শরীর দুটোর একই ছায়া
নীলাঞ্জনা নীলা
আজও ঘুম হলো না নিঁদিয়ার। এক রকম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে পার করলো সারাটি রাত। যতো দিন যাচ্ছে রোগটা বেড়েই যাচ্ছে। টেবিলের উপর ঘুমের ওষুধের খালি পাতা। প্রতিদিন এমন করে খেয়েও ঘুম নেই। কী দেখে যে বাবা নাম রেখেছিলো নিঁদিয়া, কে জানে! শেষ কবে যে তৃপ্তিতে ঘুমিয়েছিলো এখন আর মনেও নেই। বয়সের চাদর পড়ে এখন পঁয়তাল্লিশের দোরগোড়ায়। কিন্তু কে দেখে বলবে চল্লিশ পার করেছে? শরীরের ভাঁজে ভাঁজে এখনো উত্তেজনা ঢেউ তোলে। শরীর চায় নিঁদিয়া, কিন্তু আর পুরুষ তাকে টানে না। সেই কবে ছোটবেলায় দুজন মানুষ স্বাদ নিয়েছিলো অবুঝ শরীরটার। ভয় কাটাতে না কাটাতেই যাকে ভালোবেসেছিলো সেও ধর্ষকের মতোই আচরণ করলো। নিজেকে খুব ঘেন্না করা ছাড়া আর যেনো কোনো পথ ছিলো না নিঁদিয়ার। প্রেম শব্দটাই একটা হাস্যকর কৌতুকে পরিণত হয়েছিলো। বন্ধু-বান্ধবীরা যখন প্রেম করতে আর প্রেমিক প্রেমিকার গল্প নিয়ে মত্ত তার সময়টা নিজেকে নিয়েই কাটিয়ে দেওয়া লাগতো। খুব ইচ্ছে করতো আড্ডা দিতে; কিন্তু কে আড্ডা দেবে এমন বিরক্তিকর একজনের সাথে?
কতোক্ষণ আর টিভি দেখা যায়? একই প্রেমকাহিনী ঘুরেফিরে। কখনও নাটকে, কখনও সিনেমায়। আর পারিবারিক কিছু প্যাঁচপ্যাঁচে ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাও দেখে সময় তো কাটাতে হবে। বাধ্য হয়ে কিছু করা খুব কঠিন কাজ। মনের ভেতর থেকে তাগিদ না এলে সেই কাজ কখনওই পরিপূর্ণতা লাভ করে না। হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়লো নিঁদিয়া, নিজের শরীরে যে গরম কাপড় ছিলো খুলে ছুঁড়ে ফেললো অনেকটাই দূরে। নিজেকে আঁচড়ে খামচে একাকার করে এক রকম শাস্তি দেওয়া। প্রচ- ঠা-া পড়েছে। দরোজা খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে কুয়াশায় ভিজতে লাগলো নিঁদিয়া। পাপ-পুণ্য কিংবা ভালো-মন্দ নিয়ে কখনও ভাবেনি। এখন যেনো ভাবনায় এলো, পাপের শাস্তি কি দিচ্ছে নিজেকে? আবার শক্তভাবে প্রতিরোধ করলো ভাবনাকে, কীসের পাপ? বরং নিজেকে কষ্ট দিয়েছে। আর সেই কষ্ট এতো ভয়ানক যে স্বয়ং ঈশ্বরও কেঁপেছে ভয়ে।
এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো, যেদিন বিয়ের কনে সাজতে বাধ্য হয়েছিলো। রাতের শয্যায় কুঁকড়ে ছিলো এক ভয়ানক আতঙ্কে। বিছানার এক কোণায় চুপ করে নিজেকে সিঁটিয়ে নিয়ে আর হালকা আলোতে একটি হাত এগিয়ে আসার সাথে সাথেই ‘আমায় ছুঁবেন না অনুরোধ করছি এটুকু দয়া করুন।’ লোকটি কিছুটা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো কিনা তার দিকে-সেদিকে আর দেখেনি কেবল নিজেকে দেখছিলো। বেঁচে গেছে নাকি আবার আসবে এগিয়ে?
বৈঁচি তার নিজের বাসরের গল্প বলেছিলো যেদিন, সেদিন থেকে একটা ভীতির জন্ম নিঁদিয়ার ভেতর। অথচ সব বন্ধুরা হাসিতে গড়িয়ে যাচ্ছিলো। নিঁদিয়ার মুখের দিকে চোখ গেলো প্রিয়তার। প্রিয়তা বললো, শোন এমন কেনো তুই? সবাই আনন্দ করছে তুইও আনন্দ নে। কী করে যে সেইদিন বাসায় ফিরে এলো। চোখের সামনে বৈঁচির খোলা শরীর বারবার খেলে যাচ্ছিলো, আর তার বরের। বারবার কেঁপে কেঁপে উঠা শরীরকে আকঁড়ে নিয়ে রাত কাটিয়ে যখন জানালা খুলে দিলো নিঁদিয়া যেনো নিজেকে আবার ফিরে পেলো।
বিয়ের দুই দিন পরেই চলে এসে বলেছিলো আর যাবে না শ্বশুরবাড়ি। সবার একই প্রশ্ন কেনো, কেনো আর কেনো? কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। বলেই ফেললো, সে আমার শরীর ছুঁতে চায়। আমার ভয় করে মা। আমার সেই ঘটনা মনে পড়ে যায়। মা আমায় আর পাঠিয়ো না। কেউ মানেনি, যেতে হয়েছিলো। প্রতি রাতে লাশের মতো পড়ে থাকা। সেই দিনগুলো কী করে ভুলবে নিঁদিয়া? প্রিয়তাই বাচিয়ে দিলো জীবন। একদিন পথে দেখা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে যখন ফিরছিলো। সেই প্রিয়তাকে অনেকগুলো দিন পর পেয়ে নিজেকে যেনো ফিরে পেলো নিঁদিয়া। প্রিয়তা বিয়ে করেনি। নিজের জীবনের অধিকার কারো উপর অর্পণ করেনি। মুক্তির কী স্বাদ, জানে প্রিয়তা। নিঁদিয়া যে অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলো সেখানেই প্রিয়তাও কাজ করে।
মুক্তিরও একটি সুন্দর বন্ধন থাকতে পারে সে জানলো সেদিন, যেদিন প্রিয়তার সাথে জীবন শুরু হলো। ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া থেকে হঠাৎ করে অসীমের সন্ধানে ছুটে গেলে অন্যরকম এক জীবন, অনেকেই জানে না। বৃক্ষ কখনও নিঃসঙ্গ থাকে না। তার ডালপালা আর পাতার সাথে হাওয়া কথা বলে। আকাশের সাথে তার অন্যরকম ভাব। নিঁদিয়াও তেমন বৃক্ষের মতোই ডালপালা ছড়িয়ে ঠিকানা তৈরি করে নিলো।
আজ ছুটির দিন শরীর চাইছে জড়িয়ে ধরে সারাটিদিন পার করতে। শুয়েই রইলো প্রিয়তা আর নিঁদিয়া।
- জানিস গতকাল কী হয়েছে অফিসে?
নিঁদিয়া বললো, কী হয়েছে?
- আরে জি.এমের সেক্রেটারি, বসের সাথে যে লোকটা আসে প্রতিদিন-সোজা কথায় চামচা। সেই লোককে সবার সামনে জুতো দিয়ে মেরেছে সিঁথি।
- বলিস কী? কেনো?
- ওমা তুই থাকিস কই, কিছুই জানিস না?
- আরে আমি কালকে আউটিংয়ে গেলাম না। তারপর তো ওখান থেকেই বাসায় ফিরলাম।
- ওহো! তাই তো, ভুলেই গিয়েছিলাম। ওই লোকটা নাকি সিঁথিকে বলেছে ম্যাডাম এখানে কতো পাচ্ছেন? আমি আপনাকে আরো ভালো বেতন দেবো। সিঁথি বললো, কোথায়? বললো, আরে আসুনই না কেবল ভালো বেতনই না জীবনে যা যা লাগে তার সবই। হঠাৎ শুনি শব্দ, বেশ জোরে। লোকটা সেই যে অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলো পরে জি.এম যাবার সময় যে আসতো তাও আসেনি।
- ঠিকই করেছে। লোকটাকে দেখিস না মেয়েদের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকে যেনো আমরা অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছি।
দুজনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় বিছানায়। তারপর এগিয়ে আসে কাছে, এতোটাই কাছে শ্বাসের সাথে শ্বাস মিলে যায়। থেমে যায় সব কিছু, কেবল দুটি সত্তার আনন্দ এক হয়ে যায়। কে বলে ভালোবাসা কেবল বিপরীত লিঙ্গের সাথেই হতে হবে? ভালোবাসাকে কখনও কি কোনো মাপকাঠিতে মাপা যায়, কোনো মানদ- কি আছে? এই যে এগিয়ে আসা, নিশ্চিন্তের জীবন কেইবা পায় এমন? ভালোই তো যাচ্ছিলো বছরের পর বছর একত্রে থাকা। অদ্ভুত সুন্দর বন্ধন। সমাজের নিয়ম-কানুন না মানা নারী মেনে নিতে পারে না পুরুষশাসিত সমাজ। কতো যে এমন কথা শুনেছে ওরা। তবুও নিজেদের জীবনকে অস্বাভাবিক বলতে রাজি নয় কেউই। সম্পর্ক দেখে-শুনে হয় না।
নিঁদিয়ার নিজের জন্মদিনের কথা মনেও ছিলো না, আসলে কখনও তো তার জন্মদিন পালনই করেনি কেউ। প্রিয়তা সকালে উঠেই বললে, - শোন আজ সন্ধ্যায় তুই সত্তরে চলে আসিস।
- কেনো রে কিসের পাটি?
- চিনবি না তুই, তবে তোকে আমার সাথেই ইনভাইট করেছে।
- আমরা তো একসাথেই যাবো।
- না, না আমি অফিসের কাজে আরেকটা জায়গায় যাবো। সেখান থেকে ওখানে।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এলো বাসায় নিঁদিয়া, প্রস্তত হয়ে বেরুলো। সত্তরে পৌছাতেই দেখে সিঁথিসহ অফিসের অনেকেই। সিঁথি এগিয়ে এসে হাতে ফুল দিয়ে বললো, শুভ জন্মদিন নিঁদিয়া।
অবাক হয়ে গেলো সে। বুঝে নিলো এসব প্রিয়তারই কাজ। জানতে চাইলো প্রিয়তা কোথায়।
- সে তো অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো সেই পাচঁটার সময়, সিঁথি বললো। সবাইকে সাতটায় এখানে চলে আসতে বলে।
ফোন দিলো নিঁদিয়া, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। ভাবলো দুষ্টুমি করছে হঠাৎ এসে চমকে দেবার জন্যে। এরই মাঝে ফোন এলো অপরিচিত নাম্বার থেকে। নিঁদিয়ার ঠোঁটে একটু হাসি।
- হ্যালো, কে বলছেন?
- ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল থেকে বলছি আপনি কি আসতে পারবেন?
- কে বলছেন আপনি, কেনো আসতে হবে বলুন তো?
- আপনি কি প্রিয়তা চৌধুরীকে চেনেন? তার এক্সিডেন্ট হয়েছে, অবস্থা ভালো না তাড়াতাড়ি আসুন।
নিঁদিয়া বললো, আপনি কে বলুন তো সত্যি করে! প্রিয়তা আমার সাথে মজা করছে তাই না?
ও পাশের ফোন বন্ধ হয়ে গেলো। সিঁথি এগিয়ে এলো, কী হয়েছে নিঁদিয়া?
আমি বুঝতে পারছি না আসলে হাসপাতাল থেকে ফোন। বলছে প্রিয়তা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কী করবো সিথি? প্রিয়তা মজা করছে না তো?
আবার সেই নম্বর থেকে ফোন দেবার পরে বুঝে নিলো নিঁদিয়া, জন্মদিন আর এই জীবনে পালন করা হবে না। প্রিয়তাও আর ফিরে আসবে না। পাথরের মতো জলহীন চোখে সকালের ছবিটাও যেনো অস্পষ্ট ভাসে। এই তো সকালে তাকে বুকের মাঝে নিয়ে প্রিয়তা বলেছিলো, নিঁদিয়া একদিন আমাদের মধ্যে কেউ না থাকি তাও মনে রাখিস আমার কেউ হারাবো না, ছায়ার সাথে ছায়া হয়ে থাকবো।
কেনো বলেছিলো প্রিয়তা, সেকি বার্তা পেয়েছিলো ছায়া হওয়ার দিনের। চোখের জলে প্রশ্নের উত্তর পায় না নিঁদিয়া।
কানাডা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন