শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০১০

গল্প >> নিতান্ত সাধারণ মানুষ : সাঈম চৌধুরী

নিতান্ত সাধারণ মানুষ

সাঈম  চৌধুরী

সকাল দশটায় তিনি অফিস পৌঁছেন। বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যায়। শার্ট-প্যান্ট তাকে বড় যন্ত্রণা দেয়। ঘরে ফিরে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে চাপালেই রাজ্যের স্বস্তি। নিয়ম করে টিভি দেখেন ঘণ্টা তিনেক। আশপাশের প্রতিটি ঘর থেকে স্টার প্লাস কিংবা জিটিভির জমজমাট সিরিয়াল অথবা রমরমা হিন্দি গানের আওয়াজ ভেসে আসে। হিন্দি বাক্যের আগামাথা কিছুই বুঝেন না তিনি। এখনও তার সবটুকু ভরসা বিটিভিতে জমা। রাত দশটার ইংরেজি খবর তাকে ঘুমের নিমন্ত্রণ জানায়। কখনো কখনো সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েন। এই তার রোজকার রুটিন। নিতান্তই সাধারণ নির্লিপ্ত এক জীবন। যারা আড্ডাবাজ, যারা গল্পবাজ তারা এই মানুষটির বর্ণহীন সময়ের গল্পে হাঁসফাঁস করে। তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। তারা ভ্রু কুচকে বলেন, এটাও কি তবে জীবন? এ কেমন জীবন যার কোনো বাঁক নেই, গল্পের পায়রার বাকবাকুম নেই!
আড্ডাবাজেরা মানুষটির অতীত অনুসন্ধান করেন। নিষ্কর্মা সময়ে চায়ে চুমুক দিয়ে তারা না জানা গল্পের লেজ ধরে টান দিতে চান। তত্ত্ব-তালাশ করেন। এভাবে গল্পহীন মানুষটিও গল্প হয়ে যান। তাকে নিয়ে তত্ত্ব তালাশে  জানা যায়, একদিন স্ত্রীর কাছে একটি গল্প বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। নিজের জীবনের গল্প। সে গল্প শুনবেন বলে উৎসুক হয়েছিলেন স্ত্রী। ইচ্ছে প্রকাশের সে রাতে ফকফকা জোসনা ছিলো। যেনো দুধে ধুয়েছিলো কালো রাতের আন্ধার। হঠাৎ জানালা দিয়ে তাকিয়ে জোসনার আধিপত্য দেখে গল্প বলার ইচ্ছে চাপা দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এটি অন্ধকারের গল্প। কোনো এক অমাবশ্যা রাতে বলবো। তারপর আর কখনো সেটি বলা হয়নি। স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছেন দুই বছর।
এখন এই গল্প শোনার মতো কেউ তার পাশে নেই। অন্ধকারের গল্পটি আরো কয়েক বছর পর তার সঙ্গে অন্ধকার কবরে ঘুমাবার চূড়ান্ত বন্দোবস্ত নিয়েছে। জীবনের বহু গল্প ভাষাহীন থেকে যায়।
এভাবে এই গল্পটিও অপ্রকাশ্য থাকার সব যোগ্যতা অর্জন করার পর বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এক দঙ্গল আড্ডাবাজ। তারা ধারণা করে, এটি ভয়ঙ্কর কোনো রাষ্ট্রদ্রোহিতার গল্প। কারণ গেলো সপ্তাহে তিনি যখন মনোরঞ্জনের সেলুনে বসে চুল কাটছিলেন, তার হাতে পত্রিকা ছিলো। পত্রিকা পড়তে পড়তে তিনি কেনো জানি অকস্মাৎ বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষ করেন। অমার্জনীয় কটাক্ষ। বাংলাদেশকে তিনি পাছার সাথে তুলনা করেন। মনোরঞ্জন সেটা স্পষ্ট শুনেছে। মনোরঞ্জন বিস্মিত হয়েছে। আড্ডাবাজেরা বিস্মিত হয়েছে। তারা হিসেব মেলায়, জানে, এই মানুষটির একটা গোপন গল্প আছে। জানা মতে, গল্পটি শুনতে হয় অমাবশ্যা রাতে, দিনের আলোয় তা ভাষাহীন থাকে, জোসনার আলোয়ও সেটি বলা যায় না। সব মিলিয়ে বিশ্রী  চেহারা ধারণ করে গল্পটি। আড্ডাবাজেরা ক্ষেপে যায়। কেউ কেউ দেখে নেওয়ারও হুমকি দেয়। কিন্তু যতটা একজন গোঁয়ারকে দেখে নেওয়া যায়, ততোটা একজন গোবেচারাকে দেখে নেওয়া যায় না। গোবেচারা হওয়ার এই সম্ভবত একমাত্র সুবিধা।
আড্ডাবাজেরা তাকে সুযোগ দেয়। গল্প শোনাবার সুযোগ। এক অমাবশ্যা রাতে হাজির হয় তারা। টিভিতে তখন দশটার ইংরেজি সংবাদ। তিনি ঘুমোবার আয়োজন করছেন।
আড্ডাবাজেরা বলে, আপনার গল্প বলুন।
তিনি বলেন, আমার কোনো গল্প নেই।
আড্ডাবাজের একজন বলে, আপনি কি আমাকে চিনেছেন? আপনার স্ত্রী ছিলেন আমার বড় ফুপুর ননদ। তিনি ফুপুর কাছে বলেছিলেন, আপনার নাকি এমন একটা গল্প আছে যে গল্প শুনতে হলে অমাবশ্যা রাত নামতে হয়, এটি কি কোনো ভূতের গল্প নাকি ভয়ঙ্কর পাপের গল্প? জেনে রাখুন, ভূতের গল্পে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা বিশ্বাস করি, যে গল্প অন্ধকারের গল্প সেটি অবশ্যই পাপের গল্প।
আড্ডাবাজদের মধ্যে সেলুনের সেই মনোরঞ্জনও আছে। সে স্মরণ করিয়ে দেয়, বাংলাদেশকে গালি দেওয়ার বিষয়টি। 
অন্ধকারের গল্প এবং বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে গালি দুটোর মধ্যে যে একটা যোগসূত্র থাকতে পারে সেটি প্রকাশ পায় সবার কথাবার্তায়।
তিনি ঘড়ির দিকে তাকান, এগারোটা বাজে। অনেক দিন পর রুটিনের ব্যতিক্রম। আজ সময় মতো বিছানায় যাওয়া হয়নি। এক গ্লাস পানি পান করেন তিনি। আড্ডাবাজরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তখনো টিভি চলছে। একটি মোবাইল কোম্পানির নির্দিষ্ট প্যাকেজ কিনলে সারা রাত ফ্রি কথা বলা যাবে, একদল ছেলে মেয়ে নেচে গেয়ে সেই তথ্যটি জানান দিচ্ছে। তিনি টেলিভিশন অফ করেন। হঠাৎ নীরব হয়ে যায় চারপাশ। তার মাঝে গমগম করে উঠে তার কণ্ঠস্বর, আমি মুমিনুল ইসলাম। বাংলাদেশ আর আমার মাঝে সংখ্যার দিক থেকে একটা মিল আছে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল আর ছাপান্ন বছর। হ্যাঁ, বৃদ্ধই বলা যায় আমাকে। গল্পটাকে ধারণ করেছি উনচল্লিশ বছর। ছাপান্ন থেকে বিয়োগ উনচল্লিশ। রইল বাকী সতেরো। আমি তখন সতেরো বছর....
গল্প বলেন মুমিনুল ইসলাম। সতেরো বছর বয়েসের গল্প। ছাপান্নে যার নাম মুমিনুল ইসলাম, সতেরো বছর বয়েসে তার আরেক নাম রাঙা। দেখতে ছেলে রাজপুত্র বলে, বাবা আদর করে রাঙা বলে ডাকেন। রাঙা আর রঙিলা। ভাই আর বোনের রঙিন নাম। সময়টাও তাদের কাছে রঙময়। রঙিলার গান শেখার শখ। যেদিন রঙিলার আঠারো বছর পূর্ণ হলো বাবা তাকে হারমোনিয়াম কিনে দিলেন। হারমোনিয়াম বাজাতে জানে না রঙিলা। শোয়ার সময় বিছানায় হারমোনিয়ামকে সঙ্গে রাখে সে। জড়িয়ে রাখে সারারাত। বাবা হাসেন। মাও হয়তো হাসতেন। কিন্তু হারমোনিয়াম কেনার দুই বছর আগে তিনি হুট করে চলে যান। রূপকথার বয়স মাত্র পেরিয়ে এসেছে রঙিলা কিংবা রাঙা। তবুও তারা মাকে আকাশের তারায় খুঁজে। হারমোনিয়ামে সারেগামা’র মা তানটি সহজেই তুলতে জানে রঙিলা। বাবা তাদের যত্ন করে গড়ে তোলেন। বাবা যেনো বন্ধু, বাবা যেনো মা, বাবা যেনো ভাইবোনের সকল ভরসা জমা করে রাখার বিশ্বস্ত ব্যাংক।
রাঙা তখন সতেরো। দশম শ্রেণীর শান্ত সুবোধ ভালো ছাত্র। স্কুল থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে খেলার মাঠ আর বন্ধুদের সঙ্গে তুরন্ত-দুরন্ত আড্ডা। রাঙা তখন পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন। রাঙা তখন জীবনকে চিনতে শেখে এবং জীবনে আনন্দের প্রাচুর্যে সে খুবই মুগ্ধতা বোধ করে। রাঙার কাছে রাষ্ট্র তখন অচেনা বিষয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে যে ভাবতে জানে গোটা আকাশটাই তার, তার পক্ষে রাষ্ট্রের সীমানার ব্যাপার স্যাপার বুঝে নেওয়া জটিলসাধ্যই বটে।
তবুও কি রাষ্ট্রকে অতিক্রম করতে পারে মানুষ? নিজেকে কাঁটা তারে বাঁধতে না চাইলেও এক সময় বোধ হয় সে আসলে জন্মাবধি ঐ তারেই বান্ধা। রাষ্ট্র তাকে সীমানায় বন্দি করে, এমনকি রাষ্ট্র শূন্যে আন্দাজে আকাশ মেপে তৈরি করে আজগুবি আকাশসীমা। 
রাষ্ট্র বুঝে না রাঙা। তাই বলে রাষ্ট্রের জটিলতা তাকে ছেড়ে দেয় না। তখন একাত্তর। আশ্চর্য এক সময়। একটি রাষ্ট্র ভাঙছে, একটি রাষ্ট্র জন্ম নিচ্ছে। ভাঙাগড়ার অদ্ভুত সেই সময় সাত কোটি মানুষকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেখায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেখে রাঙাও। ভালো লাগে না তার। ঘরের বাইরে যাওয়া নেই। খেলা নেই। স্কুলও নেই। কিছুদিন পর প্রি টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিলো। পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন মাধব স্যার। কাজটাকে তিনি সব সময় বাড়তি ঝামেলা মনে করতেন। তাকে আর কোনোদিন খাতা দেখার ঝামেলায় যেতে হবে না। পাকিস্তানের আর্মিরা মাধব স্যারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন তার লাশ পাওয়া যায় স্কুল ঘরের সামনের ডোবায়।
মাধব স্যারের মৃত্যুর সংবাদ রাঙাকে বিচলিত করে এবং রাঙাকে তারো অধিক বিচলিত করে তার বাবার হঠাৎ পাল্টে যাওয়ার বিষয়টি। পাল্টে গেছেন রাঙার বাবা মেহরাজুল ইসলাম। তিনি রবীন্দ্র সংগীত ভালোবাসতেন। তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসতেন। মেয়ের হারমোনিয়ামে সুযোগ পেলেই হাত বুলাতেন। সুর তুলতেন। গুনগুন করে গাইতেন “আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন আকাশে আকাশে...।” ছেলেমেয়ের ডাকনাম রাঙা আর রঙিলা শুনে অনেকেই হাসতেন। মেহরাজুল ইসলাম এই বিদ্রুপের হাসিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে জানতেন।
অথচ এখন রাঙা আর রঙিলার নাম তিনি নিজেই পাল্টে দেন। রাঙাকে ডাকেন মুমিনুল ইসলাম বলে, রঙিলা হয়ে যায় খাদিজা বেগম।
