সোমবার, ৩ মার্চ, ২০১৪
প্রাসঙ্গিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক বচন...
প্রাসঙ্গিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক বচন...
গল্পের রাজাদের কত আজগুবি খেয়াল থাকে। ছেলেবেলায় পড়া গল্পের সে রাজার মাথায়ও তেমনই এক খেয়াল চাপলো। না, হাতি ঘোড়া-পোষার খেয়াল নয়। সকলের চোখ কপালে তুলে না দিতে পারলে কীসের রাজা আর কীসের খেয়াল! রাজার মাথায় খেয়াল চাপলো আলসে পোষার। দেশের সেরা আলসে লোকগুলোকে একখানে এনে খাইয়ে দাইয়ে রাখতে পারলে তবেই না অন্য রাজাদের সাথে ‘দেমাগ’ দেখানো যাবে!
রাজার খেয়াল বলে কথা! সাথে সাথে রাজবাড়ির সামনে তৈরি হলো এক বিশাল আলসেখানা। সেই আলসেখানায় ঠাঁই হলো হরেক কিসিমের আলসে লোকের। কেবল আলসেরাই নয় রাজ্যের সকল লোকই বিনে পয়সায় থাকা খাওয়ার সুযোগ নিতে আলসে সেজে জড়ো হতে লাগলো সেখানে। রাজা তো মহা মুশকিলে পড়লেন। এদের খাবার-দাবার যোগাড়ে তহবিলে টান পড়তে শুরু করলো। উপায় না দেখে উজিরের সাথে পরামর্শ করলেন। উজিরের পরামর্শে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলো আলসেখানায়। উজিরের যুক্তি, এতে নকল আলসেরা পালিয়ে যাবে। হলোও তাই। আলসেখানায় আগুন লাগামাত্র দুদ্দাড় করে নকল আলসেরা পালিয়ে গেলো। কেবল দুই আলসে তখনও ঘুমিয়ে। ঘর জ্বলতে জ্বলতে আগুন তখন তাদের পিঠের কাছে। তখনই কেবল ঘুমের রেশ ভাঙে তাদের।
রাজার আলসেখানায় সব শেষে দুজনের বেশি আলসে লোক মেলেনি। তবে ভাগ্যিস একালের আমাদের নাগাল পাননি কল্পকথার সে রাজা। আমাদের নাগাল পেলে ফতুর বোধহয় তাকে হতেই হতো। আমাদের ঘুম যে আগুনে ঘর পুড়ে গেলেও ভাঙে না। সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আমরা চোখ মেলতে রাজি নই। আর সব চুলোয় যাক, নিজেরা যে বেঁচে আছি এই ঢের।
নিজেদের নিয়ে এই বেঁচে থাকার আসলেই কি কোনো মানে আছে?
পুনঃপাঠ >> রাণুর প্রথম ভাগ : বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
রাণুর প্রথম ভাগ
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
আমার ভাইঝি রাণুর প্রথমভাগের গণ্ডি পার হওয়া আর হইয়া উঠিল না। তাহার সহস্রবিধ অন্তরায়ের মধ্যে দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, -এক তাহার প্রকৃতিগত অকালপক্ব গিন্নীপনা; আর অন্যটি তাহার আকাশচুম্বী উচ্চাকাক্সক্ষা। তাহার দৈনিক জীবনপ্রণালী লক্ষ্য করিলে মনে হয়, বিধাতা যদি তাহাকে একেবারে তাহার ঠাকুরমার মত প্রবীণা গৃহিণী এবং কাকার মত এম.এ, বি এল. করিয়া পাঠাইতেন, তাহা হইলে তাহাকে মানাইতও ভাল এবং সেও সন্তুষ্ট থাকিত। তাহার ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর পরবর্তী ভাবী নারীত্ব হঠাৎ কেমন করিয়া ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর পূর্বে আসিয়া পড়িয়া তাহার ক্ষুদ্র শরীর-মনটিতে আর আঁটিয়া উঠিতেছে না-রাণুর কার্যকলাপ দেখিলে এই রকমই একটা ধারণা মনে উপস্থিত হয়। প্রথমত, শিশুসুলভ সমস্ত ব্যাপারেই তাহার ক্ষুদ্র নাসিকাটি তাচ্ছিল্যে কুঞ্চিত হইয়া উঠে-খেলাঘর সে মোটেই বরদাস্ত করিতে পারে না, ফ্রক-জামাও না, এমন কি নোলক পরাও নয়। মুখটা গম্ভীর করিয়া বলে, ‘আমার কি আর ওসবের বয়েস আছে মেজকা?’
বলিতে হয়, ‘না মা, আর কি-তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকল।’
রাণু চতুর্থ কালের কাল্পনিক দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় মুখটা অন্ধকার করিয়া বসিয়া থাকে। আর দ্বিতীয়ত-কতকটা বোধ হয় শৈশবের সহিত সম্পর্কিত বলিয়াই-তাহার ঘোরতর বিতৃষ্ণা প্রথম ভাগে। দ্বিতীয় ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার কাকার আইন-পুস্তক পর্যন্ত আর সবগুলির সহিতই তাহার বেশ সৌহার্দ্য আছে, এবং তাহাদের সহিতই তাহার দৈনিক জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়া যায় বটে, কিন্তু প্রথম ভাগের নামেই সমস্ত উৎসাহ একেবারে শিথিল হইয়া আসে। বেচারীর মলিন মুখখানি ভাবিয়া মাঝে মাঝে আমি এলাকাড়ি দিই-মনে করি, যাকগে বাপু, মেয়ে-নাই বা এখন থেকে বই স্লেট নিয়ে মুখ গুঁজড়ে রইল, ছেলে হওয়ার পাপটা তো করে নি! নেহাতই দরকার বোধ করা যায়, আর একটু বড় হোক তখন দেখা যাবে’খন। এই রকমে দিনগুলো রাণুর বেশ যায়; তাহার গিন্নীপনা সতেজে চলিতে থাকে এবং পড়াশুনারও বিষম ধুম পড়িয়া যায়। বাড়ির নানা স্থানের অনেক সব বই হঠাৎ স্থানভ্রষ্ট হইয়া কোথায় যে অদৃশ্য হয়, তাহার খোঁজ দুরূহ হইয়া উঠে এবং উপরের ঘর নীচের ঘর হইতে সময়-অসময়ে রাণুর উঁচু গলায় পড়ার আওয়াজ আসিতে থাকে-ঐ ক-য়ে য-ফলা ঐক্য, ম-য়ে আকার ণ-য়ে হস্বই ক-য়ে য-ফলা মাণিক্য, বা পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল, অথবা তাহার রাঙা কাকার আইন মুখস্থ করার ঢঙে- হোয়ার অ্যাজ ইট ইজ, ইত্যাদি। আমার লাগে ভাল, কিন্তু রাণুর স্বাভাবিক স্ফূর্তির এইরকম দিনগুলো বেশীদিন স্থায়ী হইতে পারে না। ভাল লাগে বলিয়াই আমার মতির হঠাৎ পরিবর্তন হইয়া যায় এবং কর্তব্য জ্ঞানটা সমস্ত লঘুতাকে ভ্রুভঙ্গী করিয়া প্রবীণ গুরুমহাশয়ের বেশে আমার মধ্যে জাঁকিয়া বসে। সনাতন যুক্তির সাহায্যে হৃদয়ের সমস্ত দুর্বলতা নিরাকরণ করিয়া গুরুগম্ভীর স্বরে ডাক দিই, ‘রাণু!’ রাণু এ স্বরটি বিলক্ষণ চেনে; উত্তর দেয় না। মুখটি কাঁদ-কাঁদ করিয়া নিতান্ত অসহায় ভালমানুষের মত ধীরে ধীরে আসিয়া মাথা নীচু করিয়া দাঁড়ায়, আমার আওয়াজটা তাহার গলায় যেন একটা ফাঁস পরাইয়া টানিয়া আনিয়াছে। আমি কর্তব্যবোধে আরও কড়া হইয়া উঠি; সংক্ষেপে বলি, ‘প্রথম ভাগ! যাও।’
ইহার পরে প্রতি বারই যদি নির্বিবাদে প্রথম ভাগটি আসিয়া পড়িত এবং যেন-তেন-প্রকারের দুইটা শব্দও গিলাইয়া দেওয়া যাইত তো হাতেখড়ি হওয়া ইস্তক এই যে আড়াইটা বৎসর গেল, ইহার মধ্যে মেয়েটা যে প্রথম ভাগের ও-কয়টা পাতা শেষ করিতে পারিত না, এমন নয়। কিন্তু আমার হুকুমটা ঠিকমত তামিল না হইয়া কতকগুলা জটিল ব্যাপারের সৃষ্টি করে মাত্র- যেমন, এরূপ ক্ষেত্রে কোন কোন বার দুই-তিন দিন পর্যন্ত রাণুর টিকিটি আর দেখা যায় না। সে যে কোথায় গেল, কখন আহার করিল, কোথায় শয়ন করিল, তাহার একটা সঠিক খবর পাওয়া যায় না। দু-তিন দিন পরে হঠাৎ যখন নজরে পড়িল, তখন হয়তো সে তাহার ঠাকুরদাদার সঙ্গে চায়ের আয়োজনে মাতিয়া গিয়াছে, কিংবা তাঁহার সামনে প্রথম ভাগটাই খুলিয়া রাখিয়া তাহার কাকাদের পড়ার খরচ পাঠানো কিংবা আহার্যদ্রব্যের বর্তমান দুর্মূল্যতা প্রভৃতি সংসারের কোন একটা দুরূহ বিষয় লইয়া প্রবল বেগে জ্যাঠামি করিয়া যাইতেছে, অথবা তাঁহার বাগানের যোগাড়যন্ত্রের দক্ষিণহস্ত-স্বরূপ হইয়া সব বিষয়ে নিজের মন্তব্য দিতে দিতে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমার দিকে হয়তো একটু আড়চোখে চাহিল; বিশেষ কোন ভয় বা উদ্বেগ নাই-জানে, এমন দুর্ভেদ্য দুর্গের মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে, যেখানে সে কিছুকাল সম্পূর্ণ নির্বিঘœ।
আমি হয়তো বলিলাম, ‘কই রাণু, তোমায় না তিন দিন হল বই আনতে বলা হয়েছিল?’ সে আমার দিকে না চাহিয়া বাবার দিকে চায়, এবং তিনিই উত্তর দেন, ‘ওহে, সে একটা মহা মুশকিল ব্যাপার হয়েছে, ও বইটা যে কোথায় ফেলেছে-’
রাণু চাপা স্বরে শুধরাইয়া দেয়, ‘ফেলিনি-বল, কে যে চুরি করে নিয়েছে-’
‘হ্যাঁ, কে যে চুরি করে নিয়েছে, বেচারী অনেকক্ষণ খুঁজেও-’
রাণু যোগাইয়া দেয়, ‘তিন দিন খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েও-’
‘হ্যাঁ, তোমার গিয়ে, তিন দিন হয়রান হয়েও, শেষে না পেয়ে হাল ছেড়ে-’
রাণু ফিসফিস করিয়া বলিয়া দেয়, ‘হাল ছাড়ি নি এখনও।’
‘হ্যা, ওর নাম কি, হাল না ছেড়ে ক্রমাগত খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যা হোক, একখানা বই আজ এনে দিও, কতই বা দাম!’
রাগ করে বলি, ‘তুই বুঝি এই কাটারী হাতে করে বাগানে বাগানে বই খুঁজে বেড়াচ্ছিস? লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে!’
কাতরভাবে বাবা বলেন, ‘আহা, ওকে আর সামান্য ব্যাপারের জন্যে গালমন্দ করা কেন? এবার থেকে ঠিক করে রাখবে তো গিন্নী?’
রাণু খুব ঝুঁকাইয়া ঘাড় নাড়ে। আমি ফিরিয়া আসিতে আসিতে শুনিতে পাই, ‘তোমায় অত করে শেখাই, তবু একটুও মনে থাকে না দাদু। কি যেন হচ্ছ দিন দিন!’
কখনও কখনও হুকুম করিবার খানিক পরেই বইটার আধখানা আনিয়া হাজির করিয়া সে খোকার উপর প্রবল তম্বি আরম্ভ করিয়া দেয়। তম্বিটা আসলে আরম্ভ হয় আমাকেই ঠেস দিয়া, ‘তোমার আদুরে ভাইপোর কাজ দেখ মেজকা। লোকে আর পড়াশুনা করবে কোথা থেকে?’ আমি বুঝি, কাহার কাজ। কটমট করিয়া চাহিয়া থাকি।
দুষ্টু ছুটিয়া গিয়া বমালসুদ্ধ খোকাকে হাজির করে-সে বোধ হয় তখন একখানা পাতা মুখে পুরিয়াছে এবং বাকিগুলো কি করিলে সবচেয়ে সদগতি হয়, সেই সম্বন্ধে গবেষণা করিতেছে। তাহাকে আমার সামনে ধপ করিয়া বসাইয়া রাণু রাগ দেখাইয়া বলে, ‘পেত্যয় না যাও দেখ। আচ্ছা, এ ছেলের কখনও বিদ্যা হবে মেজকা?’
আমি তখন হয়তো বলি, ‘ওর কাজ, না তুমি নিজে ছিঁড়েছ রাণু? ঠিক আগেকার পাঁচখানা পাতা ছেঁড়া-যত বলি, তোমায় কিচ্ছু বলব না-খান তিরিশেক বই তো শেষ হল!’
ধরা পড়িয়া লজ্জা-ভয়-অপমানে নিশ্চল নির্বাক হইয়া এমন ভাবে দাঁড়াইয়া থাকে যে, নেহাত নৃশংস না হলেই উহার উপর আর কিছু তাহাকে বলা যায় না, তখনকার মত শাস্তির কথা ভুলিয়া তাহার মনের গ্লানিটুকু মুছাইয়া দিবার জন্য আমার বলিতেই হয়, ‘হ্যাঁ রে দুষ্টু, দিদির বই ছিঁড়ে দিয়েছিস? আর তুমি ও তো ওকে একটু-আধটু শাসন করবে রাণু? ওর আর কতটুকু বুদ্ধি বল!’
চাঁদ মুখখানি হইতে মেঘটা সরিয়া গিয়া হাসি ফোটে। তখন আমাদের দুইজনের মধ্য হইতে প্রথম ভাগের ব্যবধানটা একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং রাণু দিব্য সহজভাবে তাহার গিন্নীপনার ভূমিকা আরম্ভ করিয়া দেয়। এই সময়টা সে হঠাৎ এত বড় হইয়া যায় যে, ছোট ভাইটি হইতে আরম্ভ করিয়া বাপ, খুড়া, ঠাকুরমা, এমন কি ঠাকুরদাদা পর্যন্ত সবাই তাহার কাছে নিতান্ত ক্ষুদ্র এবং স্নেহ ও করুণার পাত্র হইয়া পড়ে। এই রকম একটি প্রথম ভাগ ছেঁড়ার দিনে কথাটা এইভাবে আরম্ভ হইল-‘কি করে শাসন করব বল মেজকা? আমার কি নিশ্বেস ফেলবার সময় আছে, খালি কাজ-কাজ-আর কাজ।’
হাসি পাইলেও গম্ভীর হইয়া বলিলাম, ‘তা বটে, কতদিকে আর দেখবে?’
‘যে দিকটা না দেখেছি সেই দিকেই গোল-এই তো খোকার কাণ্ড চোখেই দেখলে! কেন রে বাপু, রাণু ছাড়া আর বাড়িতে কেউ নেই? খাবার বেলা তো অনেকগুলি মুখ; বল মেজকা! আচ্ছা, কাল তোমার ঝাল-তরকারিতে নুন ছিল?’
বলিলাম, ‘না, একেবারে মুখে দিতে পারি নি।’
‘তার হেতু হচ্ছে, রাণু কাল রান্নাঘরে যেতে পারে নি- ফুরসৎ ছিল না। এই তো সবার রান্নার ছিরি। আজ আর সে রকম কম হবে না, আমি নিজের হাতে দিয়ে এসেছি নুন।’ আমার শখের ঝাল-তরকারি খাওয়া সম্বন্ধে নিরাশ হইয়া মনের দুঃখ মনে চাপিয়া বলিলাম,
‘তুমি যদি রোজ একবার করে দেখ মা-’
গাল দুইটি অভিমানে ভারী হইয়া উঠিল। -‘হবার জো নেই মেজকা, রাণু হয়েছে বাড়ির আতঙ্ক। ‘ওরে, ওই বুঝি রাণু ভাঁড়ার ঘরে ঢুকছে-রাণু বুঝি মেয়েটাকে টেনে দুধ খাওয়াতে বসেছে, দেখ দেখ-তোকে কে এত গিন্নীত্ব করতে বললে বাপু? হ্যাঁ মেজকা, এত বড়টা হলুম, দেখেছ কখনও আমায় গিন্নীত্ব করতে-ক-খ-নও- একরত্তিও?’
বলিলাম, ‘বলে দিলেই হল একটা কথা, ওদের আর কি।’
‘মুখটি বুজে শুনে যাই। একজন হয়তো বললেন, ‘ওই বুঝি রাণু রান্নাঘরে সেঁধোল!’ রাঙী বেড়ালটা বলে আমি পদে আছি। কেউ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওরে রাণু বুঝি ওর বাপের’ আচ্ছা মেজকা, বাবার ফুলদানিটা আমি ভেঙেছি বলে তোমার একটুও বিশ্বাস হয়?
এ ঘটনাটা সবচেয়ে নূতন; গিন্নীপনা করিয়া জল বদলাইতে গিয়া রাণুই ফুলদানিটা চুরমার করিয়া দিয়াছে, ঘরে আর দ্বিতীয় কেহ ছিল না। আমি বলিলাম, ‘কই আমি তো মরে গেলেও এ কথা বিশ্বাস করতে পারি না।’
ঠোঁট ফুলাইয়া রাণু বলিল, ‘যার ঘটে একটুও বুদ্ধি আছে, সে করবে না। আমার কি দরকার মেজকা, ফুলদানিতে হাত দেবার? কেন, আমার নিজের পেরথোম ভাগ কি ছিল না যে, বাবার ফুলদানি ঘাঁটতে যাব?’
প্রথম ভাগের উপর দরদ দেখিয়া ভয়ানক হাসি পাইল, চাপিয়া রাখিয়া বলিলাম, ‘মিছিমিছি দোষ দেওয়া ওদের কেমন একটা রোগ হয়ে পড়েছে।
দুষ্টু একটু মুখ নীচু করিয়া রহিল, তাহার পর সুবিধা পাইয়া তাহার সদ্য দোষটুকু সম্পূর্ণরূপে স্খলন করিয়া লইবার জন্য আমার কোলে মুখ গুঁজিয়া আরও অভিমানের সুরে আস্তে আস্তে বলিল, ‘তোমারও এ রোগটা একটু একটু আছে মেজকা, - এক্ষুণি বলছিলে, আমি পেরথোম ভাগটা ছিঁড়ে এনেছি।’
মেয়ের কাছে হারিয়া গিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার কেশের মধ্যে অঙ্গুলি সঞ্চালন করিতে লাগিলাম।
বই হারানো কি ছেঁড়া, পেট-কামড়ানো, মাথা-ব্যথা, খোকাকে ধরা প্রভৃতি ব্যাপারগুলো যখন অনেক দিন তাহাকে বাঁচাইবার পর নিতান্ত একঘেয়ে এবং শক্তিহীন হইয়া পড়ে, তখন দুই-এক দিনের জন্য নেহাত বাধ্য হইয়াই রাণু বই স্লেট লইয়া হাজির হয়। অবশ্য পড়াশুনার কিছুই হয় না। প্রথমে গল্প জমাইবার চেষ্টা করে। সংসারের উপর কোনো কিছুর জন্য মনটা খিঁচড়াইয়া থাকায় কিংবা অন্য কোন কারণে যদি সকলের নিজ নিজ কর্তব্য সম্বন্ধে আমার মনটা বেশি সজাগ থাকে তো ধমক খাইয়া বই খোলে; তাহার পর পড়া আরম্ভ হয়। সেটা রাণুর পাঠাভ্যাস, কি আমার ধৈর্য, বাৎসল্য, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সদগুণের পরীক্ষা তাহা স্থির করিয়া বলা কঠিন। আড়াইটি বৎসর গিয়াছে, ইহার মধ্যে রাণু ‘আজ-আম’র পাতা শেষ করিয়া ‘অচল-অধম’র পাতায় আসিয়া অচলা হইয়া আছে। বই খুলিয়া আমার দিকে চায়-অর্থাৎ বলিয়া দিতে হইবে। আমি প্রায়ই পড়াশুনার অত্যাবশকতা সম্বন্ধে একটি ক্ষুদ্র উপদেশ দিয়া আরম্ভ করি, ‘আচ্ছা রাণু, যদি পড়াশনা না কর তো বিয়ে হলেই যখন শুশুরবাড়ি চলে যাবে- মেজকাকা কি রকম আছে, তাকে কেউ সকালবেলা চা দিয়ে যায় কি না, নাইবার সময় তেল কাপড় গামছা দিয়ে যায় কি না, অসুখ হলে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কি না-এসব কি করে খোঁজ নেবে?
রাণু তাহার মেজকাকার ভাবী দুর্দশার কথা কল্পনা করিয়া মৌন থাকে, কিন্তু বোধ হয় প্রথম ভাগ-পারাবার পার হইবার কোন সম্ভাবনাই না দেখিয়া বলে, ‘আচ্ছা মেজকা, একেবারে দ্বিতীয় ভাগ পড়লে হয় না? আমায় একটুও বলে দিতে হবে না। এই শোন না-ঐ ক-এ-য-ফলা-’ রাগিয়া বলি, ‘ওই ডেঁপোমি ছাড় দিকিন, ওইজন্যেই তোমার কিছু হয় না। নাও, পড়। সেদিন কত দূর হয়েছিল? ‘অচল’ ‘অধম’ শেষ করেছিলে?’
রাণু নি®প্রভভাবে ঘাড় নাড়িয়া জানায়, ‘হ্যাঁ।’
বলি, ‘পড় তা হলে একবার।’
‘অচল’ কথাটির উপর কচি আঙ্গুলটি দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। আমার মাথার রক্ত গরম হইয়া উঠিতে থাকে এবং ¯েœহ, করুণা প্রভৃতি ¯িœগ্ধ চিত্তপ্রবৃত্তিগুলো বাষ্প হইয়া উড়িয়া যাইবার উপক্রম হয়। মেজাজেরই বা আর দোষ দিই কি করিয়া? আজ এক বৎসর ধরিয়া এই ‘অচল’ ‘অধম’ লইয়া কসরৎ চলিতেছে, এখনও রোজই এই অবস্থা।
তবুও ক্রোধ দমন করিয়া গম্ভীরভাবে বলি,‘ছাই হয়েছে। আচ্ছা, বল-অ-চ-আর ল- অচল।’
রাণু অ-র উপর হইতে আঙ্গুলটা না সরাইয়া তিনটি অক্ষর পড়িয়া যায়। ‘অধম’ ও ওই ভাবেই শেষ হয়; অথচ ঝাড়া দেড়টি বৎসর শুধু অক্ষর চেনায় গিয়েছিল!
তখন জিজ্ঞাসা করিতে হয়, ‘কোনটা অ?’
রাণু ভীতভাবে আমার দিকে চাহিয়া আঙ্গুলটি সরাইয়া ল-এর উপর রাখে।
ধৈর্যের সূত্রটা তখনও ধরিয়া থাকি, বলি, ‘হুঁ, কোনটা ল হল তা হলে?
আঙ্গুলটা সট করিয়া চ-এর উপর সরিয়া যায়। ধৈর্যসাধনা তখনও চলিতে থাকে, শান্তকণ্ঠে বলি ‘চমৎকার! আর চ?’
খানিকক্ষণ স্থিরভাবে বইয়ের দিকে চাহিয়া থাকে, তার পর বলে, ‘চ? চ নেই মেজকা!’ সংযত রাগটা অত্যন্ত উগ্রভাবেই বাহির হইয়া পড়ে, পিঠে চাপড় কষাইয়া বলি, ‘তা থাকবে কেন? তোমার ডেঁপোমি দেখে চম্পট দিয়েছে। হতভাগা মেয়ে-রাজ্যের কথার জাহাজ হয়েছেন, আর এদিকে আড়াই বৎসর প্রথম ভাগের আড়াইটে কথা শেষ করতে পারলে না। কত বুড়ো বুড়ো গাধা ঠেঙিয়ে পাস করিয়ে দিলাম, আর এই একরত্তি মেয়ের কাছে আমার হার মানতে হল! কাজ নেই আর তোর অক্ষর চিনে। সন্ধ্যে পর্যন্ত বসে বসে খালি অ-চ-আর ল- অচল; অ-ধ-আর-ম অধম এই আওড়াবি। তোর সমস্ত দিন খাওয়া বন্ধ।’ বিরক্তভাবে একটা খবরের কাগজ কিংবা বই লইয়া বসিয়া যাই; রাণু ক্রন্দনের সহিত সুর মিশাইয়া পড়া বলিয়া যায়।
বলি বটে, সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়িতে হইবে; কিন্তু চড়টা বসাইয়াই নিশ্চিন্ত হইয়া যাই যে, সেদিনকার পড়া ওই পর্যন্ত। রাণু এতক্ষণ চক্ষের জলের ভরসাতেই থাকে আওয়াজ পাই না; বলি, ‘কি হল?’
রাণু ক্রন্দনের স্বরে উত্তর করে, ‘নেই’।
‘কি নেই?’-বলিয়া ফিরিয়া দেখি, চক্ষের জল ‘অচল-অধম’র উপর ফেলিয়া আঙুল দিয়া ঘষিয়া ঘষিয়া কথা দুইটা বিলকুল উড়াইয়া দিয়াছে-একেবারে নীচের দুই-তিনখানা পাতার খানিকটা পর্যন্ত।
কিংবা আঙুলের ডগায় চোখের ভিজা কাজল লইয়া কথা দুইটিকে চিরান্ধকারে ডুবাইয়া দিয়াছে; এইরূপ অবস্থাতে বলে, ‘আর দেখতে পাচ্ছি না, মেজকা।’ -এই রকম আরও সব কা-। চড়টা মারা পর্যন্ত মনটা খারাপ হইয়া থাকে, তাহা ভিন্ন ওর ধূর্তামি দেখিয়া হাসিও পায়। মেয়েদের পড়াশুনা সম্বন্ধে আমার থিওরিটা ফিরিয়া আসে, বলি, ‘না, তোর আর পড়াশুনা হল না রাণু; স্লেটটা নিয়ে আয় দিকিন-দেগে দিই, বুলো। পিঠটায় লেগেছে বেশি? দেখি?’ রাণু বুঝিতে পারে, তাহার জয় আরম্ভ হইয়াছে, এখন তাহার সব কথাই চলিবে। আমার কাঁধটা জড়াইয়া আস্তে আস্তে ডাকে, ‘মেজকা!’
উত্তর দিই, ‘কি?’
‘আমি, মেজকা, বড় হই নি?’
‘তা তো খুব হয়েছ। কিন্তু, বড়র মতন-’
বাধা দিয়া বলে, ‘তা হলে স্লেট ছেড়ে ছোটকাকার মত কাগজ-পেন্সিল নিয়ে আসব? চারটে উটপেন্সিল আছে আমার। স্লেটে খোকা বড় হয়ে লিখবে’খন।’ হঠাৎ শিহরিয়া উঠিয়া বলে, ‘ও মেজকা, তোমার দুটো পাকা চুল গো! সর্বনাশ! বেছে দিই?’
বলি, ‘দাও। আচ্ছা রাণু, এই তো বুড়ো হতে চললাম, তুইও দুদিন পরে শ্বশুরবাড়ি চলবি। লেখাপড়া শিখলি নি, মরলাম কি বাঁচলাম, কি করে খোঁজ নিবি, আমায় কেউ দেখে শোনে কি না, রেঁধে-টেঁধে দেয় কি না-
রাণু বলে, ‘পড়তে তো জানি মেজকা, খালি পেরথোম ভাগটাই জানি না, বড় হয়েছি কিনা। বাড়ির আর কোন লোকটা পেরথোম ভাগ পড়ে মেজকা, দেখাও তো!’
দাদা ওদিকে ধর্ম সম্বন্ধে খুব লিবারেল মতের লোক ছিলেন, অর্থাৎ হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞতাটা যেমন গভীর করিয়া রাখিয়াছিলেন, খ্রীষ্ট এবং কবেকার জরাজীর্ণ জুরুয়াস্ত্রিয়ানবাদ সম্বন্ধে জ্ঞানটা সেইরূপ উচ্চ ছিল। দরকার হইলে বাইবেল হইতে সুদীর্ঘ কোটেশন তুলিয়া সকলকে চমৎকৃত করিয়া দিতে পারিতেন এবং দরকার না হইলেও যখন একধার হইতে সমস্ত ধর্মমত সম্বন্ধে সুতীব্র সমালোচনা করিয়া ধর্মমতমাত্রেরই অসারতা সম্বন্ধে অধার্মিক ভাষার ভূরি ভূরি প্রমাণ দিয়া যাইতেন, তখন ভক্তদের বলিতে হইত, ‘হ্যাঁ এখানে খাতির চলবে না বাবা, এ যার নাম শশাঙ্ক মুখুজ্জে!’
দাদা বলিতেন, ‘না, গোঁড়ামিকে আমি প্রশ্রয় দিতে মোটেই রাজী নই।’
প্রায় সব ধর্মবাদকেই তিনি ‘গোঁড়ামি’ নামে অভিহিত করিতেন এবং গালাগাল না দেওয়াকে কহিতেন ‘প্রশ্রয় দেওয়া।’
সেই দাদা এখন একেবারে অন্য মানুষ। ত্রিসন্ধ্যা না করিয়া জল খান না এবং জলের অতিরিক্ত যে বেশি কিছু খান বলিয়াই বোধ হয় না। পূজা পাঠ হোম লইয়াই আছেন এবং বাক ও কর্মে শুচিতা সম্বন্ধে এমন একটা ‘গেল গেল’ ভাব যে, আমাদের তো প্রাণ ‘যায় যায়’ হইয়া উঠিয়াছে।
ভক্তেরা বলে, ‘ও রকম হবে, এ তো জানা কথাই, এই হচ্ছে স্বাভাবিক বিবর্তন; এ একেবারে খাঁটি জিনিস দাঁড়িয়েছে।’
সকলের চেয়ে চিন্তার বিষয় হইয়াছে যে এই অসহায় লাঞ্ছিত হিন্দুধর্মের জন্য একটা বড় রকম ত্যাগ স্বীকার করিবার নিমিত্ত দাদা নিরতিশয় ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন এবং হাতের কাছে আর তেমন কিছু আপাতত না পাওয়ার ঝোঁকটা গিয়া পড়িয়াছে ছোট কন্যাটির উপর।
একদিন বলিলেন, ‘ওহে শৈলেন, একটা কথা ভাবছি, -ভাবছি বলি কেন, একরকম স্থিরই করে ফেলেছি।’
মুখে গম্ভীর তেজস্বিতার ভাব দেখিয়া সভয়ে প্রশ্ন করিলাম, ‘কি দাদা?’
‘গৌরীদান করব স্থির করেছি, তোমার রাণুর কত বয়স হল?’
বয়স না বলিয়া বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘সে কি দাদা! এ যুগে-’
দাদা সংযত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলিলেন, ‘যুগের ‘এ’ আর ‘সে’ নেই শৈলেন, ওইখানেই তোমরা ভুল কর। কাল এক অনস্তব্যাপী অখ- সত্তা, এবং শুদ্ধ সনাতনধর্ম সেই কালকে-’
একটু অস্থির হইয়া বলিলাম, ‘কিন্তু দাদা, ও যে এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু।’
দাদা বলিলেন, ‘এবং শিশুই থাকবে ও, যতদিন তোমরা বিবাহবন্ধনের দ্বারা ওর আত্মার সংস্কার ও পূর্ণ বিকাশের অবসর করে না দিচ্ছ। এটা তোমায় বোঝাতে হলে আগে আমাদের শাস্ত্রকাররা-’
অসহিষ্ণুভাবে বলিলাম, ‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু ওর তো এই সবে আট বছর পেরুল দাদা, ওর শরীরই বা কতটুকু আর তার মধ্যে ওর আত্মাই বা কোথায়, তা তো বুঝতে পারি না! আমার কথা হচ্ছে-’
দাদা সেদিকে মন না দিয়া নিরাশভাবে বলিলেন, ‘আট বৎসর পেরিয়ে গেছে। তা হলে আর কই হল শৈলেন? মনু বলেছেন, ‘অষ্টবর্ষা ভবেদগৌরী নববর্ষে তু রোহিণী’-জানি অতবড় পুণ্যকর্ম কি আমার হাত দিয়ে সমাধান হবে! ছোটটার বয়স কত হল?’
রাণুর ছোট রেখা পাঁচ বৎসরের। দাদা বয়স শুনিয়া মুখটা কুঞ্চিত করিয়া একটু মৌন রহিলেন। পাঁচ বৎসরের কন্যাদানের জন্য কোন একটা পুণ্যফলের ব্যবস্থা না করিয়া যাওয়ার জন্য মনুর উপরই চটিলেন, কিংবা অত পিছাইয়া জন্ম লওয়ার জন্য রেখার উপরই বিরক্ত হইলেন, বুঝিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে স্থান ত্যাগ করিলেন। আমিও আমার রদ্ধশ্বাসটা মোচন করিলাম। মনে মনে কহিলাম, ‘যাক, মেয়েটার একটা ফাঁড়া গেল।’
দুই দিন পরে দাদা ডাকিয়া পাঠাইলেন। উপস্থিত হইলে বলিলেন, ‘আমি ও সমস্যাটুকুর এক রকম সমাধান করে ফেলেছি শৈলেন। অর্থাৎ তোমার রাণুর বিবাহের কথাটা আর কি। ভেবে দেখলাম, যুগধর্মটা একটু বজায় রেখে চলাই ভাল বইকি-’
আমি হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম, হর্ষের সহিত বলিলাম, ‘নিশ্চয় শিক্ষিত সমাজে কোথায় ষোল-সতেরো বছরে বিবাহ চলছে দাদা, এ সময় একটা কচি মেয়েকে-যার নয় বছরও পুরো হয়নি-তা ভিন্ন খাটো গড়ন বলে-’
‘ঝাঁটা মারো তোমার শিক্ষিত সমাজকে! আমি সে কথা বলছি না। বলছিলাম যে, যদি এই সময়ই রাণুর বিয়ে দিই, তা মন্দ কি? বেশ তো, যুগধর্মটাও বজায় রইল, অথচ ওদিকে গৌরীদানেরও খুব কাছাকাছি রইল। ক্ষতি কি? এটা হবে যাকে বলতে পারা যায়, মডিফায়েড গৌরীদান আর কি!’
আমি একেবারে থ হইয়া গেলাম। কি করিয়া যে দাদাকে বুঝাইব, কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
দাদা বলিলেন, ‘প-িত মশায়েরও মত আছে । তিনি অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখে বললেন কলিতে এইটিই গৌরীদানের সমফলপ্রসূ হবে।’
আমি দুঃখ ও রাগ মিটাইবার একটা আধার পাইয়া একটু উষ্মার সহিত বলিলাম, ‘প-িত মশায় তা হলে একটা নীচ মিথ্যা কথা আপনাকে বলেছেন দাদা, আপনি সন্তুষ্ট হলে উনি এ কথাও বোধ হয় শাস্ত্র ঘেঁটেই বলে দেবেন যে, মেয়েকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিলেও আজকাল গৌরীদানের ফল হবার কথা। কলিযুগটা তো ওঁদের কল্পবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যখন যে বিধানটা চাইবেন, পাকা ফলের মত টুপ করে হাতে এসে পড়বে।
দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম। আমিই কথা কহিলাম, ‘যাক ওঁরা বিধান দেন, দিন বিয়ে। আমি এখন আসি, একটু কাজ আছে।’ আসিবার সময় ঘুরিয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ শরীরটা খারাপ বলে ভাবছি, মাস চারেক একটু পশ্চিমে গিয়ে কাটাব; হপ্তাখানেকের মধ্যে বোধ হয় বেরিয়ে পড়তে পারব।’-বলিয়া চলিয়া আসিলাম।
অভিমানের সাহায্যে ব্যাপারটা মাস তিন-চার কোন রকমে ঠেকাইয়া রাখিলাম, কিন্তু তাহার পর দাদা নিজেই এমন অভিমান শুরু করিয়া দিলেন যে, আমারই হার মানিতে হইল। ‘ধর্মে’র পথে অন্তরায় হইবার বয়স এবং শক্তি বাবার তো ছিলই না, তবুও নাতনীর মায়ায় তিনি দোমনা হইয়া কিছুদিন আমারই পক্ষে রহিলেন, তারপর ক্রমে ক্রমে ওই দিকেই ঢলিয়া পড়িলেন। আমি বেখাপ্পা রকম একলা পড়িয়া গিয়া একটা মস্ত বড় ধর্মদ্রোহীর মত বিরাজ করিতে লাগিলাম।
রাণুকে ঢালোয়া ছুটি দিয়া দিয়াছি। মায়াবিনী অচিরেই আমাদের পর হইবে বলিয়া যেন ক্ষুদ্র বুকখানির সমস্তটুকু দিয়া আমাদের সংসারটি জড়াইয়া ধরিয়াছে। পারুক, না পারুক- সে সমস্ত কাজেই আছে এবং যেটা ঠিকমত পারে না, সেটার জন্য এমন একটা সঙ্কোচ এবং বেদনা আজকাল তাহার দেখিতে পাই, যাহাতে সত্যই মনে হয়, নকলের মধ্য দিয়া মেয়েটার এবার আসল গৃহিণীপনার ছোঁয়াচ লাগিয়াছে। অসহায় মেজকাকাটি তো চিরদিনই তাহার একটা বিশেষ পোষ্য ছিলই; আজকাল আবার প্রথম ভাগ বিবর্জিত সুপ্রচুর অবসরের দরুণ একেবারে তাহার কোলের শিশুটিই হইয়া পড়িয়াছে বলিলে চলে!
সময় সময় গল্পও হয়; আজকাল বিয়ের গল্পটা হয় বেশি। অন্যের সঙ্গে এ বিষয় লইয়া আলোচনা করিতে রাণু ইদানীং লজ্জা পায় বটে, কিন্তু আমার কাছে কোন দ্বিধা-কুণ্ঠাই আসিবার অবসর পায় না; তাহার কারণ আমাদের দুইজনের মধ্যে সমস্ত লঘুত্ব বাদ দিয়া গুরুগম্ভীর সমস্যাবলীর আলোচনা চলিতে থাকে। বলি, ‘তা নয় হল, রাণু তুমি মাসে দুবার করে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে আমাদের সংসারটা গুছিয়ে দিয়ে গেলে। আর সবই করলে, কিন্তু তোমার মেজকাকাটির কি বন্দোবস্ত করছ?’
রাণু বিমর্ষ হইয়া ভাবে; বলে ‘আমরা সব বলে বলে তো হয়রান হয়ে গেলাম মেজকা যে, বিয়ে কর, বিয়ে কর। তা শুনলে গরিবদের কথা? রাণু কি তোমার চিরদিনটা দেখতে-শুনতে পারবে মেজকা? এর পর তার নিজের ছেলেপুলেও মানুষ করতে হবে তো? মেয়ে আর কতদিন নিজের বল? তোতাপাখির মত, কচি মুখে বুড়োদের কাছে শেখা বুলি শুনিয়া হাসিব কি কাঁদিব, ঠিক করিতে পারি না; বলি ‘আচ্ছা, একটা গিন্নীবান্নী কনে দেখে এখনও বিয়ে করলে চলে না? কি বল তুমি?’
এই বাঁধা কথাটি তাহার ভাবী শ্বশুরবাড়ি লইয়া একটি ঠাট্টার উপক্রমণিকা। রাণু কৃত্রিম অভিমানের সহিত হাসি মিশাইয়া বলে, ‘যাও মেজকা, আর গল্প করব না; তুমি ঠাট্টা করছ।’
আমি চোখ পাকাইয়া বিপুল গাম্ভীর্যের সহিত বলি, ‘মোটেই ঠাট্টা নয় রাণু; তোমার শাশুড়ীটি বড্ড গিন্নী শুনেছি তাই বলছিলাম, যদি বিয়েই করতে হয়-’
রাণু আমার মুখের দিকে রাগ করিয়া চায় এবং শেষে হাসিয়া চায়। কিছুতেই যখন আমার মুখের অটল গাম্ভীর্য বদলায় না, তখন প্রতারিত হইয়া গুরুত্বের সহিত বলে, ‘আচ্ছা, আমি তাহলে-না মেজকা, নিশ্চয় ঠাট্টা করছ যাও-’
আমি চোখ আরও বিস্ফারিত করিয়া বলি, ‘একটুও ঠাট্টা নেই এর মধ্যে রাণু; সব কথা নিয়ে কি আর ঠাট্টা চলে মা?’
রাণু তখন ভারিক্কে হইয়া বলে, ‘আচ্ছা, তা হলে আমার শাশুড়ীকে একবার বলে দেখব’খন, আগে যাই সেখানে। তিনি যদি তোমায় বিয়ে করতে রাজী হন তো তোমায় জানাব’খন; তার জন্যে ভাবতে হবে না।’ তাহার পর কৌতুকদীপ্ত চোখে চাহিয়া বলে, ‘আচ্ছা মেজকা, পেরথোম ভাগ তো শিখি নি এখনও-কি করে তোমায় জানাব বল দিকিন, তবে বুঝব হ্যাঁ-’ আমি নানান রকম আন্দাজ করি; বিজয়িনী ঝাঁকড়া মাথা দুলাইয়া হাসিয়া বলে, ‘না হল না-কখনও বলতে পারবে না, সে বড্ড শক্ত কথা।’
এই সব হাসি তামাসা গল্পগুজব হঠাৎ মাঝখানেই শেষ হইয়া যায়; রাণু চঞ্চলতার মাঝে হঠাৎ গম্ভীর হইয়া বলে, ‘যাক, সে পরের কথা পরে হবে; যাই, তোমার চা হল কি না দেখিগে।’ কিংবা-‘যাই, গল্প করলেই চলবে না, তোমার লেখার টেবিলটা আজ গুছোতে হবে, একডাঁই হয়ে রয়েছে-’ ইত্যাদি।
এই রকম ভাবে রাণুকে নিবিড় হইতে নিবিড়তর ভাবে আমার বুকের মধ্যে আনিয়া দিতে দিতে বিচ্ছেদের দিনটা আগাইয়া আসিতেছে।
বুঝিবা রাণুর বুকটিতেও এই আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনা তাহার অগোচরে একটু একটু করিয়া ঘনাইয়া উঠিতেছে। কচি সে, বুঝিতে পারে না; কিন্তু যখনই আজকাল ছুটি পাইলে নিজের মনেই স্লেট ও প্রথম ভাগটা লইয়া হাজির হয়, তখনই বুঝিতে পারি, এ আগ্রহটা তাহার কাকাকে সান্ত¡না দেওয়ারই একটা নূতন রূপ; কেন না, প্রথম ভাগ শেখার আর কোন উদ্দেশ্য থাক আর না-থাক, ইহার উপরই ভবিষ্যতে তাহার কাকার সমস্ত সুখ-সুবিধা নির্ভর করিতেছে-রাণুর মনে এ ধারণাটুকু বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে। এখন আর একেবারেই উপায় নাই বলিয়া তাহার শিশু-মনটি ব্যথায় ভরিয়া উঠে; প্রবীণার মত আমায় তবুও আশ্বাস দেয়, ‘তুমি ভেবো না মেজকা, তোমার পেরথোম ভাগ না শেষ করে আমি কখনও শ্বশুরবাড়ি যাব না। নাও, বলে দাও।’
পড়া অবশ্য এগোয় না। বলিয়া দিব কি, প্রথম ভাগটা দেখিলেই বুকে যেন কান্না ঠেলিয়া উঠে। ওদিকে আবার প্রতিদিনই গৌরীদানের বর্ধমান আয়োজন। বাড়ির বাতাসে আমার হাঁফ ধরিয়া উঠে। এক-একদিন মেয়েটাকে বুকে চাপিয়া ধরি, বলি, ‘আমাদের কোন দোষে তুই এত শিগগির পর হতে চললি রাণু?’
বোঝে না, শুধু আমার ব্যথিত মুখের দিকে চায়। এক-একদিন অবুঝভাবেই কাঁদ-কাঁদ হইয়া উঠে; এক-একদিন জোর গলায় প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে, ‘তোমার কষ্ট হয় তো বিয়ে এখন করবই না মেজকা, বাবাকে বুঝিয়ে বলব’খন।
একদিন এই রকম প্রতিজ্ঞার মাঝখানেই সানাইয়ের করুণ সুর বাতাসে ক্রন্দনের লহর তুলিয়া বাজিয়া উঠিল। রাণু কুন্ঠিত আনন্দে আমার মুখের দিকে চাহিয়া হঠাৎ কি রকম হইয়া গিয়া মুখটা নীচু করিল; বোধ করি তাহার মেজকাকার মুখে বিষাদের ছায়াটা নিতান্তই নিবিড় হইয়া তখন ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
গৌরীদান শেষ হইয়া গিয়াছে; আমাদের গৌরীর আজ বিদায়ের দিন। আমি শুভকর্মে যোগদান করিয়া পুণ্যসঞ্চয় করিতে পারি নাই, এ-বাড়ি সে-বাড়ি করিয়া বেড়াইয়াছি। বিদায়ের সময়ে বরবধুকে আশীবার্দ করিতে আসিলাম।
দীপ্তশ্রী কিশোর বরের পাশে পট্ট বস্ত্র ও অলঙ্কার-পরা, মালাচন্দনে চর্চিত রাণুকে দেখিয়া আমার তপ্ত চক্ষু দুইটা জুড়াইয়া গেল। কিন্তু ও যে বড্ড কচি-এত সকালে কি করিয়া বিদায়ের কথা মুখ দিয়া বাহির করা যায়? ও কি জানে, আজ কতই পর করিয়া ওকে বিদায় দিতেছি আমরা? চক্ষে কোঁচার খুঁট দিয়া এই পুণ্যদর্শন শিশুদম্পতিকে আশীর্বাদ করিলাম। রাণুর চিবুকটা তুলিয়া প্রশ্ন করিলাম, ‘রাণু, তোর এই কোলের ছেলেটাকে কার কাছে-?’ আর বলিতে পারিলাম না।
রাণু শুনিয়াছি এতক্ষণ কাঁদে নাই। তাহার কারণ নিশ্চয় এই যে, সংসারের প্রবেশ-পথে দাঁড়াইতেই ওর অসময়ের গৃহিণীপনাটা সরিয়া গিয়া ওর মধ্যকার শিশুটি বিস্ময়ে কৌতুহলে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। আমার কথার আভাসে সেই শিশুটিই নিজের অসহায়তায় আকুল হইয়া পড়িল। আমার বাহুতে মুখ লুকাইয়া রাণু উচ্ছ্বসিত আবেগে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
কখনও কচি মেয়ের মত ওকে ভুলাইতে হয় নাই। আমার খেলাঘরের মা হইয়া ওই এতদিন আমায় আদর করিয়াছে, আশ্বাস দিয়াছে; সেইটাই আমাদের সম্বন্ধের মধ্যে যেন সহজ এবং স্বাভাবিক হইয়া পড়িয়াছিল, ভাল মানাইত। আজ প্রথম ওকে বুকে চাপিয়া সান্ত্বনা দিলাম- যেমন দুধের ছেলেমেয়েকে শান্ত করে-বুঝাইয়া, মিথ্যা কহিয়া, কত প্রলোভন দিয়া। তবুও কি থামিতে চায়? ওর সব হাসির অন্তরালে এতদিন যে গোপনে শুধু অশ্রুই সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছিল।
অনেকক্ষণ ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া সে থামিল। অভ্যাসমত আমার করতল দিয়াই নিজের মুখটা মুছাইয়া লইল; তাহার পর হাতটাতে একটু টান দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, ‘এদিকে এস, শোন মেজকা।’
দুইজনে একটু সরিয়া গেলাম। সকলে এই সময় মাতাপুত্রের অভিনয়ের দিকে চাহিয়া রহিল। রাণু বুকের কাছ হইতে তাহার সুপ্রচুর বস্ত্রের মধ্য হইতে লাল ফিতায় যতœ করিয়া বাধাঁ দশ-বারোখানি প্রথম ভাগের একটা বান্ডিল বাহির করিল। অশ্রুসিক্ত মুখখানি আমার মুখের দিকে তুলিয়া বলিল, ‘পেরথোম ভাগগুলো হারাই নি মেজকা, আমি দুষ্টু হয়েছিলুম, মিছে কথা বলতুম।’
গলা ভাঙিয়া পড়ায় একটু থামিল, আবার বলিল, ‘সবগুলো নিয়ে যাচ্ছি মেজকা, খুব লক্ষ্মী হয়ে পড়ে পড়ে এবার শিখে ফেলব। তারপরে তোমায় রোজ রোজ চিঠি লিখব। তুমি কিছু ভেবো না মেজকা।-’
.......................................................................................................
[বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের ২৪ অক্টোবর বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার পাণ্ডুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাংবাদিকতা ও স্কুলের শিক্ষকতায় তার পেশাজীবন কেটেছে। বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার হিসেবে পরিচিত বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রসরচনায়ও রয়েছে অসামান্য দক্ষতা। ‘রাণুর প্রথম ভাগ’ গল্পটি তার রাণুর প্রথম ভাগ গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। একটি ছোট্ট বালিকা আর তার কাকার স্নেহমাখা সম্পর্ক নিয়ে গল্পটি রচিত। পরবর্তীতে বিভূতিভূষণ রাণুকে নিয়ে আরো কয়েকটি গল্প লিখলেও ‘রাণুর প্রথম ভাগ’ গল্পটিই বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। শিশুর মনোজগত পড়তে পারার বিরল ক্ষমতার কারণে বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘রাণুর মেজকা’ হিসেবেও পরিচিত। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে, রাণুর প্রথম ভাগ, রাণুর দ্বিতীয় ভাগ, বর-যাত্রী, বর্ষায়, রিক্সার গান, নীলাঙ্গুরীয়, স্বর্গাদপী গরিয়সী প্রভৃতি। ১৯৮৭ সালের ৩০ জুলাই দ্বারভাঙ্গাতেই মৃত্যু হয় এ কথা সাহিত্যিকের। - সম্পাদক]
শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪
কবিতা >> খামার : মুরাদুল ইসলাম
খামার
মুরাদুল ইসলাম
রৌদ্রতে আজ কেউ এলো না
আমার দিন কেটে যায় ত্রিকাল তপস্যায়
মদ্যশালায় সাধনা আমার শুদ্ধ ঋষির
হাওয়ার মাঝে লাঙল চালাই
অর্জিত জ্ঞান বিদ্যা আছে সুস্থ কৃষির
সাধক আমি, খাদক আমি
করুণ কাঠের সুন্দরীদের মাদক আমি, যাচ্ছেতাই
আঙুলজুড়ে নেশাগ্রস্ত পাঁচটি জাহাজ
চোখের মাঝে খোল নলচে বদলে দেওয়ার বিষণ্ন কাজ
নিঃশেষিত ইন্দ্রিয় ঘ্রাণশক্তি আমার
নশ্বরতায় নিপতিত কোষ অসংখ্য, মানব খামার।
কবিতা >> এই কবিতা বেহুলার জন্য : আবদুল্লাহ শওকত
এই কবিতা বেহুলার জন্য
আবদুল্লাহ শওকত
আমিও এক ভরা পূর্ণিমায় গৃহত্যগ করেছিলাম
সম্মুখ দরজা খোলা রেখে
গৃহে ছিলো মূল্যবান রতœরাজি
শয্যায় রূপবতী প্রিয়তমা...
লোভী তস্করের দল তখনো অপেক্ষায় ছিলো
কিছু দূর যাওয়ার পর শুনেছিলাম
দ্বাররক্ষীর মরণ চিৎকার
আমার প্রিয়তমার ভয়ার্ত স্বর...
না, আমি ফিরে যাইনি।
তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর-
আমি ক্রমশ শহরের দিকে যাচ্ছিলাম
বহুমূল্য কটিদেশের অলঙ্কার-
ছুঁড়ে দিয়েছিলাম ক্ষুধার্ত গণিকাকে
না, আমি দাতা নই।
সেই গণিকার চোখেই দেখেছিলাম
অবারিত প্রশান্তির প্রহেলিকা।
শহর পেরিয়ে এলাম বিস্তৃত প্রান্তরে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঘাসের চাদরে
সেখানে আমাকে কেটেছিলো বিষধর সর্প
আমি কি তবে লখিন্দর...?
না, আমার বেহুলা এখন তস্করের
লোভী বাহুডোরে আবদ্ধ।
কবিতা >> ভালো লাগা কিছু কথা : মেসবাহ উল হাসান গালিব
ভালো লাগা কিছু কথা
মেসবাহ উল হাসান গালিব
সেই ভালোবাসাটা বোধহয় ভালো ছিল-যখন ভালোবাসতাম বাড়ির উঠোনটা,
সকালের সূর্য,
জাম গাছের হলদে পাখি,
ভালবাসতাম পুকুরে দাপাদাপি করতে,
পাখির বাসায় হানা দিতে,
কাচা পাকা আম কুড়াতে,
সারাদিন বড়শি হাতে মাছ ধরতে।
এগুলো এখনও ভালোবাসি।
কিন্তু তারপরেও অঞ্জনের গানের মতো
‘তারপর কখন হঠাৎ সুখের মানে পাল্টে যায়’
এখন ভাল লাগে ক্লান্ত দুপুরে লম্বা ঘুম দিতে,
রাতের আঁধারে একাকী হেঁটে যেতে,
বিধ্বস্ত কাকের মত নিমগ্ন চিন্তা করতে,
হিট কোনো মুভির মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতে,
কোনো রোমাঞ্চ বই পড়ে শিহরিত হতে,
আর ভালোলাগে অচেনা আলোয় থাকা সেই অপ্সরীকে,
যার চোখের মাঝে আছে অতল সুমুদ্র,
কথায় তার সজীবতার পরশ,
যাকে দেখা হয়নি কখনও,
যাকে ভালোবাসি পুরনো থেকে নতুনে
আদি থেকে অনন্তে।
কবিতা >> প্রতীক্ষা : দুর্জয় আহমেদ
প্রতীক্ষা
দুর্জয় আহমেদ
রাত বাড়ছে রাতের মতোই করেখুঁজে পাওয়া অন্ধকার সীমাহীন
বিরহী যক্ষ মেঘের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে রাত্রি নিশীদিন।
উইয়ে ধরা বাস্তুভিটা আমার
ঝরতি পলেস্তারা দেয়ালের
অহর্নিশি গুনছি সময় খেয়াল আর বেখেয়ালে।
‘প্রথম প্রেম দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’
চামড়ার নিচে বয়ে চলা খসখসে সময়
পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখি
অস্ফুট এক চিৎকার জাগে।
বহতা নদীর বুকে খড়কুটো
পাল্টে যাওয়া জীবন বহমান
পা-ুলিপির প্রতিটি খেরোপাতা
লোনা জলে করছে অবগাহন।
কবিতা >> অস্তিত্বের প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত : দুর্জয় আহমেদ
অস্তিত্বের প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত
রাজু রণরাজ
পাপের পাহাড় হয়ে পৃথিবীছেড়ে যেতে যেতে পাপী,
সামনে দাঁড়ানো যমদূতকে বলি
দুর হ’ ভ্রান্তি কল্পনা
বিশ্বাস করি না তোকে,
বিশ্বাস করি না ঈশ্বর।
স্তম্ভিত যমদূত কাঁপে,
যথাসম্ভব দুই হাত ঢুকিয়ে দেই তার কলিজায়
ছিনিয়ে আনি অবিশ্বাসের প্রাণ।
তখন মনের অবচেতন কোণে
মৃত্যু হয় দুটি অস্তিত্বের,
ঈশ্বর ও ঐশ্বরিক ক্ষমতার।
কবিতা >> দাঁতফুল হাসি : মীম হুসাইন
দাঁতফুল হাসি
মীম হুসাইন
কথার ফাঁকে বলছি কথা,একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি
উড়লো তোমার চুল।
কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি
গালে হাসির টোল।
কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি
ভিজলো ঠোঁটের কূল।
কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি
দাঁত বাবুনার ফুল।
কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে পার হলে কি
পুলসিরাতের পুল?
কবিতা >> কষ্টের শ্লেটে প্রেমের অভিষেক : মেহেদী হাসান মিঠু
কষ্টের শ্লেটে প্রেমের অভিষেক
মেহেদী হাসান মিঠু
দেখেছো কি..মুছে যাওয়া আশ্রিত বৃষ্টির
আর্দ্র দৃষ্টিতে
হৃদয়গোধূলির ম্লানময়তায়
প্রজাপতির বিশুষ্ক ডানায় রঙধনু ছায়া..
নীল চাদরে
কষ্টের শ্লেট ভেঙে দৌড়ে পালানো
ভালোবাসা?
হয়তোবা দেখোনি
অস্তিত্বহীনতায়
প্রেমের অভিষেক
বৃথা আস্ফালনে
বসন্ত হাসি..
মেঘপুঞ্জের লাল সবুজে
ধুলোজমা মৃত্তিকার বিবর্ণ মানচিত্র।
কবিতা >> আরও আলো চাই : হাসান চিশতী
আরও আলো চাই
হাসান চিশতী
চোখ খুললেই দেখিঅন্ধকার চারদিকে
রক্তিম খেলা সারাক্ষণ
স্বার্থের শ্মশানে অকাল মৃত্যু
জীবন্ত হৃদয়েরা সব
হাহাকারে পূর্ণ- আর্ত চিৎকার
তুমি-তুমি-তুমি
একটু ভালোবেসে
শান্তি দাও, শান্তি দাও
প্রেম!
সেই চোখ
বন্ধ করলে আসে আলো
সব আলো তোমারই
পুরনো পবিত্র পোশাক পরে
আমার গায়ে।
এতো আলো কোথায় পেলে
তুমি?
কবিতা >> সূর্যেরও আসে যদি ঘুম : মেকদাদ মেঘ
সূর্যেরও আসে যদি ঘুম
মেকদাদ মেঘ
কেউই কাউকে অতি সহজে ভুলতে পারে না
ধর্মের পোশাক যদি জন্মগতভাবে পরিধান করে কেউ
আদিম বিশ্বাসে
ঈশ্বরকে ভুলতেও যুক্তির সময় বয়ে যায়
পরিচিত সামাজিক অন্ধকার গর্ত থেকে
মুক্তির নেশায় আপন সাগরে উঠে জোয়ার জৌলুস,
কাউকে কেউই সহজে ভুলতে পারছে না
স্মৃতির চাকায় যতোই থাকুক মরিচার রোগ
অ্যালুমিনিয়াম আস্তরণ দেয় ঘটনার আয়োজনে
ঠিক তখনও অনেকেই
স্মরণের কথা ভাবে প্রাণসন্ধ্যা সূর্যমুখী দিনের ঘূর্ণনে
সেও বুঝি? স্মৃতির উনুনে পেছনে তাকায়
ভুলতেই পারছিনে এই সব মোরগসকাল
কাকের দুপুর, ভাটিপুত্র, ভাটিকন্যা, পাহাড়ের রূপকথা
শাহিদার মুখ।
মনোবনে ভেসে উঠে চন্দ্রের ত্রিভুজ
চন্দ্রাণুর সাত রূপ সঙ্গী হয়ে যায়,
বন্ধু নামে অবন্ধুর যাতনাও
যথাÑপ্রকাশিত শত্রুজন মুখোশের মিত্র চোর
তাদেরকে ভুলতেও
অন্তত ভাবনা, ভাবনার বাতিঘরে
আমাকে ত্রিশূলে বিদ্ধ করে
অন্য কেউ তলোয়ারে দাগ কেটে যায়!
কবিতা >> যাদের যাদের কবিতা আমি পড়ি না : শোয়েব সর্বনাম
যাদের যাদের কবিতা আমি পড়ি না
শোয়েব সর্বনাম
সেইসব কবিদের কথাঅথবা কবিতা;
যেইসব কবি-
যাদের সন্ধ্যা নামে শাহবাগে,
শুধুই শাহবাগে
হয়তো শাহবাগে যাদের
সকাল
হয় না,
দুপুর
হয় না,
সন্ধ্যা হয় শুধু-
অন্ধকার;
লেখা থাকে যেইসব কবি
অথবা কবিতার শেষে-
সেইসব কবিদের বই, নাকি পাণ্ডুলপি
অযথাই ছাপাছাপি
করে না যারা যারা-
আহা, সেই সব কবিতাগুলো
বুকপকেটে নিয়া ঘুরতে থাকে কারা?
তাদের কবিতা আমি পড়ি নাকি?
টুইটারে লেখে না তো তারা!
সন্ধ্যায় অথবা রাতে
ঘাসের উপর বসে কম দামি গাঁজা খেতে খেতে
যেই কবি লিখে রাখে দু একটা অক্ষর-
জীবনানন্দবাবু করে নাকি ভর- তাদের উপরে যেন
ট্রামের তলে গিয়া আজো তারা মরে নাই কেন?
তাদের কবিতা আমি পরি না তো!
টুইটারে লেখে নাই তারা!
কবিতা লিখতে গিয়া লিখতে না পারা
যেইসব কবি-
করে নাকি যারা যারা কবিদের মত ভান
অথবা, হয়ত তারা
কবিই তো! কবিদের ‘সাব অলটার্ন’;
ফলে তারা ঝিম মেরে বসে থাকে
কবিতার খাতা খুলে-
কাটাকুটি খেলে নাকি?
আহা, কাটাকুটি!
শুধু কাটাকুটি?
কেন তারা শিখলো না আজও ষোলো গুটি?
অথবা
কুতকুত?
আহা, কুতকুত খেলা করা
প্রমীলা কবিরা
হাতে নিয়া নিজ নিজ কবিতার বই
(অথবা প্রেমিকের- তাহারা কে কে আজ কই?)
নাকি পাণ্ডুলিপি-
অযথাই ছাপাছাপি
করে না যারা যারা
সেইসব কবিতাগুলা জড়ায়ুর ভিতরে নিয়া ঘুরতে থাকে কারা?
তাদের কথা তো কেউ বলে না আমাকে?
তাদের কবিতা আমি পড়ি না তো!
কবিতা >> সীমান্তে : অজয় দেব
সীমান্তে
অজয় দেব
এতো ভাবতে কবে শিখেছিমনের গহীনে আষ্টেপৃষ্ঠে রাখা কথা
কেনো নীরবে এতো সুর তোলে।
জীবনের এতো পরীক্ষার পড়া
মুখস্থ করতে পারিনি কখনো কোনোদিন।
দুই একটা প্রশ্নের উত্তর কখনোই
কোনো পরীক্ষায় দিতে পারিনি।
অথচ সেই প্রিয় মুখ কত মুখস্ত।
এখনো প্রতি রাতে চোখজোড়া বন্ধ করলে
রাতের আহ্বানে চোখের পাতায় জল ছবিতে
ভেসে ওঠে সেই মুখ।
এতো ভাবতে চাইনা, এতো নির্ঘুম রাত স্মৃতির
পটে জড়ো হোক তা চাইনা,
যদিও স্মৃতিই এই জীবনটাকে আঁকড়ে ধরেছে
যা নিয়েই জীবন বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
সেদিনও সীমান্তে দাঁড়িয়ে অপলকে
তোমাকে দেখতে চেয়েছি প্রিয় বাংলাদেশ
অনেক দূর আমি দেখেছি
তোমার মাটির গন্ধ আমি পেয়েছি।
সবুজ প্রান্তরের মত তোমার শাড়ির
আঁচল উড়তে দেখেছি হাত বাড়িয়েছি কতোবার
তবুও স্পর্শ করতে পারিনি।
কতবার মৃত্যু আমাকে তাড়া করেছে
কাঁটাতারে শার্ট ছিঁড়েছে, পাঁজরের এক পাশে
আঁচড় লেগেছে।
তবুও এতো ভাবতে ভালো লাগে
সেইবারের মত অচেনা পথে হাঁটতে ভীষণ ইচ্ছে করে
তারপর প্রশ্নেরা তাড়া করে ‘এতো ভাবতে শিখেছি’ তোমাকে।
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
কবিতা >> উলঙ্গদের স্বর্গবাস : অনিরুদ্ধ সাইমূম
উলঙ্গদের স্বর্গবাস
অনিরুদ্ধ সাইমূম
নিজেরটা সযতনে রেখেঅন্যেরটা কেড়ে খাওয়ার অভ্যাস
ওদের বরাবরের
সেটা হজম হোক আর নাই হোক।
পরের কাঁধে পা রেখে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন
ওদের অনেক দিনের।
নিজের গাল ছেড়ে
পরের গালের মাছি তাড়াতেই
ওদের ব্যস্ততা বেশি।
ওরা আগাগোড়া অন্ধ
পুরোটাই বধির, জন্ম থেকেই উলঙ্গ !
লিপ্সায় লটকে থাকা লকলকে জিভ থেকে
টস টস করে এসিড ঝরে পরে সর্বক্ষণ।
বীভৎস চেহারা নিয়েই তারা হাসে
নর্দমা থেকে উঠে আসে মনুষ্য সমাজে।
শিকড় গেঁড়ে বসে
এক সময় লিক লিক করে বাড়তে থাকে
ওদের বংশধর।
খায়, দায়, বড় হয়
বড় হয়ে এরাও হাসে।
এদের শিকড় বিস্তৃত হয় মাইলের পর মাইল।
এদের কেউ ভালোবাসুক আর নাই বাসুক
তাতে কিচ্ছু যায় আসে না তাদের।
তাদের ধারণা তারা মৃত্যুঞ্জয় ,
ঘুণপোকা কোনোদিনও কাটতে পারবে না
তাদের সাধের পালঙ্ক।
দিন যায় দিন আসে...
ওদের শ্যেনদৃষ্টিতে তবুও পলক পড়ে না
ওরা হাসে, বারবার হাসে
কারণ, সব তো ওদেরই জন্য
ওদের পতন নেই।
ওরা এতটাই সংকীর্ণ
যে ওদের রাজপথের প্রয়োজন নেই
কোনো এক সঙ্কীর্ণ গলি পথে
তারা ঠিকই পৌঁছে যায় সপ্ত স্বর্গে।
অথচ আমরা...
অবলীলায় মুখটা হাঁ করে
চকচকে নোনা জলে পলক না ফেলেই চেয়ে থাকি
ওদের স্বর্গারোহনের সিঁড়ির দিকে।
তাদের নির্ভয়ে কাটে প্রতিটিক্ষণ
তাই সেখান থেকেও
তারা হাত নেড়ে নেড়ে হাসে।
আর আমরা?
বাম হাতে বুড়ো আঙুল
মুখে পুড়ে চুষতে চুষতে
মর্ত্য ধরাধামে পা কেলিয়ে বসে
ওদের স্বাগত জানাই।
কবিতা >> তালাক, পাঁজরবারান্দায় : নূর নিহাল
তালাক, পাঁজরবারান্দায়
নূর নিহাল
অনাথ অবহেলায় আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়েলুকোচুরিবাজি করো না আর...
বহুরূপী রূপকথার নকশীস্মৃতি
সেঁটে দিও না নষ্টামীর বর্ণিল কাঁথায়
যুগের যমদূত হয়ে কৃষ্ণদেহে রাধা কলঙ্ক
জগত জমিন নাচাবে জানি, গহীনে নাচাবে তুমুল।
অতঃপর প্রেম জ্জ
কালের কালিমা ছুঁয়ে অকাল জোছনা হয়ে
পড়ে থাক পাঁজরবারান্দায়।
কবিতা >> প্রতীক্ষার হিমালয় ছোঁয়ার আগে : উদয় শংকর দুর্জয়
প্রতীক্ষার হিমালয় ছোঁয়ার আগে
উদয় শংকর দুর্জয়
তুমি রঙ চুরি করে গায়ে মেখে নিলে।সদ্য জলধারা অরণ্য আকাশ
কি ছিলো না আমাতে? বিস্তীর্ণ বেলাভূমির মত
এই বুকের পাটাতন।
প্রতীক্ষার হিমালয় ছুঁয়ে দেখার আগেই
অতল স্পর্শের সন্ধানে বেমালুম ভুলে যাওয়া
সে নির্লিপ্ত চোখ। আমারও তো ছিল
এই গ্রহে আবহে এক খণ্ড জমি।
কী আলো ছায়া বুকে টেনে; চেয়েছিলে নির্বাসন
প্রেম থেকে নাকি প্রেমে থেকে।
এখানেই তো ছিল জ্যোৎস্নাধারা অবিরাম
প্রাণের বিপুল বৈভব হৃদ উচ্ছ্বাস।
আজও আছে শুভ্র ভোর
চিলেকোঠায় রোদ্দুর পেয়ালা।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
কবিতা >> যোগ-বিয়োগ : মিসবাহ উদ্দীন আহমদ
যোগ-বিয়োগ
মিসবাহ উদ্দীন আহমদ
জীবনের যাপনেকতো যোগ, কতো বিয়োগ
কতো শত অঙ্ক
কোনোটারই হিসেব মেলে না
পুঙ্খানুপুঙ্খ।
কবিতা >> গোড়ালি তফসিল : তাহমিদুর রহমান
গোড়ালি তফসিল
তাহমিদুর রহমান
বাতাসে উড়ে উড়ে কিছু লাইন এল মাথায়সেভাবেই তাদের আবারো উড়িয়ে দিলাম
আমি কি খুনি? হ্যাঁ,
গ্লানি বেদনার শীতে আমি আজ খুনি; আমাকে
এই অপরাধে রিমান্ডে নিয়ে অসহ্য প্রহারে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত
তারপর কোর্টে চালান দিয়ে ৩০২ ধারায় দণ্ডিত করা উচিত;
দণ্ডিত হওয়ার পরে আত্মকথনে বলব,
কী লাভ লাইনগুলোর আরাধনা করে?
যখন দেখি মানুষগুলোর চব্বিশটা ঘণ্টা কাটে
পেটের চিন্তায়, আগামীকালের ভাবনায়
নতুন ভ্রুণের রোদনে সামাজিক ঝগড়ায়
তাদের দেখে দেখে অন্ধ অজানাতে নিজেকে দেখি ঈশ্বরের হাতে
তখন মানুষগুলোর জন্যে আমি নিজেই হাজারটা কবিতা...
যাকগে সে আলোচনা, অনেকের কাছে এলেবেলে কথা
এখন অলস শীতকাল; নিষ্প্রাণ দিনের
কাঁচা রোদে বসে কুঁড়েমির এখনই সময়
লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকাই এখন একমাত্র কাজ,
অন্যের মতই শুরু করি নীরবে দিনাতিপাত;
বহু বহুবার আমি অসহ্যকে দেখে ব্যথিত হয়েছি
ভিড় করা মেঘগুলোকে তাড়াতে গিয়ে
জীবনের সব হিসেব করা ছেড়ে দিয়েছি।
কবিতা >> করাত : বাপী ভট্টাচার্য
করাত
বাপী ভট্টাচার্য
এই ভর দুপুরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়াতে হবেভেবে, দাঁড়াতে গিয়ে দেখি গাছ নেই।
ধুলো উড়ছে বাতাসে। ধুলোর গন্ধ নেই
ভিতর ভিতর বুকের ভিতর
ধূসর হয়ে যাচ্ছে সময়
বিশ্বাস করুন।
রাতের পর রাত বিনিদ্র শয্যায় শুইয়ে
চিন্তা যদি যদি আপনাকে দিই
কেমন হবে ভেবে দেখুন
যে শূন্যতা, হতাশা বিরাজ করছে
ভিতর ভিতর বুকের ভিতর অনুভব করে দেখুন
যেমন দু’ দিকে কাটছে করাত।
আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত
কবিতা >> ছায়াসংক্রান্ত : তানভীর আহমেদ হৃদয়
ছায়াসংক্রান্ত
তানভীর আহমেদ হৃদয়
শরীরের ছায়াকে কে আর কবে দেহের সাথেগোপন ইচ্ছের মত বাঁধতে পেরেছে বলো?
যথাযোগ্য অপমান খুব বেশি প্রগাঢ় হলে
শারীরিক ছায়াও একদিন তার সাথে দীর্ঘতর হয়।
এ আকাশ কবেই বা তার ছায়া দিয়ে মানুষের
আব্রুকে ঢাকতে পেরেছিল!
কেবলই জিজ্ঞাসা আর অমানবিকতার চোখে বালি
রঙ মেখে, ছায়াও চিরকাল দূরে থেকেছে...
কবিতা >> পরম্পরা : তুহিন দাস
পরম্পরা
তুহিন দাস
সন্ধ্যার একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঠোঁটে তুলে পাখি উড়ে যাচ্ছেমুুহূর্তের প্রেরণায়,
যারা দিনভর গাঁইতি কোদালের কোপে মূর্তি গড়ছিলো ওদের হৃদয়েও
মুচড়ে উঠছে পাথর,
ঠিক এসময় ধূলোবালি গোটা এক পাক খেয়ে আসে
পুরোটা শহর,
বাড়ি ফেরার অস্থিরতায় মেশা মুখগুলো নিঃস্তেজ ও বন্দি
ভাঙাচোরা বাসগুলোতে,
তখনই যুবকেরা মাঠে গোল হয়ে বসে ফাটিয়ে ফেলে
গাঁজার বীজ,
এক টুকরো দড়ির উপর অপ্রতিরোধ্য কসরতে নামে খেলা দেখানো
সার্কাসবালক,
একটা কাঠঠোকরা নিজের ছায়া ঠুকতে ঠুকতে খোড়লে
ঢুকে পড়ে,
ফুটপাতের দোকানে চায়ের কাপে শেষ চুমুক মেরে রাস্তায়
চলে আসে লুটেরাদের দল,
আযানের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধ ভিক্ষুকের পাত্রে
ছোঁড়া পয়সাধ্বনি,
বুনো শুয়োরের পালের মতো গাড়িগুলোর
এগিয়ে চলা,
শহরের স্যাঁতসেঁতে হাওয়ায় নিঃশ্বাস জ্যান্ত সাপের মতই
ভারি মনে হয়,
একশত বছর আগের যন্ত্র থেকে ফুঁসে ওঠা
হুইসেল,
দপ করে আলো জ্বলে উঠলো কোথাও
আকাশমুখো,
বাতাসে ভাসা পতিতাদের গানের
উচ্ছিষ্ট অংশ,
সন্ধ্যার জানালা টপকেই রজনীগন্ধার হু হু
মাতাল গন্ধ,
রাজপথে মিছিলের ব্যর্থ
আস্ফালন,
করিডোরে কারো হেঁটে যাবার
একঘেয়ে শব্দ,
হঠাৎ লোডশেডিঙয়ে বাতিদানে ছড়ানো
আলোর চুল,
কারো প্রতীক্ষায় অতিষ্ঠ
দুর্লভ সময়ের ভেঁপু,
একটি মেয়ে চুপচাপ ঢুকে পড়লো
ছাত্রীবাসে,
ছেলেটি হলুদ বাতির নিচে তখনো
হাওয়াইফোন কানে দাঁড়িয়ে,
শব্দাবলীতে জমে ওঠা এ সপ্তাহের
নাটকের আহ্লাদ,
ঘন ঘন হাততালিতে ব্যস্ত শৈল্পিক ও সক্রিয়
মানুষের হাত,
তখনো পার্কের একটু অন্ধকারে খুব দ্রুত খুলে নিচ্ছে
প্রেমের থেকেও আটসাঁট অন্ধকার,
মানুষ এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায়
পাগলের মতো ছুটছে,
আসলে কুয়াশার থেকে আর কিছুই
সত্য নয়,
পশুপাখিরা ওদের চোখগুলোকে
আধখোলা করে ফেলেছে,
ছায়াগুলো বেকুবের মত
লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে,
তাড়াহুড়ো করে রিকশা থেকে নামতে গিয়ে
একটা নখ উল্টেই গেলো,
তৃষ্ণার ভেতর দাঁত বের করে হাসছে
শুষ্ক ফুসফুস,
ওই তো আবারো কয়েকটি বাড়ির পরে রহস্যময়
আলোর সঙ্কেত,
নৈঃশব্দের ভাষা লিখতে এসে কবিকূল থেমে পড়ছে
ভূতের মতো,
শুধুই ধমনীতে রক্তের চলাচল ছাড়া আর কোনো
কৃতি নেই,
সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে আছে
আধখাওয়া ডালিমফল,
সান্ধ্যকালীন আড্ডায় কবিদের সঙ্গমকাহিনী বুঝছি
এক নারীতে উপগত সকলে,
স্বপ্নকে কেটে ফালাফালা করে দিচ্ছে কার
প্রশংসনীয় তলোয়ার,
অথচ কেউ একজন জিরাফকান তুলে বুদ্ধধ্যানে বসে আসে
অস্তপারের সন্ধ্যাবেলায়।
কবিতা >> কী আশায় : পদ্মনাভ অধিকারী
কী আশায়
পদ্মনাভ অধিকারী
উত্তরে দখিনে দু’ হাওয়ার কালো-সাদা দুই পাখিকী আনন্দে দু’ ডানায় হাওয়া কেটে কেটে
শীতলক্ষ্যা-পদ্মা, পশুর-রূপসা
পাড়ি দিয়ে এ পুণ্যভূমি যশোরে,
শরৎ থেকে হেমন্তে কী মায়ায় ডানা ঝাপটে
ঘুরে ফেরে এ সীমার অবয়ব জুড়ে!
ঘোরের ভ্রমে নয়তো-মিষ্টি জল হাওয়া
কিংবা অন্য কোনো স্বপ্নগন্ধী পরিচয়ের আঙিনা জুড়ে
থেকে কিংবা রেখে যেতে চায় স্মৃতির মিনার,
অথবা নিয়ে যেতে চায় হৃদ ভূমি উর্বরা করা
কোনো অজৈব জারন ক্রিয়ার জারক, যা
দীর্ঘদিন রাখবে সজীব-হৃদ জমিনের
উর্বরা শক্তি ও ভক্তি, হয়তো সে আশায়
কিংবাা ঘুরে ফেরে পাখি অন্য কোনো ঠিকানা-ঠাঁইয়ের
স্বপ্ন পূরাতে ডানা ঝাপটে রাত্রিদিন...
কবিতা >> পরিবির্তত পৃথিবীর পরে : সুমন আখন্দ
পরিবির্তত পৃথিবীর পরে
সুমন আখন্দ
একটি করাতকেঁপে উঠলো সারি সারি গাছ
একখানা জাল
পালিয়ে গেল শত শত মাছ
শাবল দেখে ভয় পেয়েছে একটি পাহাড়
কোদালের কথা শুনে কাঁদছে মাটি
পথের পাগল ভাবে,
এখানে আর কেমনে হাঁটি!
ঠিক তখনই দূর্ঘটনা
বাস রিকশা চায়ের দোকান
সব জায়গায় একই আলাপ
পৃথিবীর পেটে ছুরি মেরে
পালিয়েছে বিশ্রী গোলাপ!
অথচ এতদিন ফুলটি ছিলো প্রেমের প্রতীক
‘চেঞ্জ উই নিড’ বা ‘পরিবর্তনের সনদ’ যাই বলি না কেনো
কেনো আবার খুনোখুনি বাড়লো?
প্রেমিকা কেনো প্রেমিককে মারলো?
প্রশ্ন অনেক- উত্তর নেই
করাত, জাল, শাবল, কোদাল বাড়ছেই
মনে হয় মশার মতো আরো বাড়বেই!
কবিতা >> ধন্যবাদ ফেইসবুক : তুহিন চৌধুরী
ধন্যবাদ ফেইসবুক
তুহিন চৌধুরী
কাছের মানুষদের নিয়ে স্মৃতিগুলোএখনো চোখের সামনে ভাসে
আজও সেই মানুষগুলোর সাথে
যোগাযোগ হয় নিয়মিত
মুঠোফোন আর ফেইসবুকে জেনে নিই
একে অন্যের খবর
যেমনটি জেনে নিতাম অনেক আগেও
পাড়ি দিতে হতো অনেকটা পথ
নষ্ট হত অনেক সময়
তারপর হাতে হাত রেখে
দলাদলি আর গলাগলি করে
আরও কিছুটা সময় নষ্ট করতাম
এখন আর সময় নষ্ট হয় না
তবু মিলে যায় সব খবর
শুধু পরশগুলোই মিলে না
মাঝে মাঝে এই মানুষদের
ছবির মতোই মৃত লাগে
ধন্যবাদ ফেইসবুক
মৃত ভালোবাসা উপহার দেওয়ার জন্য।
কবিতা >> মাঠে : জ্যোতি আহমদ
মাঠে
জ্যোতি আহমদ
অনেক দূরে আছো, আমি দেখতে পাই।ভাবতে ভালো লাগে তুমি আছো বিভোর সুস্থির
পরম এক আকাশ অতি পুরাতন,
কিছু লোকের পায়ের ধুলোর মধ্যে পবিত্র সত্য এক
লিপিকা-আমি, আর কেউ কেউ টের পাই।
খুশি আপা বিকেলে শুয়ে থাকেন, জানালার পাশে
কোেনা মেঘ-চিহ্ন নাই, আশেপাশে সমুদ্র নাই
চিরুনি জড়িয়ে অসংখ্য ছেঁড়া চুল, তার
তীব্র প্রতীক্ষার শরীর কতবার ঘুরে এসে থেমে আছে
শাড়ির আঁচল-কুঁচকে যাওয়া, মনে হয়
আমাদের ছোট নদী তীরে নৌকোর মতো ভেসে ভেসে
এসে দাঁড়ালো কোন নগণ্য গ্রাম-কুঁচকে যাওয়া।
কাউকে কিছু না বলে অনেকটা মৃত তিনি,
বিরক্ত এক নারীর লাশ তখন খুশি আপা।
ধরলার উপর ব্রিজ দেখা যায়,
সন্ধ্যায় তরুণ-তরুণীদল উঠে পড়ে ব্রিজের উপর
রেলিং ধরে ধরে সৌরভ আলো ছড়ালো কেউ, মুঠোফোনে
ঝনঝন করে বেজে ওঠে জুবেনের গান। নিচে,
বালুর তলে অসংলগ্ন শুয়ে থাকে মরা ধরলা নদী।
সামান্য পানি, বালকের হ্যাঙ্গা জালে
একটা মাছ নাই, কাঁকড়া নাই।
অত দূরে নয় বলে এক সামান্য আলোর শহর থেকে
সেই সন্ধ্যায় একদল বিষাদগ্রস্ত লোক
বাড়ি ফিরে আসে,
কাদা-করা জমিতে ধানবীজ ছিটাবে আগামী কাল।
আশা ছিলো, প্রস্তুতি লগ্নভ্রষ্ট হলো এখন।
খুশি আপার বাড়ির পাশ দিয়ে পথ ঘুরে যায়।
অনেক পালতোলা বাড়ি- গোছানো, সজীব
কারো উদ্যান জুড়ে ছড়ানো বিভিন্ন পাতাবাহার
অলৌকিক নীল, হলুদ ও লাল এদের ঘ্রাণ
আমাকেও টানে-অন্য কেউ কেউ বিবস্ত্র হয় প্রায় রাতে
আর আমার মধ্যবিত্ত যৌন বাসনা অসাড় পড়ে থাকে
হারাবার অমূলক ভয়ে।
শৈশব দেখেছিলো এক ভয়াবহ যুদ্ধ
রক্তের বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে মৃত্যু।
হয়তো ভয় পেয়েছিলাম অথবা ক্রোধের
পরিভাষা মুখস্থ করেছি সেদিন, হতেও পারে
এক বিমূর্ত প্রতিজ্ঞা ছুঁয়েছিলো, মাকে-হঠাৎ
খামচে ধরে বলেছি কিছু।
এতো বছর পরে আব্বার ধুলোময় সব বই, মাকে লেখা
পত্রাবলী, বিবর্ণ ফটোগ্রাফ থেকে কিছুতেই
সরে যেতে পারি না রাতের ঘুমের ভিতর।
আকাশের নিচে অমর এক কাচঘরে
বিকেলে শুয়ে থাকেন খুশি আপা বিরক্ত এক লাশ হয়ে।
শুয়ে আছে মাউথ অরগান।
মেঘ দেখা জানালায় আজও কোনো মেঘ লাগে নাই
প্রবল তাপ নিয়ে শুকনো, সরু নদীর ভেতরে
সূর্য ডুবে যায় আর সন্ধ্যায় তীব্র... অসহ্য চাঁদের আলো।
বৃষ্টির সম্ভাবনা নাই জেনে সেই রাত্রিবেলায়,
সেই চাঁদের আলোয় অনতিদূরে পড়ে থাকা এক মাঠে
জড়ো হলো লগ্নভ্রষ্ট সেই কিছু লোক। বিকল্পের খোঁজে
তীব্র অনুসন্ধান হলো, আর তাদের
সরল কথোপকথন রাত-ভোর ভেসে থাকে।
অনেক দূরে আছো, আমি দেখতে পাই।
ভাবতে ভালো লাগে তুমি আছো বিভোর সুস্থির
পরম এক আকাশ অতি পুরাতন,
কিছু লোকের পায়ের ধুলোর মধ্যে পবিত্র সত্য এক
লিপিকা-আমি আর কেউ কেউ টের পাই।
কবিতা >> আমার বেদুঈন মন : সাবিত্রী গাইন নীলিমা
আমার বেদুঈন মন
সাবিত্রী গাইন নীলিমা
অন্ধগলি পথে ছুটে চলা যৌবন খুঁজে ফেরে মায়ার রোদ্দুর নিরাশার চরে খেলে যায় বিবাগী বাতাস - লুকোচুরি স্রোতে ভেসে যায় আশার বসতি ক্লান্ত অতীত সুখ - সোনালী শৈশব কৈশোর বাঁধাহীন প্রান্তরে ছুটে চলা আনমনে কথা বলা অফুরন্ত নির্ভেজাল ভালোবাসা - গায়ে লাগে ভালোলাগার পাগলা হাওয়া।
স্যাঁতস্যাঁতে ধোকাময় পথে অনন্ত হেঁটে চলা আমি আর আমার বেদুঈন মন,
স্বপ্ন সাজানো বিশ্বাসমহল খসে যায় অকস্মাৎ পড়ে থাকে আঁটকুড়ে যৌবন।
কবিতা >> মিথ্যেবাদী : সৈয়দ শিশির
মিথ্যেবাদী
সৈয়দ শিশির
ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে বলেছিলে-তুমি আমার প্রথম পুরুষ
আমি বুকভরা বিশ্বাস নিয়ে তোমার ললাটে
ঠোঁট ছোঁয়াতেই উচ্চারণ করলে-
এমনটি আমার খুবই পছন্দের!
আমার চোখ তখন স্থির হয়েছিলো
ধর্মগ্রন্থ আর ঈশ্বরের চোখে।
কবিতা >> ঈশ্বরতত্ত্ব : সুস্মিতা পাল
ঈশ্বরতত্ত্ব
সুস্মিতা পাল
ক্ষয়ের হিসেব রাখতেইআসতে হয়েছে ঘুণপোকাদের-
গর্ভের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির
প্রথম পত্তন এঁকে
ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত মানবের
ঈশ্বর পদ পেয়েছে তারা!
আদিম আরশোলা-জন্ম খোদাই হচ্ছে
সেই উল্লাসে!
হ্যানয়, ভিয়েতনাম
কবিতা >> কবি ও কমরেড : জাবেদ ভূঁইয়া
কবি ও কমরেড
জাবেদ ভূঁইয়া
এক বিপ্লবী দেখুন, সে রাষ্ট্রদ্রোহীসরকারের সমালোচনা, রাষ্ট্র-দ্রোহের সমান।
ব্যর্থ অনুসন্ধান করে তাকে খুঁজে পাবে না
সে বৃক্ষের আড়ালে যায়নি -
মিছিলে খোঁজো, দেখো পেতে পারো লিকলিকে শরীর
লুকানোর জন্য কোনো গুহা খনন করেনি সে
খুঁজেনি পর্বত-পাহাড়
শুধু রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকে
মুখোশের নগ্ন দৃশ্য দেখে
প্রকাশ্য থু-থু বাতাসের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে।
শহরের কুলাঙ্গার যারা, তারা জানেন -
সে কতটা বেয়াদব। গোলামিতে পোষে না তার,
তাই রহমতের রাত-বিরাতে বঞ্চিত পথিক,
ভীষণ যোদ্ধা, যদিও নিঃস্ব সে, তবুও সাহসী,
তোমাদের মতে হতে পারে বে-দ্বীন, নাফরমান
সে বিপ্লবী কবি ও কমরেড।
কবিতা >> ভূষণপুরাণ হাল সংস্করণ : হিরণ্ময় হিমাংশু
ভূষণপুরাণ হাল সংস্করণ
হিরণ্ময় হিমাংশু
ভূষণ- শিবতান্ত্রিক এক সিদ্ধযোগীভূষণ- ফল ফলা এক মহামাহান
যার ফলের মহিমায় ভরে যায় আঁটকুড়ো যৌবন বন্ধ্যা জরায়ুতে ফুটে পুষ্পিত জীবন
চতুরদর্শী অমাবশ্যার রাত
নিন্দে নিভাব পাড়া
শিবথানে ফল নামার মহালীলায় ব্যতিব্যস্ত ভূষণ সাথে পোহাতুর বেইচ্ছয়া
আজ ফল নামবে
শিবথানে
মর্ত্যধামে
আঁটকুড়ো ঘরে
পোহাতুর বেইচ্ছয়ার কোল আলো করে
দু’হাত হাটুতে ভর দিয়ে বগামার্কা মত প্রতীক্ষায় থাকে - বংশের প্রদীপ জ্বলে উঠলো বলে পোহাতু তাকায় বেইচ্ছয়ার তলপেটের দিকে অতঃপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা দিনের পর দিন দেখতে দেখতে আবারো অমাবশ্যার চতুরদর্শী রাত
সরিষার কামুক ঝাঁঝালো ঘ্রাণের মত উর্বর হয়ে আসা নারী অতৃপ্ত কামদেবের অনুশোচনাগ্নিতে জ্বলে যাওয়া পোহাতু-
ভূষণ তো খুঁজবেই চতুরদর্শী রাতআবারও শিবথানে ফল নামার মহালীলায় লালায়িত ভূষণÑ পোহাতুর বেইচ্ছয়া স্বপ্নবিভোর।
কবিতা >> স্বপ্নমাখা জোনাক রাতের উল্লাস : সেলিম রেজা
স্বপ্নমাখা জোনাক রাতের উল্লাস
সেলিম রেজা
কত শত বার হত্যা করতে চেয়েছি বেপরোয়া বয়সটাকেনিজেকে শুধরে নেবার চরম সিন্ধান্তে নিভু নিভু পিদিম
ভাবনার চুনকামে অন্ধকার অতল থেতলানো মগজ
মুখোশের ভেতর মুখোশ; রঙ বদলানো লুকোচুরি খেলায়
জ্যামিতিক সময় হামাগুড়ি দিয়ে আড়াল হয় মাধবকুণ্ডে;
দশহাত ঘোমটা টানে অপ্সরী মেঘ
স্বপ্নমাখা জোনাক রাতের উল্লাসে আগন্তুক
বিশ্বাসে বিশ্বাস হারিয়ে হেঁটে চলে তামাবিল
মিথ্যের গোলক ধাঁধাঁয় অক্টোপাসের মত
শুষে নেয় রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিন
চোখের পাতায় বিন্দু বিন্দু জল
ভীষণ যন্ত্রণায় ঠিকানাবিহীন দেউরিঘর;
কোমরে স্বপ্নদোষের তাবিজ, শূন্য হাতে মৃত নদীর পার-
একটি পালক নিয়ে সুতোকাটা রাতের পরী
ওড়ে শুধু ওড়ে রূপবতী হয়ে
প্রাণোৎসর্গ করে যায় যৌথশ্রমে গড়া
স্বপ্নীল বসত ভিটায়।
কুয়েত সিটি, কুয়েত
কবিতা >> তৃতীয় মাত্রা : আহমদ আফরোজ
তৃতীয় মাত্রা
আহমদ আফরোজ
জলের প্রযত্নে লিখে রাখি ধূসর দুরন্তপনাঅবলা বৈঠা মুঠোভরা রোদসমেত নিয়ে যা আমায়
সকরুণ আর্তির কাছে।
খোলসের গান নয় ধাবমান শাঁসের আকুতি
পরাণের হৈ চৈ খৈ ভাজা কড়াইয়ের মতো
হে সূর্য, বহু অন্ধকার চোখের জন্য
তোমার প্রতিনিধি করো
মানুষ যদি আলো হতে বঞ্চিত হয়
তবে তোমার মহিমা কোথায়?
হেঁটে হেঁটে এতো দূর এসেও আরো দূর খুঁজি
কাছে না থাকার দুঃখ জন্মেনি এতোটা দূরত্বের মাঝে
প্রাণের চেয়ে শিল্পের সৌন্দর্য বেশি নয়-প্রকৃতির যশ
অবলীলায় মহাকাশ ছুঁয়ে গেলেও
কারো দাবি নেই ছুঁয়েছে হৃদয়ের অন্ত
হে আকাশ, তোমার বিশালতার সঙ্গী করো
পীড়িত হাড়ের অন্য আকাশ; বাতাসে ছড়ানো আত্মদহন।
কবিতা >> ভূতো কিংবা হৃত তৃষ্ণা : জিল্লুর রাহমান জয়
ভূতো কিংবা হৃত তৃষ্ণা
জিল্লুর রাহমান জয়
কানামাছি ভোঁ ভোঁ আর সাপলুডু ভূতুড়েরাতখুনি সরেছে বটে, অথচ সারেনি মোটে
বউ বউ খেলার খায়েশ
উদাস দুপুর বেলা ঝরোঝরো বৃষ্টিতে
তখনও চাপতো ঘাড়ে যক্ষের ভূত এসে
হিমালয় কৈলাসগিরি ঘুরিনি-ফিরিনি আমি
অথচ ঘুরে ও ফিরে সেই তো খেলি কানামাছি, বউচি।
তারা দূরে নিয়ে গেছে কেউ, কেউ কেউ হাত ধরে-টরে
দেখিয়েছে পথ, অথবা আমিও কাউকে বা...
কারো কারো আঁচলের গিঁটে আমারই গিয়েছে এঁটে
এতগুলো অবসর অবসন্ন দুপুর
গোঁ ধরা গোঁয়ার্তুমিতে কখন কী করেছি না-কি
ওসবে আজও মনে খিল ধরে হাসি পায়,
কখনও জানলা ধরে বালিশে মুখটি গুঁজে
বিস্তর জলধারা গড়িয়েছি একাধারে;
কারো কারো জন্য তো এইমত দিত মনোনাড়া
ওইসব পুরনো দিন আজকাল দ্বারে এসে ঘুরপাক খায়,
তবু দরজা দেখেনি ঠুকে- 'ওখানে কে আছে গো,
কে আছ ভিতরে?' ডেকে গেলে অন্তত একবার
ঢেকে তো দেব না কোনও ঐন্দ্রজালিকে!
এই একটু পলকে দেখে তৃপ্তির সুখে ভেসে
আয়ুষ্মান হই আরও বড়জোর দুটো দিন
এ নেশা ঘুচালে তবে নিশ্চিত ছেড়ে যাবে বুকে ব্যথা চিনচিন
বউ বউ ক্রীড়নক; ভূতো কিংবা হৃত তৃষ্ণা।
কবিতা >> শূন্যতা : হামিদা রহমান
শূন্যতা
হামিদা রহমান
আমাকে টেনে রাখছে শূন্যতা। অবিকল দু’হাত ধরে, আমার সমস্ত সত্তায় যখন ভর করে; সে বিশ্বস্ত হাতে আরও চেপে ধরে, গ্রাস করে সমস্ত কিছু। আহার, নিদ্রা নাই। সে আমার কানে ফিসফিস করে বলে- আপন কথা।
ট্যাপের জলে সেও ঝলঝল করে, জলরঙ মাখি। রাতের রঙ ফিকে হয়ে আসে। সূক্ষ্ম তারতম্যের স্তরে-স্তরে প্র্রলোভিত করে। আকাশের নীল রঙ লীন হয়ে আসে। মোহ জটিলতা ঘুরপাক খায়।
কবিতা >> ইতিহাসগত পার্থক্য : ফয়সল অভি
ইতিহাসগত পার্থক্য
ফয়সল অভি
আমার জন্মের দু’মাস আগে মা নানার বাড়ি গিয়েছিল, তার মায়ের আলিঙ্গনে একজন গর্ভবতী প্রসব করলো আজান। আজান মানে আহ্বান, দলে দলে লোক আসলো।
হাতে হাতে জমলো মাটি. গড়ে তোলা হলো স্নেহ। আর ফলবতী ফসল কাটা হলো উৎসবে। সে সময় আনন্দের সংবাদ ছড়াতো সবার কানে কানে এবং মুখে মুখে হাসি আর পানের গন্ধে হতো নাতির মুখ দেখা। আমি বুঝেছি আরো পরে; তখন কোনো আশ্রম ছিল না সবাই লাঙ্গলের আর্দশে বেশ মানবিক।
ঠিক তার সাতাশ বছর পর...। শহরের সবচেয়ে উঁচু স্পিড ব্রেকার সামনে তার চেয়ে আরো আধুনিক সাদা বেডে জন্ম হলো আমার রক্তে প্রথম সূত্রপাত..... আমি হলাম বাবা। কী আশ্চর্য! সর্বোচ্চ স্বরের আজানটা এখানে আহবান হলো না। আগত সময়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ব্যাংকে খোলা হলো একটা একাউন্ট, সাথে আশ্রম থেকে আনা হলো বৃদ্ধ মাকে। কারণ এ সময়ে শিশুটির মা ও বাবা দুজনই কর্মজীবী। কর্মের দায় বয়ে বেড়াতে হবে অগোছালো মাটিকে। কিন্তু কেউ জানে না সেই মাটির বুকে কোনো এক প্রৌঢ় বৃদ্ধা আঙুলের স্রোতে নিয়তই রোপণ করে যায় অতীত। বড় হতে হতে নতুন হয় প্রাপ্তবয়স্ক জেনে যায় নগরের সকল ধারা। একসময় পরিণত নাগরিক আর দিন শেষে অনুভূতির বিষাদগ্রস্ত ভোর। তাই সে কলমের কালি গিলে গিলে জ্ঞানী হয়েছিল তারপর জ্ঞান বিক্রি করে বেঁচে থাকে আর শহরে শহরে নতুন নতুন আশ্রম উদ্বোধন হয়। সাদা মনের মানুষের তালিকা ক্রমশঃ আরো বড় হয়।
অবশেষে আমি আশ্রম থেকে লিখছি, শেষ হতে হতে একদিন সব নিঃশেষ হয়ে যাবে অতঃপর আদম ও হাওয়া থেকে আবার নতুন ইতিহাস। হয়ত এটার নাম ঈশ্বরচক্র যা বরাবরই অখণ্ড।