নতুন গান
প্রণব আচার্য্য
ধরা যাক, কয়েকটি বালক একটি মেয়েকে ধাওয়া করছিল। মেয়েটির গ্রীবা থেকে আমাদের কবিদের চিত্রকল্পসমূহ একে একে বিদায় নিচ্ছে। ফলে ক্রমেই মেয়েটির ‘মেয়েটি’ থেকে মেয়েসূচক অস্তিত্ব লোপ পাচ্ছিলো। এরকম একটি দৃশ্যকল্প মাথায় রেখে এবার আমরা একটি জনবিরল গ্রাম্য বাজারে প্রবেশ করি। বাজারটির একটি নাম দেওয়া যাক, ধরলাম বাজারটির নাম কালীবাজার। বেশ পুরোনো; দেশান্তরী হওয়ার আগে হিন্দুরা এখানে রক্ষাকালীর পুজা করতো বিধায় এই নাম দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে অবশ্য বাজারটির নাম পরিবর্তন করে কাশেম বাজার দেওয়া যায় কিনা এরকম একটা আলোচনা আলোচ্য বাজারের মধ্যবর্তী কালীগাছটির ডাল পালায় ওড়াওড়ি করছিল। ইতিমধ্যেই অশ্বত্থ পেঁচানো কালী গাছটির কয়েকটি শাখায় বটের পাতাও গজাতে শুরু করেছে।
এবার চোখ ফেরানো যাক বাজার সংলগ্ন গেটঅলা বাড়িটির দিকে। গেটের ললাটে স্পষ্ট আরবি হরফে ‘আলাহু’র জ্বলজ্বলে ক্যালিওগ্রাফি শোভা পাচ্ছে। এই ক্যালিওগ্রাফী থেকে আধ মাইল উত্তর পশ্চিমে ধাবমান বালিকার অবস্থান- এটা মাথায় রেখে আমরা বাড়িতে প্রবেশ করবো। তার আগে বাড়ি এবং গেরস্থের একটা পরিচয় দেওয়া যাক। বাড়িটির বর্তমান মালিক যথাযথ প্রক্রিয়ায় নামের আগে হাজী শব্দটি যুক্ত করেছেন সতেরো বছর হয়। অভিজ্ঞ পাঠকদের নিশ্চই মনে আছে আজ থেকে সতেরো বছর আগের সেই বিশেষ বছরটির কথা? সে বছর আমাদের ভারতীয় দাদারা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছিলেন। আর তার সুবাতাস এসে লেগেছিল আমাদের এই কালীবাজারেও। ধীমান পাঠকবৃন্দ, এটিকেও মাথায় রাখবেন। হাজি সাহেব পড়াশোনা করেছেন অবশ্য প্রবাসের মাদ্রাসায় (তখনো মাদরাসা শব্দটি প্রচলন শুরু হয়নি)। পাঠক, এখানে প্রবাস মানে কালীবাজারের বাইরের এলাকা। যেদিন তিনি প্রবাস থেকে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন তার দুই দিন পর গনেশের দোকানে চা দিয়ে পরোটা খেতে খেতে আমরা জানতে পারি, ‘ছোবান মিয়া বৈদেশ থিকা হাফেজ হইয়া আইছে। লগে দুগা বিবি আর জমজমের পানিও আনছে। হেরে অহনত্থুন আজি সাব কই ডাইকতো অইবো। এখানে একটি কথা বলে রাখি, বেশি নয়, তিন পুরুষ আগে হাজি সাহেবের বাপের দিকের কোনো এক মহিলা সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ ঘরের কনিষ্ঠা কন্যা ছিলেন।
এখন আসি যে বছর রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতীয় দাদারা উন্মাদ হলো সে বছর এ গ্রামের এক দুপুরের ঘটনায়। শিবু ধরা পড়েছে। বেঁধে রাখতে হয়নি, সুযোগ থাকলেও সে পালায় না। শ্রীযুক্ত শিবুর পরিচয় হচ্ছে সে এ গ্রামের সবচেয়ে বর্ষীয়ান চোর। এটা উত্তরাধিকারসূত্রেই প্রাপ্ত। পাকা হাত। অবশ্য তার একটা নীতি আছে, মোসলমানের ঘরে সে কখনো চুরি করে না। তার নাকি মুখে রোচে না। পাঠক, স্বধর্ম মরণং শ্রেয়, পরধর্ম ভয়াবহ- বহুকাল আগে গীতামুখে কৃষ্ণ নাকি এ কথা বলে গিয়েছিলেন। যাক সে কথা। বিচার বসেছে। শান্তিবাবুসহ অন্যান্য সালিশদাররা এখনো এসে পৌঁছাননি। এরই মধ্য শিবুকে তৃতীয় বারে মতো উত্তম মধ্যম হজম করতে হয়েছে। চতুর্থবারের সময় প্রতিরোধ গড়ে তোলে সে। উৎসাহীরা কিঞ্চিত ভয় পেয়ে নিরস্ত হয়। ভিড় থেকে সহমর্মী একজন শিবুকে একটি কে-টু সিগারেট ধরিয়ে দেয়। সিগারেট টানতে টানতে শিবু এবং উৎসাহীরা সালিশদারদের অপেক্ষা করতে থাকে। প্রিয় পাঠক, দয়া করে ঐ বালিকাটির কথা ভুলে যাবেন না।
অনেক তো ধান ভানলাম, এবার নিজের পরিচয়টা দিই। আমি গান লিখি। প্রচলিত আছে, ব্যর্থ কবিরাই নাকি গান লেখে। আমিও কবিতায় বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে কিছু দিন হলো গান লিখতে শুরু করেছি। নিজে লিখি, নিজেই সুর করি। আমি অবশ্য কালীবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা নই। থাকি ভিন গাঁ-এ। এমনকি গল্পের প্রথম থেকে যিনি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন আমি তাঁর কেউ নই। অথবা যারা তাঁকে ধাওয়া করছে তাদের সাথেও আমার কোনো পরিচয় নেই। আমি শুধু একটি গান লেখার অপেক্ষায় আছি। একটি নতুন গান। যে গানে কোনো উপমা থাকবে না। রাগ রাগীনির শৃঙ্খল থাকবে না। সুর-লয়-তাল কিছুই থাকবে না। কিন্তু সেটা গান হবে এবং সমবেতভাবে গাওয়া যাবে। আমার নিবাস আমারই নৈরাশ্যের মধ্যে।
পাঠক, আমি গল্পকে খুব বেশি দীর্ঘায়িত করতে চাই না, ভালোও লাগে না। তাই সংক্ষিপ্তসারে শেষ করে দিই এ গল্পটিও। সেদিন সালিশদাররা কেনো আসেনি জানেন? রাতেই তারা রেডিওতে খবর পেয়েছিলা বিজেপি-শিবসেনার হনুমানেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে ফলে সারা ভারতে এবং বাংলাদেশে অনুমেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে। সঙ্গত কারণেই সেদিন সালিশি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আর তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে সালিশের জন্য অপেক্ষারত শিবু চোরা এবং অন্যান্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই হাজি বাড়ির ভেতর থেকে কালীবাজারের উপরে নরক নেমে এসেছিল। নারায়ে তাকবির, আলাহু আকবর শব্দে রক্ষাকালীর আস্তানায় শেষবার রক্তের হোলি খেলা চলেছিলো ঠিক পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী। আর হাজি বাড়ির গেট থেকে আধ মাইল উত্তর পশ্চিমে যে মুসলিম বালিকাটি ধর্ষিত হচ্ছিলো তার কিছু দুরেই দাউদাউ জ্বলছিলো একটি সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ বাড়ি।
প্রিয় পাঠক, ধরে নিন বালিকাটি এখন তিন সন্তানের জননী। সব অতীত এখন, কালীবাজারও। আমি কাশেম বাজারের বাসিন্দা নই বলে আমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি- না রক্তে, না ধর্মে। এমনকি তার সাথে আমার কোনোদিন দেখাও হয় নি। কিংবা সে আমার প্রণয়িনীও ছিলো না কোনো কালে।
কিন্তু সতেরটি বছর ধরে আমি ঐ ধাবমান বালিকাটির জন্য একটি নতুন গান লেখার অপেক্ষায় আছি। কারণ এখনো আমি তার চোখে ভয়কাতর হরিণের খুরের শব্দ শুনতে পাই।
কিন্তু সতেরটি বছর ধরে আমি ঐ ধাবমান বালিকাটির জন্য একটি নতুন গান লেখার অপেক্ষায় আছি। কারণ এখনো আমি তার চোখে ভয়কাতর হরিণের খুরের শব্দ শুনতে পাই।
>> পথিক ১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন