শুক্রবার, ৫ নভেম্বর, ২০১০

অনু গল্প >> তুমি কার, কে তোমার : মুজাফফর আলী তালুকদার

তুমি কার, কে তোমার

মুজাফফর আলী তালুকদার

ছানিপড়া চোখ দিয়ে দু’ ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো হাড়সার গালের উপর। অনন্ত অজেয় মহাকাল যেনো চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ক্ষিপ্র গতিতে কাল স্রোতের সাথে মিশে প্রবাহিত হয়ে গেছে একাশিটি বছর। কীভাবে - কীভাবে? খেলার সাথী ফজল, শ্যাম, বউ জমিলা ছেলে জলিল ওবাড়ির রফি, ওপাড়ার বিন্দা, নীলি আরও - আরও - তারা কোথায়? নাহ, মেলাতে পারে না হিসেব।
বারান্দায় পাতা জনকাচৌকিতে শুয়ে শুয়ে কতো কী যে ভাবছে বিপত্নীক কবজ উল্যাহ! স্ত্রী মারা গেছে কতো দিন আগে। নাহ, আর ভাবতে পারে না সে! হেমন্তের ক্ষুদ্র দিন শেষে দুর্লভ রোদ কবজ উল্যাহর বিমর্ষ মুখ এক পলক দেখেই পালিয়ে গেলো বাড়ির পশ্চিম পাশের গাছপালার আড়ালে। এমন সময় পিতার পাশে এসে দাঁড়ালো জুলি। একমাত্র মেয়ে জুলি - জুলেখা।
ছোট ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে চাকরিস্থল - শহরের ভাড়া বাসায়। বাড়ীতে মেজো ছেলের বউ বেশিরভাগ সময় থাকে অসুস্থ। কোনোমতে ককিয়ে-ঘ্যাঙিয়ে চালায় সংসার। শ্বশুরের নামে তার মুখের বুলি ‘বুড়া’, ‘বোঝা’।
পিতার অসুখের সংবাদ পেয়ে পঞ্চগড় থেকে স্বামীসহ এসেছিলো জুলি। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা, তাই ছেলে-মেয়েকে রেখে এসেছে বাড়িতে।
ছোট ছেলে হাবিবুল্যাহকেও মোবাইল করা হয়েছিলো বাড়ি আসতে। পিতা কবজ উল্যাহ কয়েকদিন আগে একা একা বাথরুমে যেতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলো মাথা ঘুরে। তারপর জ্ঞানহীন। তিন দিন বাঁচামরার উৎকণ্ঠা। কিন্তু বাড়ি আসতে পারেনি হাবিবুল্যাহ। তার প্রেমিকা স্ত্রী দু’ বাচ্চাসহ বাপের বাড়ি গিয়ে অসুস্থ। বাসা খালি। অফিসে নয়জন কর্মচারীর মধ্যে তিনজনই ছুটিতে। বাড়ি আসতে পারেনি হাবিবুল্যাহ। বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় একাই গিয়েছে; কিন্তু বাসায় আসার সময় একা আসতে পারবে না তার স্ত্রী। হাবিবুল্যাহকে যেতে হবে আনতে। তারও নাকি মাথা ঘুরানি। কোন দিকে যাবে হাবিবুল্যাহ। তাই ছোট বোন জুলিকে মোবাইল করে বাপকে দেখতে যেতে বলেছিলো সে। এ ব্যাপারে ভাই-বোনে কথা কাটাকাটিও হয়েছে।
বৃদ্ধ কবজ উল্যাহ একটু সুস্থ হয়েই জুলিকে দেখে বলেছিলো - হাবিব আসে নাই? হাবি কই?
কিছু বলতে পারেনি জুলেখা। ঠোঁট কামড়ে রোধ করেছিলো কান্না।
মেজো বউ ঝঙ্কার দিয়ে উঠে - বুড়ার মুখে খালি হাবি-হাবি। আরেকজন যে বাড়িতে থাকে, বোঝা টানে - তার বেলায় মুখে তালা।
মেয়েকে সামনে দেখে হাতের উপর ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসলো কবজ উল্যাহ। পিতার পায়ে সালাম করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো - বাবা, যাই।
কাঁপা কাঁপা হাতে চেপে ধরে মেয়ের হাত। তাকায় মেয়ের দিকে। উদ্গত অশ্রু সংবরণ করতে শেষ শক্তি ব্যয় করার পরও অবাধ্য দুটি ফোঁটা শত্রু হয়ে দাঁড়ালো পিতার ছানিপড়া চোখে।
মেয়ে! পিতার কাছে মেয়ে এক টুকরো আগুন। জ্বালা। মেয়ে বড় হচ্ছে যেনো ছেলের সাথে দৌড়ের পাল্লায় এগিয়ে যাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। যে পর্যন্ত বিয়ে না হবে পিতার বুকে জ্বালা। বিয়ের পর পিতার বুকের গভীরে অনন্ত রক্তক্ষরণ।
পিতার স্নেহমাখা হাতের স্পর্শে বয়ষ্ক মেয়েরা মুহূর্তে বালিকা হয়ে যায় - কিন্তু জুলেখার কী হলো - তার ঘড়ির কাটা চলতে থাকলো স্বাভাবিকভাবেই। সে আবার বললো - বাবা, আমি যাই!
কী যেনো কী মনে করে। নাকি কোনো কিছু না ভেবেই, আপনা আপনি মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো কথাটি। মেয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে বললো - আমাকে নিয়ে যাবি তোর সাথে। আমি এখানে... আর পারি না।
কী উত্তর দেবে জুলি। তাকায় ভাবির দিকে। বাড়িতে একমাত্র ভাই বউয়ের কয়েকজন ছেলেমেয়ের ঝামেলার মধ্যে মধ্যে বড় ‘বোঝা’ এই বুড়া। এখনই বড় মেয়ে বাড়ি আসবে প্রাইভেট পড়ে। পিতার কথা শুনে ছলছল করে মেয়ের চোখ। এখন কী কথা বলবে সে। তার পক্ষ হয়ে দুটো কথা বলার, এই চরম বিব্রতকর অবস্থায় কী উত্তর দেয়া যায়! তাকে সাহায্য করার কেউ নেই।
বিদায় মুহূর্তে ব্যাগ হাতে চশমাপরা স্বামীর তাগাদা - জুলি, কী ব্যাপার! দেরি করছো কেনো? সাড়ে পাঁচটায় ট্রেন, সময় ভুলে গেলে নাকি?
হাতের ব্যাগ উঠানে বিছানো খড়ের উপর রেখে এগিয়ে আসে জুলির স্বামী।
জুলি এগিয়ে স্বামীর কাছে গিয়ে একটু আড়ালে এসে অপরাধী কণ্ঠে বললো - আমি এখন কী করি বলো, বাবা আমার সাথে যেতে চায়। আমি কী বলবো?
- তোমার মাথায় কিছু আছে, এ বয়েসে উনাকে অতো দূরে নিয়ে যেতে চাও?
- আমি-আমি তো নিয়ে যেতে চাই না। বাবা বললো।
- আমার অফিস, তোমার কলেজ। নিজের ছেলেমেয়েরই খোঁজ নিতে পারো না। আবার পরের বোঝা!
স্বামীর নিকট থেকে ফিরে এসে বাবার হাত ধরে বিমর্ষ মুখে জুলি বললো - বাবা, আমার কলেজে পরীক্ষা, তোমার নানুদের বর্ষশেষ পরীক্ষা। আমি এরপর এসে তোমাকে নিয়ে যাবো বাবা। তুমি ভেবো না।
মনকে কোনো দিকে নিয়ে যাওয়ার যে মানসিক শক্তি সে তো পালিয়ে গেছে আগেই - তাই অনেক চেষ্টা করেও মুখে  সামান্য একটু হাসি আনতে ব্যর্থ পিতা বললো জ্- মা রে, তোকে আমি কোলে-কাঁধে নিয়েছি। তুই তো তা পারবি না। এরপর এসে আমার ছবিটা নিয়ে যাস।


 >> পথিক ১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন