কানু বিনা গীত নাই
চৌধুরী মুফাদ আহমদ
শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র - এক রহস্যময় পুরুষ। মহাভারতের নানান লৌকিক অলৌকিক কাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন এবং ঘটনাবলীর গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি বিষ্ণুর অবতার। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি অর্জুনকে নানা বিষয়ে যে পরামর্শ ও বাণী প্রদান করেন তা-ই ‘গীতা’। ‘গীতা’ হিন্দুদের পরম পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। আবার কাশিরাম দাশের মহাভারত বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে পঠিত একটি মহাগ্রন্থ। মহাভারত বা গীতার এই শ্রীকৃষ্ণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিকট একজন পূজনীয় ব্যক্তি, বিষ্ণুর অবতার। আর অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিকট নানা কুটিল বুদ্ধিসম্পন্ন, নানা মহৎ গুণের অধিকারী একটি মহাকাব্যিক চরিত্র মাত্র। কিন্তু এই শ্রীকৃষ্ণই ব্রজের কানাই রূপে, রাধার প্রেমিক রূপে বাঙালির মনোজগতে অবাধে বিচরণ করেন। ব্রজের কানাইকে চিনে নিতে তার ধর্মীয় পরিচয় বা তার অবতারত্ব কোনো বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় না। তাই মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ কেবল হিন্দুর নিকট একজন পূজনীয় দেবতা, আর ব্রজের কানাই, বাঙালির বিরহ-ভালবাসার নিত্য সহচর।
বাংলায় শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব কোনোকালেই গভীর বা ব্যাপক ছিলো না। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে লৌকিক ধর্মের চর্চাই প্রবল ছিলো। মনসা, চন্ডী, শীতলা, বাসুলি’র বাংলার হিন্দুদের উপর যে প্রভাব ছিলো শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক কোনো দেব-দেবীর তেমন প্রভাব ছিলো না। বাংলায় সেন আমলের পূর্বে প্রাতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোনো প্রসার ঘটেনি। সেন আমলে রাজকীয় উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসারের ফলে লৌকিক ধর্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সমন্বয়-আপোষের পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু পৌরাণিক দেব-দেবী ও বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের গভীর বা ব্যাপক প্রভাব বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, হনুমান, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ, দ্রৌপদীকে বাংলায় তেমন জনপ্রিয় দেখা যায় না।
বৈষ্ণব ধর্ম নানা কারণে বাংলাদেশে এক সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো। বৈষ্ণব মত সৃষ্টি করেছিলো এক ভাব বিপ্লবের। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীর সংখ্যার তুলনায় বাঙালির চেতনায় বৈষ্ণব মতের প্রভাব অনেক গভীর ও ব্যাপক ছিলো। বৈষ্ণব মতের ধর্মীয় দিকের চেয়ে তার মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবেদনের তীব্রতা বেশি ছিলো। তাই এই মত বাঙালি চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
শ্রীচৈতন্যের জন্মের পূর্ব থেকেই বাংলায় শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা নিয়ে পদ রচনা শুরু হলেও শ্রীচৈতন্যের পর থেকে বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রকৃত অভিযাত্রা শুরু হয় বাংলা ভাষায়। চৈতন্য পরবর্তী দু’শো বছর বৈষ্ণব সাহিত্য নানা রূপে নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই যুগে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের রূপকের আশ্রয়ে মানুষের চিরন্তন প্রেম-বিরহ, আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। এই সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে এমন একটি কাব্যাদর্শের সৃষ্টি করেছে যাকে কোনো সংকীর্ণ ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না, যায়নি। এ কারণে মুসলমান কবির লেখায় বৈষ্ণব কবিতার অভাব ঘটেনি। এই কাব্যাদর্শ যুগ যুগ ধরে বাঙালি কবিদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এবং এই ধারা আজও বহমান। রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী নানা রূপে, নানা রঙে, নানা ভাবে যুগে যুগে তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠেছে, বাঙালির কানের ভেতর দিয়ে মরমে পৌঁছে মনপ্রাণ আকুল করে তুলেছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলার কবিকূল আপন মনের প্রেম-বিরহের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য রাধা-কৃষ্ণের রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন অকৃপণভাবে, বৈষ্ণব ভাবাদর্শে অবগাহন করেছেন অকুন্ঠ চিত্তে।
রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী ভক্তদের নিকট জীবাত্মা (রাধা) ও পরমাত্মার (কৃষ্ণ) মিলনের রূপক কাহিনী। এই রূপককে আশ্রয় করে তাদের ভক্তিপূর্ণ্য কাব্য রচনায় অনেক মুসলমান কবিই কুন্ঠিত হননি। যেমন সুফী মতবাদ দ্বারা অসংখ্য হিন্দু কবি (রবীন্দ্রনাথসহ) প্রভাবিত হয়েছেন এবং সুফিদের মতো ঈশ্বরকে দয়িতা কল্পনা করে ভক্তিপূর্ণ কাব্য রচনা করেছেন।
বৈষ্ণব কবিতা মানেই গান। ভক্ত বৈষ্ণবের নিকট এক সময় গান মাত্রেই ছিলো নাম-গান। চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রাচীনতম নিদর্শন বড়– চন্ডীদাশের কাব্য। সেই আদিকাল থেকেই বাঙালি কবির জিজ্ঞাসা-‘কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই-কূলে/কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।’ সেই বাংলা গানে গানে রাই আর কানুর কথা। বাঙালি কবির-গীতিকারের চেতনে অবচেতনে রাধার আর তার চিকন কালার প্রেম-বিরহের বিচিত্র লীলা। আজকের জনপ্রিয় শিল্পী হাজার দর্শকের সামনে স্টেজ কাঁপিয়ে ব্যান্ডের তালে তালে যখন গান করেন ‘বন্ধু যখন বৌ লইয়া, আমার বাড়ির সামনে দিয়া হাইট্যা যায়,- বুকটা ফাইট্যা যায়’ তখন এই চটুল গানের মধ্যেও রাধার বুকফাটা একই আকুতি শনাক্ত করতে পারি যা চন্ডীদাশের কন্ঠে যুগে যুগে অমর হয়ে আছে-‘কেমনে রাখিব হিয়া / আমার বধুঁয়া আন বাড়ি যায় / আমার আঙ্গিনা দিয়া।’
ভানু সিংহের ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেন, ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সম’ কিংবা নজরুল যখন গেয়ে ওঠেন, ‘পদ্মার ঢেউ রে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা’ তখন বাংলার শ্রেষ্ঠ দু’জন গীতিকবি রাধার বিরহেই আকুল হন।
আধুনিক বাংলা গান, সিনেমার গান, কোথায় নেই রাধা আর কানু? উদাহরণ দিতে যাওয়া হাস্যকর। তবুও দিই। কারণ এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অনেক জনপ্রিয় গানের বাণীর অর্থ বোঝেন না। পঞ্চাশের জনপ্রিয় গান ‘গোপীজন মোর চোর, গিরিধারী নাগর’, মান্না দে’র ‘ওকে আজ চলে যেতে বল না ললিতা’, হেমন্তের গাওয়া ‘ও বাঁশিতে ডাকে কে শুনিতে যে আজ মন / পরান গাড়িতে চায় সে রাখাল গায়’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গানগুলো যে রাধা-কৃষ্ণের রূপকাশ্রয়ী তা অনেকেই হয়তো বুঝেন না।
তা বাঁশির কথা তো এসেই গেল। বাঁশি আর কৃষ্ণ তো অনেকটা সমার্থক হয়ে গেছে। বড়– চন্ডীদাশ যখন লিখেন ‘বাঁশির শবদে মোঁ আউলাইলো রান্ধন’। আর শচীন দেব বর্মনের কন্ঠে যখন শুনি ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই / সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’ কিংবা ”লতা মুঙ্গেশকার যখন গেয়ে ওঠেন ‘বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়’ তখন সেই বংশী ও বংশীবাদককে চিনতে কারো কষ্ট হয় না। এই বাঁশি বা মুরলী হাতে বলেই ব্রজের কানাইয়ের আরেক নাম মুরলীধরন। প্রেমিক কৃষ্ণের কারণে বাঁশী মাত্রেই প্রেমিকের প্রতীক। বাঁশির সুর মানেই আকুল হওয়া। এই সেদিনও এদেশে লোকালয়ে কোনো তরুণের বাঁশি বাজানো সামাজিকভাবে সমর্থনযোগ্য ছিলো না-যাদের তরুণী ভার্যা বা কন্যা আছে তাদের কাছে তো নয়ই।
ইদানীং বিভিন্ন লোক কবির বা অল্প খ্যাত কবিদের গান, বিশেষত, সিলেট অঞ্চলের গান, নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয় টিভি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের এ বিষয়ে একটি অগ্রণী ভূমিকা আছে। রাধারমন, হাসন রাজা, সৈয়দ শাহনূর, বাউল আবদুল করিমের গান - এ যুগের তরুণদের কাছে নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দ্রুত তালে নানা আধুনিক শব্দযন্ত্র সহযোগে দেশে বিদেশে আলো ঝলমল কনসার্টে সিলেট অঞ্চলের নানা গান গীত হচ্ছে। এসব গানের মধ্যে ‘কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে’, ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে’ ‘অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে-ভ্রমর কইও গিয়া’ এর মতো জনপ্রিয় গানগুলো আধুনিক তরুণ-তরুণীর মনকে (এবং ব্যান্ডের তালে তালে দেহকে) নাড়া দেয়। কিন্তু এসব গানের রূপক কাহিনীটি সম্পর্কে তারা সামান্যই খবর রাখে।
সিলেট অঞ্চলের লোকগানে রাই আর কানাইয়ের প্রভাব অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। এর সুনির্দিষ্ট সামাজিক ঐতিহাসিক কারণ নিশ্চয়ই আছে। ‘সোহাগ চান বদনী ধনি নাচো তো দেখি’ কিংবা ‘তোমরা দেখ গো আসিয়া কমলায় নৃত্য করইন থমকিয়া থমকিয়া’-এর মতো চিরন্তন সুন্দর গানগুলোর কথা ভাবুন।
শত শত বৎসর ধরে বাংলা গান রাধা-কৃষ্ণের, রাই-কানাইয়ের প্রেম-বিরহ কাহিনী থেকে রস আহরণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই বলা হয় বাংলাদেশে ‘কানু বিনা গীত নাই।’ এখানে বাঁশি বলতেই কৃষ্ণের বাঁশি, প্রেমিকার শাড়ি মাত্রেই নীলাম্বরী, তারা যেখানেই থাকুক জল আনতে যমুনায় যেতে হয়, তমাল-কদম্ব ছাড়া জুৎসই গাছ নেই, প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন স্থান বা ‘রাধেভুঁ’ মাত্রেই কুঞ্জ, বিরহী প্রেমিকার স্বেচ্ছা মৃত্যুর জন্য (যমুনার) জলে ডোবার চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা হয় না, প্রেমিকা মাত্রেই কলঙ্কিনী এবং কলঙ্কের গর্বে গর্বিতা, রাধাকে গঞ্জনা দেওয়ার কারণে শ্বাশুড়ি, ননদী মাত্রেই খল-নায়িকা।
শেষ করছি একটি সত্যি গল্প দিয়ে। আজ থেকে সিকি শতাব্দী পূর্বের ঘটনা। গল্পটি সুনামগঞ্জ অঞ্চলের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিকে নিয়ে। অবিভক্ত আসামে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন, এমএলএ ছিলেন। তাঁর বয়স তখন আশি ছুঁই ছুঁই। প্রচন্ড ধর্মপ্রাণ আলহাজ্ব। গান বাজনা মোটেই পছন্দ নয়। ঘরে রেডিওতে খবর ছাড়া অন্য কিছু শোনার অনুমতি নেই। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশালী। একবার তার জ্বর হয়েছে। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছেন। হঠাৎ সবাইকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে গেয়ে উঠলেন-
‘সই গো সই, আমি মরলে ঐ করিও
না গাড়িও না পুড়িও, ঐ তমাল ডালে
বেঁধে রাখিস তোরা।
মোর বন্ধু যদি ফিরে আসে
বলিস তোরা বন্ধুর কাছে
ঐ তমাল ডালে তোর পিরীতির মরা। ’
সত্যিই। কানু বিনা গীত নাই।
বাংলায় শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব কোনোকালেই গভীর বা ব্যাপক ছিলো না। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে লৌকিক ধর্মের চর্চাই প্রবল ছিলো। মনসা, চন্ডী, শীতলা, বাসুলি’র বাংলার হিন্দুদের উপর যে প্রভাব ছিলো শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক কোনো দেব-দেবীর তেমন প্রভাব ছিলো না। বাংলায় সেন আমলের পূর্বে প্রাতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোনো প্রসার ঘটেনি। সেন আমলে রাজকীয় উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসারের ফলে লৌকিক ধর্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সমন্বয়-আপোষের পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু পৌরাণিক দেব-দেবী ও বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের গভীর বা ব্যাপক প্রভাব বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, হনুমান, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ, দ্রৌপদীকে বাংলায় তেমন জনপ্রিয় দেখা যায় না।
বৈষ্ণব ধর্ম নানা কারণে বাংলাদেশে এক সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো। বৈষ্ণব মত সৃষ্টি করেছিলো এক ভাব বিপ্লবের। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীর সংখ্যার তুলনায় বাঙালির চেতনায় বৈষ্ণব মতের প্রভাব অনেক গভীর ও ব্যাপক ছিলো। বৈষ্ণব মতের ধর্মীয় দিকের চেয়ে তার মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবেদনের তীব্রতা বেশি ছিলো। তাই এই মত বাঙালি চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
শ্রীচৈতন্যের জন্মের পূর্ব থেকেই বাংলায় শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা নিয়ে পদ রচনা শুরু হলেও শ্রীচৈতন্যের পর থেকে বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রকৃত অভিযাত্রা শুরু হয় বাংলা ভাষায়। চৈতন্য পরবর্তী দু’শো বছর বৈষ্ণব সাহিত্য নানা রূপে নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই যুগে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের রূপকের আশ্রয়ে মানুষের চিরন্তন প্রেম-বিরহ, আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। এই সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে এমন একটি কাব্যাদর্শের সৃষ্টি করেছে যাকে কোনো সংকীর্ণ ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না, যায়নি। এ কারণে মুসলমান কবির লেখায় বৈষ্ণব কবিতার অভাব ঘটেনি। এই কাব্যাদর্শ যুগ যুগ ধরে বাঙালি কবিদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এবং এই ধারা আজও বহমান। রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী নানা রূপে, নানা রঙে, নানা ভাবে যুগে যুগে তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠেছে, বাঙালির কানের ভেতর দিয়ে মরমে পৌঁছে মনপ্রাণ আকুল করে তুলেছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলার কবিকূল আপন মনের প্রেম-বিরহের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য রাধা-কৃষ্ণের রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন অকৃপণভাবে, বৈষ্ণব ভাবাদর্শে অবগাহন করেছেন অকুন্ঠ চিত্তে।
রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী ভক্তদের নিকট জীবাত্মা (রাধা) ও পরমাত্মার (কৃষ্ণ) মিলনের রূপক কাহিনী। এই রূপককে আশ্রয় করে তাদের ভক্তিপূর্ণ্য কাব্য রচনায় অনেক মুসলমান কবিই কুন্ঠিত হননি। যেমন সুফী মতবাদ দ্বারা অসংখ্য হিন্দু কবি (রবীন্দ্রনাথসহ) প্রভাবিত হয়েছেন এবং সুফিদের মতো ঈশ্বরকে দয়িতা কল্পনা করে ভক্তিপূর্ণ কাব্য রচনা করেছেন।
বৈষ্ণব কবিতা মানেই গান। ভক্ত বৈষ্ণবের নিকট এক সময় গান মাত্রেই ছিলো নাম-গান। চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রাচীনতম নিদর্শন বড়– চন্ডীদাশের কাব্য। সেই আদিকাল থেকেই বাঙালি কবির জিজ্ঞাসা-‘কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই-কূলে/কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।’ সেই বাংলা গানে গানে রাই আর কানুর কথা। বাঙালি কবির-গীতিকারের চেতনে অবচেতনে রাধার আর তার চিকন কালার প্রেম-বিরহের বিচিত্র লীলা। আজকের জনপ্রিয় শিল্পী হাজার দর্শকের সামনে স্টেজ কাঁপিয়ে ব্যান্ডের তালে তালে যখন গান করেন ‘বন্ধু যখন বৌ লইয়া, আমার বাড়ির সামনে দিয়া হাইট্যা যায়,- বুকটা ফাইট্যা যায়’ তখন এই চটুল গানের মধ্যেও রাধার বুকফাটা একই আকুতি শনাক্ত করতে পারি যা চন্ডীদাশের কন্ঠে যুগে যুগে অমর হয়ে আছে-‘কেমনে রাখিব হিয়া / আমার বধুঁয়া আন বাড়ি যায় / আমার আঙ্গিনা দিয়া।’
ভানু সিংহের ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেন, ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সম’ কিংবা নজরুল যখন গেয়ে ওঠেন, ‘পদ্মার ঢেউ রে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা’ তখন বাংলার শ্রেষ্ঠ দু’জন গীতিকবি রাধার বিরহেই আকুল হন।
আধুনিক বাংলা গান, সিনেমার গান, কোথায় নেই রাধা আর কানু? উদাহরণ দিতে যাওয়া হাস্যকর। তবুও দিই। কারণ এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অনেক জনপ্রিয় গানের বাণীর অর্থ বোঝেন না। পঞ্চাশের জনপ্রিয় গান ‘গোপীজন মোর চোর, গিরিধারী নাগর’, মান্না দে’র ‘ওকে আজ চলে যেতে বল না ললিতা’, হেমন্তের গাওয়া ‘ও বাঁশিতে ডাকে কে শুনিতে যে আজ মন / পরান গাড়িতে চায় সে রাখাল গায়’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গানগুলো যে রাধা-কৃষ্ণের রূপকাশ্রয়ী তা অনেকেই হয়তো বুঝেন না।
তা বাঁশির কথা তো এসেই গেল। বাঁশি আর কৃষ্ণ তো অনেকটা সমার্থক হয়ে গেছে। বড়– চন্ডীদাশ যখন লিখেন ‘বাঁশির শবদে মোঁ আউলাইলো রান্ধন’। আর শচীন দেব বর্মনের কন্ঠে যখন শুনি ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই / সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’ কিংবা ”লতা মুঙ্গেশকার যখন গেয়ে ওঠেন ‘বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়’ তখন সেই বংশী ও বংশীবাদককে চিনতে কারো কষ্ট হয় না। এই বাঁশি বা মুরলী হাতে বলেই ব্রজের কানাইয়ের আরেক নাম মুরলীধরন। প্রেমিক কৃষ্ণের কারণে বাঁশী মাত্রেই প্রেমিকের প্রতীক। বাঁশির সুর মানেই আকুল হওয়া। এই সেদিনও এদেশে লোকালয়ে কোনো তরুণের বাঁশি বাজানো সামাজিকভাবে সমর্থনযোগ্য ছিলো না-যাদের তরুণী ভার্যা বা কন্যা আছে তাদের কাছে তো নয়ই।
ইদানীং বিভিন্ন লোক কবির বা অল্প খ্যাত কবিদের গান, বিশেষত, সিলেট অঞ্চলের গান, নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয় টিভি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের এ বিষয়ে একটি অগ্রণী ভূমিকা আছে। রাধারমন, হাসন রাজা, সৈয়দ শাহনূর, বাউল আবদুল করিমের গান - এ যুগের তরুণদের কাছে নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দ্রুত তালে নানা আধুনিক শব্দযন্ত্র সহযোগে দেশে বিদেশে আলো ঝলমল কনসার্টে সিলেট অঞ্চলের নানা গান গীত হচ্ছে। এসব গানের মধ্যে ‘কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে’, ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে’ ‘অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে-ভ্রমর কইও গিয়া’ এর মতো জনপ্রিয় গানগুলো আধুনিক তরুণ-তরুণীর মনকে (এবং ব্যান্ডের তালে তালে দেহকে) নাড়া দেয়। কিন্তু এসব গানের রূপক কাহিনীটি সম্পর্কে তারা সামান্যই খবর রাখে।
সিলেট অঞ্চলের লোকগানে রাই আর কানাইয়ের প্রভাব অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। এর সুনির্দিষ্ট সামাজিক ঐতিহাসিক কারণ নিশ্চয়ই আছে। ‘সোহাগ চান বদনী ধনি নাচো তো দেখি’ কিংবা ‘তোমরা দেখ গো আসিয়া কমলায় নৃত্য করইন থমকিয়া থমকিয়া’-এর মতো চিরন্তন সুন্দর গানগুলোর কথা ভাবুন।
শত শত বৎসর ধরে বাংলা গান রাধা-কৃষ্ণের, রাই-কানাইয়ের প্রেম-বিরহ কাহিনী থেকে রস আহরণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই বলা হয় বাংলাদেশে ‘কানু বিনা গীত নাই।’ এখানে বাঁশি বলতেই কৃষ্ণের বাঁশি, প্রেমিকার শাড়ি মাত্রেই নীলাম্বরী, তারা যেখানেই থাকুক জল আনতে যমুনায় যেতে হয়, তমাল-কদম্ব ছাড়া জুৎসই গাছ নেই, প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন স্থান বা ‘রাধেভুঁ’ মাত্রেই কুঞ্জ, বিরহী প্রেমিকার স্বেচ্ছা মৃত্যুর জন্য (যমুনার) জলে ডোবার চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা হয় না, প্রেমিকা মাত্রেই কলঙ্কিনী এবং কলঙ্কের গর্বে গর্বিতা, রাধাকে গঞ্জনা দেওয়ার কারণে শ্বাশুড়ি, ননদী মাত্রেই খল-নায়িকা।
শেষ করছি একটি সত্যি গল্প দিয়ে। আজ থেকে সিকি শতাব্দী পূর্বের ঘটনা। গল্পটি সুনামগঞ্জ অঞ্চলের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিকে নিয়ে। অবিভক্ত আসামে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন, এমএলএ ছিলেন। তাঁর বয়স তখন আশি ছুঁই ছুঁই। প্রচন্ড ধর্মপ্রাণ আলহাজ্ব। গান বাজনা মোটেই পছন্দ নয়। ঘরে রেডিওতে খবর ছাড়া অন্য কিছু শোনার অনুমতি নেই। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশালী। একবার তার জ্বর হয়েছে। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছেন। হঠাৎ সবাইকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে গেয়ে উঠলেন-
‘সই গো সই, আমি মরলে ঐ করিও
না গাড়িও না পুড়িও, ঐ তমাল ডালে
বেঁধে রাখিস তোরা।
মোর বন্ধু যদি ফিরে আসে
বলিস তোরা বন্ধুর কাছে
ঐ তমাল ডালে তোর পিরীতির মরা। ’
সত্যিই। কানু বিনা গীত নাই।
>> পথিক ১৮
সুচিন্তিত প্রতিবেদন।
উত্তরমুছুন