রঙিলাকে নিয়ে মাস কয়েক আগেও বাড়তি কোনো চিন্তা ছিলো না মেহরাজুল ইসলামের। কিন্তু যখন একাত্তর আসে, যখন রঙিলা হয়ে যায় খাদিজা বেগম তখন মেহরাজুল ইসলামের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় রঙিলাই। তার বয়স আঠারো। রূপবতী মেয়ে। নারীর রূপ তখন গোটা রাষ্ট্রের সকল পিতা-মাতার সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠার বিষয়। রাঙা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে তার বাবা রঙিলার গান গাওয়ার শখটিকে এখন ভালো চোখে দেখছেন না।
একদিনের ঘটনা। রাতে ঘুমিয়ে ছিলো রঙিলা। বিছানার পাশে তার হারমোনিয়াম রাখা। মেহরাজুল ইসলাম মেয়ের বিছানার কাছে আসেন। রঙিলার একটা হাত হারমোনিয়ামের উপর রাখা। আলতো করে হাতটা সরিয়ে নেন তিনি। হারমোনিয়ামের উপর নিজস্ব দখল প্রতিষ্ঠা করেন। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরেন সেটিকে। ঠাণ্ডা পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরের বাইরে যান। সতর্কতা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকান। বাড়ির পাশে ছোট পুকুর। হারমোনিয়াম হাতে নিয়ে পুকুরের পাড়ে কিছু সময় নীরব দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। এক সময় ভারমুক্ত হন। নীরব-ঘুমন্ত পানিতে হঠাৎ ঝুপ করে বেশ বড় ধরনের একটা শব্দ হয়। আবার ধীর পায়ে ঘরে ফিরে আসেন মেহরাজুল ইসলাম। চমকে উঠেন। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রাঙা এবং রঙিলা। রঙিলা বুঝে এবং জেনে গেছে তার ক্ষতির সংবাদ। রঙিলা কাঁদে। রঙিলার চোখে একই সাথে জল আর বিস্ময়। বাবা এমন কাণ্ড করতে পারেন এটি তার ধারণার অতীত।
ধারণার অতীত আরো কিছু কাণ্ড করেন মেহরাজুল ইসলাম। একাত্তর সাল আশ্চর্য সময় বলেই স্বভাববিরুদ্ধ অনেক কিছুই ঘটে সেই সময়ে। তখন যুদ্ধ চলছে। একদল মানুষ যুদ্ধে চলে গেছে। তাদের ফেরা আর না ফেরার বিষয়টি চরম অনিশ্চিত। আর যারা যুদ্ধে যায়নি, তারাও বাস করে অনিশ্চয়তার জগতে। অনিশ্চয়তা তীব্র ছিলো বলেই মানুষ ছোটখাটো নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়। মেহরাজুল ইসলামও এরকম ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তার ব্যাকুলতার বিষয় মেয়ের বিয়ে। যেনো রঙিলার বিয়ে হয়ে গেলেই একাত্তর উপাখ্যানের ইতি ঘটবে। যেনো তার বিয়ে হচ্ছে না বলেই যুদ্ধ থামছে না। রঙিলার বয়স আঠারো। বয়স অনুপাতে বুদ্ধির বৃদ্ধি ঘটেনি। খানিকটা বোকা সে। বোকা বলেই অভিমান তার খুব বেশি। সেই যে বাবা হারমোনিয়াম পানিতে ফেলে দিলেন তারপর থেকে বাবার সঙ্গে কথাই বলে না সে। বাবা যখন তাকে জানান, আসছে শুক্রবারে তার বিয়ে হচ্ছে, তখন সে সিদ্ধান্তটির প্রতিবাদ করে না। কারণ প্রতিবাদ করতে হলে বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আর কথা বললেই আড়ি ভেঙে যাবে। আড়ি ধরে রাখায় অধিক মনোযোগী রঙিলা তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের খবরেও অমনোযোগী থাকে।
রঙিলার বিয়ে হচ্ছে আবদুল খালিকের সাথে। আবদুল খালিকের বাবা আবদুল গফুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। যুদ্ধের সময়কালে তিনি এলাকার সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তি। পাকিস্তানি আর্মির কর্নেল, মেজররা তার বাসায় নিত্য যাওয়া আসা করে। এমন ক্ষমতাধর ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে রঙিলার বিয়ে সৌভাগ্য হিসেবেই মানেন মেহরাজুল ইসলাম। রঙিলার সঙ্গে তার হবু স্বামী আবদুল খালিকের বয়েসের অনেক তফাত। তফাত আছে আরো অনেক কিছুতেই। কিন্তু একাত্তরে  এতো সব দেখতে নেই। একাত্তরের স্বস্তি হচ্ছে শান্তি কমিটির সদস্য কারো সঙ্গে আত্মীয়তায় বাঁধা পড়া।
দেখতে দেখতে রঙিলার বিয়ে হয়ে যায়। যথেষ্ট জাঁকজমকেই বিয়ে হয়। আর্মির লোকেরাও দাওয়াত খেতে আসে। তাদের সেবা করতে পেরে বিগলিত মেহরাজুল ইসলাম খেয়ালই করেন না, এমনকি বিয়ের দিনেও অভিমানী রঙিলা তার সঙ্গে কথা বলেনি। হারমোনিয়ামের দুঃখ মেয়ে কিছুতেই ভুলে না।
বিয়ের অনুষ্ঠানেই মেহরাজুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয় মেজর ইকবাল কাদিরের। মেজরের বিনয়ী কথাবার্তায় মুগ্ধ হন মেহরাজুল ইসলাম। মেজর বলেন, শেখ মুজিব একজন আবেগসর্বস্ব মানুষ। তাকে এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের সেই আবেগেরই মূল্য দিতে হচ্ছে। মেজর তাকে আরো জানান, যদি কোনোভাবে দুই পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে ভারত এসে নাক গলায়, তাহলে আমেরিকা আর চীন বসে থাকবে না। তারা পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। আসন্ন যুদ্ধজয়ের কল্পনায় মেজর ইকবাল কাদিরকে বেশ সুখী মনে হয়।
মেজরের কথায় তাল দেন মেহরাজুল ইসলাম। দুজনের আলাপ বেশ জমে উঠে। রাঙাকে মেজরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন মেহরাজুল ইসলাম। মেজর রাঙাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। বলেন, এই বয়েসের ছেলে ছোকরাই তো মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে, তাই না?
কথা কেড়ে নেন মেহরাজুল ইসলাম। বলেন, আমার ছেলে মুমিনুল ইসলাম পাকিস্তানের একনিষ্ঠ ভক্ত, আল্লামা ইকবাল তার প্রিয় কবি।
মেজর তখন রাঙাকে আল্লামা ইকবালের কবিতা আবৃত্তি করতে বলেন। রাঙা নীরব থাকে। মেজর তাকে কাছে ডেকে নেন। কাঁধে হাত রাখেন। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেন, পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করতে হবে, রাজী আছো?
রাঙা কিছু বলে না। তার বাবা মেহরাজুল ইসলাম বলেন, ছোট ছেলে, দেশের জন্য কাজ করার বয়েস হয়নি এখনও।
মেজর ইকবাল কাদির লাল চোখে তাকান। বলেন, দেশ ভাঙার জন্য এই বয়েসে যুদ্ধে যাওয়া যায়, আর দেশ গড়ার জন্য যাওয়া যায় না? তারপর দৃঢ়স্বরে মেজর নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, আমি চাই আপনার ছেলে দেশের জন্য কাজ করুক।
কিছু বলেন না মেহরাজুল ইসলাম। বাতাস উড়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে যান তিনি।
দুদিন পরেই মেজর ইকবাল কাদিরের দূত আসে রাঙাদের বাসায়। রাঙাকে ক্যাম্পে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মেজর। আজ বিকেলেই যেতে হবে। মেহরাজুল ইসলাম ভয়ে কাঁপেন। দৌড়ে যান নতুন বেয়াইয়ের বাড়িতে। বেয়াই আবদুল গফুর সান্ত্বনা দেন, ভয়ের কিছু নাই। বড় জোর আপনার ছেলেকে হয়তো রাজাকারে নাম লেখাতে হতে পারে। তাকে বলে দিবেন, যেনো সে কোনো কিছুতে আপত্তি না করে। বুঝেনই তো পাকিস্তানিরা আবার আপত্তি পছন্দ করে না।
ঘরে ফিরে আসেন মেহরাজুল ইসলাম। বিকেল নামছে। এখনই রাঙাকে ক্যাম্পে যেতে হবে। আয়াতুল কুরসি পড়ে ছেলের বুকে ফুঁ দেন তিনি। বলেন, বাবারে কোনো কিছুতে আপত্তি করিস না, যদি বলে রাজাকার হতে, হয়ে যাবি রাজাকার। যা বলে তাই মেনে আসিস।
রাঙা বলে, আমার ভয় করে বাবা, খুব ভয় করে। মেহরাজুল ইসলাম ছেলের সঙ্গে যাবেন বলে মনস্থির করেন। ছেলেকে একা তিনি ছেড়ে দেবেন না।
শেষ বিকেলে পথে নামেন দুজন। রাঙা আর তার বাবা। সূর্য ডুবছে। রাঙা ভয়ে কাঁপছে। মেহরাজুল ইসলাম শক্ত করে ছেলের হাত ধরে রাখেন।
ক্য্যাম্পে মেহরাজুল ইসলামকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। রাঙা ক্যাম্পে প্রবেশ করে। পেছন ফিরে চায়। বাবা হাত নাড়েন। রাঙার কান্না পায়।
একজন সিপাহী রাঙাকে নিয়ে মেজরের রূমে আসে। ভয়ে কাঁপে রাঙা। মাধব স্যারের কথা তার মনে পড়ে। রাঙা ভাবে আর কি কোনোদিন বাবাকে দেখা হবে, আর কি কোনোদিন রঙিলা বুবুকে দেখা হবে?
মেজর রাঙার কাছে আসেন। তার চোখ অন্যরকম। মেজর রাঙার শরীরে হাত দেন। রাঙার শার্ট খুলেন, রাঙার প্যান্ট খুলেন। রাঙা আপত্তি করে না। বাবা বলে দিয়েছেন যাই ঘটুক কোনো কিছুতে আপত্তি করিস না। রাঙা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। রাঙার শরীরের উপর মেজরের শক্ত শরীরের ভার। সতেরো বছর বয়েসি রাঙার উপর যেনো ভর করেছে কঠিন পৃথিবী। তীব্র ব্যথায় জ্ঞান হারায় সে।
একসময় জ্ঞান ফিরে রাঙার, মাঝে কত সময় গেলো কিছুই জানে না সে। শরীরের ঠিক মধ্যস্থানে তার অসহ্য যন্ত্রণা, প্রচণ্ড ব্যথা।
মেজর তাকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। তবে শর্ত হচ্ছে যখনই ডাকবেন, হাজির হতে হবে।
তীব্র ব্যথা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে রাঙা। বাইরে রাত নেমেছে। বাবা তখনও অপেক্ষারত। ছেলেকে ফিরে পেয়ে দৌড়ে কাছে আসেন। প্রবল ভাবে বুকে টেনে নেন। কাঁদেন তিনি। রাঙা কাঁদে না। রাঙা বাবার কাঁধে হাত রেখে হাঁটে। রাঙাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে মেহরাজুল ইসলাম জানতে চান, তোকে ওরা মারেনি তো?
লজ্জায় নীরব থাকে রাঙা। মেহরাজুল ইসলাম ছেলের শরীর ধরে ঝাকুনি দেন, কী হয়েছে বল আমাকে, ও বাবা বল আমাকে?
হাঁটতে কষ্ট হয় রাঙার। উহ্, উচ্চারণে সে তার কষ্ট প্রকাশ করে। মেহরাজুল ইসলাম ব্যাকুল হন, ও সোনা যাদু, কী হয়েছে রে তোর?
বাবার কণ্ঠের মমতা আর ব্যাকুলতায় নিজেকে ধরে রাখতে পারে না রাঙা। প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বাবার কাছে কীভাবে বলে সে অপমানের কথা কিংবা কীভাবেই সেটা গোপন করে রাখে? কাঁদতে কাঁদতে রাঙা বলে, যে ভয়ে তুমি রঙিলা বুবুর বিয়ে দাও, মেজর আমাকে সেটাই করেন, মেজর আমাকে...
কান্নার তোড়ে বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারে না রাঙা। তবু যা  বোঝার বুঝে নেন মেহরাজুল ইসলাম। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। লজ্জায় তিনি ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারেন না, মাথা নিচে নামিয়ে নেন। বলেন, ওগো আল্লাহ তোমার আরশ কি কেঁপে উঠে না?
গল্প শেষ হয়। আড্ডাবাজেরা চলে যায়। পরদিন সকাল দশটায় তিনি অফিস পৌঁছেন। বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যায়। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে চাপিয়ে স্বস্তি লাভ করেন। নিয়ম মতো টিভি দেখেন ঘণ্টা তিনেক। রাত দশটার ইংরেজি সংবাদ তাকে ঘুমের নিমন্ত্রণ জানায়। তিনি ঘুমোতে যান।

>> পথিক ১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন