শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ভিনদেশী সাহিত্য >> মাংস : টেরি বিসন (সামিরা মুসলেহ)

মাংস

মূল : টেরি বিসন ।। ভাষা বদল : সামিরা মুসলেহ

- মাংসের তৈরি ওরা!
- মাংস?
- তো আর বলছি কী! রীতিমত মাংসের তৈরি!
- মাংস?!
- আর কোনো সন্দেহই নেই তাতে। গ্রহের নানান জায়গা থেকে জনাকয়েককে তুলে নিয়েছি, আমাদের অনুসন্ধান যানে তুলে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি ওদের। আপাদমস্তক মাংস!
- অবিশ্বাস্য! বেতার তরঙ্গগুলোর মানে কী তাহলে? আর তারায় পাঠানো বার্তাগুলো, সেগুলো কারা পাঠিয়েছে?
- ওরাই তো কথা বলার জন্য বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে হে! তবে সেগুলো ওদের শরীর থেকে বেরোয় না। যন্ত্র থেকে আসে সংকেতগুলো।
- তাই বলো! যন্ত্রগুলো কারা বানিয়েছে? তাদের সাথেই না আমাদের যোগাযোগ করার কথা!
- আরে ওরাই বানিয়েছে যন্ত্র। এ কথাটাই তো তোমাকে বলার চেষ্টা করছি এতক্ষণ ধরে, মাংসরাই যন্ত্র বানিয়েছে!
- হাস্যকর! মাংস কেমন করে যন্ত্র বানাতে পারবে? আমাকে বুদ্ধিমান মাংসে বিশ্বাস করতে অনুরোধ করছো বুঝি!
- অনুরোধ করবো কেন, জানাচ্ছি বরং তোমাকে। মহাকাশের এই অংশে থাকা একমাত্র বুদ্ধিমান জাতি এরা, তার ওপর আবার মাংসের তৈরি!
- আচ্ছা-মনে হচ্ছে এরা ওরফোলেইদের মতো কিছু; ঐ যে, কার্বনভিত্তিক যেই বুদ্ধিমান প্রাণগুলো জীবনচক্রের একটা সময়ে মাংসল পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যায়।
- না না! এরা মাংস হয়েই জন্মায়, মাংস অবস্থাতেই মারা যায়। এদের বেশ কিছু প্রজন্মের ওপর নজর রেখেছি আমরা, আয়ু কম বলে খুব বেশি সময় লাগেনি তাতে। তোমার কোনো ধারণা আছে মাংসের আয়ুষ্কাল কেমন হতে পারে সে ব্যাপারে?
- মাফ চাই! আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, যে ওরা আধ-মাংসল ওয়েডিলেইদের মতো? ঐ যে যাদের মাংসল মাথার ভেতর ইলেকট্রন প্লাজমার মগজ থাকে?
- উঁহু, অমন মনে হয়েছিলো আমাদেরও শুরুতে, মাংসের তৈরি মাথাগুলো দেখে। কিন্তু বললামই তো, গবেষণা হয়েছে ওদের ওপর, পুরোটাই মাংস।
- কী?! কোনো মগজই নেই বলছো?
- আরে না, মগজ তো আছেই একটা যথাস্থানে! কিন্তু সেই মগজও মাংসের তৈরি। এই কথাটাই তো বারবার করে বলতে চাইছি আমি!

- হুমম-চিন্তাটা করে কোথায় তাহলে ভাবছি।
- তুমি আসলে বুঝতেই পারোনি কিছু, তাই না? আমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবতেই চাইছো না তুমি। আরে মাংসল মগজটাই তো চিন্তা করে সব, মাংসটাই চিন্তা করে!
- চিন্তাশীল মাংস! তুমি আমাকে চিন্তাশীল মাংসে বিশ্বাস করতে বলছো!
- হ্যাঁ চিন্তাশীল মাংস! সচেতন মাংস। প্রেমময় মাংস। স্বপ্নবাজ মাংস। মাংসই সবকিছু! তুমি কি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারছো এখন, নাকি আমি আবার প্রথম থেকে শুরু করবো?
- হায় খোদা! তুমি কৌতুক করছো না তাহলে? আসলেই মাংসের তৈরি ওরা!
- ধন্যবাদ, অবশেষে! হ্যাঁ, ওরা নিশ্চিত মাংসের তৈরি। আর ওদের হিসেবে, প্রায় এক শ’ বছর ধরে আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে ওরা।
- হায় খোদা! মাংসগুলো চায়টা কী বলো তো!
- শুরুতে আমাদের সাথে কথা বলতে চায় এরা। তারপর আমার ধারণা, মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে, অন্য সব বুদ্ধিমান প্রাণের সাথে যোগাযোগ করতে আর চিন্তা, তথ্য বিনিময় করতে চাইবে-অন্যরা যেমনটা চায় আর কি!
- আমাদেরকে তাহলে মাংসের সাথে কথা বলতে হবে!
- ব্যাপার তো সেটাই, বেতারে এই বার্তাটাই পাঠাচ্ছে ওরা। ‘হ্যালো! কেউ কি আছো? বাড়ি আছো কেউ?’-এ ধরনের কথাবার্তা।
- তারা আসলেই কথা বলতে পারে তাহলে? শব্দ, ভাবনা, ধারণা এসব ব্যবহার করে কথা বলে?
- সেটাই করে, কেবল কাজটা সাধিত হয় মাংসের সাহায্য নিয়ে, এই যাঃ!
- মাত্রই না বললে বেতার ব্যবহার করে ওরা?
- করে তো, কিন্তু বেতারে কী থাকে বলে তোমার ধারণা? মাংসের শব্দ থাকে! মাংসে চাপড় দিলে কিংবা কোথাও মাংস দিয়ে বাড়ি দিলে কেমন একটা শব্দ হয় না, জানো তো? ওরাও ওদের মাংস একটা আরেকটার সাথে বাড়ি দিয়ে কথা বলে, এমন কি মাংসের ফাঁকে বাতাস ছুঁড়ে গানও গাইতে পারে!
- হায় খোদা! গায়ক মাংস? ব্যাপারটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আসলে। এখন তোমার পরামর্শ কী, কী করবো আমরা?
- আনুষ্ঠানিক পরামর্শ, নাকি অনানুষ্ঠানিক?

- দুটোই।
- আনুষ্ঠানিকভাবে, কোনোরকম কুসংস্কার, ভয় কিংবা পক্ষপাত ছাড়াই আমাদের উচিত যে কোনো এবং সব বুদ্ধিমান জাতি আর বহুসত্ত্বার সাথে যোগাযোগ করা, তাদেরকে স্বাগত জানানো ও মহাকাশের এই চতুর্থাংশে প্রবেশ করতে দেওয়া। অনানুষ্ঠানিকভাবে আমি বলবো, ওদের খোঁজ পাওয়ার সব প্রমাণ মুছে ফেলে পুরো ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়া।
- আমার মনে হচ্ছিলো তুমি এমন কিছু বলবে।
- শুনতে রুক্ষ লাগছে জানি, কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে, তাই না? আমরা কি আসলেও কোনো মাংসের সাথে যোগাযোগ করতে চাই?
- তোমার সাথে শতভাগ একমত আমি। ওদের সাথে বলার মতো কী কথা আছে বলো? ‘হ্যালো, মাংস! কেমন চলছে দিনকাল?’ কিন্তু এতে কি কাজ হবে কোনো? আচ্ছা, ওদের এরকম গ্রহ ক’টা আছে বলো দেখি?
- একটাই কেবল। অন্য গ্রহগুলোতে ওরা বিশেষ মাংসবাহী যানে চেপে যেতে পারে, তবে সেখানে বাস করতে পারে না। তাছাড়া মাংস হওয়ার কারণে শুধু মহাকাশের সি-অংশেই ওদের বিচরণ, আর তাই আলোর গতিকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না, আমাদের সাথে পরে যে আবার যোগাযোগ করতে পারবে সে সম্ভাবনাও তাই ক্ষীণ; ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সম্ভাবনা আছে বলতে পারো।
- তাহলে আমরা ভান করবো যেনো মহাকাশে এমন কোনো বসতি নেই, তাই তো?
- সেটাই বলছি আমি।
- কী নিষ্ঠুর! কিন্তু তোমার ঐ কথাটাও ঠিক, কে-ই বা মাংসের সাথে দেখা করতে, কথা বলতে চায়? তবে আমাদের যানে যাদেরকে তুলে নিয়েছি পরীক্ষা করার জন্য, তাদের কী হবে? ওদের যে পরে কিছু মনে পড়বে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত তুমি?
- মনে পড়লে ওদেরকে পাগল বলবে অন্য মাংসেরা। আমরা ওদের মাথার ভেতর ঢুকে মিলিয়ে দিয়ে এসেছি সবকিছু, যেন আমাদেরকে কেবল স্বপ্ন বলেই মনে হয় পরে।
- মাংসের স্বপ্ন! কী আশ্চর্য অথচ বাস্তব একটা ব্যাপার, আমরা তবে মাংসের স্বপ্ন হতে যাচ্ছি!
- আর পুরো গ্রহটাকে প্রাণহীন হিসেবে চিহ্নিতও করে দিয়েছি আমরা মানচিত্রে।
- ভালো করেছো। রাজি আমি এই সিদ্ধান্তে, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক দু’ভাবেই। মামলা ডিসমিস! আর কেউ? ছায়াপথের ঐ প্রান্তে আগ্রহী কেউ আছে?
- হ্যাঁ, জি৪৪৫ এলাকার নবম শ্রেণীর একটা তারায় একটু লাজুক কিন্তু মিষ্টি এক হাইড্রোজেন কোর ক্লাস্টার বুদ্ধিমান প্রাণ আছে। দুই ছায়াঘূর্ণন আগে দেখা হয়েছিলো একবার এর সাথে, আবারও বন্ধু হতে চাইছে।

- বারবারই ফিরে আসে ওরা, তাই না?
- কেন আসবে না বলো? এই মহাকাশে কাউকে একলা থাকতে হলে তার জন্য এটা কেমন এক অসহ্য, অবর্ণনীয় কঠিন জায়গা হতো চিন্তা করো।
.......................................................................................................

[টেরি বিসন (Terry Bisson)। পুরো নাম টেরি ব্যালান্টাইন বিসন। ১৯৪২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার কেন্টাকিতে জন্ম। আমেরিকান কল্প গল্প লেখক বিসন ১৯৮১ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে লিখে চলেছেন। বিসন বেশি পরিচিত তার ছোটগল্পগুলোর কারণেই। হিউগো, নেবুলার মতো বিজ্ঞান কল্প জগতের সেরা পদকগুলো ইতোমধ্যেই জমা পড়েছে তার ঝুলিতে। মাংস গল্পটি তার ‘দে আর মেইড আউট অব মিট’ গল্পের বাংলা রূপ।  - অনুবাদক]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন