আমার হাতছাড়া করা উচিত নয়। আর মনে মনে ভাবলাম, চোর তুমি যতো বড় মাস্টারই হও; এখানে মাস্টারি করতে পারবে না।
সে চালের ভাণ্ডটি গড়িয়ে গড়িয়ে  চাদরের দিকে আনতে লাগলো, আর আমি মেঝে থেকে তার চাদরের কোণ ধরে খাটের দিকে টানতে লাগলাম। যেখানে সে চাদরটি বিছিয়েছিলো, সেখানেই চালের ভান্ডটি এনে উপুড় করে ঢেলে দিলো। আমি চাদরটি আমার পিঠের নিচে রেখে শুয়ে পড়লাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, সে চাল নিতে পারবে না। রান্নার সময় চালগুলো একটু ধুয়ে নিতে হবে, এই যা! এরপর খালি ভাণ্ডটি সে যেখান থেকে এনেছিলো সেখানে রেখে দিলো। এরপর চালের কাছে ফিরে এসে চাদরের সন্ধান করতে লাগলো। অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে লাগলো - ‘ওবো, দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তুর, আশি, নব্বুই, শ’। শ’, নব্বুই, আশি, সত্তুর, ষাট, পঞ্চাশ, চল্লিশ, ত্রিশ, বিশ, দশ, ওবো। আমি কি ভুল করে চালগুলো মেঝেতে ঢেলে ফেললাম?’ সে চালের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসলো এবং আরো সতর্কতার সাথে চাদরটি খুঁজতে লাগলো।
: ‘হায়!’ মনে হলো কী যেনো তাকে আঘাত করেছে।
: ‘কী জুলুমের মধ্যে পড়লাম।’ কথাটা বোধহয় একটু উচ্চস্বরে হয়েছিলো। তাই আমার স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেলো। সে আমাকে বলতে লাগলো -
: ‘কে জুলুমের মধ্যে পড়লো? আমি কি তোমার সাথে জুলুম করেছি? আমাকে এমন কথা তুমি বলতে পারলে!’ এই বলে সে কান্না জুড়ে দিলো।
আমি বললাম -
: ‘চুপ করো! আমি কিছু বলিনি। ঘরে চোর ঢুকেছে।’ এই কথা শোনার পর জোড়া পায়ে আমার স্ত্রী লাথি মারলো।
আমি কৃত্রিম হাই তুলে বললাম -
: ‘ঘুমাও, কোনো চোর ঢুকেনি।’
এই সময় যেনো ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলো। চোর আহত বাঘের মতো গর্জন করে বললো -
: ‘ঘরে চোর ঢুকেনি বলছো! তাহলে কে - কে আমার  এতো সুন্দর চাদরটি নিলো?


(চীনা গল্পের ছায়া অবলম্বনে) 

>> পথিক ১৮

গল্প >> নতুন গান : প্রণব আচার্য্য

নতুন গান

প্রণব আচার্য্য

ধরা যাক, কয়েকটি বালক একটি মেয়েকে ধাওয়া করছিল। মেয়েটির গ্রীবা থেকে আমাদের কবিদের চিত্রকল্পসমূহ একে একে বিদায় নিচ্ছে। ফলে ক্রমেই মেয়েটির ‘মেয়েটি’ থেকে মেয়েসূচক অস্তিত্ব লোপ পাচ্ছিলো। এরকম একটি দৃশ্যকল্প মাথায় রেখে এবার আমরা একটি জনবিরল গ্রাম্য বাজারে প্রবেশ করি। বাজারটির একটি নাম দেওয়া যাক, ধরলাম বাজারটির নাম কালীবাজার। বেশ পুরোনো; দেশান্তরী হওয়ার আগে হিন্দুরা এখানে রক্ষাকালীর পুজা করতো বিধায় এই নাম দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে অবশ্য বাজারটির নাম পরিবর্তন করে কাশেম বাজার দেওয়া যায় কিনা এরকম একটা আলোচনা আলোচ্য বাজারের মধ্যবর্তী কালীগাছটির ডাল পালায় ওড়াওড়ি করছিল। ইতিমধ্যেই অশ্বত্থ পেঁচানো কালী গাছটির কয়েকটি শাখায় বটের পাতাও গজাতে শুরু করেছে।
এবার চোখ ফেরানো যাক বাজার সংলগ্ন গেটঅলা বাড়িটির দিকে। গেটের ললাটে স্পষ্ট আরবি হরফে ‘আলাহু’র জ্বলজ্বলে ক্যালিওগ্রাফি শোভা পাচ্ছে। এই ক্যালিওগ্রাফী থেকে আধ মাইল উত্তর পশ্চিমে ধাবমান বালিকার অবস্থান- এটা মাথায় রেখে আমরা বাড়িতে প্রবেশ করবো। তার আগে বাড়ি এবং গেরস্থের একটা পরিচয় দেওয়া যাক। বাড়িটির বর্তমান মালিক যথাযথ প্রক্রিয়ায় নামের আগে হাজী শব্দটি যুক্ত করেছেন সতেরো বছর হয়। অভিজ্ঞ পাঠকদের নিশ্চই মনে আছে আজ থেকে সতেরো বছর আগের সেই বিশেষ বছরটির কথা? সে বছর আমাদের ভারতীয় দাদারা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছিলেন। আর তার সুবাতাস এসে লেগেছিল আমাদের এই কালীবাজারেও। ধীমান পাঠকবৃন্দ, এটিকেও মাথায় রাখবেন। হাজি সাহেব পড়াশোনা করেছেন অবশ্য প্রবাসের মাদ্রাসায় (তখনো মাদরাসা শব্দটি প্রচলন শুরু হয়নি)। পাঠক, এখানে প্রবাস মানে কালীবাজারের বাইরের এলাকা। যেদিন তিনি প্রবাস থেকে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন তার দুই দিন পর গনেশের দোকানে চা দিয়ে পরোটা খেতে খেতে আমরা জানতে পারি, ‘ছোবান মিয়া বৈদেশ থিকা হাফেজ হইয়া আইছে। লগে দুগা বিবি আর জমজমের পানিও আনছে। হেরে অহনত্থুন আজি সাব কই ডাইকতো অইবো। এখানে একটি কথা বলে রাখি, বেশি নয়, তিন পুরুষ আগে হাজি সাহেবের বাপের দিকের কোনো এক মহিলা সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ ঘরের কনিষ্ঠা কন্যা ছিলেন।
এখন আসি যে বছর রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতীয় দাদারা উন্মাদ হলো সে বছর এ গ্রামের এক দুপুরের ঘটনায়। শিবু ধরা পড়েছে। বেঁধে রাখতে হয়নি, সুযোগ থাকলেও সে পালায় না। শ্রীযুক্ত শিবুর পরিচয় হচ্ছে সে এ গ্রামের সবচেয়ে বর্ষীয়ান চোর। এটা উত্তরাধিকারসূত্রেই প্রাপ্ত। পাকা হাত। অবশ্য তার একটা নীতি আছে, মোসলমানের ঘরে সে কখনো চুরি করে না। তার নাকি মুখে রোচে না। পাঠক, স্বধর্ম মরণং শ্রেয়, পরধর্ম ভয়াবহ- বহুকাল আগে গীতামুখে কৃষ্ণ নাকি এ কথা বলে গিয়েছিলেন। যাক সে কথা। বিচার বসেছে। শান্তিবাবুসহ অন্যান্য সালিশদাররা এখনো এসে পৌঁছাননি। এরই মধ্য শিবুকে তৃতীয় বারে মতো উত্তম মধ্যম হজম করতে হয়েছে। চতুর্থবারের সময় প্রতিরোধ গড়ে তোলে সে। উৎসাহীরা কিঞ্চিত ভয় পেয়ে নিরস্ত হয়। ভিড় থেকে সহমর্মী একজন শিবুকে একটি কে-টু সিগারেট ধরিয়ে দেয়। সিগারেট টানতে টানতে শিবু এবং উৎসাহীরা সালিশদারদের অপেক্ষা করতে থাকে। প্রিয় পাঠক, দয়া করে ঐ বালিকাটির কথা ভুলে যাবেন না।
অনেক তো ধান ভানলাম, এবার নিজের পরিচয়টা দিই। আমি গান লিখি। প্রচলিত আছে, ব্যর্থ কবিরাই নাকি গান লেখে। আমিও কবিতায় বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে কিছু দিন হলো গান লিখতে শুরু করেছি। নিজে লিখি, নিজেই সুর করি। আমি অবশ্য কালীবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা নই। থাকি ভিন গাঁ-এ। এমনকি গল্পের প্রথম থেকে যিনি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন আমি তাঁর কেউ নই। অথবা যারা তাঁকে ধাওয়া করছে তাদের সাথেও আমার কোনো পরিচয় নেই। আমি শুধু একটি গান লেখার অপেক্ষায় আছি। একটি নতুন গান। যে গানে কোনো উপমা থাকবে না। রাগ রাগীনির শৃঙ্খল থাকবে না। সুর-লয়-তাল কিছুই থাকবে না। কিন্তু সেটা গান হবে এবং সমবেতভাবে গাওয়া যাবে। আমার নিবাস আমারই নৈরাশ্যের মধ্যে।
পাঠক, আমি গল্পকে খুব বেশি দীর্ঘায়িত করতে চাই না, ভালোও লাগে না। তাই সংক্ষিপ্তসারে শেষ করে দিই এ গল্পটিও। সেদিন সালিশদাররা কেনো আসেনি জানেন? রাতেই তারা রেডিওতে খবর পেয়েছিলা বিজেপি-শিবসেনার হনুমানেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে ফলে সারা ভারতে এবং বাংলাদেশে অনুমেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে। সঙ্গত কারণেই সেদিন সালিশি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আর তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে সালিশের জন্য অপেক্ষারত শিবু চোরা এবং অন্যান্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই হাজি বাড়ির ভেতর থেকে কালীবাজারের উপরে নরক নেমে এসেছিল। নারায়ে তাকবির, আলাহু আকবর শব্দে রক্ষাকালীর আস্তানায় শেষবার রক্তের হোলি খেলা চলেছিলো ঠিক পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী। আর হাজি বাড়ির গেট থেকে আধ মাইল উত্তর পশ্চিমে যে মুসলিম বালিকাটি ধর্ষিত হচ্ছিলো তার কিছু দুরেই দাউদাউ জ্বলছিলো একটি সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ বাড়ি।
প্রিয় পাঠক, ধরে নিন বালিকাটি এখন তিন সন্তানের জননী। সব অতীত এখন, কালীবাজারও। আমি কাশেম বাজারের বাসিন্দা নই বলে আমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি- না রক্তে, না ধর্মে। এমনকি তার সাথে আমার কোনোদিন দেখাও হয় নি। কিংবা সে আমার প্রণয়িনীও ছিলো না কোনো কালে।
কিন্তু সতেরটি বছর ধরে আমি ঐ ধাবমান বালিকাটির জন্য একটি নতুন গান লেখার অপেক্ষায় আছি। কারণ এখনো আমি তার চোখে ভয়কাতর হরিণের খুরের শব্দ শুনতে পাই। 

>> পথিক ১৮

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০১০

গল্প >> নিতান্ত সাধারণ মানুষ : সাঈম চৌধুরী

নিতান্ত সাধারণ মানুষ

সাঈম  চৌধুরী

সকাল দশটায় তিনি অফিস পৌঁছেন। বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যায়। শার্ট-প্যান্ট তাকে বড় যন্ত্রণা দেয়। ঘরে ফিরে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে চাপালেই রাজ্যের স্বস্তি। নিয়ম করে টিভি দেখেন ঘণ্টা তিনেক। আশপাশের প্রতিটি ঘর থেকে স্টার প্লাস কিংবা জিটিভির জমজমাট সিরিয়াল অথবা রমরমা হিন্দি গানের আওয়াজ ভেসে আসে। হিন্দি বাক্যের আগামাথা কিছুই বুঝেন না তিনি। এখনও তার সবটুকু ভরসা বিটিভিতে জমা। রাত দশটার ইংরেজি খবর তাকে ঘুমের নিমন্ত্রণ জানায়। কখনো কখনো সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েন। এই তার রোজকার রুটিন। নিতান্তই সাধারণ নির্লিপ্ত এক জীবন। যারা আড্ডাবাজ, যারা গল্পবাজ তারা এই মানুষটির বর্ণহীন সময়ের গল্পে হাঁসফাঁস করে। তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। তারা ভ্রু কুচকে বলেন, এটাও কি তবে জীবন? এ কেমন জীবন যার কোনো বাঁক নেই, গল্পের পায়রার বাকবাকুম নেই!
আড্ডাবাজেরা মানুষটির অতীত অনুসন্ধান করেন। নিষ্কর্মা সময়ে চায়ে চুমুক দিয়ে তারা না জানা গল্পের লেজ ধরে টান দিতে চান। তত্ত্ব-তালাশ করেন। এভাবে গল্পহীন মানুষটিও গল্প হয়ে যান। তাকে নিয়ে তত্ত্ব তালাশে  জানা যায়, একদিন স্ত্রীর কাছে একটি গল্প বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। নিজের জীবনের গল্প। সে গল্প শুনবেন বলে উৎসুক হয়েছিলেন স্ত্রী। ইচ্ছে প্রকাশের সে রাতে ফকফকা জোসনা ছিলো। যেনো দুধে ধুয়েছিলো কালো রাতের আন্ধার। হঠাৎ জানালা দিয়ে তাকিয়ে জোসনার আধিপত্য দেখে গল্প বলার ইচ্ছে চাপা দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এটি অন্ধকারের গল্প। কোনো এক অমাবশ্যা রাতে বলবো। তারপর আর কখনো সেটি বলা হয়নি। স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছেন দুই বছর।
এখন এই গল্প শোনার মতো কেউ তার পাশে নেই। অন্ধকারের গল্পটি আরো কয়েক বছর পর তার সঙ্গে অন্ধকার কবরে ঘুমাবার চূড়ান্ত বন্দোবস্ত নিয়েছে। জীবনের বহু গল্প ভাষাহীন থেকে যায়।
এভাবে এই গল্পটিও অপ্রকাশ্য থাকার সব যোগ্যতা অর্জন করার পর বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এক দঙ্গল আড্ডাবাজ। তারা ধারণা করে, এটি ভয়ঙ্কর কোনো রাষ্ট্রদ্রোহিতার গল্প। কারণ গেলো সপ্তাহে তিনি যখন মনোরঞ্জনের সেলুনে বসে চুল কাটছিলেন, তার হাতে পত্রিকা ছিলো। পত্রিকা পড়তে পড়তে তিনি কেনো জানি অকস্মাৎ বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষ করেন। অমার্জনীয় কটাক্ষ। বাংলাদেশকে তিনি পাছার সাথে তুলনা করেন। মনোরঞ্জন সেটা স্পষ্ট শুনেছে। মনোরঞ্জন বিস্মিত হয়েছে। আড্ডাবাজেরা বিস্মিত হয়েছে। তারা হিসেব মেলায়, জানে, এই মানুষটির একটা গোপন গল্প আছে। জানা মতে, গল্পটি শুনতে হয় অমাবশ্যা রাতে, দিনের আলোয় তা ভাষাহীন থাকে, জোসনার আলোয়ও সেটি বলা যায় না। সব মিলিয়ে বিশ্রী  চেহারা ধারণ করে গল্পটি। আড্ডাবাজেরা ক্ষেপে যায়। কেউ কেউ দেখে নেওয়ারও হুমকি দেয়। কিন্তু যতটা একজন গোঁয়ারকে দেখে নেওয়া যায়, ততোটা একজন গোবেচারাকে দেখে নেওয়া যায় না। গোবেচারা হওয়ার এই সম্ভবত একমাত্র সুবিধা।
আড্ডাবাজেরা তাকে সুযোগ দেয়। গল্প শোনাবার সুযোগ। এক অমাবশ্যা রাতে হাজির হয় তারা। টিভিতে তখন দশটার ইংরেজি সংবাদ। তিনি ঘুমোবার আয়োজন করছেন।
আড্ডাবাজেরা বলে, আপনার গল্প বলুন।
তিনি বলেন, আমার কোনো গল্প নেই।
আড্ডাবাজের একজন বলে, আপনি কি আমাকে চিনেছেন? আপনার স্ত্রী ছিলেন আমার বড় ফুপুর ননদ। তিনি ফুপুর কাছে বলেছিলেন, আপনার নাকি এমন একটা গল্প আছে যে গল্প শুনতে হলে অমাবশ্যা রাত নামতে হয়, এটি কি কোনো ভূতের গল্প নাকি ভয়ঙ্কর পাপের গল্প? জেনে রাখুন, ভূতের গল্পে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা বিশ্বাস করি, যে গল্প অন্ধকারের গল্প সেটি অবশ্যই পাপের গল্প।
আড্ডাবাজদের মধ্যে সেলুনের সেই মনোরঞ্জনও আছে। সে স্মরণ করিয়ে দেয়, বাংলাদেশকে গালি দেওয়ার বিষয়টি। 
অন্ধকারের গল্প এবং বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে গালি দুটোর মধ্যে যে একটা যোগসূত্র থাকতে পারে সেটি প্রকাশ পায় সবার কথাবার্তায়।
তিনি ঘড়ির দিকে তাকান, এগারোটা বাজে। অনেক দিন পর রুটিনের ব্যতিক্রম। আজ সময় মতো বিছানায় যাওয়া হয়নি। এক গ্লাস পানি পান করেন তিনি। আড্ডাবাজরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তখনো টিভি চলছে। একটি মোবাইল কোম্পানির নির্দিষ্ট প্যাকেজ কিনলে সারা রাত ফ্রি কথা বলা যাবে, একদল ছেলে মেয়ে নেচে গেয়ে সেই তথ্যটি জানান দিচ্ছে। তিনি টেলিভিশন অফ করেন। হঠাৎ নীরব হয়ে যায় চারপাশ। তার মাঝে গমগম করে উঠে তার কণ্ঠস্বর, আমি মুমিনুল ইসলাম। বাংলাদেশ আর আমার মাঝে সংখ্যার দিক থেকে একটা মিল আছে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল আর ছাপান্ন বছর। হ্যাঁ, বৃদ্ধই বলা যায় আমাকে। গল্পটাকে ধারণ করেছি উনচল্লিশ বছর। ছাপান্ন থেকে বিয়োগ উনচল্লিশ। রইল বাকী সতেরো। আমি তখন সতেরো বছর....
গল্প বলেন মুমিনুল ইসলাম। সতেরো বছর বয়েসের গল্প। ছাপান্নে যার নাম মুমিনুল ইসলাম, সতেরো বছর বয়েসে তার আরেক নাম রাঙা। দেখতে ছেলে রাজপুত্র বলে, বাবা আদর করে রাঙা বলে ডাকেন। রাঙা আর রঙিলা। ভাই আর বোনের রঙিন নাম। সময়টাও তাদের কাছে রঙময়। রঙিলার গান শেখার শখ। যেদিন রঙিলার আঠারো বছর পূর্ণ হলো বাবা তাকে হারমোনিয়াম কিনে দিলেন। হারমোনিয়াম বাজাতে জানে না রঙিলা। শোয়ার সময় বিছানায় হারমোনিয়ামকে সঙ্গে রাখে সে। জড়িয়ে রাখে সারারাত। বাবা হাসেন। মাও হয়তো হাসতেন। কিন্তু হারমোনিয়াম কেনার দুই বছর আগে তিনি হুট করে চলে যান। রূপকথার বয়স মাত্র পেরিয়ে এসেছে রঙিলা কিংবা রাঙা। তবুও তারা মাকে আকাশের তারায় খুঁজে। হারমোনিয়ামে সারেগামা’র মা তানটি সহজেই তুলতে জানে রঙিলা। বাবা তাদের যত্ন করে গড়ে তোলেন। বাবা যেনো বন্ধু, বাবা যেনো মা, বাবা যেনো ভাইবোনের সকল ভরসা জমা করে রাখার বিশ্বস্ত ব্যাংক।
রাঙা তখন সতেরো। দশম শ্রেণীর শান্ত সুবোধ ভালো ছাত্র। স্কুল থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে খেলার মাঠ আর বন্ধুদের সঙ্গে তুরন্ত-দুরন্ত আড্ডা। রাঙা তখন পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন। রাঙা তখন জীবনকে চিনতে শেখে এবং জীবনে আনন্দের প্রাচুর্যে সে খুবই মুগ্ধতা বোধ করে। রাঙার কাছে রাষ্ট্র তখন অচেনা বিষয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে যে ভাবতে জানে গোটা আকাশটাই তার, তার পক্ষে রাষ্ট্রের সীমানার ব্যাপার স্যাপার বুঝে নেওয়া জটিলসাধ্যই বটে।
তবুও কি রাষ্ট্রকে অতিক্রম করতে পারে মানুষ? নিজেকে কাঁটা তারে বাঁধতে না চাইলেও এক সময় বোধ হয় সে আসলে জন্মাবধি ঐ তারেই বান্ধা। রাষ্ট্র তাকে সীমানায় বন্দি করে, এমনকি রাষ্ট্র শূন্যে আন্দাজে আকাশ মেপে তৈরি করে আজগুবি আকাশসীমা। 
রাষ্ট্র বুঝে না রাঙা। তাই বলে রাষ্ট্রের জটিলতা তাকে ছেড়ে দেয় না। তখন একাত্তর। আশ্চর্য এক সময়। একটি রাষ্ট্র ভাঙছে, একটি রাষ্ট্র জন্ম নিচ্ছে। ভাঙাগড়ার অদ্ভুত সেই সময় সাত কোটি মানুষকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেখায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেখে রাঙাও। ভালো লাগে না তার। ঘরের বাইরে যাওয়া নেই। খেলা নেই। স্কুলও নেই। কিছুদিন পর প্রি টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিলো। পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন মাধব স্যার। কাজটাকে তিনি সব সময় বাড়তি ঝামেলা মনে করতেন। তাকে আর কোনোদিন খাতা দেখার ঝামেলায় যেতে হবে না। পাকিস্তানের আর্মিরা মাধব স্যারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন তার লাশ পাওয়া যায় স্কুল ঘরের সামনের ডোবায়।
মাধব স্যারের মৃত্যুর সংবাদ রাঙাকে বিচলিত করে এবং রাঙাকে তারো অধিক বিচলিত করে তার বাবার হঠাৎ পাল্টে যাওয়ার বিষয়টি। পাল্টে গেছেন রাঙার বাবা মেহরাজুল ইসলাম। তিনি রবীন্দ্র সংগীত ভালোবাসতেন। তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসতেন। মেয়ের হারমোনিয়ামে সুযোগ পেলেই হাত বুলাতেন। সুর তুলতেন। গুনগুন করে গাইতেন “আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন আকাশে আকাশে...।” ছেলেমেয়ের ডাকনাম রাঙা আর রঙিলা শুনে অনেকেই হাসতেন। মেহরাজুল ইসলাম এই বিদ্রুপের হাসিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে জানতেন।
অথচ এখন রাঙা আর রঙিলার নাম তিনি নিজেই পাল্টে দেন। রাঙাকে ডাকেন মুমিনুল ইসলাম বলে, রঙিলা হয়ে যায় খাদিজা বেগম।
রঙিলাকে নিয়ে মাস কয়েক আগেও বাড়তি কোনো চিন্তা ছিলো না মেহরাজুল ইসলামের। কিন্তু যখন একাত্তর আসে, যখন রঙিলা হয়ে যায় খাদিজা বেগম তখন মেহরাজুল ইসলামের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় রঙিলাই। তার বয়স আঠারো। রূপবতী মেয়ে। নারীর রূপ তখন গোটা রাষ্ট্রের সকল পিতা-মাতার সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠার বিষয়। রাঙা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে তার বাবা রঙিলার গান গাওয়ার শখটিকে এখন ভালো চোখে দেখছেন না।
একদিনের ঘটনা। রাতে ঘুমিয়ে ছিলো রঙিলা। বিছানার পাশে তার হারমোনিয়াম রাখা। মেহরাজুল ইসলাম মেয়ের বিছানার কাছে আসেন। রঙিলার একটা হাত হারমোনিয়ামের উপর রাখা। আলতো করে হাতটা সরিয়ে নেন তিনি। হারমোনিয়ামের উপর নিজস্ব দখল প্রতিষ্ঠা করেন। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরেন সেটিকে। ঠাণ্ডা পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরের বাইরে যান। সতর্কতা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকান। বাড়ির পাশে ছোট পুকুর। হারমোনিয়াম হাতে নিয়ে পুকুরের পাড়ে কিছু সময় নীরব দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। এক সময় ভারমুক্ত হন। নীরব-ঘুমন্ত পানিতে হঠাৎ ঝুপ করে বেশ বড় ধরনের একটা শব্দ হয়। আবার ধীর পায়ে ঘরে ফিরে আসেন মেহরাজুল ইসলাম। চমকে উঠেন। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রাঙা এবং রঙিলা। রঙিলা বুঝে এবং জেনে গেছে তার ক্ষতির সংবাদ। রঙিলা কাঁদে। রঙিলার চোখে একই সাথে জল আর বিস্ময়। বাবা এমন কাণ্ড করতে পারেন এটি তার ধারণার অতীত।
ধারণার অতীত আরো কিছু কাণ্ড করেন মেহরাজুল ইসলাম। একাত্তর সাল আশ্চর্য সময় বলেই স্বভাববিরুদ্ধ অনেক কিছুই ঘটে সেই সময়ে। তখন যুদ্ধ চলছে। একদল মানুষ যুদ্ধে চলে গেছে। তাদের ফেরা আর না ফেরার বিষয়টি চরম অনিশ্চিত। আর যারা যুদ্ধে যায়নি, তারাও বাস করে অনিশ্চয়তার জগতে। অনিশ্চয়তা তীব্র ছিলো বলেই মানুষ ছোটখাটো নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়। মেহরাজুল ইসলামও এরকম ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তার ব্যাকুলতার বিষয় মেয়ের বিয়ে। যেনো রঙিলার বিয়ে হয়ে গেলেই একাত্তর উপাখ্যানের ইতি ঘটবে। যেনো তার বিয়ে হচ্ছে না বলেই যুদ্ধ থামছে না। রঙিলার বয়স আঠারো। বয়স অনুপাতে বুদ্ধির বৃদ্ধি ঘটেনি। খানিকটা বোকা সে। বোকা বলেই অভিমান তার খুব বেশি। সেই যে বাবা হারমোনিয়াম পানিতে ফেলে দিলেন তারপর থেকে বাবার সঙ্গে কথাই বলে না সে। বাবা যখন তাকে জানান, আসছে শুক্রবারে তার বিয়ে হচ্ছে, তখন সে সিদ্ধান্তটির প্রতিবাদ করে না। কারণ প্রতিবাদ করতে হলে বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আর কথা বললেই আড়ি ভেঙে যাবে। আড়ি ধরে রাখায় অধিক মনোযোগী রঙিলা তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের খবরেও অমনোযোগী থাকে।
রঙিলার বিয়ে হচ্ছে আবদুল খালিকের সাথে। আবদুল খালিকের বাবা আবদুল গফুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। যুদ্ধের সময়কালে তিনি এলাকার সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তি। পাকিস্তানি আর্মির কর্নেল, মেজররা তার বাসায় নিত্য যাওয়া আসা করে। এমন ক্ষমতাধর ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে রঙিলার বিয়ে সৌভাগ্য হিসেবেই মানেন মেহরাজুল ইসলাম। রঙিলার সঙ্গে তার হবু স্বামী আবদুল খালিকের বয়েসের অনেক তফাত। তফাত আছে আরো অনেক কিছুতেই। কিন্তু একাত্তরে  এতো সব দেখতে নেই। একাত্তরের স্বস্তি হচ্ছে শান্তি কমিটির সদস্য কারো সঙ্গে আত্মীয়তায় বাঁধা পড়া।
দেখতে দেখতে রঙিলার বিয়ে হয়ে যায়। যথেষ্ট জাঁকজমকেই বিয়ে হয়। আর্মির লোকেরাও দাওয়াত খেতে আসে। তাদের সেবা করতে পেরে বিগলিত মেহরাজুল ইসলাম খেয়ালই করেন না, এমনকি বিয়ের দিনেও অভিমানী রঙিলা তার সঙ্গে কথা বলেনি। হারমোনিয়ামের দুঃখ মেয়ে কিছুতেই ভুলে না।
বিয়ের অনুষ্ঠানেই মেহরাজুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয় মেজর ইকবাল কাদিরের। মেজরের বিনয়ী কথাবার্তায় মুগ্ধ হন মেহরাজুল ইসলাম। মেজর বলেন, শেখ মুজিব একজন আবেগসর্বস্ব মানুষ। তাকে এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের সেই আবেগেরই মূল্য দিতে হচ্ছে। মেজর তাকে আরো জানান, যদি কোনোভাবে দুই পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে ভারত এসে নাক গলায়, তাহলে আমেরিকা আর চীন বসে থাকবে না। তারা পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। আসন্ন যুদ্ধজয়ের কল্পনায় মেজর ইকবাল কাদিরকে বেশ সুখী মনে হয়।
মেজরের কথায় তাল দেন মেহরাজুল ইসলাম। দুজনের আলাপ বেশ জমে উঠে। রাঙাকে মেজরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন মেহরাজুল ইসলাম। মেজর রাঙাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। বলেন, এই বয়েসের ছেলে ছোকরাই তো মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে, তাই না?
কথা কেড়ে নেন মেহরাজুল ইসলাম। বলেন, আমার ছেলে মুমিনুল ইসলাম পাকিস্তানের একনিষ্ঠ ভক্ত, আল্লামা ইকবাল তার প্রিয় কবি।
মেজর তখন রাঙাকে আল্লামা ইকবালের কবিতা আবৃত্তি করতে বলেন। রাঙা নীরব থাকে। মেজর তাকে কাছে ডেকে নেন। কাঁধে হাত রাখেন। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেন, পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করতে হবে, রাজী আছো?
রাঙা কিছু বলে না। তার বাবা মেহরাজুল ইসলাম বলেন, ছোট ছেলে, দেশের জন্য কাজ করার বয়েস হয়নি এখনও।
মেজর ইকবাল কাদির লাল চোখে তাকান। বলেন, দেশ ভাঙার জন্য এই বয়েসে যুদ্ধে যাওয়া যায়, আর দেশ গড়ার জন্য যাওয়া যায় না? তারপর দৃঢ়স্বরে মেজর নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, আমি চাই আপনার ছেলে দেশের জন্য কাজ করুক।
কিছু বলেন না মেহরাজুল ইসলাম। বাতাস উড়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে যান তিনি।
দুদিন পরেই মেজর ইকবাল কাদিরের দূত আসে রাঙাদের বাসায়। রাঙাকে ক্যাম্পে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মেজর। আজ বিকেলেই যেতে হবে। মেহরাজুল ইসলাম ভয়ে কাঁপেন। দৌড়ে যান নতুন বেয়াইয়ের বাড়িতে। বেয়াই আবদুল গফুর সান্ত্বনা দেন, ভয়ের কিছু নাই। বড় জোর আপনার ছেলেকে হয়তো রাজাকারে নাম লেখাতে হতে পারে। তাকে বলে দিবেন, যেনো সে কোনো কিছুতে আপত্তি না করে। বুঝেনই তো পাকিস্তানিরা আবার আপত্তি পছন্দ করে না।
ঘরে ফিরে আসেন মেহরাজুল ইসলাম। বিকেল নামছে। এখনই রাঙাকে ক্যাম্পে যেতে হবে। আয়াতুল কুরসি পড়ে ছেলের বুকে ফুঁ দেন তিনি। বলেন, বাবারে কোনো কিছুতে আপত্তি করিস না, যদি বলে রাজাকার হতে, হয়ে যাবি রাজাকার। যা বলে তাই মেনে আসিস।
রাঙা বলে, আমার ভয় করে বাবা, খুব ভয় করে। মেহরাজুল ইসলাম ছেলের সঙ্গে যাবেন বলে মনস্থির করেন। ছেলেকে একা তিনি ছেড়ে দেবেন না।
শেষ বিকেলে পথে নামেন দুজন। রাঙা আর তার বাবা। সূর্য ডুবছে। রাঙা ভয়ে কাঁপছে। মেহরাজুল ইসলাম শক্ত করে ছেলের হাত ধরে রাখেন।
ক্য্যাম্পে মেহরাজুল ইসলামকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। রাঙা ক্যাম্পে প্রবেশ করে। পেছন ফিরে চায়। বাবা হাত নাড়েন। রাঙার কান্না পায়।
একজন সিপাহী রাঙাকে নিয়ে মেজরের রূমে আসে। ভয়ে কাঁপে রাঙা। মাধব স্যারের কথা তার মনে পড়ে। রাঙা ভাবে আর কি কোনোদিন বাবাকে দেখা হবে, আর কি কোনোদিন রঙিলা বুবুকে দেখা হবে?
মেজর রাঙার কাছে আসেন। তার চোখ অন্যরকম। মেজর রাঙার শরীরে হাত দেন। রাঙার শার্ট খুলেন, রাঙার প্যান্ট খুলেন। রাঙা আপত্তি করে না। বাবা বলে দিয়েছেন যাই ঘটুক কোনো কিছুতে আপত্তি করিস না। রাঙা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। রাঙার শরীরের উপর মেজরের শক্ত শরীরের ভার। সতেরো বছর বয়েসি রাঙার উপর যেনো ভর করেছে কঠিন পৃথিবী। তীব্র ব্যথায় জ্ঞান হারায় সে।
একসময় জ্ঞান ফিরে রাঙার, মাঝে কত সময় গেলো কিছুই জানে না সে। শরীরের ঠিক মধ্যস্থানে তার অসহ্য যন্ত্রণা, প্রচণ্ড ব্যথা।
মেজর তাকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। তবে শর্ত হচ্ছে যখনই ডাকবেন, হাজির হতে হবে।
তীব্র ব্যথা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে রাঙা। বাইরে রাত নেমেছে। বাবা তখনও অপেক্ষারত। ছেলেকে ফিরে পেয়ে দৌড়ে কাছে আসেন। প্রবল ভাবে বুকে টেনে নেন। কাঁদেন তিনি। রাঙা কাঁদে না। রাঙা বাবার কাঁধে হাত রেখে হাঁটে। রাঙাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে মেহরাজুল ইসলাম জানতে চান, তোকে ওরা মারেনি তো?
লজ্জায় নীরব থাকে রাঙা। মেহরাজুল ইসলাম ছেলের শরীর ধরে ঝাকুনি দেন, কী হয়েছে বল আমাকে, ও বাবা বল আমাকে?
হাঁটতে কষ্ট হয় রাঙার। উহ্, উচ্চারণে সে তার কষ্ট প্রকাশ করে। মেহরাজুল ইসলাম ব্যাকুল হন, ও সোনা যাদু, কী হয়েছে রে তোর?
বাবার কণ্ঠের মমতা আর ব্যাকুলতায় নিজেকে ধরে রাখতে পারে না রাঙা। প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বাবার কাছে কীভাবে বলে সে অপমানের কথা কিংবা কীভাবেই সেটা গোপন করে রাখে? কাঁদতে কাঁদতে রাঙা বলে, যে ভয়ে তুমি রঙিলা বুবুর বিয়ে দাও, মেজর আমাকে সেটাই করেন, মেজর আমাকে...
কান্নার তোড়ে বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারে না রাঙা। তবু যা  বোঝার বুঝে নেন মেহরাজুল ইসলাম। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। লজ্জায় তিনি ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারেন না, মাথা নিচে নামিয়ে নেন। বলেন, ওগো আল্লাহ তোমার আরশ কি কেঁপে উঠে না?
গল্প শেষ হয়। আড্ডাবাজেরা চলে যায়। পরদিন সকাল দশটায় তিনি অফিস পৌঁছেন। বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যায়। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে চাপিয়ে স্বস্তি লাভ করেন। নিয়ম মতো টিভি দেখেন ঘণ্টা তিনেক। রাত দশটার ইংরেজি সংবাদ তাকে ঘুমের নিমন্ত্রণ জানায়। তিনি ঘুমোতে যান।

>> পথিক ১৮

গল্প >> পরিপ্রেক্ষিত : সুকুমার রুজ

পরিপ্রেক্ষিত

সুকুমার রুজ

খেলাটা বেশ জমে উঠেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে সুন্দরী রমণীর কমনীয় হাত প্রসারিত হচ্ছে শুধু। এক-আধখানা নয়, গোটা ছয়েক হাত। হস্তধারিনীরা পর্দার আড়ালে। অন্তরাল থেকে প্রমীলা বাহিনীর কলস্বরে ঝঙ্কার - খুঁজে নিন তো মেজ্ জামাইবাবু, নিজের বৌয়ের হাতখানা। ভুল হাত ধরলেই এক শ’ টাকা জরিমানা।
- এ কী! সব হাতই যে এক রকম। চেনার জো নেই। সব আঙুলেই একই রংয়ের নেল-পলিশ! চুড়ি, আংটিগুলো খুলে রেখেছে পাঁজির দল। এতো বেশ ফাঁপড়ে পড়া গেলো। মেজ জামাইবাবুকে সত্যিই হতাশ মনে হয়। কিন্তু হাত না ধরেও নিস্তার নেই। ভেতর থেকে হুমকি - অর্থদণ্ডের ভয়ে হাত না ধরে চম্পট দিলে, এ হাতের সেবা থেকে এক সপ্তাহ বঞ্চিত হতে হবে।
কি আর করা, একখানা হাত ধরতেই হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি ঝরণার কলকলানি, নাকি শালিক পাখির ক্যাঁচক্যাচানি - ছি-ছি-ছি, জামাইবাবু! শেষে কিনা আমার ননদের হাতটাই পছন্দ হলো? অ্যাঁ মনে মনে এতো! হাত ছাড়ুন, আর এক শ’ টাকা ছাড়ুন. পরস্ত্রীর হাত ধরার জরিমানা।
শুধু কি জরিমানা, সঙ্গে ভর্ৎসনা - ছ্যা ছ্যা জামাইবাবু, অগ্নিস্বাক্ষী করে, যদিদং তদিদং... মন্তর-টন্তর পড়ে যে হাত হাতে নিয়েছেন; দশ বছর ধরে যে হাতের সেবা নিচ্ছেন; এখনো সেই হাতটাই চিনে উঠতে পারলেন না! গোটা দিদিকে চিনতে তো এ জনমটা কাবার হয়ে যাবে গো জামাইবাবু!
শুধু মেজ জামাইবাবু নয়, বড়, সেজ, ছোট, সব বাবুরই এক দশা। ‘বাঁশ বনে ডোম কানা’ বলে না; এ হচ্ছে সেই দশা। কেউ কেউ জিদে পড়ে চার পাঁচশ অবধি গচ্চা দিয়েছে। সব জামাইবাবু ভাবছে, গোটা বৌটাকে বহুজনের ভিড়ের মাঝেও চিনতে ভুল হয় না; অথচ এতো কাছ থেকে শুধুমাত্র হাতটা চিনে নেওয়া যাচ্ছে না! কিন্তু ফাজিল মেয়েগুলোর কাছে হেরে গেলে তো চলবে না! তাই, ছোট জামাইবাবু প্রতিনিধিসূচক গলা চড়িয়ে বলে - আমরা তো সব সময় তোমাদের সুন্দর মুখের দিকে তাকাই গো সুন্দরী! তোমাদের হাত দেখার আর সময় কোথায়!
এক মুহূর্ত স্তব্ধতা। তারপর ছোট শ্যালিকার উচ্চকণ্ঠ - ঠিক আছে। মুখ দেখেন সব সময়, তখন নিশ্চয় মুখের মাঝে উচ্চতম স্থান নাকটা সবার আগে চোখে পড়ে। পর্দার ফাঁক দিয়ে এবার শুধুমাত্র নাকটা বেরোবে। না চিনতে পারলে দু’ শ’ প্লাস। চিনলে ফেরত এক শ’।
বড় জামাইবাবু মুখ খোলে - ঠিক আছে রাজি।
সবাই রাজি। ভাবে যদি অন্তত এক শ’ টাকা উশুল হয়। মিনিট দুয়েক পরে নাক প্রদর্শন। দুটো পর্দার মাঝখানের ফাঁকে এক সারি নাক। এবার কিন্তু কথা বন্ধ। কথা বললে নাক খুঁজে পেয়ে যাবে যে! গলার স্বরটা তো ভুল হবে না।
নাঃ! নাক নিয়েও নাকাল হতে হলো। নথ-খোলা, নাকের টাব্, নাকছাবি-খোলা - সব নাকই যেনো এক রকম! বড় জামাইবাবু ভেবেছিলো, তার গিন্নির নাকটা তো একটু বসা। ঠিক চিনে নেবে। ও বাবা! ছয় নাকের মাঝে কোথায় খাঁদা নাক! সবই যেনো এক। শুধু নাকটাই যে বেরিয়ে আছে। নাকের পাশে গাল, ঠোঁট এসব দেখতে পেলে খাঁদা-বোঁচা বুঝা যেতো!
জামাইবাবুদের মানিব্যাগগুলো ক্রমশ হালকা হচ্ছে। ওরা মজাটা আর উপভোগ করতে পারছে না। বড় জামাইবাবু তো গজরাতে শুরু করেছে - কার মাথা থেকে বেরোলো? নিশ্চয় ওই মিটমিটে শয়তান ছোট শালিটার বুদ্ধি।
ছোট জামাই বলে যাই বলুন দাদা! ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু ভাবার আছে। আমরা সবাই সবাইকে চিনি। আবার কেই কাউকে চিনি না।
- সে আবার কী?
- হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এক জনের সামগ্রিকভাবে চোখ মুখের গড়ন, তার সাজ পোশাক, আচার আচরণ থেকেই আমরা চিনতে পারি। আংশিক কিছু দেখে চেনা যায় না তার প্রমাণ তো মানিব্যাগেই। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে। ‘পারস্পেক্টিভ’ অর্থাৎ পরিপ্রেক্ষিত থেকেই অন্যের থেকে একজনকে আলাদাভাবে চেনা যায়।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ ওঠে - কী গো তুমি বিয়ে বাড়িতে এসে দর্শনের ক্লাস নেওয়া শুরু করলে নাকি? আমি ঠেলায় পড়ে মাঝে সাঝে তোমার ছাত্রী হই, বেচারা জামাইবাবুরা তোমার ছাত্র হতে যাবে কোন দুঃখে।
মেজ জামাই বলে - এই যে মিসেস তুবড়ি, তুমি একটু থামো। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং! বলো তো ভায়া কী বলছিলে!
ছোট জামাই উৎসাহের সঙ্গে বলতে থাকে - এই যে বড়দার কথা-ই ধরা যাক। আমরা তাকে দেখতে অভ্যস্ত ধুতি-পাঞ্জাবিতে, আর মুখে সব সময় পান। এখন এই ভিড়ভাট্টা বিয়ে বাড়ির মধ্যে বড়দা যদি কাউকে কিছু না বলে, কোট-প্যান্ট-টাই টুপি মাথায়, মুখে চুরুট ধরিয়ে হেঁটে যায়, আমরা কি চট করে বড়দাকে চিনতে পারবো?
বাঃ, বা-বা-বা বাঃ! বেড়ে বলেছো তো - খুশির আতিশয্যে গাবদা গোবদা বড় জামাইয়ের মুখ থেকে পানের পিক গড়ায়।
ইতিমধ্যে ঘরের প্রমিলা বাহিনীও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছোট জামাইয়ের মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে গেছে। শুধু ছোট শ্যালিকা তুবড়ি কর্তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তার এই মজার খেলা উদ্ভাবনের গূঢ় রহস্যটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
সব শুনে বড়দি বলে ওঠে - ও যতই কোট-প্যান্ট টুপি পড়ুক আমি ঠিক ধরে ফেলবোই। পনেরো বছর ওকে হাড়ে হাড়ে চিনেছি। আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
মেজ জামাই ফুট কাটে - দিদি! জামাইবাবুর হাড় ছাড়া আর কোন জিনিসটা আপনার বেশি চেনা?
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। এমন সময় বাড়ির চাকর মানিক এসে হাউমাউ করে করে বলে, বড়দিমণি, জামাইবাবু, আপনারা এখানে বসে হাসি-তামাশা কচ্চো; ওদিকে রিমিকে কখন থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কর্তা মা কান্নাকাটি শুরু করেচে। শিগগির এসো।
বড়দি মোটা শরীর নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। গলা ছেড়ে কান্না শুরু করে - ওগো আমার মেয়ে কোথায় গেলো গো - এই তো একটু আগে নীল জামা পরে ঘুরঘুর করছিলো আর কাটি লজেন চুষছিলো গো -।
পুরো বিয়ে বাড়ি তোলপাড়। সব বাচ্চা আছে, বড় মেয়ে ঝিমি আছে, শুধু ছোট মেয়ে রিমি নেই। সমস্ত ঘর, ছাদ, কুয়ো, কুয়োতলা, খড়ের পালার নিচে, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির বাইরে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। আশপাশের বাড়িতে, রাস্তায় যাকে দেখা যাচ্ছে তাকেই শুধোনো হচ্ছে - ওগো নীল জামা পরা ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছো?
বাড়ির পাশে পুকুরে একটা নীল রংয়ের কিছু ভেসে থাকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দুজনের জলে ঝাঁপ। নাঃ, জামা নয়! নীল লুঙ্গি, ছেঁড়া।
কেউ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে - গায়ে হলুদের গাড়ি গেলো তো এখুনি। দেখো ওই গাড়িতে উঠে পড়েছে কি না। ছোট বোন তুবড়ি বলে - তা হতে পারে দিদি। বাপন তো গায়ে হলুদ নিয়ে গাড়িতে গেলো। দাদার সঙ্গে সেও হয়তো পিছু ধরেছে। একটু পরেই ফিরে আসবে। তুই কাঁদিস না। ওদের বাড়িতে টেলিফোন আছে কি?
এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে হৈ হৈ শোনা যায় - পাওয়া গেছে - রিমিকে পাওয়া গেছে।
খামার বাড়িতে, যেখানে ভিয়েন হচ্ছে, ওখান থেকে রিমিকে আবিষ্কার করে মানিক। একটা ঢোলা প্যান্ট আর একটা ছেলেদের হাফ শার্ট গায়ে বসে। শালপাতায় ছানা নিয়ে খাচ্ছে।
বড় জামাই তো ভিয়েনের কারিগরকে এই মারে সেই মারে - বাচ্চাটা এখানে আছে তোমরা বলছো না!
- কী করে জানবো বাবু ওকে খুঁজছেন? আপনারা তো নীল জামা পরা মেয়েকে খুঁজছিলেন। বাচ্চা ছেলেটা এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই হাতে একটু ছানা দিলাম। আমার কী দোষ!
বড়দি ওকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে একটু কেঁদে নেয়। তারপর শুধোয় তোকে দাদার প্যান্ট জামা কে পরিয়ে দিলো?
ছোট জামাই বড় জামাইয়ের কাঁধে হাত দেয় - নিন, দাদা আর টেনশন নেবেন না।  সিগারেট ধরান একটা।

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

>> পথিক ১৮

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১০

গল্প >> ঘূর্ণি : অমল কর

ঘূর্ণি

অমল কর

ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ শব্দে চলছে গরুর গাড়ি। মেঠো পথ। গাড়িটাও বুড়ো। শব্দ তো নয়, যেন ককানি। কৃশকায় হাড় জিরজিরে বলদ দুটোরও হাঁফ ধরে গেছে। অনেকক্ষণ দানা পানি পড়েনি। চোখ করুণ, গাল বেয়ে অবিশ্রান্ত লালা চুঁইয়ে পড়ছে।
ধূমল ধুলোর মেঘের ভেতর সম্রাট বরাট স্ত্রী শতাব্দীকে নিয়ে নামলো গাড়ি থেকে। বোঝা হাল্কা হওয়ায় খানিক স্বস্তি জোড়া বলদের।
পাহাড়ে ঘেরা সবুজ আস্তরণে ঢাকা ছোট্ট শহর। ক্লান্তিকর একঘেয়ে গাড়ি চড়ে বিরক্তি নিয়ে শহরের আদালতকক্ষে ঢুকে আদব কায়দা ভুলে বিচারকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডাকাবুকো মেয়ের মতো শতাব্দী ঝলসে উঠলো, ‘হুজুর,  আমরা ডিভোর্স চাই।’ ঝাউবনের ভেতর থেকে যেন একাট সোঁ সোঁ আর্ত বাতাস বয়ে  এলো।
শতাব্দীর কথা শুনে সম্রাট বরাটের বুকের ভেতর কেমন যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠলো। কি এক অব্যক্ত ব্যথায় গুমরে উঠছে সমস্ত মন, শরীর। সে-ব্যথা গোপন রেখে সম্রাটও ততোধিক দৃঢ়তায় বললো, ‘হ্যাঁ, বিবাহ বিচ্ছেদ। আজই। এক্ষুণি।’ বিচারকের পেছনের দেওয়ালে একটা আরশোলাকে একটা টিকটিকি গিলে ফেললো। দেখলো করুণভাবে শতাব্দী। মুখটা পাণ্ডুর হয়ে গেলো। সম্রাটের কথায়, নাকি টিকটিকি-আরশোলার কাণ্ডে - বুঝতে পারা গেলো না।
সম্রাট আরও বললো, ‘হুজুর, এভাবে আমরা আর থাকতে পারি না। এ-এক দুর্বিষহ ব্যাপার। নিঃসঙ্গ পাহাড়ি জায়গাতেও ওকে আমি সইতে পারছি না। ওঃ, হরিবল। বন-বেড়ালের মতো সারাক্ষণ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ আর হুঁতোম প্যাঁচার মতো গোমড়া মুখ, অসহ্য।’
শতাব্দীর পাল্টা অভিযোগ। যেন ঠোঁটের ডগায় তৈরি উত্তর। ‘অবশ্যি লোকটা যদি অপদার্থই হয়। মদো মাতালের সাথে দোস্তি করে মদ গিলে চুর হয়ে থাকে, বিছানায় বমি ওগড়ায়, কুম্ভকর্ণের মতো বেসুরো নাক ডাকে আর বাজে মার্কা হাড়হাভাতে কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়...’
‘আর মহিলাটি যদি দিবানিদ্রা দেয়, গল্পের বই পড়ে রান্না পোড়ায়, আচার খায়, পোষা কুকুরের গায়ে গরম জল ঢেলে দেয় আর রান্নাঘরে ঢুকে এটা নেই-ওটা নেই-সেটা নেই বলে চৌপরদিন অভিযোগের পাহাড় গড়ে তোলে, তাহলে...’
‘আর লোকটা যদি এখানে ওখানে সেখানে এর ওর তার সাথে অকারণে শ্লীল-অশ্লীল কথা বলে বদনাম কুড়োয়, তখন তার সাথে এক দণ্ডও থাকা...’
‘অর্ডার! অর্ডার!’ জাস্টিস অব পীস্ ইন্দ্রনীল ডাইসন আইনের বই ঘেঁটে অনেক কসরতের পর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘যদিও এ-আদালতকে আইনগতভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনও নির্দেশ দেওয়া নেই, তথাপি ন্যায়নীতি সংবিধান এবং গোল্ডেন রুলের ... ধারা অনুসারে জাস্টিস অব পীস্ পুরুষ এবং নারীর বিয়ের গাঁটছড়া যেমন বেঁধে দিতে পারেন, তেমনি ... উপধারানুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদও করাবার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। এবং’ চশমাটা উপরে তুলে পিট পিট চোখে বিপর্যস্ত নারী পুরুষকে দেখে নিয়ে বললেন ‘সুপ্রীম কোর্টেও তা আইনত গ্রাহ্য। এ-ব্যাপারে আদালতের দক্ষিণা স্ট্যাম্প খরচ, মুহুরীর পারিশ্রমিক এবং টাইপ খরচসহ দিতে হবে একুনে ... টাকা।’
সম্রাট অসহায়ের মতো টাকা গুনে দেয়। শারীরিক কসরত এবং মানসিক পরিশ্রম করে হুকুমনামা লিখলেন মি. ডাইসন -
‘এতদ্বারা দেশের আইন মোতাবেক সকলকে অবহিত করা হচ্ছে যে, সম্রাট বরাট এবং শতাব্দী বরাট সশরীরে আদালতে উপস্থিত হয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে বিনা প্ররোচনায় এই অঙ্গীকার করছেন যে, একের পছন্দ অপরের অপছন্দ হওয়ায় তারা এক ঘরে থাকবেন না, এক বিছানায় শোবেন না, একে অপরকে মেনে চলবেন না, একে অপরের দায় বহন করবেন না, একে অপরকে ভালোবাসবেন না, স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকবেন না এবং এ রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা, শান্তি ও মর্যাদা রক্ষা করে বিবাহ-বিচ্ছেদের এ-হুকুমনামা মেনে চলবেন।’ স্বাক্ষর - ইন্দ্রনীল ডাইসন। জাস্টিস অব পীস্। ... রাজ্য।
সই করলো আদালত রেজিস্ট্রারে সম্রাট। দূরে কোথায় কড়্ কড়্ কড়াৎ বজ্রপাত হলো। দু’ জোড়া চোখে দৃষ্টি বিনিময়ের পর জাস্টিস কড়া চোখে তাকিয়ে শতাব্দীর দিকে রেজিস্ট্রারে সইয়ের ইশারা করলেন। শতাব্দী সই করলো। আদালতের পাশের চওড়া রাস্তা ত্বরিতে দমকলের গাড়ি ছুটে গেলো ঘণ্টা বাজিয়ে। জাকির হোসেনের তবলার বোল সম্রাটের বুকে। সুধা চন্দ্রনের নাচের দাপাদাপি শতাব্দীর হৃদপিণ্ডে।
সব শেষ হয়ে গেলো। দশ বছরের একসাথে থাকা-শোওয়া-বসা-আদর-সোহাগ-অনুযোগ-তম্বি এক লহমায় শেষ। বিবাহ জীবনের ইতি। কত উচ্ছ্বাস, কত আনন্দ, কত বিতর্ক। কিন্তু আজ! ঝাড়া হাত-পা। নেই কোন দায়, নেই দায়িত্ব, নেই রুটিনমাফিক চলাফেরা, নেই নিয়মের বালাই। একটা সই দু’জনের মাঝে দুস্তর ব্যবধান গড়ে দিলো। বেহিসেবি একটা সিদ্ধান্তে সব হিসেব ওলোট-পালোট। হঠাৎ যৌবন দুপুরটা যেন ঝুপ করে বুড়িয়ে সাঁঝ হয়ে গেলো।
বিষণ্নভাবে শতাব্দী বসে। এখন তো কোন সম্পর্ক নেই। তবুও সম্রাট নিতান্ত ভদ্রতাবশত জানতে চাইলো, ‘তুমি কি তোমার মা’র কাছে যাবে?’ কোন পরিচিতাকে মামুলি প্রশ্নের মতো শোনালো সম্রাটের  কথা।
কোন অচেনা পুরুষ অনধিকার চর্চা করছে মনে হলো শতাব্দীর। মুখে শান্ত ভাব বজায় রেখে সসঙ্কোচে শতাব্দী বললো, যেন কান্নার শব্দ ‘হ্যাঁ। কিন্তু পথ তো অনেক। ভাড়া তো লাগবে! তোমার কাছে টাকা হবে?’
সম্রাট টাকা এগিয়ে দিলো। হাতটা কি একটু কেঁপে উঠলো সম্রাটের! শতাব্দী হয়তো ভুল দেখেছে। বললো, ‘মা হয়তো অনাদর করবেন না। কিংবা কষ্ট পাবেন। কিন্তু উপায় কি, আমার তো আর কোথাও যাবার নেই!’
‘অতোটা পথ যাবে, খিদে পাবে না? খাবে কিছু?’ সম্রাটের গলা ভেজা।
অনেক খেয়েছি তোমার পয়সায়। কিন্তু আর নয়। থাক ওসব। শোনো, এখন আর বেশি মদ খেয়ো না। তাছাড়া আমি যখন নেই, মদ বেশি খাবার দরকার কি? তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। ঘড়িতে সময়মতো চাবি দিও। তোমার জন্যে রুটি-তড়কা রাখা আছে, খেয়ে নিও। ভালো থেকো।’ অভিভাবিকার মতো শতাব্দী বললো, যেন কিছুদিনের জন্য বিদেশ বিভুঁই পাড়ি দিচ্ছে।
‘এখন এসব কথার কোনো মানে আছে? ক্ষেপে গিয়ে ডিভোর্স চাইলে। এসব শুনতে ভালো লাগছে না।’ অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে সম্রাট বললো। শেষের দিকে সম্রাটের গলাটা কেমন যেন করুণ শোনালো। নাকি শতাব্দী ভুল শুনলো?
আমি না হয় রাগের মাথায় ডিভোর্স চেয়েছি। কই, তুমি তো নিষেধ করোনি একবারও। খালি আমার দোষ খুঁজলে। তুমি চাওনি ডিভোর্স?’ শতাব্দীর চোখে জল।
‘তুমি তো থাকতে চাওনি।’ অনুযোগ করে সম্রাট। ‘এখন কে রান্না করে দেবে, কেই বা বমি পরিষ্কার করবে, কেই বা বুড়ো ঘড়িটায় দম দেবে, কেই বা...’
‘থামো। যে থাকে না তার স্মৃতিও থাকে না। কেটে যাবে দিন। সয়ে যাবে সব। সময় সব ত ধুয়ে দেয়। ঝরা পাতার জন্য গাছের শোক করলে চলে নাকি!’ শতাব্দী উদাস, যেন দার্শনিক।
টাইটানিক ডুবছে। সম্রাট তবু বলে, ‘তুমি তো নেই। কুকুরগুলো এখন আর কাউকে বিরক্ত করবে না।’ খানিক নিস্তব্ধতা।
‘মা’র ওখানে গলগ্রহ হয়ে দিবানিদ্রা তো দূর অস্ত। খেতে পেলেই বর্তে যাবো। আবার আচার? পাগল না পান্তাবুড়ি?’ শতাব্দী আপন মনে বিড়বিড় করে।’
‘সংসারের সব ঝক্কিই তো পোয়াতে হবে আমাকে। কাজেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেই হবে। মদ খেলে আর চলবে না। আর তখনই ষণ্ডামার্কা গুণ্ডাগুলোকে এড়িয়ে চলা যাবে।’ সম্রাট যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে। বোঝাপড়া করছে নিজের সাথে।
‘অভিযোগ তুলবার কোনো অধিকার মা’র ওখানে নেই। মুখ গোমড়াও করতে হবে না। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচই বা করবো কার সাথে, কোন স্পর্ধায়?’ শতাব্দী ভেঙে পড়ছে। চোখের নদীতে কুলু কুলু, থই থই। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে প্রসঙ্গ বদলায় শতাব্দী। - ‘আচ্ছা চলি। বেলা হয়। যেতে হবে বহু দূর।’ বাইরে মেঘ, ভেতরেও।
সম্রাট শতাব্দীর ভেঙে পড়া নজর করে। তার বুকে ঝোড়ো হাওয়া, দামাল মাতাল করছে। শক্ত হলো সম্রাট। শেষ শর ছুঁড়ে দিলো সম্রাট, ‘আমায় একা ফেলে নাইবা গেলে শতু।’ বলেই সম্রাট চমকে উঠলো। আরক্ত হলো। কিন্তু হাতের তাস মেঝেতে। দূরে দেখলো ডানাভাঙা বাবুই পাখি                      তালগাছে হাওয়ার সাথে লড়ে বাসা বুনছে। সম্বিৎ ফিরে এলেই শতাব্দীর দিকে হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে দিলো সম্রাট।
তীব্র স্রোতের মুখে ভেসে যাওয়া খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো সম্রাটের হাত শক্ত করে ধরলো শতাব্দী। সমর্পণের। দূরে শোনা গেলো শঙ্খধ্বনি। কোনো উৎসবের?
বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে জাস্টিস অব পীস্ ইন্দ্রনীল ডাইসন ধমকে উঠলেন, ‘আপনারা আদালত অবমাননা করছেন। এখন আপনারা স্বামী-স্ত্রী নন।’ সম্রাট শতাব্দী চুপসে গেলো বেলুনের মতো। কেঁদে ফেললো শতাব্দী। সম্রাট নির্বাক।
মি. ডাইসন কি ভেবে আবার বললেন, ‘অবশ্যি এ-রাজ্যের আইন অনুযায়ী আপনাদের পুনর্বার বিয়ে দেবার এক্তিয়ার আদালতের রয়েছে। খরচ ... টাকা।’
বত্রিশের শতাব্দী তেইশের যুবতীর মতো আনন্দে ঝর্ণা হাসি হেসে গাড়ি ভাড়া বাবদ সম্রাটের দেওয়া টাকার নোট লম্বা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলো। আদালতের রেজিস্ট্রারে পরষ্পর সই করলো। সাক্ষী থাকলো আদালত।
নতুন বর-কনে বনের পাশ দিয়ে গরুর গাড়িতে আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ঘর বাঁধতে এগিয়ে চললো।
ছোপ ছোপ দাগ লাল মোরগটা বোকার মতো ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দ করে করতে করতে ঐ পথের দিকে তাকিয়ে হেলে দুলে সদর রাস্তাটা পার হয়ে গেলো।
(ও হেনরি’র গল্পের ছায়া অবলম্বনে)                                                  

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

>> পথিক ১৮

আলাপচারিতা >> ‘পাখিরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না’ : আসাদ চৌধুরী

‘পাখিরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না’

আসাদ চৌধুরী

· কবি নয়, আসাদ চৌধুরী মানুষটা কেমন?
·· আমি গণভবন, বঙ্গভবন চিনি না। স্বাধীনচেতা একজন মানুষ এমনকি নগরবাড়িতে পুলিশের পিটুনিও খেয়েছি। যা বলার তা বলে ফেলি।’
· রাজনীতি সম্পর্কে কবির ভাবনাটা কেমন?
·· রাজনীতিতে চিরস্থায়ী কোনো শত্রু নেই বন্ধুও নেই।
· (দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবির এ দর্শনের তেমন কোনো ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে বলে মনে হয় না। তাই ঢুকে পড়ি সাহিত্যের পথে) একজন লেখকের কাজ কী?
·· লেখকের কাজ অবশ্যই লেখালেখি, কিন্তু লেখালেখিতে সবারই একটা খারাপ সময় যায়। সাহিত্যের এই বন্ধ্যা সময়ে একজন লেখকের উচিত হবে পুরনো লেখাগুলিকে রোদে শুকাতে দেওয়া।  অর্থাৎ সেগুলিকে নিয়ে কাজ করা।
· পুরনো লেখা বলতে কি লেখকের পুরনো লেখা না কি আমাদের সাহিত্যের পুরনো লেখা।
·· পুরনো লেখাটা হচ্ছে, আমাদের সাহিত্যের পুরনো লেখা, বিশেষ করে আমাদের লোকসাহিত্য -এগুলো নিয়ে কাজ করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। অনেকে হয়তো এটাকে লজ্জাজনক মনে করবেন কিন্তু এগুলোকে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করলে তিনি নিজে উপকৃত হবেন, উপকৃত হবে বাংলা সাহিত্যও।
আমি নিজেও এক সময় ভাবতাম কেবল রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকে নিয়েই এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।  কিন্তু আমাদের লোকসাহিত্যেও প্রচুর ভাববার উপকরণ রয়েছে, রয়েছে কাজ করার প্রচুর ক্ষেত্র। আসলে আমাদের লোক সাহিত্যটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আরও আগে কেন এদিকে নজর দিলাম না এ জন্য আমার মাঝে মাঝে আফসোস হয়।
· আমাদের সমৃদ্ধির পরিধিটা কেমন?
·· ইংরেজরা আমাদের দেশে এমনি এমনি আসেনি। আমাদের সম্পদের লোভেই তারা এখানে ঘাঁটি গেঁড়েছিল। কেবল সম্পদই নয় এদেশ সব দিক দিয়েই ছিল সমৃদ্ধ। সম্প্রতি আবিষ্কৃত উয়ারী বটেশ্বরের ইটের রাস্তা এর প্রমাণ। তাছাড়া আমাদের পাহাড়পুর-ময়নামতিতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চলছে তখন অক্সফোর্ডে শেয়াল ডাকছে।
· সেই ভাণ্ডার কি ফুরিয়ে গেছে?
·· আমাদের দেশ এখনো সমৃদ্ধশালী। তাই তো, প্রতিবছর সাইবেরিয়া থেকে শীতের সময় পাখিরা আমাদের দেশে আসে। কেবল উষ্ণতার জন্যই তারা এখানে আসে না, খাদ্যের জন্যও আসে। মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করলেও পাখিরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। পাখিরা এখনও ভালোবাসে বাংলার মাটিকে। তবে আমাদের সমৃদ্ধির গল্প ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। কিছুদিন আগেও এমন ছিল না। আমার মনে আছে, আট টাকাতে একমণ চাল পাওয়া যেত। একবার আমি এক টাকাতে সাতটি ইলিশ মাছ কিনেছিলাম। মাছ দেখে আমার মা তো ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন, ‘এ ছেলে তো জমিদারি ধরে রাখতে পারবে না। এ-ক টাকার মাছ কিনে এনেছে!’ কিন্তু এখন সম্পদ কিছু লোকের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। আবার দুঃখজনক হলেও সত্য, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দেশে না খেয়ে লোক মারা যায়।’
· এর দায়টা কার?
·· দায় কেউ এড়াতে পারবে না। সরকারেরও দায় রয়েছে, জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, এ শ্রমিকগুলো কোথায় যাবে, কী খাবে? একসময় দেশে ৭২টা জুট মিল ছিল এখন এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪-এ। ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আর এ কারণেই আমাদের বোনদের ডিসির কাছে দেহ ব্যবসার জন্য অনুমতি আনার জন্য লাইন ধরতে হয়। এটা আমাদের জন্য কতটা লজ্জার বিষয়, তা কোনোভাবেই বুঝানো যাবে না।
· তবে কি সমাজতন্ত্রে সমাধান খুঁজে নিতে হবে?
·· সমাজতন্ত্র হয়তো ভালো, কিন্তু নানা ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এদিক দিয়ে গণতন্ত্র অনেকটাই উৎকৃষ্ট। গণতন্ত্র সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেয়। যেটা সমাজতন্ত্রে নেই।
· (গুরুগম্ভীর কথা ছেড়ে সাহিত্যের রাস্তা খুঁজি) উর্দু সাহিত্যের সাথে আপনার একটা সখ্যতা আছে। যেহেতু উর্দু ভাষা নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে উর্দু কবিতার প্রতি সহানুভূতি কেমন চোখে দেখা হয়?
·· আমিও শামিল ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। তারপরও আমি পাকিস্তানী কবিদের সাথে কবিতা পাঠ করেছি, ভারতীয় কবিদের সাথেও কবিতা পাঠ করেছি। আসলে সাহিত্যের ক্ষেত্রটা আলাদা। বিষয়টা আসলে আপেক্ষিক নইলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে দেশ ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলো, সে দেশের সীমান্তরক্ষীরা পাখির মতো গুলি করে আমাদের দেশের মানুষদের হত্যা করবে কেন?
· সাহিত্যে ভেদাভেদ নেই বলে আপনি মানেন। যদিও আমাদের সাহিত্যটা দুটি ধারায় বিভক্ত এবং এ বিভক্তিটা খুব চরম পর্যায়ের। আপনার দৃষ্টিতে এটা কেমন?
·· আসলেই এটা দুঃখজনক।
· (আবারও ফিরে যাই উর্দু কবিতার প্রসঙ্গে) বাংলাদেশী উর্দু কবিদের সম্ভাবনা কেমন?
·· একসময় আমাদের উর্দু কবিরা উর্দু সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। যা জাহাঙ্গীরনগর স্টাইল হিসেবে পরিচিত। উর্দু সাহিত্যে এর বেশ আদরও রয়েছে।
· ছড়া সাহিত্যেও তো আপনার পদচারণা রয়েছে। তো এখনকার ছড়া সাহিত্যকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?
·· এখনকার ছড়ায় একটা বক্তব্য জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে সত্যিকারের ছড়া হয়ে উঠছে না। আসলে ছড়া ঠিক অতোটা বক্তব্য পছন্দ করে না। শুধু ছড়া কেন কবিতাও খুব বক্তব্যধর্মী হওয়া উচিত নয়।’
· (ছড়া ছেড়ে কবিতার পথে হাঁটি) এখনকার তরুণ লেখকদের সম্পর্কে কবির মূল্যায়ন।
·· এখনকার তরুণ লেখকেরা বেশ সিরিয়াস। কিন্তু তারা মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারছে না না। ফলে তাদের মধ্যে এক প্রকার ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে। এখন লেখকের বেশি হওয়ার কারণে ভালো লেখা সনাক্ত করা বেশ একটা কঠিন কাজ। কিন্তু আমাদের সময়ে একজন লেখক একটু ভালো লিখলেই প্রশংসা পেতেন। সেদিক থেকে এখনকার লেখকেরা একটু দুর্ভাগাই বলা যেতে পারে।

· সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাঈদ চৌধুরী টিপু

>> পথিক ১৮

বুধবার, ১০ নভেম্বর, ২০১০

প্রবন্ধ >> গাটু, গাটুগান ও গাটুনাচ : মোহাম্মদ আবদুল হাই

গাটু, গাটুগান ও গাটুনাচ

মোহাম্মদ আবদুল হাই

লোক সংস্কৃতির এক প্রাণবন্ত ধারা হচ্ছে লোক সাহিত্য। কোনো নির্দিষ্ট ভৌগলিক পরিমণ্ডলে বসবাসরত একটি জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য হচ্ছে লোক সাহিত্যের বুনিয়াদ। মৌখিক ধারার এ সাহিত্য সাধারণত, অরজ্ঞানহীন সমাজে স্মৃতি ও শ্রুতির মাধ্যমে লালিত পালিত হয়। মূলে ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও সমষ্টির চর্চায় পুষ্ট হয়ে তা পরিপক্কতা লাভ করে। লোক সাহিত্য এজন্য জনগোষ্ঠীর আবেগ, ঐতিহ্য, চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে শিল্প সৌন্দর্যের মাধ্যমে রস ও  আনন্দদান করে। কোনো জাতির আত্মার নিনাদ লোক সাহিত্যের মধ্যে শোনা যায়। বাংলা লোক সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্যে এরকম একটি সমৃদ্ধ উপাদান হচ্ছে গাটুগান ও গাটু নাচ।
বাংলা লোকসাহিত্য গবেষকদের প্রায় সবাই গাটু গান ও গাটু নাচ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, ড. ওয়াকিল আহমদ, আবদুল হাফিজ, অধ্যাপক আসদ্দর আলী প্রমুখ লোক সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে গাটু গান বা গাটু নাচ কিংবা উভয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তবে এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি, বিস্তৃত ও অনুসন্ধানী আলোচনা করেছেন মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী। ‘লোকসাহিত্যে গাডু গান’ শীর্ষক তথ্যবহুল এ লেখায় গাটু গান ও গাটু নাচের উৎপত্তির পাশাপাশি অনেকগুলো গাটু গান বিবৃত করা হয়েছে। মনে করা হয় যে, এ লেখনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই পরবর্তীতে গবেষকগণ গাটু গান ও গাটু নাচের প্রতি উৎসাহী হন এবং তাকে প্রায় অবিকৃতভাবে অনুসরণ করেছেন। গাটু গান ও গাটু গান নিয়ে রচিত লেখাগুলো পড়লেই এর সত্যতা পাওয়া যায়। বিশেষ করে, গাটু গানের উৎপত্তি সংক্রান্ত আলোচনায় তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। কোনো গবেষকই সিরাজুদ্দিন কাসিমপুরীর বক্তব্যের সত্যাসত্য নির্ণয়ের চেষ্টা করেননি। এমনকি কোনো ভিন্নমতও তাদের লেখনীতে পাওয়া যায় না। তাই সিরাজুদ্দিন কাসিমপুরীর মতামতই প্রশ্নাতীতভাবে গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। গাটু গান ও গাটু নাচ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা সকল লোকসাহিত্য গবেষকদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে যে, তাদের লেখায় গাটু গান বা গাটু নাচ কিংবা উভয়টির উপর গুরুত্বারোপ করলেও ‘গাটু’ ব্যাপারটি উপেক্ষিত থেকে গেছে। বর্তমান আলোচনায় গাটু গান ও গাটু নাচের পাশাপাশি ‘গাটু’ বিষয়টির ব্যাপারে আলোকপাতের প্রচেষ্টা থাকবে। পাশাপাশি গাটু গানের উৎপত্তি বিষয়ক গতানুগতিক মতের ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশের চেষ্টা করা হবে।
‘গাটু’ শব্দটির উদ্ভবের ইতিহাস অস্পষ্ট। শব্দটি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। কোথাও ‘গাঁডু’, ‘গাডু’ আবার কোথাও উচ্চারিত হয় ‘ঘাঁটু’ ‘ঘাটু’ বা ‘গাটু’। পশ্চিমা কুলিদের মধ্যে উচ্চারিত হয় ‘গান্টু’। এটি একটি আঞ্চলিক শব্দ। এ শব্দের মূল বিচার করলে দুটি শব্দ পাওয়া যায় - ‘গান’ আর ‘ঘাট’। গান+টু>গান্টু>গাটু; আর ঘাট+উ>ঘাটু। বর্ষার দিগন্তব্যাপী হাওড়ের কূলে নৌকার পাতাটনের উপর গাটু গানের আসর বসার পর তা ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াতো বলে গানের বালককে গাটু এবং গানগুলোকে গাটু গান বলা হতো বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে সিরাজুদ্দিন কাসিমপুরী বলেন, ‘‘গান্টু’ নামে বালকদের নৃত্য সম্বলিত একপ্রকার গান বৃন্দাবন মথুরা থেকে গঙ্গার তীর ধরে রাজমহল পর্যন্ত প্রচলিত ছিলো; সে বিচারে গানগুলোর নাম ‘গাটু’ হওয়াই স্বাভাবিক।’ আমরা এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে সোজা-সাপটা ‘গাটু’ শব্দটি গ্রহণ করলাম।
লোক সাহিত্যের অন্যান্য উপাদানের মতো বাংলার সকল অঞ্চলে গাটু গান ও গাটু নাচের প্রচলন ছিলো না। ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনেকাংশ, ত্রিপুরার কিছু অংশ এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এর প্রচলন ছিলো বলে গবেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। উপরোল্লিখিত অঞ্চলের মধ্যে আবার যেসব এলাকা তুলনামূলকভাবে পশ্চাৎপদ, অনগ্রসর, ভৌগলিকভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম সেসব জনপদে এর বেশি প্রচলন ছিলো। জনসাধারণের মধ্যে গ্রামের কৃষক ও দিনমজুর শ্রেণীই ছিলো গাটুর প্রধান শৌখিন। অবশ্য সম্পন্ন পরিবারের বিশিষ্ট অনেক লোকও গাটু’র মোহে পড়তো এবং পৃষ্ঠপোষকতা দান করতো। ধর্মের দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, গাটু গান ও গাটু নাচের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় সবাই মুসলমান। কঠোর রক্ষণশীলতা, গতিহীনতা, শিক্ষার অভাব অপর্যাপ্ত বিনোদন ব্যবস্থা ছিলো গাটু’র প্রতিপালক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিশ্বায়ন নামের সর্বব্যাপী দৈত্যের হাত ধরে আসা অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার বিস্তার, বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রেডিও, টেলিভিশনসহ অন্যান্য মাধ্যমের সহজলভ্যতা; কঠোর, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারণে বিংশ শতকের সর্বশেষ দশকে গাটু গান ও গাটু নাচের প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি হারিয়ে যায়। যদিও বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে ও লোকচক্ষুর অন্তরালে গ্রামীণ কিছু অঞ্চলে এর সন্ধান পাওয়া যায়।
‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ গ্রন্থে ‘গাটু’ সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘বিশেষ ধরনের পেশাদার গাইয়ে ও নাচিয়ে ছেলে’। সাধারণভাবে বলা যায়, ‘গাটু’ হচ্ছে এমন একজন বালক যাকে দিয়ে বিশেষ ধরনের নৃত্য-সম্বলিত গান গাওয়ানো হতো। বাহ্যিকভাবে ‘গাটু’র এরকম সংজ্ঞাই প্রযোজ্য। কিন্তু ব্যাপারটি এতো সরল নয়। আমরা যদি আরেকটু গভীরে, অন্দরমহলে প্রবেশ করি তবে এরকম সাধাসিদে সংজ্ঞা নিতান্তই হাস্যকর মনে হবে। গাটু’র অন্তর্নিহিত বিষয়াদি জানার জন্য আমরা কয়েকটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দিই। আমরা জানতে চেষ্টা করেছি- ‘গাটু’ কে রাখতো, কেনো রাখতো কী ধরনের বালক গাটু হিসেবে নির্বাচিত হতো, গাটু ছেলের সঙ্গে কর্মের দিক দিয়ে প্রাধান্য পেতো কী - ইত্যাদি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে - গাটু’র রমরমা অবস্থাটির বিলুপ্তি ঘটে আজ থেকে মাত্র এক দশক আগে। বিক্ষিপ্ত ও লোক সমাজের অগোচর এখনো কিছু স্থানে অদ্যবধিও এর প্রচলন রয়েছে। সেদিনের সে গাটু বালকেরা আজ যৌবনের কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত; আর পৃষ্ঠপোষক ও শোখিনরা জীবনের অস্তায়মান দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছেন। সে রকম তিনজন যুবক (যারা শৈশব ও কৈশোরের দুরন্ত সময় গাটু হিসেবে অতিক্রান্ত করেছে) ব্যাপক খোঁজ করে পাওয়া গেছে। ব্যাপক অনুসন্ধানে চারজন গাটু গান, গাটু নাচ সর্বোপরি গাটুর প্রতিপালক, পৃষ্ঠপোষক ও সমঝদার পঞ্চাশ/ষাটোর্ধ্ব বয়সী লোক পাওয়া গেছে যারা অকপটে বিনিময় করেছেন তাদের জীবনের ফেলে আসা দিনের মূল্যবান অভিজ্ঞতা।
মাত্র এক দশক আগেও গাটু রাখা আর গাটু হওয়া যেখানে বিবেচিত হতো মর্যাদা আর বীরত্বের ব্যাপার হিসেবে, আজ তা বিবেচিত হচ্ছে লজ্জা, কলঙ্ক ও কুসংস্কার হিসেবে। যে বালক কোমরের হেলনিতে উন্মাদ করে তুলতো কঠিন মনের মানুষদের; নৃত্য ও গানের অপরূপ যাদুতে সম্মোহিত করতো তরুণ আর যুবকদের - সেদিনের সে বালকও আজ সঙ্কোচবোধ করে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান যৌবনকালের সবটুকুই যে কাটিয়েছে গাটুর পেছনে, বাহাদুর সে যুবকটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেও নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। মানবজীবনের এও এক অদ্ভুত দিক। নানাবিধ কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করে সেসব মানুষদের সাথে অন্তরঙ্গ ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা হয়। এভাবে তাদের জবানে গাটু জীবনের খুঁটিনাটি নানা দিক সম্পর্কে অকপট স্বীকারোক্তির মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়।
যে ‘গাটু’ বালকের প্রতিপালক, শোখিন, রক্ষাকর্তা - সর্বোপরি মালিক ছিলো সমাজে তাকে ‘খলিফা’ ডাকা হতো। এ বিখ্যাত রকম একজন ‘খলিফা’ ছিলেন - সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সেলগ্রামের আবদুল করিম। তিনি জীবনে ১৬টি ‘গাটু’ রেখেছিলেন। সত্তরোর্ধ্ব সে প্রবীণ ব্যক্তির অকপট ও সরল স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে ‘গাটু’ সম্পর্কিত অনেক অজানা অধ্যায়। তার মতে, ‘গাটু’ ছিলো মূলত একটা নেশার নাম। এ ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করতো। নেশাখোর যেমন নেশার টানে বুঁদ হয়ে যায়; গাটু ব্যাপারটিও সেরকম।
‘গাটু’ বালক সাধারণত, দূরান্তের কোনো স্থান থেকে ধরে আনা হতো। পছন্দ হলে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় ধরে আনা হতো। ‘গাটু’ হিসেবে সে ছেলেকেই পছন্দ করা হতো, যে দেখতে সুন্দর আকর্ষণীয়। শারীরিক নিখুঁততার দিকেও নজর দেওয়া হতো। মিথ্যা প্রলোভন কিংবা চাকরির প্রলোভন দিয়ে ফুঁসলিয়ে আনা হতো। আনার পর আদর যত্ন সোহাগ আর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হতো জীবন। সুন্দর সুন্দর দামি পোশাক, সুস্বাদু খাবার আর সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রী গাটু’কে ভুলিয়ে দিতো ফেলে আসা জীবনের কথা। এক সময় সে পোষ মানা পাখির মতো ‘খলিফা’র জীবনের সাথে জড়িয়ে যেতো। গাটু বালক ‘খলিফা’কে মামা নামে সম্বোধন করতো। বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ মাঝে মাঝে সমবয়সী প্রিয়জনদের কাছে ‘খলিফা’ ‘গাটু’কে ‘নাইওর’ দিতো। অন্যান্যরাও তাদের ‘গাটু’কে অন্য ‘খলিফার কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘নাইওর’ দিতো। আপন স্ত্রী-সন্তানের চেয়ে অগ্রাধিকারের দিক থেকে ‘গাটু’ একটুও কম ছিলো না। ক্ষেত্র বিশেষে ‘গাটু’ এগিয়েও ছিলো। ‘গাটু’কে এরপর বিশেষ ধরনের নাচ ও গানের তালিম দেওয়া হতো। সাধারণত, ‘খলিফা’রাই এ কাজটি করতো। দাড়ি, গোঁফ আর ‘Pubic Hair’ গজানোর সাথে সাথে ‘গাটু’কে সসম্মানে বিদায় করা হতো। অনেককে আর্থিক পুনর্বাসনও করা হতো। এ মতের সাথে অন্য দু’জন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিখ্যাত ‘খলিফা’ একমত পোষণ করেছেন। গাটুদের সাথে যৌন সঙ্গম যে মূখ্য ছিলো এ ব্যাপারেও তারা একমত পোষণ করেন।
সিলেট-তামাবিল সড়কে ট্রাক চালক হিসেবে কর্মরত আছেন করিম ও ফারুক। দু’জনেই এক সময় ছিলেন নামকরা ‘গাটু’। বর্তমানে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত মুদি দোকানদার হচ্ছেন মদচ্ছির। তিনিও শৈশব ও কৈশোর অতিক্রান্ত করেছেন ‘গাটু’ হিসেবে। সবাই-ই বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায় - প্রত্যেককে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। অভাবের তাড়না আর মা-বাবার নির্যাতনে এদের দু’জন চাঁদনিঘাটে ও অন্যজন কালিঘাটে নামকাওয়াস্তে মজুরিতে দিন মজুরের কাজ করতো। রাতে ঘুমাতো ব্রিজের নিচে। একদিন একজন ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যায়। তারপর শুধুই আদর সোহাগ আর সুখ-যা তারা জন্মের পরও পায়নি। মাস শেষে টাকাও দেওয়া হতো। কিন্তু কাজের কথা বললে এড়িয়ে যাওয়া হতো। এভাবে এক সময় তারাও নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
কী করা হতো তোমার সঙ্গে - জানতে চাইলে ফারুক প্রথমত ইতস্তত করলেও পরবর্তীতে বলেন, মূলত, আমার সাথে মামা যৌনকর্মই করতো। এমন সব বিচিত্র কৌশলে -যা সে জীবনেও কল্পনা করেনি। তার মতে, আমার মামার স্ত্রী ছিলো অত্যন্ত সুন্দর। কিন্তু একদিনও আমি মামাকে স্ত্রীর কাছে যেতে দেখিনি। একই বিছানায় আমরা সবাই মাঝে মাঝে থাকতাম। মামা আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। অন্য মামারাও ‘নাইওর’ নিয়ে একই কাজ করতেন। তাদের ধ্যান জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বদা আমিই থাকতাম। যৌন সঙ্গমের সুনির্দিষ্ট ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে করিম বলেন, আসলে মাঝে ‘Sodomy’ করা হতো। ‘Oral Sex’ও কম হতো না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবলম্বন করা হতো অন্য প্রকার কৌশল। ব্যাপারটি তিনি বিস্তারিত বললেও এ সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে। যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে উপরোক্ত তিনজনই প্রায় একই মত প্রকাশ করেছেন। বর্তমানেও যে ‘গাটু’ প্রথা বিচ্ছিন্নভাবে প্রচলিত আছে তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাপক অনুসন্ধানে এ রকম এক ‘গাটু’র সন্ধান পাওয়া গেছে। তার নাম হচ্ছে বুলবুল (১৩)। সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার হাখরপুর গর্দনা গ্রামের বুলবুল বর্তমানে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে ‘গাটু’ হিসেবে দিনাতিপাত করছে।
দেখা যাচ্ছে ‘গাটু’ ব্যাপারটির সাথে যৌন সম্পর্কের দিকটিই মূখ্য। বিশেষ করে সমকামিতার ব্যাপারটি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাতের প্রয়োজন আছে। এটি ‘গাটু’র উৎপত্তি সংক্রান্ত আলোচনায় সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।
ইংরেজি ‘Homosexuality’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে সমকামিতা। সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার যৌন প্রবৃত্তিকে সমকামিতা বলা হয়। আর যারা সমলিঙ্গের প্রতি এ রকম আকর্ষণ বোধ করেন তাদের বলা হয় সমকামী। আরবিতে সমকামীকে ‘Mukhanalth’ বলা হয়। প্রাচীনকালে সমকামীদের বোঝাতে ‘পরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। কেউ কেউ সমকামীতাকে আরেকটু শালীন রূপ দিতে সমপ্রেম শব্দটির প্রচলন ঘটাতে চান। সমকামিতার ইতিহাস মানুষের যৌন ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাচীন শিকারী-সংগ্রাহক সমাজ থেকে শুরু করে আজকের শিল্প সমাজ পর্যন্ত তা বিস্তৃত। বিভিন্ন সমাজে তার রূপ ছিলো বিভিন্ন। কখনো তা প্রকাশিত হয়েছে, সমাজচক্ষুর ভয়ে তা আবার চর্চিত হয়েছে অগোচরে। প্রাচীন রোম, গ্রীস থেকে শুরু করে আজকের সভ্যতার প্রত্যেক স্তরে সমকামিতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে বর্তমানে একে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনও চলছে।
কোরআন, বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টে লুত (আ.) নবীর জাতির মধ্যে সমকামীতার উল্লেখ পাওয়া যায়। সমকামীতার শাস্তিস্বরূপ বসবাসস্থলসহ পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে বিবরণ আছে। ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতো মুসলমান সমাজেও তা লোকচক্ষুর অন্তরালে ও বিচ্ছিন্নভাবে চর্চার প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। খলিফা আল মু’তাসিমের শাসনকালে চালুকৃত ‘Ghilman’দের কথা বলা যায় - যা ভারতীয় উপমহাদেশেও প্রচলিত হয়। যদিও ‘Ghilman’রা বাহ্যিকভাবে দাস সৈন্য ছিলো; তারপরও তাদেরকে যৌন কাজে লিপ্ত করা হতো। হেরেম প্রহরার জন্য ‘Eunuch’দের (খোজা) কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিখ্যাত শাসক মাহমুদ গজনভীর সুদর্শন বালকপ্রেমের কথা ও আয়াজের ঘটনা ইতিহাসে সুবিদিত।
বাংলার রক্ষণশীল সমাজেও সুদর্শন বালকপ্রীতির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলো। কঠোর রক্ষণশীল সে সমাজে পরনারী দর্শন চরম পাপ ও বিনোদনের সুযোগ ছিলো সীমিত। এমন বৃদ্ধ ও স্থবির সমাজের যুবকেরা যে যৌন প্রবৃত্তি নিবারণ ও বৈচিত্রতার জন্য সামাজিকভাবে অনেকটা সহনীয়  - সুদর্শন ও আকর্ষণীয় বালকদের প্রতি ঝুঁকতে পারে তা অস্বাভাবিক নয়। পাশ্চাত্যেও এ রকম শিশু থেকে যৌন আনন্দলাভের কৌশল চালু আছে। যাকে ‘Pedophilia’ বলা হয়। কিন্তু বাংলার যুবকরা ধরে আনা সুন্দর বালকদের সাথে যা করতো তার নাম হচ্ছে ‘Thighing’। যৌন কর্মের এ কৌশলটি হচ্ছে ‘The child’s legs are pressed together and the abuser inserts his penis between thighs of the little boy or girl.’ ‘গাটু’ ছেলেদের জবানি ও ‘খলিফা’দের স্বীকারোক্তিতে ব্যাপারটি পুরোপুরি মিলে যায়।
‘গাটু’ গানের উৎপত্তি সম্পর্কে সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরী বলেছেন, ‘ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে শ্রীহট্টের আজমিরীগঞ্জ নিবাসী জনৈক আচার্য্য রাধাভাবের নানা লীলাখেলার মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকতেন। ক্রমে তার শিষ্য সংখ্যা বাড়তে লাগলো - নিম্নশ্রেণীর বহু বালকও তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো। এই ছেলেদের রাধিকাভাব সম্পন্ন উক্ত আচার্যের সখী সাজানো হতো এবং তারা নীরবে নেচে রাধার বিরহের বিভিন্ন অবস্থা প্রকাশ করতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিরহ সঙ্গীতের সমন্বয়ে গড়ে উঠে ‘গাঁডু’ গান।’ সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরীর এ মতের সত্যাসত্য নিরূপণের জন্য আজমিরীগঞ্জের প্রবীণ, অভিজ্ঞ, গাটু গানের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজন ব্যক্তির সাথে কথা হয়। তাদের কেউ-ই সে বৈষ্ণব আচার্যের কোনো সন্ধান দিতে পারেননি। আজমিরীগঞ্জই যে গাটু গানের উৎপত্তিস্থল - এ ব্যাপারটিও তাদের অজানা। সম্ভবত, জনশ্রুতি বা কোনো কল্পনাপ্রবণ ব্যক্তির বর্ণনা দ্বারা সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরী প্রভাবিত হয়েছিলেন। লোক সাহিত্যের অনেক উপাদানের মূলে ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব যে ছিলো - তা অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু গাটু গানের উৎপত্তির ব্যাপারটি যেভাবে সরলভাবে বিবৃত হয়েছে - প্রকৃতপক্ষে তা তথ্যভিত্তিক ও যুক্তিসঙ্গত নয় বলে আমরা মনে করি। কঠোর রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে যৌবপ্রবৃত্তি নিবারণের জন্য সুদর্শন ও আকর্ষণীয় ‘গাটু’ বালক রাখার যে প্রচলন ছিলো; কালক্রমে এ ছেলেকে দিয়ে আরো বিনোদন ও আনন্দ উপভোগ করার জন্য গান ও নাচের ব্যাপারটি যুক্ত হয়েছে বলে আমরা মনে করি। লঘু রঙ্গরসের আলকাপ গানের সাথে ছোকড়া নাচের যে প্রচলন পশ্চিবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদহ জেলায় চালু ছিলো - সেটিই এতদঞ্চলে গাটু গান ও গাটু নাচ রূপে ব্যক্ত হয় বলে আমাদের বিশ্বাস। সিলেটের বিথঙ্গলের জগন্মোহন প্রবর্তিত ‘কিশোরীভজন’ নামে বৈষ্ণব উপ সম্প্রদায়ের ভজন ও নাচের প্রভাব এক্ষেত্রে থাকতে পারে। ষোড়শ শতকে আজমিরীগঞ্জে ‘গাটু’ ছেলেদের  আনুষ্ঠানিকভাবে হয়তো প্রথম ‘ছোকড়া নাচ’ অথবা ‘কিশোরীভজন’র ব্যাপারটি ভিন্ন ঢঙে পরিবেশিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ‘গাটু’র পুরো ব্যাপারটি আরো পুরনো। বলা যায়, বিকৃত কিংবা অস্বাভাবিক যৌনরুচির সর্বজনীন কৌশল ‘সমকামীতা’র স্থানীয় রূপ হচ্ছে ‘গাটু’ - যার সাথে পরবর্তীতে গান ও নাচ যুক্ত হয়। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে - গাটুর সমঝদার ও প্রতিপালক লোকেরা যদি সমকামী বিশেষত Gay হয়, তাহলে এরা বিপরীত লিঙ্গের অধিকারীকে বিয়ে করে ঘর সংসার করে কীভাবে? তাদের কাউকেই তো চিরকুমার জীবন যাপন করতে দেখা যায়নি।  এক্ষেত্রে বলা যায়, সমকামীতাকে নিরুৎসাহিত করে বিসমকামীতাকে উৎসাহিত করার সামাজিক একটা চাপ সর্বদাই থেকে যায়। অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ রক্ষণশীল সমাজে এই চাপ আরো প্রবল। ফলে দেখা গেছে, সমাজের চাপে পড়ে একজন সমকামী ব্যক্তি বিসমকামী হয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্ত্রী বা স্বামী বাচ্চা নিয়ে সংসার করছেন। এদের বলা হয় নিভৃত সমকামী (Closet Gay)। আমাদের আলোচ্য গাটু সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা মূলত, নিভৃত সমকামী (Closet Gay) বৈ কিছু নয়। 
‘গাটু নাচ’ হচ্ছে মেয়ের সাজে ছেলের নাচ। এটি বাংলার আঞ্চলিক নাচ। মূলত, নাচের জন্যই রচিত হতো বিশেষ গান। লোকনৃত্যের মধ্যে একমাত্র গাটু নাচেই গানের ভাবার্থ ধরে নাচের ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলা হয়। গাটু গান আধুনিক অপেরার মতো অভিনয়মুখী। অপেরার নেপথ্যের গানের ভাবকে সুবিন্যস্ত অঙ্গভঙ্গি দ্বারা ব্যক্ত করা হয়। এ ধরনের গ্রামীণ সংস্করণ গাটু নাচ। গানের বিষয়, কণ্ঠের সুর, বাদ্যের তাল-সঙ্কেত অনুযায়ী গাটু অঙ্গ প্রতঙ্গের বাহ্যিক কলা-কৌশল দ্বারা নৃত্যাভিনয় করতে থাকে। গানের ভাবও তাল বাদ্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার নৃত্যভঙ্গিমাও পরিবর্তিত হয়। এরূপ একটি দীর্ঘ পালাকে সারা রাত ধরে ঘাটু নৃত্যমূর্তি দান করে। ঘাটু নাচের আসরে ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো উপলক্ষ নেই; লোক মনোরঞ্জনের নিমিত্তই এর আয়োজন করা হতো। গাটু নাচের দলগুলো অধিকাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের; দর্শক ও মুসলমান জন-সাধারণ। পরপুরুষ দর্শনমাত্র যেখানে কঠোর পাপের শাস্ত্রীয় বিধান রয়েছে সেখানে লোক মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে রমণীর নাচের অংশগ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিলো । সমাজের জনগণের চাহিদা পূরণের জন্য বালকের দ্বারাই তাই রমণীয় বেশ-বাশে সাজিয়ে ছেলেকে নাচানো হতো।
গাটু গান হচ্ছে গাটু ছেলের গান। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গাটু নাচের জন্যই গাটু গান রচিত হয়। রাধার বিরহই হচ্ছে গাটু গানের প্রধান উপজীব্য। গানগুলো সংক্ষিপ্ত দুইপদী বা তিনপদী। গায়কেরা এগুলোকে দুহারী বা তিহারী বলে থাকেন। চম্পক আঙ্গুলি সঞ্চালন করে নৃত্যের ভঙ্গিমায় বর্ষা মেদুর প্রকৃতির পটভূমিতে গাটু বালকদের বিরহসুর শ্রোতাদের উন্মাদ করে তুলতো। অনেক সময় সমঝদাররা আসর করে বসে পালাক্রমে গান গেয়ে থাকে। এ সময় ‘গাটু ছোকরা’ নীরব অঙ্গভঙ্গি সহকারে নেচে গীত সংগীতে ভাবের অভিব্যক্ত প্রকাশ করে থাকে। গাটুর গানের মধ্যে নৃত্যসম্বলিত গীত, খেয়াল আর অঙ্গভঙ্গি দ্বারা ভাব প্রকাশক সমগানই প্রসিদ্ধ। সমগানের রাগিনী বড়ই করুণ, মধুর ও হৃদয়গ্রাহী। সমগানের প্রত্যেকটি কথা ফেটে যেনো বিরহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। গাটু গানের যন্ত্র হিসেবে ঢোল, করতাল, মন্দিরা, বেহারা প্রভৃতির প্রচলন ছিলো। গাটু গান সমসাময়িক বিষয়বস্তু ও ভাব সম্ভার নিয়েও রচিত হতো।

এক.
বাড়ীত দিওনা ও মামুজি বাড়ীত দিও না
হেনগামের মামু যারা
চউখে দেখি লাল
চঙল মারি ধইরা আইনলা
ছ’মাসের ছাবাল (শিশু)।
মামুজি বাড়ীত দিওনা
আমি যে তোমার
তুমি যে আমার
তুমি বিনেও মামুজি দুনিয়া অন্ধকার।
বাড়ীত দিওনা ও মামুজি বাড়ীত দিও না
গাঙে কাইটা ভাসাই দেও মামু
বাড়ীত দিওনা ॥

দুই.
আজ নিশী স্বপনের কথা
বুঝতাম পারি না
বাজারে চইলাসো মামু
ফিরে আইলেনা।
বাড়ির কান্দাত (কাছে) বাজার ছিল যাইতে পারিনা।
উত্তর বাড়ীর কালা গুণ্ডা কয় মনের কথা
দরবস্ত বাজারের সিগারেট খাইতে দিলনা।

তিন.
কেঁদে কেঁদে কেঁদে মরি
কেউ নাই আমার দরদী,
রূপ তোমার মনধারা
সোনার অঙ্গ হইলো সারা
দুই নয়নে নদী-নালা
অভাগিনীর জোরে মরি।

চার.
কেনেরে ফুল রক্ত জবা জলে ভাস কি জন্য?
চার কোণে চার সন্দুক আছে কন্যার ঘরে সন্তান হইলে
পিতা ডাকবো কারে
ছগ তুই আশা দিয়া কোন আশা কোন বলনা
পথে ঘাটে দিয়া আশা পরারে দিয়াছো যখন
আমারে কর মানা আশা
পিরিতি সকলে জানেনা
হায়রে মন আমার পিরিত গাছের ফল
শুধু ডাব নারিকেলের জল
এরু (এটুকু) খাইয়া সোনা বন্দের মন হয় পাগল
আয়না চোখে কাজল দিয়া রং মহলে চাইতেছি
রং মহলের বাবু যারা
ঝিলমিল মশর ফারা (ছেঁড়া)
টানাটানি করই নারে
গাটু আমার পুরানা ॥

পাঁচ.
ফুল মতি মিনরাই, প্রেমের ডোরে বানছে তরে
কাল সকালে যদি নাগাল পাই’
গেছোগো রাই তোর মন্দিরে
কেন রাই দেখা দিলে
মনের আগুন দ্বিগুণ জ্বালাইলে।

ছয়.
বড় ইশকেরই পাগলরে বন্ধু
পাগল করিলে
তোমায় যদি পাইতামরে বন্ধু
মনের দুঃখ খুলিয়া কইতাম,
তোমারে পাইলেরে বন্ধু।

সাত.
নিশি ফুলের গুমেল ছই
নিমুখ ইয়া যাইতে এখন আইছো প্রেম বাড়াইতে
প্রেমযান না অখালায় চান
কালিযান কান্দাইতে॥

আট.
আমার ভাঙ্গা নায় যে বাইতে পারে
তারি বলি নাইয়া
উজান গাঙ্গের সুজন নাইয়া
বালু চরে নাও লাগাইয়া ডাকে রসের বাইয়া
এদেশের চল্ না (রীতি) যত নানি বড় নানা ছোট
নানা হয়রে গাঙ্গের পানি নানি
লয়রে মজার গান, লম্বা চুলের বরমসিল
ময়মনসিংহ জেলায়।

নয়.
দেশের ছোকড়ি দেশে আয় কত গুন্ডার মন মজায়
তরে লইয়া মামলা চলে বিচার হয় হাই কোটেতে
ময়মনসিংহ জেলায়।
পাকি আম পাকি জাম এলেকির পরে
আজ তোমারে লইয়া যাইবো মধু খাওয়াতে
গহিনও জঙ্গলার মাঝে আছে ময়দান
বিছানা বিছাইয়ারে ময়নায়
যৌবন করল দান।

দশ.
বাইরে অবিজিল শাড়ী সোনায় বরণ শরীরে
আমার রূপের শরীরলে গামছা
তোমার গামছা কান বিছাইয়া, শামরে
ও শাম পুরায় মনের বাসনা।
এগারো.
হালকা ধুত্তি কোমর ধান সুন্দরীগো যৌবন কর দান
তোমার  ঠোঁট দেখা যায়
লামার ছকিনা গাঁজায় টান
সুন্দরীগো যৌবন কইরা যায় দান।

বারো.
নদীয়ার কিনারে বাঁশি বাজাইছ নারে কালার চান
শুনিয়া কালার বাঁশির টান বাইরম বাইরম করে,
আমার হাতের বাজুর বাইন্দার
শোনতাম কালার বাঁশির নাম।

তেরো.
মধু মালা গো সখি তরে যদি পাই
কতই নদী কতই সাগর পারি দিয়ে যাই
মালা তরে যদি পাই।
তোর মতো সুন্দরী পাইলে বুকে বুক মিলাই
মালা তোরে যদি পাই .... ।

চৌদ্দ.
সালামও জানাইলাম সালাম।
সিলট জিলায় বসত বাড়ী
জৈন্তাপুর থানা পোস্ট অফিস দরবস্ত বাজার।
শিলং লানির পশ্চিম দ্বারে ডাউয়া গেরাম।
উস্তাদের নাম নূরুল হক
মামা, সভায় জানাইলাম।
এত রাত্রের পরের গাজন সাজাই আনি
তোলা গাউটার (গ্রামের) মাথায় তুলে
দাওরে সকল ফুলের নমুনা।
বন্ধনা যে করি গো শাম মায়ের বংকো
ব্যাপারি কোন উস্তাদের চরণ
শিরে করি বন্ধন।
কৈলাশেতে গিয়ে আমরা
শির বন্ধন করিগো ॥
তোর মন যদি এত ছিলো
হাঁরে কালার ছান।
আজই আমারে আইনা দেরে
আসমানের চান।
মন্দিরারই উননু ঝুননুর
বেহালার লম্বা টান
ঢোলকেরই আগলা টুকা
উত্তাইলো পরান।

পনেরো.
কেন গো মা তুমি
পাগলীর বেশে
জবা রক্ত ফুল গাঁথিয়া
দিলাগো মা তোর শরীরে
আজি বিহনে ছাড়লাম গো মা
পাগলীর বেশে।
শাম, তোমায় করি মানা
ভাঙ্গা ঘর ছুঁইওনা
ভাঙ্গা ঘরে নেরার (খড়কুটো) ছানি
টপ টপ পাইয়া পড়ে পানি
বালিশ ভিজলে যেমন তেমন
তোশক ভিজলে ছাড়বো না।

ষোলো.
গেলগো পিরিতের নেশা
ও যুবতী জল ভরবো না
ভরবো আর ভরবোনা ইন্দুস্তানী।
আর যাবোনা গাটু’র গানে
যদি বাঁচি
নাচো নাচো ও সুন্দরী
যতন করিয়া,
হাতে তোমার বান্ধা ঘড়ি
ঘড়ি পিছে লেখা আছে
ঐখানে তুই নাচতে হবে
তুমি যাওরে তরু দলে
আমি আসবো সন্ধ্যা পরে।

সতেরো.
নাছন কর সুন্দর পিয়ারী
আউলাইয়া মাথার কেশ।
নাছিয়ে নাছিয়ে দুই আংকিটারিয়ে
নিষেধ করি মামা
কমর ভাঙ্গা নানা দেশ।
আজই আমায় ছুঁইওনা,
একদিন দুইদিন তিন দিন
যে ব্যামার (রোগ) হইয়াছে রে শ্যাম
চান্দ মাসের লাঞ্ছনা
যে ব্যামার হইয়াছে নিদি
তোমারই শরীরের মাঝে
ঢাকা থাকি আনলাম ডাক্তার
রোগী ধরি দেখবে ডাক্তার
ব্যামার আমার পেটের তলায়।

আঠারো.
কালায়নিল কুল মান
কালার জাত ও বেঈমান,
কালা আমার শালা
নাইরে বুঝি জ্ঞান
এমন করি আইছে কালা
নিতো কুলমান ।
সখি, আর কত জ্বালা সইবো
অভোলার পানে
সারা নিশি ঘুরে মরি
প্রেমের অনলে
ঘুরে ঘুরে আওরে পাখি
আকাশ ভুবনে .... ।

ঊনিশ.
সবারই মাঝে সালাম জানাই আমি অধমে
সালাম জানাই আমি অধমে, সালাম জানাই
আমি অধমে।
সালাম পরে আলেক (উত্তর) লইলাম তার পাশে বন্দনা গাইলাম
তার পাশে তার বইবার জায়গা চাই
সবারই মাঝে,
সালাম জানাই আমি অধমে।

বিশ.
ললিত গো কৃষ্ণ সাজাও
মনের বাঞ্চা পুরাইতে আসিবেন গোলকবিহারী
ফুলের রত্ম সিংহাসনে,
বইসে রইলাম রাই কো কুঞ্জে
আসবে বৈলে আশায় আশায়’
হোইলাম নিশি
প্রাণ সখিরে আইলোনা পোড়া বিদেশী
কোন না কামিনী সনে কাটা এদিন রাতিয়া
পিউয়া আরে দহে মোরা ছাতিয়া॥

একুশ.
কি হেরিলাম যমুনায় আসিয়া গো সজনী
বনমালী তরুয়া মূলে।
যাইতে যমুনার জলে
সেই কালা কদম তলে
ও রূপ চাইতে কলসী নিল স্রোতে।

বাইশ.
দেখবে ইংরেজ লোকে কি কল কৈরাছে?
সাত সাগর পাড়ি দিয়া রাজ্য পাতাইছে
জঙ্গল কাইট্যা সড়ক দিছে
সেই সড়কে তার বসাইছে
দিনের খবর ঘড়িত্ আইনাছে ॥
 
>> পথিক ১৮