বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১০

ভিনদেশী সাহিত্য >> আকাশে চারটি তারা : আহমাদ নদীম কাসমী (ফায়যুর রাহমান)

আকাশে চারটি তারা

আহমাদ নদীম কাসমী (ফায়যুর রাহমান)

ঘর থেকে মসজিদে যাওয়া-আসা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিলো না মিয়া হানিফের। তার বাড়িতে একটি মাত্র ঘর। ঘরটিও বেশ লম্বা। পুরো ঘরে দরোজা একটাই। মাঝখানে। ছাদে গোলাকৃতির একটি ছিদ্র, যেনো ম্যানহোল। বর্ষাকালে মিয়া হানিফ এই ছিদ্রটি পাকা মাটির ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় ভাষায় এই ছিদ্রকে বলে ‘মুখা’। দরোজা যখন বন্ধ থাকে, তখন বাইরের জগতের সঙ্গে মিয়া হানিফের যোগাযোগের মাধ্যম ওই ছিদ্রই। দিনের বেলায় ওই ছিদ্র দিয়ে আলো-বাতাস আসে। রাতের বেলা মিয়া হানিফ শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকায়, তারা খোঁজে ওই ছিদ্র দিয়ে। তার ধারণা, ছোট্ট এই ঘরে একাকি বসবাস করলেও সে আসলে একা নয়। আকাশের তারাগুলো তার বন্ধু। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের প্রতি সে ভয়াবহ বিরক্ত, কারণ বৃষ্টির জন্য এ সময়টাতে ছাদের ছিদ্রটি ঢেকে রাখতে হয়। যখন তার তারা দেখার তেষ্টা জাগে খুব, তখন ঢাকনাটি সরিয়ে দেখে, আকাশের তারাগুলো মেঘে মেঘে ঢেকে আছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সে নিমগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওই ছিদ্র দিয়ে কোনো তারা দেখতে না পেলে সে অস্থির হয়ে পড়ে। তখন খাটখানা এদিক-ওদিক সরিয়ে শোয়। শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তারা খোঁজে। অনেক চেষ্টার পর ছোট্ট একটি তারা যখন তার দৃষ্টিগোচর হয়, খুশিতে আত্মহারা হয় সে। যেনো স্রষ্টার সাক্ষাৎ পেয়েছে। তখন মনে মনে বলে, ‘বন্ধু তোমাকে দেখার জন্য সারাটা আকাশ ঘুরে এলাম, আঁতিপাতি করে খুঁজেও তোমাকে পেলাম না। এবার যখন পেলাম, তবে আর পালিয়ে যেও না, আমি তোমাকে প্রাণভরে দেখবো, নয়তো আমার ঘুম আসবে না।
ঘরের মাঝখানে একটি তাক। ওখানে সে গম রাখে। কয়েক বিঘা জমি আছে মিয়া হানিফের। বর্গা চাষিরা বছর শেষে তার পাওনা গম বাড়িতে পৌঁছে দেয়। গম ছাড়াও তাকের ওপর সে রাখে পানির একটি হাতলবিহীন পানপাত্র। আর একটা মাটির প্রদীপ। প্রদীপের সলতেটা সারাক্ষণই কেরোসিনে ডুবে থাকে। মিয়া হানিফ এশার নামাজের পর ঘরে ফিরে প্রদীপটা জ্বালায়। তারপর দরোজা বন্ধ করে খাটে বসে সুরেলা কণ্ঠে কুরানের শেষ পারার পনেরটি সুরা পড়তে থাকে। এই সুরাগুলো সে নামাজেও পড়ে। নামাজ ছাড়াও ঘরে বসে বারবার পড়ে। মাথা দুলাতে দুলাতে পড়ে। এক সময় দেয়ালের খুঁটিতে ঝোলানো তসবি নিয়ে বিড় বিড় করে কালেমা তৈয়ব আওড়ায়। ক্লান্ত হলে খাটে শুয়ে পড়ে, আর ছাদের ছিদ্র দিয়ে আকাশের নক্ষত্র খোঁজে। হঠাৎ যখন একটি নক্ষত্র তার চোখে পড়ে, সে এতোই খুশি হয় যেনো স্রষ্টার দর্শন পেয়েছে।
কৈশোরে মিয়া হানিফ মাদরাসায় আট কেলাশ পর্যন্ত পড়েছে। কুরানও মুখস্থ করেছে। যৌবনে তার বিয়ে হয়েছিলো। এক বছর পর সন্তান প্রসবের সময় স্ত্রীর মৃত্যু হয়। নবজাতকও হয় মৃত। এই ঘটনার পর পৃথিবীর উপর থেকে মন উঠে যায় মিয়া হানিফের। সবকিছু ছেড়ে দেয় সে। শুধু আল্লাহর সাথে সংযোগ রক্ষায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তার আত্মীয়-স্বজনরা এলাকার বিখ্যাত পীরের কাছে তাকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তাদের ধারণা, পীরের কাছে মুরিদ হলে তার জীবনে একটা গতি আসবে। নিজেকে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু মিয়া হানিফ রাজি হয় না। বলে, আমার পীর রাসূলুল্লাহ। তিনি সবচে’ বড় পীর, দুনিয়ার পীরেরা  আমার রসুলের উপর নির্ভরশীল, তিনিই আমাকে মাওলার কাছে পৌঁছে দেবেন।
এক পৌষ মাসে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিলো। এক নাগাড়ে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই, ছাড়বার নাম নেই। ছাদের ফাঁক ফোকর চুঁইয়ে বৃষ্টির পানি ঘরের মেঝেতে পড়ছিলো। ঘরের যেখানেই বৃষ্টির পানি পড়ে, মিয়া হানিফ সেখানেই বাসন-কোসন, পেয়ালা-পাতিল বসিয়ে দেয়, যাতে পানির ফোঁটায় মেঝেতে গর্ত সৃষ্টি না হয়। এ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে টপটপ করে যখন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, তখন বৃষ্টির ফোঁটাকে মিয়া হানিফের মনে হয় মধুর শব্দ। একেকটা পাত্রে পানির ফোঁটার শব্দ হচ্ছে একেক রকম, আর সব ক’টি শব্দ মিলে সৃষ্টি হচ্ছে জলতরঙ্গের মতো সুর। মিয়া হানিফ এই শব্দ শুনে মুচকি মুচকি হাসে। সে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানায় তার উপর দয়া করার জন্য। কারণ, ছাদ থেকে ঘরের সবখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, কিন্তু কী আশ্চর্য, তার খাটখানা অক্ষত। এক ফোঁটা পানিও তার বিছানায় পড়েনি। সে এ জন্য আনন্দিত। ভাবে, সৃষ্টিকর্তা তার অনুগত বান্দাকে নিশ্চয়ই দেখছেন, সে ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে ঘর ছাড়া কোথাও যায় না, সবসময় তার জিকিরে ব্যস্ত থাকে। নিশ্চয়ই তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে তার অনুগত বান্দা ভোরের আযান পর্যন্ত ঘুমোয়, সেটা যেনো বৃষ্টি থেকে অক্ষত থাকে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
মধ্য রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে তার ঘুম ভাঙে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। তার মনে হয় রোজ কেয়ামত এসে গেছে। সে কালেমা তৈয়ব পড়তে থাকে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিজলির আলো ঘরে আসছে খানিকটা। সে খাট থেকে নেমে তাকের উপর রাখা বাতিটা খুঁজতে যায়। ঘরের মাঝখানের খুঁটিটা পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে দেখে সবকিছু ভিজে একাকার। ঘরের ভিতরে বৃষ্টির ধারা এলো কী করে - মিয়া হানিফ ভেবে পায় না। আবার বিদ্যুৎ চমকালে দেখলো ছাদের অর্ধেকটা ভেঙে পড়েছে। সে বিড়বিড় করে বলে, মাওলা, তুমি এ কী করলে? তোমার নতজানু বান্দার সাথেও একই ব্যবহার করলে, যা অন্যদের ব্যাপারে মানায়!
সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে খাটে গিয়ে বসে। ভয়ে কাঁপছিলো সে। এবার বলে, মাওলা আমার, খামাখাই তোমাকে অভিযুক্ত করলাম, তোমার দেওয়া বৃষ্টিতে ছাদের একাংশ ভেঙেছে তো কী হয়েছে, অন্য অংশ তো এখনো অক্ষত, যার নিচে তোমার অনুগত বান্দা শুয়ে আছে। তুমি মানুষকে দেখিয়েছো, পুরো ছাদ ভাঙার দরকার নেই, পৃথিবীর বুকে এখনো অনুগত বান্দারা আছে, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নও তো আছে। তোমার প্রিয় বান্দাকে তাই নিরাপদে রেখেছো। তোমার রহস্য কি সবাই বুঝতে পারে?
দূর থেকে ভোরের আযান ভেসে আসে। মসজিদ তেমন দূরে না। তবু প্রবল বৃষ্টির কারণে আযানের ধ্বনি ভালোমতো শোনা যাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো, বহুদূর থেকে আযানের সুর আসছে। আযান শেষ হলে মিয়া হানিফ দোয়া পড়লো। তারপর গায়ে চাদর দিয়ে বৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছাতা নিয়ে বের হলো। দরোজায় তালা লাগাতে গিয়ে তার মনে হলো, ছাদ যেখানে ভেঙে পড়েছে, সেখানে তালা লাগানোর দরকার কী। তবু সে তালা লাগালো। গলিতে পানি জমেছে। সে পানি ভেঙে মসজিদে গিয়ে ছাতাটা এক পাশে রেখে দেয়। মসজিদের টেপে অজু করে। জামাতে শামিল হয়। নামাজের পর ইমাম সাহেব দোয়া করেন, ‘ইয়া এলাহি, আমাদের রক্ষা করো, আমরা গরীব, আমাদের বাড়িঘর কাঁচা, বৃষ্টির পানি আমাদের বাড়িঘর গিলে খাচ্ছে, এবার বৃষ্টি থামাও হে খোদা’।
মিয়া হানিফ বেশ শব্দ করে বলে, আমিন। তার শব্দে মসজিদে গুঞ্জন সৃষ্টি করে। ইমাম সাহেব ও মুসল্লিরা তার দিকে তাকায়। দোয়ার পুনরাবৃত্তি চলে, ‘বৃষ্টি থামাও’।
মিয়া হানিফ এবার গর্জে উঠে - আমিন।
‘বৃষ্টি থামাও’।
মিয়া হানিফের জোর গলা - আমিন।
সমবেত মুসল্লিরা মিয়া হানিফের দিকে তাকায়। তারা হয়তো ভাবে, স্বল্পভাষী এই লোকটার কী হলো আজ। তার আমিন উচ্চারণের শব্দ যেনো মসজিদের ছাদ পেরিয়ে ওপাশে চলে যাচ্ছিলো। দোয়ার পর ইমাম সাহেব বললেন, দোয়ায় আমিন বলা বিধিসম্মত, কিন্তু এতো জোরে বলার কী দরকার ছিলো।
মিয়া হানিফ বলে, মৌলভী সাহেব, এটা আমার মাওলার কারবার। তারপর সে বিড় বিড় করে বলে, হে প্রভো, হে খোদা, একি তোমার খেলা! উপস্থিত মুসল্লিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মিয়া হানিফ ভেজা চাদর গায়ে দিয়ে ছাতা নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়। সূর্যোদয় হয়েছে কিন্তু আবছা অন্ধকার এখনো লেগে আছে। আকাশে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। টপ টপাটপ বৃষ্টি পড়ছে। মিয়া হানিফ গলির হাঁটু পানি ভেঙে যেই ঘরের দুয়ারে এলো, অমনি মুষলধারে বৃষ্টি শুরু। সে তালা খোলার জন্য হাত বাড়াতেই বিকট গর্জন শুনে পিছু হটে। বিস্ফোরিত চোখে দেখে ঘরের বাকি অর্ধেক ছাদও ধ্বসে পড়ছে।
তালা খুলে দরোজায় ধাক্কা দিয়ে হানিফ দেখলো, খৃলছে না। কারণ, ছাদের বাকি অংশ ভেঙে পড়ে দরোজা খোলার পথটি বন্ধ হয়ে গেছে। সে অস্থির হয়ে ওঠে। ভেঙে পড়া ছাদের অংশ নিজের চোখে দেখতে চায়। বিকট শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়েছিলো। তারা সকলে বন্ধ দরোজায় হাত লাগায়। সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে কিছুটা ফাঁক হয় দরোজাটি। মিয়া হানিফ আধ-খোলা দরোজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। তারপর মুচকি হেসে পেছন ফিরে তাকায়, বলে, ‘শক্তিমান প্রভু, তোমার তুলনা হয় না। তোমার কুদরত বুঝা দায়। এই ঘটনা যদি তোমার ইচ্ছায় হয়ে থাকে, তবে তাই হোক।
লোকজন সবাই চলে যায়। সে তালাটি একদিকে ছুঁড়ে মারে। মসজিদে রওয়ানা হয়। সে যখন মসজিদের নিকট পৌঁছে তখন বিদ্যুৎ চমকায় আর মেঘের গর্জনে আকাশটা কেঁপে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার খুব রাগ হচ্ছে বুঝি এই বান্দার ওপর, প্রভো? তার একমাত্র ভরসা তুমি। তোমার দেওয়া বৃষ্টিতে তার ঘরের ছাদ ধ্বসে পড়েছে, এখন আবার মেঘের গর্জন কেনো? আমার উপর শুধু বজ্রপাত হওয়া বাকি, সেটাও করতে চাও? হে মেঘ এসো, বজ্রপাত করো’। সে রেগে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
সে যখন মসজিদে প্রবেশ করে, তখন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে জবুথবু অবস্থা। শীতে কাঁপছিলো। মিম্বরের কাছে মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। ‘প্রভু, আমি রাগের মাথায় এসব কথা বলেছি, ক্ষমা করো, এই নতজানু বান্দাকে ক্ষমা করো’।
আশপাশের কয়েকজন এসে মিয়া হানিফকে সান্ত্বনা দেয়। মিয়া হানিফের কান্না থামে না। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়। কিছুক্ষণ পরপর বাড়িঘরের দেয়াল ধ্বসে পড়ার শব্দ শোনা যায়। সেই শব্দে মিয়া হানিফ চমকে ওঠে। তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ‘কাঁচা ঘরবাড়ি সব ধ্বসে পড়ছে, আর পাকা বাড়িগুলো অক্ষত। তোমার লীলা বুঝা দায় হে প্রভু’- মিয়া হানিফ বলে।
মাগরিবের নামাজের পর সবাই হতবাক। আকাশ পরিস্কার। মেঘের রেশটুকুও নেই। ভরা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো আর আকাশের তারা ঝলমল করছে। ইমাম সাহেব ও মুসল্লিরা তাকে মসজিদের হুজরায় নিয়ে আসে। একজন তার জন্য বিছানাপাতির ব্যবস্থা করে।
ইমাম সাহেব দরদ নিয়ে বলেন, মিয়া হানিফ, তুমি আল্লাহওয়ালা লোক, মসজিদের হুজরায় থাকার অধিকার তোমার রয়েছে। এখন থেকে তুমি এখানেই থাকবে। হানিফ বলে, ঠিক আছে মৌলভী সাহেব, আমার বাড়ির ছাদ ভেঙেছে তো কী হয়েছে, প্রভুর ঘর মসজিদ তো আছে। আমার প্রভু অবশ্যই আমাকে আশ্রয় দেবেন।
এশার নামাজের পর মসজিদ শূন্য হয়ে যায়। মিয়া হানিফ হুজরায় যায়। মেঝেতে বিছানা পেতে কুরানের শেষ পারার পনেরোটি সুরা পড়তে থাকে। ক্লান্ত হয়ে সে বিছানায় যায়। শুয়ে পড়ে। হঠাৎ বিছানা থেকে হকচকিয়ে উঠে বসে। অন্ধকার হুজরার মধ্যে ঘোরাঘুরি করে আর ছাদের চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। হতাশ হয়ে সে হুজরার দরোজা খুলে বাইরে আসে। সে জানে, মসজিদের এক কোণে একজন খাদেম থাকে। মিয়া হানিফ তার দরোজায় কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে খাদেম বলে, কে?
‘আমি হানিফ, প্রভুর বান্দা।’
খাদেম বাইরে এসে হানিফের হাত ধরে বলে, কী খবর মিয়াজী, আপনি তো হুজরায় ছিলেন, না’?
‘হ্যাঁ ভাই ছিলাম। আপনার কাছে জানতে এসেছি, হুজরায় কি কোনো ছিদ্র নেই’?
‘আছে, কিন্তু বৃষ্টির জন্য তো সেটি এখন ঢেকে দেয়া হয়েছে।
‘বৃষ্টি তো ভাই থেমে গেছে। ঢাকনাটি এখনই খুলে দেয়া উচিত।’
‘ঠিক আছে, খুলে দেবো। কাল ভোরে উঠে এটিই হবে আমার প্রথম কাজ।
হানিফ আপত্তি জানায়, বলে, ‘না ভাই ছাদে গিয়ে এখনই ঢাকনাটি সরিয়ে দাও, আমার প্রভুর সাথে আলাপ আছে।’
খাদেম নিশ্চুপ। মিয়া হানিফের কথায় সে খানিকটা ভীত। তবু সে ছাদে গিয়ে ঢাকনা সরিয়ে দেয়। হানিফ তাকে প্রাণভরে দোয়া করে, ‘আমার প্রভু তোমাকে সুখে রাখুক।’
হুজরায় এসে হানিফ ছিদ্র দিয়ে থাকিয়ে থাকে। হঠাৎ আকাশে চারটি তারা চোখে পড়ে তার। সে আনন্দিত হয়। নীরবে হাসে। ‘এক সঙ্গে চারটি তারা। প্রভু আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছো। কখনো অকৃতজ্ঞ হয়েছি আমি। আমি তোমার নতজানু বান্দা, সারা জীবন একটি তারা দেখেই কষ্ট ভুলে থাকি’। 

[উর্দু সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক আহমদ নাদীম কাসমী একাধারে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক। পাকিস্তানের খোশাব জেলার পার্বত্য গ্রাম আঙ্গায় ১৯১৬ সালের ২০ নভেম্বর তার জন্ম। পাঞ্জাব বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। সরকারি চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। উর্দু সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘ফনুন’ সম্পাদনা করেন দীর্ঘ ৫০ বছর। দৈনিক ইমরোজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। প্রভাবশালী দৈনিক জং পত্রিকায় দীর্ঘদিন ‘রেওয়ান-দেওয়ান’ শিরোনামে সমকালীন বিষয়ে কলাম লিখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৫০ টিরও বেশি। সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৮ সালে লাভ করেন রাষ্ট্রপতি পদক, পাকিস্তান একাডেমি থেকে পান আজীবন সম্মাননা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘সিতারায়ে ইমতিয়াজেও ভূষিত হন। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ফুল, তাহযিবই নিসওয়ান, আদাব-ই- লাতিফ, সাভেরা ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, চৌপল, সানাতা, কাপাস কা ফুল, গারসে গার তক ইত্যাদি। তার মেয়ে ড. নাহিদ কাসমী ও ছেলে নোমান কাসমী। শক্তিমান এই লেখক ২০০৬ এর ১০ জুলাই ইন্তেকাল করেন।
গল্পটি মাসিক উর্দু ডাইজেস্ট থেকে অনূদিত -অনুবাদক]

>> পথিক ১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন