বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১০

আলাপচারিতা >> ‘পাখিরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না’ : আসাদ চৌধুরী

‘পাখিরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না’

আসাদ চৌধুরী

· কবি নয়, আসাদ চৌধুরী মানুষটা কেমন?
·· আমি গণভবন, বঙ্গভবন চিনি না। স্বাধীনচেতা একজন মানুষ এমনকি নগরবাড়িতে পুলিশের পিটুনিও খেয়েছি। যা বলার তা বলে ফেলি।’
· রাজনীতি সম্পর্কে কবির ভাবনাটা কেমন?
·· রাজনীতিতে চিরস্থায়ী কোনো শত্রু নেই বন্ধুও নেই।
· (দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবির এ দর্শনের তেমন কোনো ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে বলে মনে হয় না। তাই ঢুকে পড়ি সাহিত্যের পথে) একজন লেখকের কাজ কী?
·· লেখকের কাজ অবশ্যই লেখালেখি, কিন্তু লেখালেখিতে সবারই একটা খারাপ সময় যায়। সাহিত্যের এই বন্ধ্যা সময়ে একজন লেখকের উচিত হবে পুরনো লেখাগুলিকে রোদে শুকাতে দেওয়া।  অর্থাৎ সেগুলিকে নিয়ে কাজ করা।
· পুরনো লেখা বলতে কি লেখকের পুরনো লেখা না কি আমাদের সাহিত্যের পুরনো লেখা।
·· পুরনো লেখাটা হচ্ছে, আমাদের সাহিত্যের পুরনো লেখা, বিশেষ করে আমাদের লোকসাহিত্য -এগুলো নিয়ে কাজ করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। অনেকে হয়তো এটাকে লজ্জাজনক মনে করবেন কিন্তু এগুলোকে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করলে তিনি নিজে উপকৃত হবেন, উপকৃত হবে বাংলা সাহিত্যও।
আমি নিজেও এক সময় ভাবতাম কেবল রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকে নিয়েই এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।  কিন্তু আমাদের লোকসাহিত্যেও প্রচুর ভাববার উপকরণ রয়েছে, রয়েছে কাজ করার প্রচুর ক্ষেত্র। আসলে আমাদের লোক সাহিত্যটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আরও আগে কেন এদিকে নজর দিলাম না এ জন্য আমার মাঝে মাঝে আফসোস হয়।
· আমাদের সমৃদ্ধির পরিধিটা কেমন?
·· ইংরেজরা আমাদের দেশে এমনি এমনি আসেনি। আমাদের সম্পদের লোভেই তারা এখানে ঘাঁটি গেঁড়েছিল। কেবল সম্পদই নয় এদেশ সব দিক দিয়েই ছিল সমৃদ্ধ। সম্প্রতি আবিষ্কৃত উয়ারী বটেশ্বরের ইটের রাস্তা এর প্রমাণ। তাছাড়া আমাদের পাহাড়পুর-ময়নামতিতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চলছে তখন অক্সফোর্ডে শেয়াল ডাকছে।
· সেই ভাণ্ডার কি ফুরিয়ে গেছে?
·· আমাদের দেশ এখনো সমৃদ্ধশালী। তাই তো, প্রতিবছর সাইবেরিয়া থেকে শীতের সময় পাখিরা আমাদের দেশে আসে। কেবল উষ্ণতার জন্যই তারা এখানে আসে না, খাদ্যের জন্যও আসে। মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করলেও পাখিরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। পাখিরা এখনও ভালোবাসে বাংলার মাটিকে। তবে আমাদের সমৃদ্ধির গল্প ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। কিছুদিন আগেও এমন ছিল না। আমার মনে আছে, আট টাকাতে একমণ চাল পাওয়া যেত। একবার আমি এক টাকাতে সাতটি ইলিশ মাছ কিনেছিলাম। মাছ দেখে আমার মা তো ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন, ‘এ ছেলে তো জমিদারি ধরে রাখতে পারবে না। এ-ক টাকার মাছ কিনে এনেছে!’ কিন্তু এখন সম্পদ কিছু লোকের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। আবার দুঃখজনক হলেও সত্য, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দেশে না খেয়ে লোক মারা যায়।’
· এর দায়টা কার?
·· দায় কেউ এড়াতে পারবে না। সরকারেরও দায় রয়েছে, জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, এ শ্রমিকগুলো কোথায় যাবে, কী খাবে? একসময় দেশে ৭২টা জুট মিল ছিল এখন এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪-এ। ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আর এ কারণেই আমাদের বোনদের ডিসির কাছে দেহ ব্যবসার জন্য অনুমতি আনার জন্য লাইন ধরতে হয়। এটা আমাদের জন্য কতটা লজ্জার বিষয়, তা কোনোভাবেই বুঝানো যাবে না।
· তবে কি সমাজতন্ত্রে সমাধান খুঁজে নিতে হবে?
·· সমাজতন্ত্র হয়তো ভালো, কিন্তু নানা ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এদিক দিয়ে গণতন্ত্র অনেকটাই উৎকৃষ্ট। গণতন্ত্র সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেয়। যেটা সমাজতন্ত্রে নেই।
· (গুরুগম্ভীর কথা ছেড়ে সাহিত্যের রাস্তা খুঁজি) উর্দু সাহিত্যের সাথে আপনার একটা সখ্যতা আছে। যেহেতু উর্দু ভাষা নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে উর্দু কবিতার প্রতি সহানুভূতি কেমন চোখে দেখা হয়?
·· আমিও শামিল ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। তারপরও আমি পাকিস্তানী কবিদের সাথে কবিতা পাঠ করেছি, ভারতীয় কবিদের সাথেও কবিতা পাঠ করেছি। আসলে সাহিত্যের ক্ষেত্রটা আলাদা। বিষয়টা আসলে আপেক্ষিক নইলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে দেশ ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলো, সে দেশের সীমান্তরক্ষীরা পাখির মতো গুলি করে আমাদের দেশের মানুষদের হত্যা করবে কেন?
· সাহিত্যে ভেদাভেদ নেই বলে আপনি মানেন। যদিও আমাদের সাহিত্যটা দুটি ধারায় বিভক্ত এবং এ বিভক্তিটা খুব চরম পর্যায়ের। আপনার দৃষ্টিতে এটা কেমন?
·· আসলেই এটা দুঃখজনক।
· (আবারও ফিরে যাই উর্দু কবিতার প্রসঙ্গে) বাংলাদেশী উর্দু কবিদের সম্ভাবনা কেমন?
·· একসময় আমাদের উর্দু কবিরা উর্দু সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। যা জাহাঙ্গীরনগর স্টাইল হিসেবে পরিচিত। উর্দু সাহিত্যে এর বেশ আদরও রয়েছে।
· ছড়া সাহিত্যেও তো আপনার পদচারণা রয়েছে। তো এখনকার ছড়া সাহিত্যকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?
·· এখনকার ছড়ায় একটা বক্তব্য জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে সত্যিকারের ছড়া হয়ে উঠছে না। আসলে ছড়া ঠিক অতোটা বক্তব্য পছন্দ করে না। শুধু ছড়া কেন কবিতাও খুব বক্তব্যধর্মী হওয়া উচিত নয়।’
· (ছড়া ছেড়ে কবিতার পথে হাঁটি) এখনকার তরুণ লেখকদের সম্পর্কে কবির মূল্যায়ন।
·· এখনকার তরুণ লেখকেরা বেশ সিরিয়াস। কিন্তু তারা মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারছে না না। ফলে তাদের মধ্যে এক প্রকার ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে। এখন লেখকের বেশি হওয়ার কারণে ভালো লেখা সনাক্ত করা বেশ একটা কঠিন কাজ। কিন্তু আমাদের সময়ে একজন লেখক একটু ভালো লিখলেই প্রশংসা পেতেন। সেদিক থেকে এখনকার লেখকেরা একটু দুর্ভাগাই বলা যেতে পারে।

· সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাঈদ চৌধুরী টিপু

>> পথিক ১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন