পরিপ্রেক্ষিত
সুকুমার রুজ
খেলাটা বেশ জমে উঠেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে সুন্দরী রমণীর কমনীয় হাত প্রসারিত হচ্ছে শুধু। এক-আধখানা নয়, গোটা ছয়েক হাত। হস্তধারিনীরা পর্দার আড়ালে। অন্তরাল থেকে প্রমীলা বাহিনীর কলস্বরে ঝঙ্কার - খুঁজে নিন তো মেজ্ জামাইবাবু, নিজের বৌয়ের হাতখানা। ভুল হাত ধরলেই এক শ’ টাকা জরিমানা।
- এ কী! সব হাতই যে এক রকম। চেনার জো নেই। সব আঙুলেই একই রংয়ের নেল-পলিশ! চুড়ি, আংটিগুলো খুলে রেখেছে পাঁজির দল। এতো বেশ ফাঁপড়ে পড়া গেলো। মেজ জামাইবাবুকে সত্যিই হতাশ মনে হয়। কিন্তু হাত না ধরেও নিস্তার নেই। ভেতর থেকে হুমকি - অর্থদণ্ডের ভয়ে হাত না ধরে চম্পট দিলে, এ হাতের সেবা থেকে এক সপ্তাহ বঞ্চিত হতে হবে।
কি আর করা, একখানা হাত ধরতেই হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি ঝরণার কলকলানি, নাকি শালিক পাখির ক্যাঁচক্যাচানি - ছি-ছি-ছি, জামাইবাবু! শেষে কিনা আমার ননদের হাতটাই পছন্দ হলো? অ্যাঁ মনে মনে এতো! হাত ছাড়ুন, আর এক শ’ টাকা ছাড়ুন. পরস্ত্রীর হাত ধরার জরিমানা।
শুধু কি জরিমানা, সঙ্গে ভর্ৎসনা - ছ্যা ছ্যা জামাইবাবু, অগ্নিস্বাক্ষী করে, যদিদং তদিদং... মন্তর-টন্তর পড়ে যে হাত হাতে নিয়েছেন; দশ বছর ধরে যে হাতের সেবা নিচ্ছেন; এখনো সেই হাতটাই চিনে উঠতে পারলেন না! গোটা দিদিকে চিনতে তো এ জনমটা কাবার হয়ে যাবে গো জামাইবাবু!
শুধু মেজ জামাইবাবু নয়, বড়, সেজ, ছোট, সব বাবুরই এক দশা। ‘বাঁশ বনে ডোম কানা’ বলে না; এ হচ্ছে সেই দশা। কেউ কেউ জিদে পড়ে চার পাঁচশ অবধি গচ্চা দিয়েছে। সব জামাইবাবু ভাবছে, গোটা বৌটাকে বহুজনের ভিড়ের মাঝেও চিনতে ভুল হয় না; অথচ এতো কাছ থেকে শুধুমাত্র হাতটা চিনে নেওয়া যাচ্ছে না! কিন্তু ফাজিল মেয়েগুলোর কাছে হেরে গেলে তো চলবে না! তাই, ছোট জামাইবাবু প্রতিনিধিসূচক গলা চড়িয়ে বলে - আমরা তো সব সময় তোমাদের সুন্দর মুখের দিকে তাকাই গো সুন্দরী! তোমাদের হাত দেখার আর সময় কোথায়!
এক মুহূর্ত স্তব্ধতা। তারপর ছোট শ্যালিকার উচ্চকণ্ঠ - ঠিক আছে। মুখ দেখেন সব সময়, তখন নিশ্চয় মুখের মাঝে উচ্চতম স্থান নাকটা সবার আগে চোখে পড়ে। পর্দার ফাঁক দিয়ে এবার শুধুমাত্র নাকটা বেরোবে। না চিনতে পারলে দু’ শ’ প্লাস। চিনলে ফেরত এক শ’।
বড় জামাইবাবু মুখ খোলে - ঠিক আছে রাজি।
সবাই রাজি। ভাবে যদি অন্তত এক শ’ টাকা উশুল হয়। মিনিট দুয়েক পরে নাক প্রদর্শন। দুটো পর্দার মাঝখানের ফাঁকে এক সারি নাক। এবার কিন্তু কথা বন্ধ। কথা বললে নাক খুঁজে পেয়ে যাবে যে! গলার স্বরটা তো ভুল হবে না।
নাঃ! নাক নিয়েও নাকাল হতে হলো। নথ-খোলা, নাকের টাব্, নাকছাবি-খোলা - সব নাকই যেনো এক রকম! বড় জামাইবাবু ভেবেছিলো, তার গিন্নির নাকটা তো একটু বসা। ঠিক চিনে নেবে। ও বাবা! ছয় নাকের মাঝে কোথায় খাঁদা নাক! সবই যেনো এক। শুধু নাকটাই যে বেরিয়ে আছে। নাকের পাশে গাল, ঠোঁট এসব দেখতে পেলে খাঁদা-বোঁচা বুঝা যেতো!
জামাইবাবুদের মানিব্যাগগুলো ক্রমশ হালকা হচ্ছে। ওরা মজাটা আর উপভোগ করতে পারছে না। বড় জামাইবাবু তো গজরাতে শুরু করেছে - কার মাথা থেকে বেরোলো? নিশ্চয় ওই মিটমিটে শয়তান ছোট শালিটার বুদ্ধি।
ছোট জামাই বলে যাই বলুন দাদা! ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু ভাবার আছে। আমরা সবাই সবাইকে চিনি। আবার কেই কাউকে চিনি না।
- সে আবার কী?
- হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এক জনের সামগ্রিকভাবে চোখ মুখের গড়ন, তার সাজ পোশাক, আচার আচরণ থেকেই আমরা চিনতে পারি। আংশিক কিছু দেখে চেনা যায় না তার প্রমাণ তো মানিব্যাগেই। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে। ‘পারস্পেক্টিভ’ অর্থাৎ পরিপ্রেক্ষিত থেকেই অন্যের থেকে একজনকে আলাদাভাবে চেনা যায়।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ ওঠে - কী গো তুমি বিয়ে বাড়িতে এসে দর্শনের ক্লাস নেওয়া শুরু করলে নাকি? আমি ঠেলায় পড়ে মাঝে সাঝে তোমার ছাত্রী হই, বেচারা জামাইবাবুরা তোমার ছাত্র হতে যাবে কোন দুঃখে।
মেজ জামাই বলে - এই যে মিসেস তুবড়ি, তুমি একটু থামো। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং! বলো তো ভায়া কী বলছিলে!
ছোট জামাই উৎসাহের সঙ্গে বলতে থাকে - এই যে বড়দার কথা-ই ধরা যাক। আমরা তাকে দেখতে অভ্যস্ত ধুতি-পাঞ্জাবিতে, আর মুখে সব সময় পান। এখন এই ভিড়ভাট্টা বিয়ে বাড়ির মধ্যে বড়দা যদি কাউকে কিছু না বলে, কোট-প্যান্ট-টাই টুপি মাথায়, মুখে চুরুট ধরিয়ে হেঁটে যায়, আমরা কি চট করে বড়দাকে চিনতে পারবো?
বাঃ, বা-বা-বা বাঃ! বেড়ে বলেছো তো - খুশির আতিশয্যে গাবদা গোবদা বড় জামাইয়ের মুখ থেকে পানের পিক গড়ায়।
ইতিমধ্যে ঘরের প্রমিলা বাহিনীও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছোট জামাইয়ের মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে গেছে। শুধু ছোট শ্যালিকা তুবড়ি কর্তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তার এই মজার খেলা উদ্ভাবনের গূঢ় রহস্যটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
সব শুনে বড়দি বলে ওঠে - ও যতই কোট-প্যান্ট টুপি পড়ুক আমি ঠিক ধরে ফেলবোই। পনেরো বছর ওকে হাড়ে হাড়ে চিনেছি। আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
মেজ জামাই ফুট কাটে - দিদি! জামাইবাবুর হাড় ছাড়া আর কোন জিনিসটা আপনার বেশি চেনা?
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। এমন সময় বাড়ির চাকর মানিক এসে হাউমাউ করে করে বলে, বড়দিমণি, জামাইবাবু, আপনারা এখানে বসে হাসি-তামাশা কচ্চো; ওদিকে রিমিকে কখন থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কর্তা মা কান্নাকাটি শুরু করেচে। শিগগির এসো।
বড়দি মোটা শরীর নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। গলা ছেড়ে কান্না শুরু করে - ওগো আমার মেয়ে কোথায় গেলো গো - এই তো একটু আগে নীল জামা পরে ঘুরঘুর করছিলো আর কাটি লজেন চুষছিলো গো -।
পুরো বিয়ে বাড়ি তোলপাড়। সব বাচ্চা আছে, বড় মেয়ে ঝিমি আছে, শুধু ছোট মেয়ে রিমি নেই। সমস্ত ঘর, ছাদ, কুয়ো, কুয়োতলা, খড়ের পালার নিচে, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির বাইরে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। আশপাশের বাড়িতে, রাস্তায় যাকে দেখা যাচ্ছে তাকেই শুধোনো হচ্ছে - ওগো নীল জামা পরা ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছো?
বাড়ির পাশে পুকুরে একটা নীল রংয়ের কিছু ভেসে থাকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দুজনের জলে ঝাঁপ। নাঃ, জামা নয়! নীল লুঙ্গি, ছেঁড়া।
কেউ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে - গায়ে হলুদের গাড়ি গেলো তো এখুনি। দেখো ওই গাড়িতে উঠে পড়েছে কি না। ছোট বোন তুবড়ি বলে - তা হতে পারে দিদি। বাপন তো গায়ে হলুদ নিয়ে গাড়িতে গেলো। দাদার সঙ্গে সেও হয়তো পিছু ধরেছে। একটু পরেই ফিরে আসবে। তুই কাঁদিস না। ওদের বাড়িতে টেলিফোন আছে কি?
এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে হৈ হৈ শোনা যায় - পাওয়া গেছে - রিমিকে পাওয়া গেছে।
খামার বাড়িতে, যেখানে ভিয়েন হচ্ছে, ওখান থেকে রিমিকে আবিষ্কার করে মানিক। একটা ঢোলা প্যান্ট আর একটা ছেলেদের হাফ শার্ট গায়ে বসে। শালপাতায় ছানা নিয়ে খাচ্ছে।
বড় জামাই তো ভিয়েনের কারিগরকে এই মারে সেই মারে - বাচ্চাটা এখানে আছে তোমরা বলছো না!
- কী করে জানবো বাবু ওকে খুঁজছেন? আপনারা তো নীল জামা পরা মেয়েকে খুঁজছিলেন। বাচ্চা ছেলেটা এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই হাতে একটু ছানা দিলাম। আমার কী দোষ!
বড়দি ওকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে একটু কেঁদে নেয়। তারপর শুধোয় তোকে দাদার প্যান্ট জামা কে পরিয়ে দিলো?
ছোট জামাই বড় জামাইয়ের কাঁধে হাত দেয় - নিন, দাদা আর টেনশন নেবেন না। সিগারেট ধরান একটা।
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
>> পথিক ১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন