মণিপুরী সংস্কৃতির অন্তর্গত লড়াই ও রাসলীলা
শুভাশিস সিনহা
একটি শিল্পআঙ্গিক বা সাংস্কৃতিক উপাদানের বিচার করতে গিয়ে তার ভৌগলিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের সাথে নির্ণিত এবং বিনির্মিত রূপটির ভেতরটি ধরতে না গিয়ে নন্দনতত্ত্ব অনেক সময় কেবল তার বাহ্যকাঠামোর চুলচেরা বিশ্লেষণে গলদঘর্ম থাকে এবং শেষতক সেই জাতি-সাংস্কৃতিক বর্গটির সর্বনাশ না করে ছাড়ে না। মণিপুরীদের শত বছরের প্রচলিত রাসলীলার ক্ষেত্রেও তা-ই দেখা গেছে। রাসনৃত্যের মুদ্রাগুলো অনন্য... পোশাকটা এতো রাজকীয়... গায়কীটা খুব শ্রুতিমনোহর... এতো চমৎকার পারফরম্যান্স আর হয় না... ইত্যাদি ইত্যাদি। মণিপুরীদের রাসলীলানুকরণ অনুষ্ঠান যারা দেখতে আসেন, বা সোজা কথায় যারা রাসনৃত্য দেখতে আসেন, তাদের মন্তব্য এরকমই। শিল্পের মাপকাঠি দিয়ে মেপে মেপে একটি জনপদের একটি বিশাল কাণ্ডকে মাপার চেষ্টা বহুদিন ধরে চলেছে। ক্লাসিকাল নাচের গ্রামার দিয়ে, লোকজ উপাদানের শিল্পবিচারের দণ্ড দিয়ে ইতোমধ্যে রাসলীলাকে বেশ অলঙ্কৃত করা গেছে। কিন্তু ভেতর থেকে দেখার আর বুঝবার সবচেয়ে কঠিন আবার সবচেয়ে সাদামাটা যে রাস্তাটা, সেই রাস্তায় কেউ যায়নি বলা যায়। আমরা যে এখন যেতে পারব তারও নিশ্চয়তা নেই। কারণ বিষয়গুলো এখন বেশ অভ্যস্ত একটা ভাব নিয়ে ফেলেছে, আর তরিকা চেনাটাও কঠিন। কিন্তু এটা তো সত্য যে, রাস মানে কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, কেবল একটা কৃত্যও নয়, আরও কিছু। কী সেটা। শিল্পরুচির আধুনিকতা নিয়ে চাখলে, সেই স্বাদটা কি পাওয়া যাবে?
পয়লা আমরা ইতিহাসে যাই। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগের কথা। ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে দেখলেন তিনি রাসলীলার আয়োজন করেছেন। নিজের কন্যা বিম্বাবতীকে রাধারূপে দেখলেন। এরপর মণিপুরে আয়োজিত হয় প্রথম রাসলীলা, ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। এর পেছনে আরেকটা প্রাসঙ্গিক কাহিনী আছে। সেটা হলো মণিপুরের প্রাকৃত ধর্মানুসারী মণিপুরী জাতিসত্তা তার কিছু আগে সবেমাত্র বৈষ্ণব ধর্মের বলয়ের মধ্যে এসেছে। বাঙালি বৈষ্ণব প্রচারকেরা মণিপুরে গিয়ে এ ধমের্র বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর মণিপুরের জনগণ ততদিনে নিজেদের অন্তর্বিতর্কের সূত্রগুলো বেশ চিনে নিয়েছিলো । ফলে বেড়েছে দ্বন্দ্ব। এম্নিতেই নানান মত, পার্বণ আর কৃত্যছাওয়া রাজ্যটি। অনেকেই তাই কৃষ্ণ-রাধার পর-ঐহিক সম্পর্কের গাঁথাটিকে খুব আদরে মেনে নিলো। অনেকে মানলো না। সে যাই হোক, রাসলীলা প্রেক্ষিতটাকে এখন হয়ত একটু চিনে নেয়া গেলো। অপরের ধর্মকে নিজের করে নেওয়া বা নেওয়াবার জন্য একটা বিশাল হাতিয়ার ছিলো রাসলীলা, অন্তত ভাগ্যচন্দ্রের কাছে। বৈষ্ণব পদকর্তাদের নানান পদ ও বোল নিয়ে মনিপুরী চিন্তকেরা রচনা করতে লাগলেন রাসলীলার আঙ্গিক। আর ভারতের ভরত প্রমুখ শিল্পগুরুদের নানান মুদ্রা বা করণের সাথে মণিপুরের লোকনৃত্যকলার নানান নমুনার পরিমিত সিনথেসিস গড়ে উঠল এই নব্য ক্লাসিক শিল্পআঙ্গিকে। সব কিছুই কিন্তু একটি ধর্মদার্শনিক ভাবনা অধিগ্রহণের প্রয়াস। বৈষ্ণবিজম গিয়ে ছিলো বাঙলা থেকে, ফলে রাসলীলায় বাঙলায়ন তো থাকবেই, আর ক্লাসিক রীতিতে ভাষার যে উচ্চতার ধারণা থাকে, তার প্রেক্ষিত অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতাবলম্বী মণিপুরীদের মাঝে ছিলো ভাষাগত হীনম্মন্যতাও। ফলে সহজেই বাংলা গানগুলো নিয়ে নেয়া হলো।
কিন্তু বাঙলা হলে কী হবে, তার গায়কী, উচ্চারণ রীতি, ভঙ্গি, আবেগ, প্রক্ষেপণ সবকিছুতে থেকে গেলো একেবারেই মণিপুরী ছাপ। যে কারণে এখনো অনেক বাঙালি চিন্তকের কাছে অবিশ্বাস্য যে রাসলীলার গানগুলো বাঙলা বা অপভ্রংশ বা ব্রজবুলি ভাষায় হয়। শুনেও তারা ধরে উঠতে পারেন না যে এটা বাঙলা। তাদের ধারণা সব গানই মণিপুরী ভাষার। আর গায়কীর মজাটা মণিপুরী ধরনে, সেখানে মিহি আর কাঁপা কাঁপা সুরের বৈচিত্র্য আছে। আর মণিপুরীদের নিজেদের শিল্পনকশার ধারণা থেকে বানানো হলো পোশাক, অনেকটাই রাজকীয়, সোনার আর জরির কাজ করা, দেখলে চোখ পলক ফেলবে না। আর মণিপুরীরা কীর্তনের খোল আর ঢোলের একটা সংমিশ্রন করে নিলো। যার নাম মৃদঙ্গ। এর চামড়া খুবই শক্ত। আর সহজপ্রাপ্তও নয়। অর্থাৎ একটা প্রান্তিক জনপদের মানুষ একটি ধর্ম আর মতাদর্শকে মেনে নিলো, কিন্তু দিয়ে দিলো নিজস্বতার ছাপ। কেউ বলতে পারবে না যে এটা আর কোনো জাতির বা বাঙালির।
তো রাস হয়ে গেলো। একেবারে আদিমধ্যঅন্ত সম্পন্ন একটি কাহিনীমূলক নয়, ভাবাত্মক প্রযোজনা। গান আর নাচ, সাথে বাদ্য। কেন্দ্রে কৃষ্ণ আর রাধা। কিন্তু এই কৃষ্ণ আর রাধাকে স্বর্গ আর মর্ত্যে পৃথক করার উপায় নেই। তারা দুজনেই একেবারে মর্ত্যের মানুষ। এভাবে ভাবলেই আবেগের খেলাটি জমে ওঠে। শিল্প হবার পরে সেটা মনেরই সম্পদ হতে চায়। আর তা ভাবুক বা দার্শনিকের নয়। রাসের মণ্ডলি বা মাটিতে রাধাকৃষ্ণরূপী শিল্পীরা নেচে গেয়ে প্রেমলীলা করে, আর ভক্তরা আর কাউকে মনে করে আবেগায়িত হয়, কাঁদে, এই কৃষ্ণের বাইরে তারা আর কোনো সত্তাকে খুঁজতে থাকে। অসংখ্যবার রাস দেখবার পর এমনই মনে হয়েছে।
মণিপুরে নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুরু হয়ে গেলো, মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নেই। বারবার আন্তঃ ও অন্তর্কোন্দল আর বর্মীদের আক্রমণে বিপর্যস্ত অনেক মণিপুরী ভারতের সীমানা ছেড়ে চলে এলো বাংলাদেশে। নিয়ে এলো তাদের বিশ্বাস ও কৃত্যের মিশ্র আচার।
জীবনকে নতুন করে সাজানো আর নিজের সম্মানজনক অস্তিত্বের জানান দেয়া। সারারাত ধরে যে অনুষ্ঠানটি চলে, তার সময়গত একটা ক্ষমতাই প্রথমে ধরা পড়বে, এটা স্বাভাবিক। আর নাচ গান অভিনয় ভঙ্গিমা সব মিলিয়ে জটিলতার একটা বিশাল ক্যানভাস। এটাকে নিয়েই জানান দিতে হবে নিজেদের অস্তিত্বের রূপটা। আর তারই ভেতরে শিকড় গাঁড়ল দিনকে দিন নিজের ভাব আর দর্শনের জায়গাটাও। সেখানে বিরহ মূখ্য, অর্থাৎ বিরহের যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো, অন্তিমে পা রাখা। কৃষ্ণ সেই লক্ষ্য। আর যাত্রীরা সকলে রাধা। এক কৃষ্ণের মণ্ডলে রাধা আর অজস্র গোপিনীর লীলা সে সত্যই সামনে আনে- আমরা পরমআবর্তিত সামান্য কতোগুলো চিহ্ন মাত্র।
এই ভাবকে চেনানোর জন্য ভাগবত গ্রন্থের একটি অধ্যায় যতোটা কাজ করেছে, তার চেয়ে মনে হয় বেশি মানুষের তাড়িত জীবনের আবেগ আর বেদনা। ভূমি হারানোর যন্ত্রণা। এই হারানো আর পাওয়ার মধ্যকার দ্বন্দ্বের নামই যেনো রাধা। রাধার মধ্য দিয়ে মণিপুরী জনগণ যেনো পৌঁছে যায় নিজেদের জৈবনিক ব্যথাভারাতুর সত্তাটির কাছে।
এখন এই কাণ্ডগুলোর ব্যাকরণিক যে অবয়ব, তার দিকে একটু নজর দেয়া যাক।
রস্যতে অনেন ইতি রাসঃ। অর্থাৎ যার দ্বারা রস জন্মায় তাই রাস। এখন এই রসউৎপাদন বা নিষ্পত্তির জন্য রাসকাররা কতোই না কাহিনী ফেঁদেছেন। ফাঁদতে ফাঁদতে তারা আর থিতু হতে না পেরে রাসকে নানা ভাগে ভেঙেই ফেলেছেন। মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, নিত্যরাস ইত্যাদি। সবের মূল কথা এক, তবে মূলকে চেনার বা পাওয়ার তরিকাগুলো ভিন্ন। বিভিন্ন কাল বা ঋতুর সাথে ভাবরসের একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা। তবে নিত্যরাস কালনিরপেক্ষ। আর জনপ্রিয়ও হয়েছে এটাই।
যা হোক সব ধরনের রাস বিচার করে যে মূল কিছু সূত্র পাওয়া যায় সেগুলো হলো, রাসের আগে একটা পালা থাকবে। নটপালা। নট মানে অভিনেতা, অর্থাৎ অভিনেতাদের পালা । রাসের বলা যায় একটা প্রাগআয়োজন এটি। এটা পুরুষদের পালা। আর রাস মূলত নারীদের। অর্থাৎ একটা ভারসাম্য। এভাবে সাজানো থাকে আয়োজনটি।
নটপালাও রাধাকৃষ্ণের বিষয় আশয় নিয়ে। তবে তার ভাব শান্ত নয়, নাট্যমূলক। সেখানে দরাজ কন্ঠে উদাত্তভবে গান পরিবেশন করা হয়, আর লোকজ ধারার পরিবেশনার ভঙ্গি পাওয়া যায়। গায়ক সেখানে নিজেই পাত্রপাত্রী। আর থাকে বাদ্যের ঝনঝনানি। কিন্তু রাস ধ্যানের, ধীরস্থ। শুরু হয় রাগালাপ দিয়ে। সূত্রধারীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে রাসের নির্দিষ্ট রাগগুলো গাইতে থাকেন। সাথে থাকে মৃদঙ্গের তাল।
এই দীর্ঘ রাগালাপের পর রাস শাস্ত্রকাররা বলেছিলেন বৃন্দাবনের গীতবর্ণন থাকবে। কিন্তু এটা অবাক করার বিষয় যে পুরাণের সীমা থেকে সরে রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের সকল সূত্রের বাইরে আরেকটি চরিত্র রাসলীলায় অনিবার্য অংশ নিয়ে নিলো। স্থান করে নিলো ভাবক হৃদয়ে। তার নাম বৃন্দা। বৃন্দাবনে থাকে বলে তার নাম বৃন্দা, নাকি বৃন্দা থেকে বৃন্দাবন নাম হলো ঠিক করা মুশকিল। তবে এটা মেনে নিতে বাধা নেই যে বৃন্দা একেবারেই লোকমানসজাত। সে নারীচরিত্র, কৃষ্ণানুরাগীই কেবল নয়, কৃষ্ণঅন্তপ্রাণ, কৃষ্ণকে সেই আসরে ডেকে নিয়ে আসে, তার জন্য ফিদা বা বিশেষ আসন পেতে দেয়, নিজের সমস্ত মায়া প্রেম সে আসনে বিছিয়ে দেয়, এবং আকুল কন্ঠে গান করে- আমি কৃষ্ণের প্রেমে কাঙ্গালিনী/ বৃন্দাবনে বৃন্দা দুর্ভাগিনী / এ সুখনিশীথে যমুনাপুলিনে শ্রীরাসমণ্ডলে... / আমি যুগলচরণ সেবা করিব/ যুগলরূপ নেহারিব/ জীবন সফল করিব...। বোঝা গেলো এ বৃন্দার বাস যমুনার তীরে, সেখানেই রাসমণ্ডলি সাজায়, আর যুগলচরণ সেবা করে কৃষ্ণের। রাধার প্রেমে যে কৃষ্ণলীন হবার আকাঙ্ক্ষা, বৃন্দার প্রেমে সেটা নেই, বরং নিজেকে সেই পরম সত্তার চরণে সঁপে দেবার এক ভক্তিময় আকুলতা।
কেউ বলতে পারে না রাসলীলার কাহিনীতে বৃন্দা কবে কোথায় কীভাবে আসলো; কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে রাসের সবচেয়ে আবেদনময় রসময় আবেগবহ গীতিপর্যায়টি বৃন্দা-অংশেই থাকে। রাধা যখন নিখাদ মানবী হয়েও ভক্তরসিকের মনে কৃষ্ণ নামক অধরা সত্তাটির সাথে লীলাখেলায় গিয়ে নিজেকেও দৈবের অংশ করে ফেলল একসময়, তখনই কি বৃন্দা এসেছে মানবিক প্রেমের ব্যাকুলতা নিয়ে? কৃষ্ণকে নিজের করে পাওয়ার দরকার নেই, নিজেকে তার মঙ্গলময় সত্তার চরণদাসী করাই সাধনা, এটা বলাতে?
যা হোক, আমরা ফিরব রাসলীলার অঙ্গে। বৃন্দা কুঞ্জ সাজিয়ে দিয়ে গেলো, রাধা আর কৃষ্ণের প্রেমের বাসর সাজিয়ে দিয়ে গেলো। এরপর কৃষ্ণ আসনে এসে উপবিষ্ট হবেন। শিল্পীটি সচরাচর একজন বালক বা কিশোর। কিন্তু তার অভিনেয় অংশটি হবে প্রাপ্তবয়স্কের ভূমিকায়। যে গাইবে উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী, কিশোরী নয়ন রাধা... তাঁর মনের ভেতরটা তো বোঝাই যায়। এই বালককৃষ্ণ নেচে নেচে নানান ভঙ্গিতে মণ্ডলিময় রাধার প্রেমে আকুলতা বিলিয়ে যাবে। এরপর আসবে রাধা।
রাধা ও সখিরা অভিসার রচনা করবে কৃষ্ণ দরশনের। শুরু হবে নানান বাদানুবাদ।
এরই মধ্যে শাস্ত্রকারের নানান উপচার। ভঙ্গীপারেং থেকে শুরু করে অনেককিছুই। বাহ্যত বোঝা যাবে না কী বিশেষ অর্থ। কিন্তু একটি কৃত্যকলাকে শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যে চির সমুন্নত রাখার যে ব্যাপক যজ্ঞ, সেখানে মুদ্রার নানান জটিলতা তো থাকবেই। আর ছিলো বলেই মণিপুরী সংস্কৃতি একটি আলাদা আসন নিয়ে দিব্যি অটুট রয়েছে। বাণিজ্যের শিল্পবেত্তারা এখানে হাত দিতে পারেন না। কারণ সেই কঠিন দীর্ঘসাধনের স্তরগুলোয় নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি করার ধৈর্য আর সাধনা কতোজনের আছে!
কিন্তু মণিপুরীরা পেরেছে এই কঠিন সাধনায় ব্রতী হতে। সমস্ত কিছুতে। তাই একটি কৃত্য, তার প্রস্তুতি চলতে পারে মাসব্যাপী। মূল লক্ষ্য মানত পূরণ, মঙ্গল, কিন্তু তার সিদ্ধিতে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ একটি শিল্পরস সাধনের বহুল শর্ত। পোশাক থেকে শুরু করে মণ্ডলি সাজানো, নিমন্ত্রণকর্ম সবকিছুতে মানতে হবে অনেক বিধি নিষেধ।
রাসের শিল্পীরা যে পোশাক পরবে সেগুলোও হতে হবে নিখুঁত আর দেবতার উদ্দেশ্যে ধূপবাতি জ্বেলে সেগুলো নিবেদন করে প্রণাম জানাতে হবে। তারপরই পাবে পরিধানের স্বীকৃতি। এখনো তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। এছাড়া গোপিনীদের নিয়ে রাসের আগের দিন হয় আরেকটি কৃত্য। রাসের অজা বা রাসধারীসহ সবাই মিলে এই কৃত্যটি করা হয়ে থাকে। নিজেদের একটি পরম মঙ্গলময় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ভাবার বিশ্বাসের লীনবিন্দুতে পৌঁছানোর সূত্র।
আর সেদিন সেই প্রাগকৃত্যের অংশ হিসেবে রাসের একটু অংশেরও মহড়া হবে।
আর রাসের মঞ্চ বা মণ্ডলি, তাতেও সেই ঐতিহ্য আর ইতিহাসের অটুটতা। বাঁশের খুটি বৃত্তাকারে গেড়ে উপরে কাগজের নকশা করা বেড়। সব মণ্ডলিই গড়নে এই একই রকম। নকশার মধ্যে আলাদা সৃষ্টিশীলতা, কিন্তু অবয়বে কোনো পরিবর্তন আসবে না। নকশাগুলোও বাজারচলতি নয়, মণিপুরী শিল্পমানসের ভেতর থেকে একটা ব্যাকরণে দাঁড় করানো বিশেষ প্রকারে তা হয়ে থাকে। মণ্ডলির নিচেও বৃত্তাকার এক-দুহাত উঁচু বেড়া। তার একদিক মাত্র খোলা। অর্থাৎ ভেতরে যাবার পথটি খুবই সঙ্কীর্ণ। যে যাবে সেই ছোট্ট পথের মধ্যেই নিজের রাস্তা বের করে ঢুকবে নৃত্যআসরে। গিয়ে প্রেম বা ভক্তি নিবেদন করবে।
কার কাছে প্রেম, কার কাছে ভক্তি? যে ছোট্ট ছেলেটি গতকালও ছিলো পাড়ার এক দুষ্টু কিশোর বা শিশু, তাকেই আজ কৃষ্ণের বেশে দেখে ভাবুক বা ভক্তের নয়ন অশ্রুবিগলিত। দুপায়ে তার লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খায়, আত্মহারা। কৃষ্ণদর্শনের পুলক তার পুরোটা শরীরে ও হৃদয়ে। আবার এটাও নয় যে, সেই ভাবুক বা ভক্তগণ বিস্মৃত এই সত্য থেকে- সে আসলে কৃষ্ণের ভূমিকা নেয়া একজন শিল্পী। তার শিল্পভঙ্গিমার চমৎকারিত্বের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা থাকে ভক্তের মনেও। অর্থাৎ ‘ডায়ালেকটিক্যাল’ ভাবটা দর্শকের মনে পর্যন্ত। শিল্পী আর উদ্দিষ্ট সত্তা একই অঙ্গে বিরাজ করে, যে কৃষ্ণ সেই শিল্পী, তার শিল্পত্ব বিচার্য, আবার তার পরম কৃষ্ণত্বও প্রণম্য।
নিজের সন্তান, যে কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত রাসমণ্ডলিতে, তাকেই কৃষ্ণজ্ঞানে স্রাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বিহ্বল পিতৃমাতৃহৃদয়ও। আর এটাই রাস। জীবনের সকল চিহ্ন বাস্তবতার সীমার উপরের জমিনে গিয়ে অন্তরের নানান জায়গা থেকে চেনার মহাযজ্ঞ। এ যজ্ঞে ঘৃত নেই, আহুতি নেই, আছে ভাব রস প্রেম আর ভক্তি। আছে মহান বিশ্বাস।
এর সমাজতাত্ত্বিক কতো কার্যকারণই না থাকতে পারে। আমরা তা খুঁজতে যাইনি। এর সাথে জড়িয়ে আছে একটি প্রান্তিক জনপদের টিকে থাকবার সমস্ত কলাকৌশলের ছকও। খুঁটিয়ে দেখিনি। অনেকদিনের একটা প্রস্তুতি, আয়োজন, গ্রামে গ্রামে বিশেষ প্রকারের কৃত্যে বার্তন বা নিমন্ত্রণ, একটি রাতের পরিবেশনা... কেনো? এর মধ্যে কি কোথাও অগোচরে লুকিয়ে নেই সামাজিক সংহতি ও সম্মিলনের তাগিদ বা আকাঙ্ক্ষা?
অবশ্যই আছে। আছে বলেই, ভাবুকের যতো সমাগম রসিকের যতো সমাবেশ, রাসের রসনিষ্পত্তি ততই মনোহর, এ প্রবাদ আছে। আর গ্রামে গ্রামে বার্তন বা নিমন্ত্রণ পাঠানোর কাজটিও খুবই কঠিন বলা যায়। কেউ বাদ পড়বে না। প্রত্যেক বাড়িতে রাসের নিমন্ত্রণ পৌঁছানো চাই। আর প্রত্যেক বাড়ির কেউ না কেউ উপস্থিত থাকবে রাসে। নাহলে যে পরমমঙ্গলের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হবে।
রাস শুরু হয অনেক রাত করে। রাত বারোটা তো বেজেই যায়। এমনও হয়, একটা দুটো বেজে গেলো। কিন্তু শেষ হবে ভোরে, অবশ্যই। যদি কোনো রাস শুরু হতে দেরি হয়ে যায়, তাহলে মাঝখানে গুরুত্ববিবেচ্যে কিছু অংশ কাটছাঁট করে হলেও ভোরের মধ্যে তার সমাপ্তি টানতে হবে। সারারাত্রির অভিসার শেষে ভোরে যে রাধা আর সখিগণ নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসে। দিনের আলো যতো ফুটে উঠবে তত ধরা পড়বার ভয়। এ যে শান্ত পরিকল্পিত যৌথ পরকীয়া।
আসলে কার সাথে পরকীয়া? ভাবুক কী ভাবেন, যারা সারারাত রাস দেখেন, রাসে মগ্ন থাকেন? এই পরকীয়া নিজেরই ভেতরের সাথে, সেই সত্তা যে নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকে বস্তুজগতের নানান বাহ্যকাজের চাপে তাড়নায়? তাকেই বের করে এনে হৃদয়ের সাথে বোঝাপড়া, নাকি? নাহলে মানুষ রাসের মণ্ডলির চারধারে বসে কেনো কাঁদে হারানো প্রিয়জনের কথা ভেবে? রাসের রাধা বা বৃন্দা বা কৃষ্ণের আর্তির গীতনৃত্যভঙ্গির ভেতরে ঢুকেও কেনো মানুষ সেই ভাব আবেগ আর রসের রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে? শুরু করে হাহাকার, আর্তনাদ, পূর্বপুরুষের বা অকালহারানো প্রিয় মানুষের নাম ধরে?
রাধাকৃষ্ণের মিলন শেষে বর্তি বা প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করা হয়, ব্রাম্মণ বা পুরোহিত সে আরতির মধ্যমণি, তিনি প্রদীপের থালা বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে আরতির গানের সূত্র ধরেন, সাথে থাকেন সূত্রধারীরা। গোপী রাধা কৃষ্ণ সবাই মণ্ডলাকারে সে আরতির আঁচ, তার মঙ্গলস্পর্শ নেয়, সমাগতরাও। অগ্নিশুদ্ধ জীবনের নতুন সঞ্চার।
মূলত এই তো রাস। একই কাহিনী, একই কথা, একই বক্তব্য, তবু বছরের পর বছর ধরে এই পুনরাবৃত্ত শিল্পকৃত্যআঙ্গিক মানুষের কাছে নতুন নতুন করে ফিরে আসে। নতুন যা থাকে তা অংশ নেয়া শিল্পী-বিচারে, ভিন্ন ভিন্ন অজা বা রাসধারীর শিল্পরুচির তারতম্য অনুসারে নির্বাচিত গানের ক্ষেত্রে থেকে, কিন্তু ফিগার বা কাঠামো সেই একই। ক্লাসিকাল পর্যায়ের শিল্পনিরীক্ষা থেকে গৃহীত ভাবমুদ্রাগীতি ধীরে ধীরে একেবারেই লৌকিক বা প্রাকৃত হয়ে যায় রাসলীলায়। এ এক আশ্চর্য রূপান্তরকরণ। যদি তাই না হতো, তাহলে আবালবৃদ্ধবনিতা এভাবে রাসের স্বাদ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারত না। গানের কথায় সরল কমিউনিকেটিভ ধরন নেই, নাচের মুদ্রাগুলোর ভেতরেও নেই সহজ প্রকাশরীতি, প্রতিবেশ পরিবেশ কোথাও নেই লৌকিকতার সাধারণ উপাদান; তবু রাস সকলের, প্রাণের, অন্তরের, সব আবেগ আর আর্তির বোঝাপড়ার ফিরে দেখবার খুঁজে পাবার সমাবেশ।
মণিপুরীরা নিজেদের অস্থিরতার কালে, রাজ্যশাসকদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সময়ে, আগ্রাসনের নতুন নতুন ধরনের মুখে একটি ভাবধর্মকে নিজেদের মতো করে গ্রহণ করেছিলো, সেখানে আচার নয় মন্ত্র নয়, ছিলো প্রেমে আর রসে পরমকে চিনবার তরিকা, সেখান থেকেই নিজেদের শিল্পনন্দনের ভাবনায় তারা আরও আড়াল তৈরি করলো একটি সুদীর্ঘ জটিল আঙ্গিক, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল, সেই আড়ালের ভেতর প্রতিদিনের সাধনার ভেতর দিয়ে তারা নিজেরা নিজেদের কাছের হয়েছে, আত্মীয় হয়েছে, আর টিকে থাকবার রাজনীতিতে হারিয়ে ফেলবার বিরুদ্ধ লড়াইয়ে সেই আড়াল আর রহস্যের উচ্চ সৌন্দর্যআঙ্গিকের বিভায় স্বাতন্ত্রে তারা অক্ষুণ্ন থাকতে পেরেছে নিজেদের মুদ্রায় নিজেদের সুরে। রাসলীলা তাই মণিপুরীদের কাছে একটি সামগ্রিক ভাবলীলা, জীবন ভাবনা, পাওয়া না-পাওয়া মান- অভিমান অভিসার আর দর্শনের ব্যাকরণের ভিতর দিয়ে নিজের সাথে নিজের পরিচয় ও বোঝাপড়ার চলমান ব্যাকরণ।
পয়লা আমরা ইতিহাসে যাই। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগের কথা। ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে দেখলেন তিনি রাসলীলার আয়োজন করেছেন। নিজের কন্যা বিম্বাবতীকে রাধারূপে দেখলেন। এরপর মণিপুরে আয়োজিত হয় প্রথম রাসলীলা, ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। এর পেছনে আরেকটা প্রাসঙ্গিক কাহিনী আছে। সেটা হলো মণিপুরের প্রাকৃত ধর্মানুসারী মণিপুরী জাতিসত্তা তার কিছু আগে সবেমাত্র বৈষ্ণব ধর্মের বলয়ের মধ্যে এসেছে। বাঙালি বৈষ্ণব প্রচারকেরা মণিপুরে গিয়ে এ ধমের্র বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর মণিপুরের জনগণ ততদিনে নিজেদের অন্তর্বিতর্কের সূত্রগুলো বেশ চিনে নিয়েছিলো । ফলে বেড়েছে দ্বন্দ্ব। এম্নিতেই নানান মত, পার্বণ আর কৃত্যছাওয়া রাজ্যটি। অনেকেই তাই কৃষ্ণ-রাধার পর-ঐহিক সম্পর্কের গাঁথাটিকে খুব আদরে মেনে নিলো। অনেকে মানলো না। সে যাই হোক, রাসলীলা প্রেক্ষিতটাকে এখন হয়ত একটু চিনে নেয়া গেলো। অপরের ধর্মকে নিজের করে নেওয়া বা নেওয়াবার জন্য একটা বিশাল হাতিয়ার ছিলো রাসলীলা, অন্তত ভাগ্যচন্দ্রের কাছে। বৈষ্ণব পদকর্তাদের নানান পদ ও বোল নিয়ে মনিপুরী চিন্তকেরা রচনা করতে লাগলেন রাসলীলার আঙ্গিক। আর ভারতের ভরত প্রমুখ শিল্পগুরুদের নানান মুদ্রা বা করণের সাথে মণিপুরের লোকনৃত্যকলার নানান নমুনার পরিমিত সিনথেসিস গড়ে উঠল এই নব্য ক্লাসিক শিল্পআঙ্গিকে। সব কিছুই কিন্তু একটি ধর্মদার্শনিক ভাবনা অধিগ্রহণের প্রয়াস। বৈষ্ণবিজম গিয়ে ছিলো বাঙলা থেকে, ফলে রাসলীলায় বাঙলায়ন তো থাকবেই, আর ক্লাসিক রীতিতে ভাষার যে উচ্চতার ধারণা থাকে, তার প্রেক্ষিত অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতাবলম্বী মণিপুরীদের মাঝে ছিলো ভাষাগত হীনম্মন্যতাও। ফলে সহজেই বাংলা গানগুলো নিয়ে নেয়া হলো।
কিন্তু বাঙলা হলে কী হবে, তার গায়কী, উচ্চারণ রীতি, ভঙ্গি, আবেগ, প্রক্ষেপণ সবকিছুতে থেকে গেলো একেবারেই মণিপুরী ছাপ। যে কারণে এখনো অনেক বাঙালি চিন্তকের কাছে অবিশ্বাস্য যে রাসলীলার গানগুলো বাঙলা বা অপভ্রংশ বা ব্রজবুলি ভাষায় হয়। শুনেও তারা ধরে উঠতে পারেন না যে এটা বাঙলা। তাদের ধারণা সব গানই মণিপুরী ভাষার। আর গায়কীর মজাটা মণিপুরী ধরনে, সেখানে মিহি আর কাঁপা কাঁপা সুরের বৈচিত্র্য আছে। আর মণিপুরীদের নিজেদের শিল্পনকশার ধারণা থেকে বানানো হলো পোশাক, অনেকটাই রাজকীয়, সোনার আর জরির কাজ করা, দেখলে চোখ পলক ফেলবে না। আর মণিপুরীরা কীর্তনের খোল আর ঢোলের একটা সংমিশ্রন করে নিলো। যার নাম মৃদঙ্গ। এর চামড়া খুবই শক্ত। আর সহজপ্রাপ্তও নয়। অর্থাৎ একটা প্রান্তিক জনপদের মানুষ একটি ধর্ম আর মতাদর্শকে মেনে নিলো, কিন্তু দিয়ে দিলো নিজস্বতার ছাপ। কেউ বলতে পারবে না যে এটা আর কোনো জাতির বা বাঙালির।
তো রাস হয়ে গেলো। একেবারে আদিমধ্যঅন্ত সম্পন্ন একটি কাহিনীমূলক নয়, ভাবাত্মক প্রযোজনা। গান আর নাচ, সাথে বাদ্য। কেন্দ্রে কৃষ্ণ আর রাধা। কিন্তু এই কৃষ্ণ আর রাধাকে স্বর্গ আর মর্ত্যে পৃথক করার উপায় নেই। তারা দুজনেই একেবারে মর্ত্যের মানুষ। এভাবে ভাবলেই আবেগের খেলাটি জমে ওঠে। শিল্প হবার পরে সেটা মনেরই সম্পদ হতে চায়। আর তা ভাবুক বা দার্শনিকের নয়। রাসের মণ্ডলি বা মাটিতে রাধাকৃষ্ণরূপী শিল্পীরা নেচে গেয়ে প্রেমলীলা করে, আর ভক্তরা আর কাউকে মনে করে আবেগায়িত হয়, কাঁদে, এই কৃষ্ণের বাইরে তারা আর কোনো সত্তাকে খুঁজতে থাকে। অসংখ্যবার রাস দেখবার পর এমনই মনে হয়েছে।
মণিপুরে নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুরু হয়ে গেলো, মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নেই। বারবার আন্তঃ ও অন্তর্কোন্দল আর বর্মীদের আক্রমণে বিপর্যস্ত অনেক মণিপুরী ভারতের সীমানা ছেড়ে চলে এলো বাংলাদেশে। নিয়ে এলো তাদের বিশ্বাস ও কৃত্যের মিশ্র আচার।
জীবনকে নতুন করে সাজানো আর নিজের সম্মানজনক অস্তিত্বের জানান দেয়া। সারারাত ধরে যে অনুষ্ঠানটি চলে, তার সময়গত একটা ক্ষমতাই প্রথমে ধরা পড়বে, এটা স্বাভাবিক। আর নাচ গান অভিনয় ভঙ্গিমা সব মিলিয়ে জটিলতার একটা বিশাল ক্যানভাস। এটাকে নিয়েই জানান দিতে হবে নিজেদের অস্তিত্বের রূপটা। আর তারই ভেতরে শিকড় গাঁড়ল দিনকে দিন নিজের ভাব আর দর্শনের জায়গাটাও। সেখানে বিরহ মূখ্য, অর্থাৎ বিরহের যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো, অন্তিমে পা রাখা। কৃষ্ণ সেই লক্ষ্য। আর যাত্রীরা সকলে রাধা। এক কৃষ্ণের মণ্ডলে রাধা আর অজস্র গোপিনীর লীলা সে সত্যই সামনে আনে- আমরা পরমআবর্তিত সামান্য কতোগুলো চিহ্ন মাত্র।
এই ভাবকে চেনানোর জন্য ভাগবত গ্রন্থের একটি অধ্যায় যতোটা কাজ করেছে, তার চেয়ে মনে হয় বেশি মানুষের তাড়িত জীবনের আবেগ আর বেদনা। ভূমি হারানোর যন্ত্রণা। এই হারানো আর পাওয়ার মধ্যকার দ্বন্দ্বের নামই যেনো রাধা। রাধার মধ্য দিয়ে মণিপুরী জনগণ যেনো পৌঁছে যায় নিজেদের জৈবনিক ব্যথাভারাতুর সত্তাটির কাছে।
এখন এই কাণ্ডগুলোর ব্যাকরণিক যে অবয়ব, তার দিকে একটু নজর দেয়া যাক।
রস্যতে অনেন ইতি রাসঃ। অর্থাৎ যার দ্বারা রস জন্মায় তাই রাস। এখন এই রসউৎপাদন বা নিষ্পত্তির জন্য রাসকাররা কতোই না কাহিনী ফেঁদেছেন। ফাঁদতে ফাঁদতে তারা আর থিতু হতে না পেরে রাসকে নানা ভাগে ভেঙেই ফেলেছেন। মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, নিত্যরাস ইত্যাদি। সবের মূল কথা এক, তবে মূলকে চেনার বা পাওয়ার তরিকাগুলো ভিন্ন। বিভিন্ন কাল বা ঋতুর সাথে ভাবরসের একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা। তবে নিত্যরাস কালনিরপেক্ষ। আর জনপ্রিয়ও হয়েছে এটাই।
যা হোক সব ধরনের রাস বিচার করে যে মূল কিছু সূত্র পাওয়া যায় সেগুলো হলো, রাসের আগে একটা পালা থাকবে। নটপালা। নট মানে অভিনেতা, অর্থাৎ অভিনেতাদের পালা । রাসের বলা যায় একটা প্রাগআয়োজন এটি। এটা পুরুষদের পালা। আর রাস মূলত নারীদের। অর্থাৎ একটা ভারসাম্য। এভাবে সাজানো থাকে আয়োজনটি।
নটপালাও রাধাকৃষ্ণের বিষয় আশয় নিয়ে। তবে তার ভাব শান্ত নয়, নাট্যমূলক। সেখানে দরাজ কন্ঠে উদাত্তভবে গান পরিবেশন করা হয়, আর লোকজ ধারার পরিবেশনার ভঙ্গি পাওয়া যায়। গায়ক সেখানে নিজেই পাত্রপাত্রী। আর থাকে বাদ্যের ঝনঝনানি। কিন্তু রাস ধ্যানের, ধীরস্থ। শুরু হয় রাগালাপ দিয়ে। সূত্রধারীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে রাসের নির্দিষ্ট রাগগুলো গাইতে থাকেন। সাথে থাকে মৃদঙ্গের তাল।
এই দীর্ঘ রাগালাপের পর রাস শাস্ত্রকাররা বলেছিলেন বৃন্দাবনের গীতবর্ণন থাকবে। কিন্তু এটা অবাক করার বিষয় যে পুরাণের সীমা থেকে সরে রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের সকল সূত্রের বাইরে আরেকটি চরিত্র রাসলীলায় অনিবার্য অংশ নিয়ে নিলো। স্থান করে নিলো ভাবক হৃদয়ে। তার নাম বৃন্দা। বৃন্দাবনে থাকে বলে তার নাম বৃন্দা, নাকি বৃন্দা থেকে বৃন্দাবন নাম হলো ঠিক করা মুশকিল। তবে এটা মেনে নিতে বাধা নেই যে বৃন্দা একেবারেই লোকমানসজাত। সে নারীচরিত্র, কৃষ্ণানুরাগীই কেবল নয়, কৃষ্ণঅন্তপ্রাণ, কৃষ্ণকে সেই আসরে ডেকে নিয়ে আসে, তার জন্য ফিদা বা বিশেষ আসন পেতে দেয়, নিজের সমস্ত মায়া প্রেম সে আসনে বিছিয়ে দেয়, এবং আকুল কন্ঠে গান করে- আমি কৃষ্ণের প্রেমে কাঙ্গালিনী/ বৃন্দাবনে বৃন্দা দুর্ভাগিনী / এ সুখনিশীথে যমুনাপুলিনে শ্রীরাসমণ্ডলে... / আমি যুগলচরণ সেবা করিব/ যুগলরূপ নেহারিব/ জীবন সফল করিব...। বোঝা গেলো এ বৃন্দার বাস যমুনার তীরে, সেখানেই রাসমণ্ডলি সাজায়, আর যুগলচরণ সেবা করে কৃষ্ণের। রাধার প্রেমে যে কৃষ্ণলীন হবার আকাঙ্ক্ষা, বৃন্দার প্রেমে সেটা নেই, বরং নিজেকে সেই পরম সত্তার চরণে সঁপে দেবার এক ভক্তিময় আকুলতা।
কেউ বলতে পারে না রাসলীলার কাহিনীতে বৃন্দা কবে কোথায় কীভাবে আসলো; কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে রাসের সবচেয়ে আবেদনময় রসময় আবেগবহ গীতিপর্যায়টি বৃন্দা-অংশেই থাকে। রাধা যখন নিখাদ মানবী হয়েও ভক্তরসিকের মনে কৃষ্ণ নামক অধরা সত্তাটির সাথে লীলাখেলায় গিয়ে নিজেকেও দৈবের অংশ করে ফেলল একসময়, তখনই কি বৃন্দা এসেছে মানবিক প্রেমের ব্যাকুলতা নিয়ে? কৃষ্ণকে নিজের করে পাওয়ার দরকার নেই, নিজেকে তার মঙ্গলময় সত্তার চরণদাসী করাই সাধনা, এটা বলাতে?
যা হোক, আমরা ফিরব রাসলীলার অঙ্গে। বৃন্দা কুঞ্জ সাজিয়ে দিয়ে গেলো, রাধা আর কৃষ্ণের প্রেমের বাসর সাজিয়ে দিয়ে গেলো। এরপর কৃষ্ণ আসনে এসে উপবিষ্ট হবেন। শিল্পীটি সচরাচর একজন বালক বা কিশোর। কিন্তু তার অভিনেয় অংশটি হবে প্রাপ্তবয়স্কের ভূমিকায়। যে গাইবে উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী, কিশোরী নয়ন রাধা... তাঁর মনের ভেতরটা তো বোঝাই যায়। এই বালককৃষ্ণ নেচে নেচে নানান ভঙ্গিতে মণ্ডলিময় রাধার প্রেমে আকুলতা বিলিয়ে যাবে। এরপর আসবে রাধা।
রাধা ও সখিরা অভিসার রচনা করবে কৃষ্ণ দরশনের। শুরু হবে নানান বাদানুবাদ।
এরই মধ্যে শাস্ত্রকারের নানান উপচার। ভঙ্গীপারেং থেকে শুরু করে অনেককিছুই। বাহ্যত বোঝা যাবে না কী বিশেষ অর্থ। কিন্তু একটি কৃত্যকলাকে শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যে চির সমুন্নত রাখার যে ব্যাপক যজ্ঞ, সেখানে মুদ্রার নানান জটিলতা তো থাকবেই। আর ছিলো বলেই মণিপুরী সংস্কৃতি একটি আলাদা আসন নিয়ে দিব্যি অটুট রয়েছে। বাণিজ্যের শিল্পবেত্তারা এখানে হাত দিতে পারেন না। কারণ সেই কঠিন দীর্ঘসাধনের স্তরগুলোয় নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি করার ধৈর্য আর সাধনা কতোজনের আছে!
কিন্তু মণিপুরীরা পেরেছে এই কঠিন সাধনায় ব্রতী হতে। সমস্ত কিছুতে। তাই একটি কৃত্য, তার প্রস্তুতি চলতে পারে মাসব্যাপী। মূল লক্ষ্য মানত পূরণ, মঙ্গল, কিন্তু তার সিদ্ধিতে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ একটি শিল্পরস সাধনের বহুল শর্ত। পোশাক থেকে শুরু করে মণ্ডলি সাজানো, নিমন্ত্রণকর্ম সবকিছুতে মানতে হবে অনেক বিধি নিষেধ।
রাসের শিল্পীরা যে পোশাক পরবে সেগুলোও হতে হবে নিখুঁত আর দেবতার উদ্দেশ্যে ধূপবাতি জ্বেলে সেগুলো নিবেদন করে প্রণাম জানাতে হবে। তারপরই পাবে পরিধানের স্বীকৃতি। এখনো তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। এছাড়া গোপিনীদের নিয়ে রাসের আগের দিন হয় আরেকটি কৃত্য। রাসের অজা বা রাসধারীসহ সবাই মিলে এই কৃত্যটি করা হয়ে থাকে। নিজেদের একটি পরম মঙ্গলময় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ভাবার বিশ্বাসের লীনবিন্দুতে পৌঁছানোর সূত্র।
আর সেদিন সেই প্রাগকৃত্যের অংশ হিসেবে রাসের একটু অংশেরও মহড়া হবে।
আর রাসের মঞ্চ বা মণ্ডলি, তাতেও সেই ঐতিহ্য আর ইতিহাসের অটুটতা। বাঁশের খুটি বৃত্তাকারে গেড়ে উপরে কাগজের নকশা করা বেড়। সব মণ্ডলিই গড়নে এই একই রকম। নকশার মধ্যে আলাদা সৃষ্টিশীলতা, কিন্তু অবয়বে কোনো পরিবর্তন আসবে না। নকশাগুলোও বাজারচলতি নয়, মণিপুরী শিল্পমানসের ভেতর থেকে একটা ব্যাকরণে দাঁড় করানো বিশেষ প্রকারে তা হয়ে থাকে। মণ্ডলির নিচেও বৃত্তাকার এক-দুহাত উঁচু বেড়া। তার একদিক মাত্র খোলা। অর্থাৎ ভেতরে যাবার পথটি খুবই সঙ্কীর্ণ। যে যাবে সেই ছোট্ট পথের মধ্যেই নিজের রাস্তা বের করে ঢুকবে নৃত্যআসরে। গিয়ে প্রেম বা ভক্তি নিবেদন করবে।
কার কাছে প্রেম, কার কাছে ভক্তি? যে ছোট্ট ছেলেটি গতকালও ছিলো পাড়ার এক দুষ্টু কিশোর বা শিশু, তাকেই আজ কৃষ্ণের বেশে দেখে ভাবুক বা ভক্তের নয়ন অশ্রুবিগলিত। দুপায়ে তার লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খায়, আত্মহারা। কৃষ্ণদর্শনের পুলক তার পুরোটা শরীরে ও হৃদয়ে। আবার এটাও নয় যে, সেই ভাবুক বা ভক্তগণ বিস্মৃত এই সত্য থেকে- সে আসলে কৃষ্ণের ভূমিকা নেয়া একজন শিল্পী। তার শিল্পভঙ্গিমার চমৎকারিত্বের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা থাকে ভক্তের মনেও। অর্থাৎ ‘ডায়ালেকটিক্যাল’ ভাবটা দর্শকের মনে পর্যন্ত। শিল্পী আর উদ্দিষ্ট সত্তা একই অঙ্গে বিরাজ করে, যে কৃষ্ণ সেই শিল্পী, তার শিল্পত্ব বিচার্য, আবার তার পরম কৃষ্ণত্বও প্রণম্য।
নিজের সন্তান, যে কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত রাসমণ্ডলিতে, তাকেই কৃষ্ণজ্ঞানে স্রাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বিহ্বল পিতৃমাতৃহৃদয়ও। আর এটাই রাস। জীবনের সকল চিহ্ন বাস্তবতার সীমার উপরের জমিনে গিয়ে অন্তরের নানান জায়গা থেকে চেনার মহাযজ্ঞ। এ যজ্ঞে ঘৃত নেই, আহুতি নেই, আছে ভাব রস প্রেম আর ভক্তি। আছে মহান বিশ্বাস।
এর সমাজতাত্ত্বিক কতো কার্যকারণই না থাকতে পারে। আমরা তা খুঁজতে যাইনি। এর সাথে জড়িয়ে আছে একটি প্রান্তিক জনপদের টিকে থাকবার সমস্ত কলাকৌশলের ছকও। খুঁটিয়ে দেখিনি। অনেকদিনের একটা প্রস্তুতি, আয়োজন, গ্রামে গ্রামে বিশেষ প্রকারের কৃত্যে বার্তন বা নিমন্ত্রণ, একটি রাতের পরিবেশনা... কেনো? এর মধ্যে কি কোথাও অগোচরে লুকিয়ে নেই সামাজিক সংহতি ও সম্মিলনের তাগিদ বা আকাঙ্ক্ষা?
অবশ্যই আছে। আছে বলেই, ভাবুকের যতো সমাগম রসিকের যতো সমাবেশ, রাসের রসনিষ্পত্তি ততই মনোহর, এ প্রবাদ আছে। আর গ্রামে গ্রামে বার্তন বা নিমন্ত্রণ পাঠানোর কাজটিও খুবই কঠিন বলা যায়। কেউ বাদ পড়বে না। প্রত্যেক বাড়িতে রাসের নিমন্ত্রণ পৌঁছানো চাই। আর প্রত্যেক বাড়ির কেউ না কেউ উপস্থিত থাকবে রাসে। নাহলে যে পরমমঙ্গলের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হবে।
রাস শুরু হয অনেক রাত করে। রাত বারোটা তো বেজেই যায়। এমনও হয়, একটা দুটো বেজে গেলো। কিন্তু শেষ হবে ভোরে, অবশ্যই। যদি কোনো রাস শুরু হতে দেরি হয়ে যায়, তাহলে মাঝখানে গুরুত্ববিবেচ্যে কিছু অংশ কাটছাঁট করে হলেও ভোরের মধ্যে তার সমাপ্তি টানতে হবে। সারারাত্রির অভিসার শেষে ভোরে যে রাধা আর সখিগণ নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসে। দিনের আলো যতো ফুটে উঠবে তত ধরা পড়বার ভয়। এ যে শান্ত পরিকল্পিত যৌথ পরকীয়া।
আসলে কার সাথে পরকীয়া? ভাবুক কী ভাবেন, যারা সারারাত রাস দেখেন, রাসে মগ্ন থাকেন? এই পরকীয়া নিজেরই ভেতরের সাথে, সেই সত্তা যে নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকে বস্তুজগতের নানান বাহ্যকাজের চাপে তাড়নায়? তাকেই বের করে এনে হৃদয়ের সাথে বোঝাপড়া, নাকি? নাহলে মানুষ রাসের মণ্ডলির চারধারে বসে কেনো কাঁদে হারানো প্রিয়জনের কথা ভেবে? রাসের রাধা বা বৃন্দা বা কৃষ্ণের আর্তির গীতনৃত্যভঙ্গির ভেতরে ঢুকেও কেনো মানুষ সেই ভাব আবেগ আর রসের রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে? শুরু করে হাহাকার, আর্তনাদ, পূর্বপুরুষের বা অকালহারানো প্রিয় মানুষের নাম ধরে?
রাধাকৃষ্ণের মিলন শেষে বর্তি বা প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করা হয়, ব্রাম্মণ বা পুরোহিত সে আরতির মধ্যমণি, তিনি প্রদীপের থালা বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে আরতির গানের সূত্র ধরেন, সাথে থাকেন সূত্রধারীরা। গোপী রাধা কৃষ্ণ সবাই মণ্ডলাকারে সে আরতির আঁচ, তার মঙ্গলস্পর্শ নেয়, সমাগতরাও। অগ্নিশুদ্ধ জীবনের নতুন সঞ্চার।
মূলত এই তো রাস। একই কাহিনী, একই কথা, একই বক্তব্য, তবু বছরের পর বছর ধরে এই পুনরাবৃত্ত শিল্পকৃত্যআঙ্গিক মানুষের কাছে নতুন নতুন করে ফিরে আসে। নতুন যা থাকে তা অংশ নেয়া শিল্পী-বিচারে, ভিন্ন ভিন্ন অজা বা রাসধারীর শিল্পরুচির তারতম্য অনুসারে নির্বাচিত গানের ক্ষেত্রে থেকে, কিন্তু ফিগার বা কাঠামো সেই একই। ক্লাসিকাল পর্যায়ের শিল্পনিরীক্ষা থেকে গৃহীত ভাবমুদ্রাগীতি ধীরে ধীরে একেবারেই লৌকিক বা প্রাকৃত হয়ে যায় রাসলীলায়। এ এক আশ্চর্য রূপান্তরকরণ। যদি তাই না হতো, তাহলে আবালবৃদ্ধবনিতা এভাবে রাসের স্বাদ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারত না। গানের কথায় সরল কমিউনিকেটিভ ধরন নেই, নাচের মুদ্রাগুলোর ভেতরেও নেই সহজ প্রকাশরীতি, প্রতিবেশ পরিবেশ কোথাও নেই লৌকিকতার সাধারণ উপাদান; তবু রাস সকলের, প্রাণের, অন্তরের, সব আবেগ আর আর্তির বোঝাপড়ার ফিরে দেখবার খুঁজে পাবার সমাবেশ।
মণিপুরীরা নিজেদের অস্থিরতার কালে, রাজ্যশাসকদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সময়ে, আগ্রাসনের নতুন নতুন ধরনের মুখে একটি ভাবধর্মকে নিজেদের মতো করে গ্রহণ করেছিলো, সেখানে আচার নয় মন্ত্র নয়, ছিলো প্রেমে আর রসে পরমকে চিনবার তরিকা, সেখান থেকেই নিজেদের শিল্পনন্দনের ভাবনায় তারা আরও আড়াল তৈরি করলো একটি সুদীর্ঘ জটিল আঙ্গিক, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল, সেই আড়ালের ভেতর প্রতিদিনের সাধনার ভেতর দিয়ে তারা নিজেরা নিজেদের কাছের হয়েছে, আত্মীয় হয়েছে, আর টিকে থাকবার রাজনীতিতে হারিয়ে ফেলবার বিরুদ্ধ লড়াইয়ে সেই আড়াল আর রহস্যের উচ্চ সৌন্দর্যআঙ্গিকের বিভায় স্বাতন্ত্রে তারা অক্ষুণ্ন থাকতে পেরেছে নিজেদের মুদ্রায় নিজেদের সুরে। রাসলীলা তাই মণিপুরীদের কাছে একটি সামগ্রিক ভাবলীলা, জীবন ভাবনা, পাওয়া না-পাওয়া মান- অভিমান অভিসার আর দর্শনের ব্যাকরণের ভিতর দিয়ে নিজের সাথে নিজের পরিচয় ও বোঝাপড়ার চলমান ব্যাকরণ।
>> পথিক ১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন