শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কবিতা >> খামার : মুরাদুল ইসলাম

খামার

মুরাদুল ইসলাম 

রৌদ্রতে আজ কেউ এলো না
আমার দিন কেটে যায় ত্রিকাল তপস্যায়
মদ্যশালায় সাধনা আমার শুদ্ধ ঋষির
হাওয়ার মাঝে লাঙল চালাই
অর্জিত জ্ঞান বিদ্যা আছে সুস্থ কৃষির
সাধক আমি, খাদক আমি
করুণ কাঠের সুন্দরীদের মাদক আমি, যাচ্ছেতাই
আঙুলজুড়ে নেশাগ্রস্ত পাঁচটি জাহাজ
চোখের মাঝে খোল নলচে বদলে দেওয়ার বিষণ্ন কাজ
নিঃশেষিত ইন্দ্রিয় ঘ্রাণশক্তি আমার
নশ্বরতায় নিপতিত কোষ অসংখ্য, মানব খামার।

কবিতা >> এই কবিতা বেহুলার জন্য : আবদুল্লাহ শওকত

এই কবিতা বেহুলার জন্য

আবদুল্লাহ শওকত

আমিও এক ভরা পূর্ণিমায় গৃহত্যগ করেছিলাম
সম্মুখ দরজা খোলা রেখে
গৃহে ছিলো মূল্যবান রতœরাজি
শয্যায় রূপবতী প্রিয়তমা...
লোভী তস্করের দল তখনো অপেক্ষায় ছিলো
কিছু দূর যাওয়ার পর শুনেছিলাম
দ্বাররক্ষীর মরণ চিৎকার
আমার প্রিয়তমার ভয়ার্ত স্বর...
না, আমি ফিরে যাইনি। 

তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর-
আমি ক্রমশ শহরের দিকে যাচ্ছিলাম
বহুমূল্য কটিদেশের অলঙ্কার-
ছুঁড়ে দিয়েছিলাম ক্ষুধার্ত গণিকাকে
না, আমি দাতা নই।
সেই গণিকার চোখেই দেখেছিলাম 
অবারিত প্রশান্তির প্রহেলিকা। 

শহর পেরিয়ে এলাম বিস্তৃত প্রান্তরে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঘাসের চাদরে
সেখানে আমাকে কেটেছিলো বিষধর সর্প
আমি কি তবে লখিন্দর...?
না, আমার বেহুলা এখন তস্করের 
লোভী বাহুডোরে আবদ্ধ। 

কবিতা >> ভালো লাগা কিছু কথা : মেসবাহ উল হাসান গালিব

ভালো লাগা কিছু কথা 

মেসবাহ উল হাসান গালিব

সেই ভালোবাসাটা বোধহয় ভালো ছিল-
যখন ভালোবাসতাম বাড়ির উঠোনটা, 
সকালের সূর্য, 
জাম গাছের হলদে পাখি,
ভালবাসতাম পুকুরে দাপাদাপি করতে, 
পাখির বাসায় হানা দিতে, 
কাচা পাকা আম কুড়াতে, 
সারাদিন বড়শি হাতে মাছ ধরতে।
এগুলো এখনও ভালোবাসি।

কিন্তু তারপরেও অঞ্জনের গানের মতো
‘তারপর কখন হঠাৎ সুখের মানে পাল্টে যায়’
এখন ভাল লাগে ক্লান্ত দুপুরে লম্বা ঘুম দিতে, 
রাতের আঁধারে একাকী হেঁটে যেতে, 
বিধ্বস্ত কাকের মত নিমগ্ন চিন্তা করতে,
হিট কোনো মুভির মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতে, 
কোনো রোমাঞ্চ বই পড়ে শিহরিত হতে,
আর ভালোলাগে অচেনা আলোয় থাকা সেই অপ্সরীকে, 
যার চোখের মাঝে আছে অতল সুমুদ্র,
কথায় তার সজীবতার পরশ,
যাকে দেখা হয়নি কখনও,
যাকে ভালোবাসি পুরনো থেকে নতুনে
আদি থেকে অনন্তে।

কবিতা >> প্রতীক্ষা : দুর্জয় আহমেদ

প্রতীক্ষা

দুর্জয় আহমেদ

রাত বাড়ছে রাতের মতোই করে
খুঁজে পাওয়া অন্ধকার সীমাহীন
বিরহী যক্ষ মেঘের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে রাত্রি নিশীদিন।
উইয়ে ধরা বাস্তুভিটা আমার
ঝরতি পলেস্তারা দেয়ালের 
অহর্নিশি গুনছি সময় খেয়াল আর বেখেয়ালে।
‘প্রথম প্রেম দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’
চামড়ার নিচে বয়ে চলা খসখসে সময়
পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখি
অস্ফুট এক চিৎকার জাগে।
বহতা নদীর বুকে খড়কুটো 
পাল্টে যাওয়া জীবন বহমান
পা-ুলিপির প্রতিটি খেরোপাতা
লোনা জলে করছে অবগাহন।

কবিতা >> অস্তিত্বের প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত : দুর্জয় আহমেদ

অস্তিত্বের প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত

রাজু রণরাজ

পাপের পাহাড় হয়ে পৃথিবী
ছেড়ে যেতে যেতে পাপী,
সামনে দাঁড়ানো যমদূতকে বলি
দুর হ’ ভ্রান্তি কল্পনা
বিশ্বাস করি না তোকে,
বিশ্বাস করি না ঈশ্বর।
স্তম্ভিত যমদূত কাঁপে,
যথাসম্ভব দুই হাত ঢুকিয়ে দেই তার কলিজায়
ছিনিয়ে আনি অবিশ্বাসের প্রাণ।
তখন মনের অবচেতন কোণে
মৃত্যু হয় দুটি অস্তিত্বের,
ঈশ্বর ও ঐশ্বরিক ক্ষমতার।

কবিতা >> দাঁতফুল হাসি : মীম হুসাইন

দাঁতফুল হাসি

মীম হুসাইন

কথার ফাঁকে বলছি কথা, 
একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি 
উড়লো তোমার চুল।

কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি 
গালে হাসির টোল।

কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি
ভিজলো ঠোঁটের কূল।

কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে হাসলে তুমি 
দাঁত বাবুনার ফুল।

কথার ফাঁকে বলছি কথা
একটি কথা ভুল
হা হা করে পার হলে কি
পুলসিরাতের পুল?

কবিতা >> কষ্টের শ্লেটে প্রেমের অভিষেক : মেহেদী হাসান মিঠু

কষ্টের শ্লেটে প্রেমের অভিষেক

মেহেদী হাসান মিঠু

দেখেছো কি..
মুছে যাওয়া আশ্রিত বৃষ্টির
আর্দ্র দৃষ্টিতে
হৃদয়গোধূলির ম্লানময়তায়
প্রজাপতির বিশুষ্ক ডানায় রঙধনু ছায়া..
নীল চাদরে
কষ্টের শ্লেট ভেঙে দৌড়ে পালানো
ভালোবাসা?

হয়তোবা দেখোনি
অস্তিত্বহীনতায় 
প্রেমের অভিষেক
বৃথা আস্ফালনে 
বসন্ত হাসি..
মেঘপুঞ্জের লাল সবুজে
ধুলোজমা মৃত্তিকার বিবর্ণ মানচিত্র।

কবিতা >> আরও আলো চাই : হাসান চিশতী

আরও আলো চাই

হাসান চিশতী

চোখ খুললেই দেখি 
অন্ধকার চারদিকে
রক্তিম খেলা সারাক্ষণ
স্বার্থের শ্মশানে অকাল মৃত্যু
জীবন্ত হৃদয়েরা সব
হাহাকারে পূর্ণ- আর্ত চিৎকার
তুমি-তুমি-তুমি
একটু ভালোবেসে 
শান্তি দাও, শান্তি দাও
প্রেম!

সেই চোখ 
বন্ধ করলে আসে আলো
সব আলো তোমারই
পুরনো পবিত্র পোশাক পরে
আমার গায়ে।

এতো আলো কোথায় পেলে
তুমি?

কবিতা >> সূর্যেরও আসে যদি ঘুম : মেকদাদ মেঘ

সূর্যেরও আসে যদি ঘুম

মেকদাদ মেঘ

কেউই কাউকে অতি সহজে ভুলতে পারে না
ধর্মের পোশাক যদি জন্মগতভাবে পরিধান করে কেউ
আদিম বিশ্বাসে 
ঈশ্বরকে ভুলতেও যুক্তির সময় বয়ে যায়
পরিচিত সামাজিক অন্ধকার গর্ত থেকে 
মুক্তির নেশায় আপন সাগরে উঠে জোয়ার জৌলুস,

কাউকে কেউই সহজে ভুলতে পারছে না
স্মৃতির চাকায় যতোই থাকুক মরিচার রোগ
অ্যালুমিনিয়াম আস্তরণ দেয় ঘটনার আয়োজনে
ঠিক তখনও অনেকেই 
স্মরণের কথা ভাবে প্রাণসন্ধ্যা সূর্যমুখী দিনের ঘূর্ণনে 
সেও বুঝি? স্মৃতির উনুনে পেছনে তাকায়
ভুলতেই পারছিনে এই সব মোরগসকাল
কাকের দুপুর, ভাটিপুত্র, ভাটিকন্যা, পাহাড়ের রূপকথা
শাহিদার মুখ।

মনোবনে ভেসে উঠে চন্দ্রের ত্রিভুজ
চন্দ্রাণুর সাত রূপ সঙ্গী হয়ে যায়,

বন্ধু নামে অবন্ধুর যাতনাও 
যথাÑপ্রকাশিত শত্রুজন মুখোশের মিত্র চোর
তাদেরকে ভুলতেও
অন্তত ভাবনা, ভাবনার বাতিঘরে
আমাকে ত্রিশূলে বিদ্ধ করে 
অন্য কেউ তলোয়ারে দাগ কেটে যায়!

কবিতা >> যাদের যাদের কবিতা আমি পড়ি না : শোয়েব সর্বনাম

যাদের যাদের কবিতা আমি পড়ি না

শোয়েব সর্বনাম

সেইসব কবিদের কথা
অথবা কবিতা;
যেইসব কবি-
যাদের সন্ধ্যা নামে শাহবাগে,
শুধুই শাহবাগে
হয়তো শাহবাগে যাদের
সকাল
হয় না,
দুপুর
হয় না,
সন্ধ্যা হয় শুধু-
অন্ধকার;
লেখা থাকে যেইসব কবি
অথবা কবিতার শেষে-
সেইসব কবিদের বই, নাকি পাণ্ডুলপি
অযথাই ছাপাছাপি
করে না যারা যারা-
আহা, সেই সব কবিতাগুলো
বুকপকেটে নিয়া ঘুরতে থাকে কারা?

তাদের কবিতা আমি পড়ি নাকি?

টুইটারে লেখে না তো তারা!

সন্ধ্যায় অথবা রাতে
ঘাসের উপর বসে কম দামি গাঁজা খেতে খেতে
যেই কবি লিখে রাখে দু একটা অক্ষর-
জীবনানন্দবাবু করে নাকি ভর- তাদের উপরে যেন
ট্রামের তলে গিয়া আজো তারা মরে নাই কেন?

তাদের কবিতা আমি পরি না তো!

টুইটারে লেখে নাই তারা!

কবিতা লিখতে গিয়া লিখতে না পারা
যেইসব কবি-
করে নাকি যারা যারা কবিদের মত ভান
অথবা, হয়ত তারা
কবিই তো! কবিদের ‘সাব অলটার্ন’;
ফলে তারা ঝিম মেরে বসে থাকে
কবিতার খাতা খুলে-
কাটাকুটি খেলে নাকি?
আহা, কাটাকুটি!
শুধু কাটাকুটি?
কেন তারা শিখলো না আজও ষোলো গুটি?
অথবা
কুতকুত?
আহা, কুতকুত খেলা করা
প্রমীলা কবিরা
হাতে নিয়া নিজ নিজ কবিতার বই
(অথবা প্রেমিকের- তাহারা কে কে আজ কই?)
নাকি পাণ্ডুলিপি-
অযথাই ছাপাছাপি
করে না যারা যারা
সেইসব কবিতাগুলা জড়ায়ুর ভিতরে নিয়া ঘুরতে থাকে কারা?

তাদের কথা তো কেউ বলে না আমাকে?

তাদের কবিতা আমি পড়ি না তো!

কবিতা >> সীমান্তে : অজয় দেব

সীমান্তে

অজয় দেব

এতো ভাবতে কবে শিখেছি
মনের গহীনে আষ্টেপৃষ্ঠে রাখা কথা
কেনো নীরবে এতো সুর তোলে।

জীবনের এতো পরীক্ষার পড়া
মুখস্থ করতে পারিনি কখনো কোনোদিন।
দুই একটা প্রশ্নের উত্তর কখনোই
কোনো পরীক্ষায় দিতে পারিনি।

অথচ সেই প্রিয় মুখ কত মুখস্ত।

এখনো প্রতি রাতে চোখজোড়া বন্ধ করলে
রাতের আহ্বানে চোখের পাতায় জল ছবিতে
ভেসে ওঠে সেই মুখ।

এতো ভাবতে চাইনা, এতো নির্ঘুম রাত স্মৃতির
পটে জড়ো হোক তা চাইনা,
যদিও স্মৃতিই এই জীবনটাকে আঁকড়ে ধরেছে
যা নিয়েই জীবন বাঁচার স্বপ্ন দেখে।

সেদিনও সীমান্তে দাঁড়িয়ে অপলকে
তোমাকে দেখতে চেয়েছি প্রিয় বাংলাদেশ

অনেক দূর আমি দেখেছি
তোমার মাটির গন্ধ আমি পেয়েছি।
সবুজ প্রান্তরের মত তোমার শাড়ির
আঁচল উড়তে দেখেছি হাত বাড়িয়েছি কতোবার
তবুও স্পর্শ করতে পারিনি।

কতবার মৃত্যু আমাকে তাড়া করেছে
কাঁটাতারে শার্ট ছিঁড়েছে, পাঁজরের এক পাশে
আঁচড় লেগেছে।
তবুও এতো ভাবতে ভালো লাগে
সেইবারের মত অচেনা পথে হাঁটতে ভীষণ ইচ্ছে করে
তারপর প্রশ্নেরা তাড়া করে ‘এতো ভাবতে শিখেছি’ তোমাকে।
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

কবিতা >> উলঙ্গদের স্বর্গবাস : অনিরুদ্ধ সাইমূম

উলঙ্গদের স্বর্গবাস

অনিরুদ্ধ সাইমূম

নিজেরটা সযতনে রেখে
অন্যেরটা কেড়ে খাওয়ার অভ্যাস
ওদের বরাবরের
সেটা হজম হোক আর নাই হোক।
পরের কাঁধে পা রেখে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন
ওদের অনেক দিনের।
নিজের গাল ছেড়ে
পরের গালের মাছি তাড়াতেই
ওদের ব্যস্ততা বেশি।

ওরা আগাগোড়া অন্ধ
পুরোটাই বধির, জন্ম থেকেই উলঙ্গ !
লিপ্সায় লটকে থাকা লকলকে জিভ থেকে
টস টস করে এসিড ঝরে পরে সর্বক্ষণ।
বীভৎস চেহারা নিয়েই তারা হাসে
নর্দমা থেকে উঠে আসে মনুষ্য সমাজে।
শিকড় গেঁড়ে বসে
এক সময় লিক লিক করে বাড়তে থাকে 
ওদের বংশধর।
খায়, দায়, বড় হয়
বড় হয়ে এরাও হাসে।
এদের শিকড় বিস্তৃত হয় মাইলের পর মাইল।
এদের কেউ ভালোবাসুক আর নাই বাসুক
তাতে কিচ্ছু যায় আসে না তাদের।
তাদের ধারণা তারা মৃত্যুঞ্জয় ,
ঘুণপোকা কোনোদিনও কাটতে পারবে না
তাদের সাধের পালঙ্ক।

দিন যায় দিন আসে...
ওদের শ্যেনদৃষ্টিতে তবুও পলক পড়ে না
ওরা হাসে, বারবার হাসে
কারণ, সব তো ওদেরই জন্য
ওদের পতন নেই।
ওরা এতটাই সংকীর্ণ
যে ওদের রাজপথের প্রয়োজন নেই
কোনো এক সঙ্কীর্ণ গলি পথে
তারা ঠিকই পৌঁছে যায় সপ্ত স্বর্গে।
অথচ আমরা...
অবলীলায় মুখটা হাঁ করে
চকচকে নোনা জলে পলক না ফেলেই চেয়ে থাকি
ওদের স্বর্গারোহনের সিঁড়ির দিকে।
তাদের নির্ভয়ে কাটে প্রতিটিক্ষণ
তাই সেখান থেকেও
তারা হাত নেড়ে নেড়ে হাসে।
আর আমরা? 
বাম হাতে বুড়ো আঙুল
মুখে পুড়ে চুষতে চুষতে
মর্ত্য ধরাধামে পা কেলিয়ে বসে
ওদের স্বাগত জানাই।

কবিতা >> তালাক, পাঁজরবারান্দায় : নূর নিহাল

তালাক, পাঁজরবারান্দায়

নূর নিহাল

অনাথ অবহেলায় আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে
লুকোচুরিবাজি করো না আর...
বহুরূপী রূপকথার নকশীস্মৃতি 
সেঁটে দিও না নষ্টামীর বর্ণিল কাঁথায়
যুগের যমদূত হয়ে কৃষ্ণদেহে রাধা কলঙ্ক
জগত জমিন নাচাবে জানি, গহীনে নাচাবে তুমুল।
অতঃপর প্রেম জ্জ
কালের কালিমা ছুঁয়ে অকাল জোছনা হয়ে
পড়ে থাক পাঁজরবারান্দায়।

কবিতা >> প্রতীক্ষার হিমালয় ছোঁয়ার আগে : উদয় শংকর দুর্জয়

প্রতীক্ষার হিমালয় ছোঁয়ার আগে

উদয় শংকর দুর্জয়

তুমি রঙ চুরি করে গায়ে মেখে নিলে। 

সদ্য জলধারা অরণ্য আকাশ 
কি ছিলো না আমাতে? বিস্তীর্ণ বেলাভূমির মত 
এই বুকের পাটাতন। 

প্রতীক্ষার হিমালয় ছুঁয়ে দেখার আগেই 
অতল স্পর্শের সন্ধানে বেমালুম ভুলে যাওয়া 
সে নির্লিপ্ত চোখ। আমারও তো ছিল 
এই গ্রহে আবহে এক খণ্ড জমি। 
কী আলো ছায়া বুকে টেনে; চেয়েছিলে নির্বাসন 
প্রেম থেকে নাকি প্রেমে থেকে। 

এখানেই তো ছিল জ্যোৎস্নাধারা অবিরাম 
প্রাণের বিপুল বৈভব হৃদ উচ্ছ্বাস। 
আজও আছে শুভ্র ভোর
চিলেকোঠায় রোদ্দুর পেয়ালা।

লন্ডন, যুক্তরাজ্য

কবিতা >> যোগ-বিয়োগ : মিসবাহ উদ্দীন আহমদ

যোগ-বিয়োগ

মিসবাহ উদ্দীন আহমদ

জীবনের যাপনে
কতো যোগ, কতো বিয়োগ
কতো শত অঙ্ক
কোনোটারই হিসেব মেলে না

পুঙ্খানুপুঙ্খ।

কবিতা >> গোড়ালি তফসিল : তাহমিদুর রহমান

গোড়ালি তফসিল

তাহমিদুর রহমান

বাতাসে উড়ে উড়ে কিছু লাইন এল মাথায়
সেভাবেই তাদের আবারো উড়িয়ে দিলাম
আমি কি খুনি? হ্যাঁ,
গ্লানি বেদনার শীতে আমি আজ খুনি; আমাকে   
এই অপরাধে রিমান্ডে নিয়ে অসহ্য প্রহারে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত
তারপর কোর্টে চালান দিয়ে ৩০২ ধারায় দণ্ডিত করা উচিত;
দণ্ডিত হওয়ার পরে আত্মকথনে বলব,
কী লাভ লাইনগুলোর আরাধনা করে?
যখন দেখি মানুষগুলোর চব্বিশটা ঘণ্টা কাটে
পেটের চিন্তায়, আগামীকালের ভাবনায়
নতুন ভ্রুণের রোদনে সামাজিক ঝগড়ায়
তাদের দেখে দেখে অন্ধ অজানাতে নিজেকে দেখি ঈশ্বরের হাতে
তখন মানুষগুলোর জন্যে আমি নিজেই হাজারটা কবিতা...
যাকগে সে আলোচনা, অনেকের কাছে এলেবেলে কথা
এখন অলস শীতকাল; নিষ্প্রাণ দিনের
কাঁচা রোদে বসে কুঁড়েমির এখনই সময়
লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকাই এখন একমাত্র কাজ,
অন্যের মতই শুরু করি নীরবে দিনাতিপাত;
বহু বহুবার আমি অসহ্যকে দেখে ব্যথিত হয়েছি
ভিড় করা মেঘগুলোকে তাড়াতে গিয়ে

জীবনের সব হিসেব করা ছেড়ে দিয়েছি।

কবিতা >> করাত : বাপী ভট্টাচার্য

করাত

বাপী ভট্টাচার্য

এই ভর দুপুরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়াতে হবে
ভেবে, দাঁড়াতে গিয়ে দেখি গাছ নেই।
ধুলো উড়ছে বাতাসে। ধুলোর গন্ধ নেই 
ভিতর ভিতর বুকের ভিতর
ধূসর হয়ে যাচ্ছে সময়
বিশ্বাস করুন।

রাতের পর রাত বিনিদ্র শয্যায় শুইয়ে 
চিন্তা যদি যদি আপনাকে দিই
কেমন হবে ভেবে দেখুন
যে শূন্যতা, হতাশা বিরাজ করছে
ভিতর ভিতর বুকের ভিতর অনুভব করে দেখুন
যেমন দু’ দিকে কাটছে করাত। 


আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত

কবিতা >> ছায়াসংক্রান্ত : তানভীর আহমেদ হৃদয়

ছায়াসংক্রান্ত

তানভীর আহমেদ হৃদয়

শরীরের ছায়াকে কে আর কবে দেহের সাথে
গোপন ইচ্ছের মত বাঁধতে পেরেছে বলো?

যথাযোগ্য অপমান খুব বেশি প্রগাঢ় হলে 
শারীরিক ছায়াও একদিন তার সাথে দীর্ঘতর হয়।

এ আকাশ কবেই বা তার ছায়া দিয়ে মানুষের 
আব্রুকে ঢাকতে পেরেছিল!
কেবলই জিজ্ঞাসা আর অমানবিকতার চোখে বালি

রঙ মেখে, ছায়াও চিরকাল দূরে থেকেছে...

কবিতা >> পরম্পরা : তুহিন দাস

পরম্পরা

তুহিন দাস

সন্ধ্যার একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঠোঁটে তুলে পাখি উড়ে যাচ্ছে
মুুহূর্তের প্রেরণায়,
যারা দিনভর গাঁইতি কোদালের কোপে মূর্তি গড়ছিলো ওদের হৃদয়েও
মুচড়ে উঠছে পাথর,
ঠিক এসময় ধূলোবালি গোটা এক পাক খেয়ে আসে
পুরোটা শহর,
বাড়ি ফেরার অস্থিরতায় মেশা মুখগুলো নিঃস্তেজ ও বন্দি
ভাঙাচোরা বাসগুলোতে,
তখনই যুবকেরা মাঠে গোল হয়ে বসে ফাটিয়ে ফেলে
গাঁজার বীজ,
এক টুকরো দড়ির উপর অপ্রতিরোধ্য কসরতে নামে খেলা দেখানো
সার্কাসবালক,
একটা কাঠঠোকরা নিজের ছায়া ঠুকতে ঠুকতে খোড়লে
ঢুকে পড়ে,
ফুটপাতের দোকানে চায়ের কাপে শেষ চুমুক মেরে রাস্তায়
চলে আসে লুটেরাদের দল,
আযানের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধ ভিক্ষুকের পাত্রে
ছোঁড়া পয়সাধ্বনি,
বুনো শুয়োরের পালের মতো গাড়িগুলোর
এগিয়ে চলা,
শহরের স্যাঁতসেঁতে হাওয়ায় নিঃশ্বাস জ্যান্ত সাপের মতই
ভারি মনে হয়,
একশত বছর আগের যন্ত্র থেকে ফুঁসে ওঠা
হুইসেল,
দপ করে আলো জ্বলে উঠলো কোথাও
আকাশমুখো,
বাতাসে ভাসা পতিতাদের গানের
উচ্ছিষ্ট অংশ,
সন্ধ্যার জানালা টপকেই রজনীগন্ধার হু হু
মাতাল গন্ধ,
রাজপথে মিছিলের ব্যর্থ
আস্ফালন,
করিডোরে কারো হেঁটে যাবার
একঘেয়ে শব্দ,
হঠাৎ লোডশেডিঙয়ে বাতিদানে ছড়ানো
আলোর চুল,
কারো প্রতীক্ষায় অতিষ্ঠ
দুর্লভ সময়ের ভেঁপু,
একটি মেয়ে চুপচাপ ঢুকে পড়লো
ছাত্রীবাসে,
ছেলেটি হলুদ বাতির নিচে তখনো
হাওয়াইফোন কানে দাঁড়িয়ে,
শব্দাবলীতে জমে ওঠা এ সপ্তাহের
নাটকের আহ্লাদ,
ঘন ঘন হাততালিতে ব্যস্ত শৈল্পিক ও সক্রিয়
মানুষের হাত,
তখনো পার্কের একটু অন্ধকারে খুব দ্রুত খুলে নিচ্ছে
প্রেমের থেকেও আটসাঁট অন্ধকার,
মানুষ এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায়
পাগলের মতো ছুটছে,
আসলে কুয়াশার থেকে আর কিছুই
সত্য নয়,
পশুপাখিরা ওদের চোখগুলোকে
আধখোলা করে ফেলেছে,
ছায়াগুলো বেকুবের মত
লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে,
তাড়াহুড়ো করে রিকশা থেকে নামতে গিয়ে
একটা নখ উল্টেই গেলো,
তৃষ্ণার ভেতর দাঁত বের করে হাসছে
শুষ্ক ফুসফুস,
ওই তো আবারো কয়েকটি বাড়ির পরে রহস্যময়
আলোর সঙ্কেত,
নৈঃশব্দের ভাষা লিখতে এসে কবিকূল থেমে পড়ছে
ভূতের মতো,
শুধুই ধমনীতে রক্তের চলাচল ছাড়া আর কোনো
কৃতি নেই,
সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে আছে
আধখাওয়া ডালিমফল,
সান্ধ্যকালীন আড্ডায় কবিদের সঙ্গমকাহিনী বুঝছি
এক নারীতে উপগত সকলে,
স্বপ্নকে কেটে ফালাফালা করে দিচ্ছে কার
প্রশংসনীয় তলোয়ার,
অথচ কেউ একজন জিরাফকান তুলে বুদ্ধধ্যানে বসে আসে

অস্তপারের সন্ধ্যাবেলায়।

কবিতা >> কী আশায় : পদ্মনাভ অধিকারী

কী আশায়

পদ্মনাভ অধিকারী

উত্তরে দখিনে দু’ হাওয়ার কালো-সাদা দুই পাখি
কী আনন্দে দু’ ডানায় হাওয়া কেটে কেটে 
শীতলক্ষ্যা-পদ্মা, পশুর-রূপসা 
পাড়ি দিয়ে এ পুণ্যভূমি যশোরে, 
শরৎ থেকে হেমন্তে কী মায়ায় ডানা ঝাপটে
ঘুরে ফেরে এ সীমার অবয়ব জুড়ে! 
ঘোরের ভ্রমে নয়তো-মিষ্টি জল হাওয়া 
কিংবা অন্য কোনো স্বপ্নগন্ধী পরিচয়ের আঙিনা জুড়ে 
থেকে কিংবা রেখে যেতে চায় স্মৃতির মিনার, 
অথবা নিয়ে যেতে চায় হৃদ ভূমি উর্বরা করা 
কোনো অজৈব জারন ক্রিয়ার জারক, যা 
দীর্ঘদিন রাখবে সজীব-হৃদ জমিনের 
উর্বরা শক্তি ও ভক্তি, হয়তো সে আশায় 
কিংবাা ঘুরে ফেরে পাখি অন্য কোনো ঠিকানা-ঠাঁইয়ের 

স্বপ্ন পূরাতে ডানা ঝাপটে রাত্রিদিন...

কবিতা >> পরিবির্তত পৃথিবীর পরে : সুমন আখন্দ

পরিবির্তত পৃথিবীর পরে

সুমন আখন্দ

একটি করাত
কেঁপে উঠলো সারি সারি গাছ
একখানা জাল
পালিয়ে গেল শত শত মাছ
শাবল দেখে ভয় পেয়েছে একটি পাহাড়
কোদালের কথা শুনে কাঁদছে মাটি
পথের পাগল ভাবে, 
এখানে আর কেমনে হাঁটি! 
ঠিক তখনই দূর্ঘটনা
বাস রিকশা চায়ের দোকান
সব জায়গায় একই আলাপ
পৃথিবীর পেটে ছুরি মেরে
পালিয়েছে বিশ্রী গোলাপ!
অথচ এতদিন ফুলটি ছিলো প্রেমের প্রতীক 
‘চেঞ্জ উই নিড’ বা ‘পরিবর্তনের সনদ’ যাই বলি না কেনো
কেনো আবার খুনোখুনি বাড়লো?
প্রেমিকা কেনো প্রেমিককে মারলো?
প্রশ্ন অনেক- উত্তর নেই
করাত, জাল, শাবল, কোদাল বাড়ছেই

মনে হয় মশার মতো আরো বাড়বেই!

কবিতা >> ধন্যবাদ ফেইসবুক : তুহিন চৌধুরী

ধন্যবাদ ফেইসবুক

তুহিন চৌধুরী

কাছের মানুষদের নিয়ে স্মৃতিগুলো
এখনো চোখের সামনে ভাসে
আজও সেই মানুষগুলোর সাথে
যোগাযোগ হয় নিয়মিত
মুঠোফোন আর ফেইসবুকে জেনে নিই
একে অন্যের খবর
যেমনটি জেনে নিতাম অনেক আগেও
পাড়ি দিতে হতো অনেকটা পথ
নষ্ট হত অনেক সময়
তারপর হাতে হাত রেখে 
দলাদলি আর গলাগলি করে
আরও কিছুটা সময় নষ্ট করতাম
এখন আর সময় নষ্ট হয় না
তবু মিলে যায় সব খবর
শুধু পরশগুলোই মিলে না
মাঝে মাঝে এই মানুষদের
ছবির মতোই মৃত লাগে
ধন্যবাদ ফেইসবুক 

মৃত ভালোবাসা উপহার দেওয়ার জন্য।

কবিতা >> মাঠে : জ্যোতি আহমদ

মাঠে

জ্যোতি আহমদ

অনেক দূরে আছো, আমি দেখতে পাই।

ভাবতে ভালো লাগে তুমি আছো বিভোর সুস্থির
পরম এক আকাশ অতি পুরাতন,
কিছু লোকের পায়ের ধুলোর মধ্যে পবিত্র সত্য এক
লিপিকা-আমি, আর কেউ কেউ টের পাই। 

খুশি আপা বিকেলে শুয়ে থাকেন, জানালার পাশে
কোেনা মেঘ-চিহ্ন নাই, আশেপাশে সমুদ্র নাই
চিরুনি জড়িয়ে অসংখ্য ছেঁড়া চুল, তার
তীব্র প্রতীক্ষার শরীর কতবার ঘুরে এসে থেমে আছে
শাড়ির আঁচল-কুঁচকে যাওয়া, মনে হয়
আমাদের ছোট নদী তীরে নৌকোর মতো ভেসে ভেসে
এসে দাঁড়ালো কোন নগণ্য গ্রাম-কুঁচকে যাওয়া।
কাউকে কিছু না বলে অনেকটা মৃত তিনি,
বিরক্ত এক নারীর লাশ তখন খুশি আপা। 

ধরলার উপর ব্রিজ দেখা যায়,
সন্ধ্যায় তরুণ-তরুণীদল উঠে পড়ে ব্রিজের উপর
রেলিং ধরে ধরে সৌরভ আলো ছড়ালো কেউ, মুঠোফোনে 
ঝনঝন করে বেজে ওঠে জুবেনের গান। নিচে,
বালুর তলে অসংলগ্ন শুয়ে থাকে মরা ধরলা নদী।
সামান্য পানি, বালকের হ্যাঙ্গা জালে 
একটা মাছ নাই, কাঁকড়া নাই। 
অত দূরে নয় বলে এক সামান্য আলোর শহর থেকে
সেই সন্ধ্যায় একদল বিষাদগ্রস্ত লোক
বাড়ি ফিরে আসে,
কাদা-করা জমিতে ধানবীজ ছিটাবে আগামী কাল। 
আশা ছিলো, প্রস্তুতি লগ্নভ্রষ্ট হলো এখন।

খুশি আপার বাড়ির পাশ দিয়ে পথ ঘুরে যায়। 
অনেক পালতোলা বাড়ি- গোছানো, সজীব
কারো উদ্যান জুড়ে ছড়ানো বিভিন্ন পাতাবাহার
অলৌকিক নীল, হলুদ ও লাল এদের ঘ্রাণ
আমাকেও টানে-অন্য কেউ কেউ বিবস্ত্র হয় প্রায় রাতে
আর আমার মধ্যবিত্ত যৌন বাসনা অসাড় পড়ে থাকে
হারাবার অমূলক ভয়ে।

শৈশব দেখেছিলো এক ভয়াবহ যুদ্ধ
রক্তের বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে মৃত্যু।
হয়তো ভয় পেয়েছিলাম অথবা ক্রোধের
পরিভাষা মুখস্থ করেছি সেদিন, হতেও পারে
এক বিমূর্ত প্রতিজ্ঞা ছুঁয়েছিলো, মাকে-হঠাৎ
খামচে ধরে বলেছি কিছু।

এতো বছর পরে আব্বার ধুলোময় সব বই, মাকে লেখা
পত্রাবলী, বিবর্ণ ফটোগ্রাফ থেকে কিছুতেই 
সরে যেতে পারি না রাতের ঘুমের ভিতর।

আকাশের নিচে অমর এক কাচঘরে
বিকেলে শুয়ে থাকেন খুশি আপা বিরক্ত এক লাশ হয়ে।
শুয়ে আছে মাউথ অরগান।
মেঘ দেখা জানালায় আজও কোনো মেঘ লাগে নাই
প্রবল তাপ নিয়ে শুকনো, সরু নদীর ভেতরে
সূর্য ডুবে যায় আর সন্ধ্যায় তীব্র... অসহ্য চাঁদের আলো।

বৃষ্টির সম্ভাবনা নাই জেনে সেই রাত্রিবেলায়,
সেই চাঁদের আলোয় অনতিদূরে পড়ে থাকা এক মাঠে
জড়ো হলো লগ্নভ্রষ্ট সেই কিছু লোক। বিকল্পের খোঁজে
তীব্র অনুসন্ধান হলো, আর তাদের 
সরল কথোপকথন রাত-ভোর ভেসে থাকে।

অনেক দূরে আছো, আমি দেখতে পাই। 

ভাবতে ভালো লাগে তুমি আছো বিভোর সুস্থির
পরম এক আকাশ অতি পুরাতন, 
কিছু লোকের পায়ের ধুলোর মধ্যে পবিত্র সত্য এক

লিপিকা-আমি আর কেউ কেউ টের পাই।

কবিতা >> আমার বেদুঈন মন : সাবিত্রী গাইন নীলিমা

আমার বেদুঈন মন

সাবিত্রী গাইন নীলিমা

অন্ধগলি পথে ছুটে চলা যৌবন খুঁজে ফেরে মায়ার রোদ্দুর নিরাশার চরে খেলে যায় বিবাগী বাতাস - লুকোচুরি স্রোতে ভেসে যায় আশার বসতি ক্লান্ত অতীত সুখ - সোনালী শৈশব কৈশোর বাঁধাহীন প্রান্তরে ছুটে চলা আনমনে কথা বলা অফুরন্ত নির্ভেজাল ভালোবাসা - গায়ে লাগে ভালোলাগার পাগলা হাওয়া।

স্যাঁতস্যাঁতে ধোকাময় পথে অনন্ত হেঁটে চলা আমি আর আমার বেদুঈন মন,
স্বপ্ন সাজানো বিশ্বাসমহল খসে যায় অকস্মাৎ পড়ে থাকে আঁটকুড়ে যৌবন।

কবিতা >> মিথ্যেবাদী : সৈয়দ শিশির

মিথ্যেবাদী

সৈয়দ শিশির

ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে বলেছিলে-
তুমি আমার প্রথম পুরুষ
আমি বুকভরা বিশ্বাস নিয়ে তোমার ললাটে
ঠোঁট ছোঁয়াতেই উচ্চারণ করলে-
এমনটি আমার খুবই পছন্দের!

আমার চোখ তখন স্থির হয়েছিলো

ধর্মগ্রন্থ আর ঈশ্বরের চোখে।

কবিতা >> ঈশ্বরতত্ত্ব : সুস্মিতা পাল

ঈশ্বরতত্ত্ব

সুস্মিতা পাল

ক্ষয়ের হিসেব রাখতেই
আসতে হয়েছে ঘুণপোকাদের-
গর্ভের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির 
প্রথম পত্তন এঁকে 
ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত মানবের
ঈশ্বর পদ পেয়েছে তারা!
আদিম আরশোলা-জন্ম খোদাই হচ্ছে
সেই উল্লাসে!

হ্যানয়, ভিয়েতনাম

কবিতা >> কবি ও কমরেড : জাবেদ ভূঁইয়া

কবি ও কমরেড

জাবেদ ভূঁইয়া

এক বিপ্লবী দেখুন, সে রাষ্ট্রদ্রোহী
সরকারের সমালোচনা, রাষ্ট্র-দ্রোহের সমান।
ব্যর্থ অনুসন্ধান করে তাকে খুঁজে পাবে না
সে বৃক্ষের আড়ালে যায়নি -
মিছিলে খোঁজো, দেখো পেতে পারো লিকলিকে শরীর
লুকানোর জন্য কোনো গুহা খনন করেনি সে
খুঁজেনি পর্বত-পাহাড়
শুধু রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকে 
মুখোশের নগ্ন দৃশ্য দেখে 
প্রকাশ্য থু-থু বাতাসের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে।
শহরের কুলাঙ্গার যারা, তারা জানেন -
সে কতটা বেয়াদব। গোলামিতে পোষে না তার,
তাই রহমতের রাত-বিরাতে বঞ্চিত পথিক,
ভীষণ যোদ্ধা, যদিও নিঃস্ব সে, তবুও সাহসী,
তোমাদের মতে হতে পারে বে-দ্বীন, নাফরমান

সে বিপ্লবী কবি ও কমরেড।

কবিতা >> ভূষণপুরাণ হাল সংস্করণ : হিরণ্ময় হিমাংশু

ভূষণপুরাণ হাল সংস্করণ

হিরণ্ময় হিমাংশু

ভূষণ- শিবতান্ত্রিক এক সিদ্ধযোগী 
ভূষণ- ফল ফলা এক মহামাহান
যার ফলের মহিমায় ভরে যায় আঁটকুড়ো যৌবন বন্ধ্যা জরায়ুতে ফুটে পুষ্পিত জীবন
চতুরদর্শী অমাবশ্যার রাত
                         নিন্দে নিভাব পাড়া
শিবথানে ফল নামার মহালীলায় ব্যতিব্যস্ত ভূষণ সাথে পোহাতুর বেইচ্ছয়া
আজ ফল নামবে
                 শিবথানে
                         মর্ত্যধামে
                                  আঁটকুড়ো ঘরে
                                              পোহাতুর বেইচ্ছয়ার কোল আলো করে
দু’হাত হাটুতে ভর দিয়ে বগামার্কা মত প্রতীক্ষায় থাকে - বংশের প্রদীপ জ্বলে উঠলো বলে পোহাতু তাকায় বেইচ্ছয়ার তলপেটের দিকে অতঃপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা দিনের পর দিন দেখতে দেখতে আবারো অমাবশ্যার চতুরদর্শী রাত

সরিষার কামুক ঝাঁঝালো ঘ্রাণের মত উর্বর হয়ে আসা নারী অতৃপ্ত কামদেবের অনুশোচনাগ্নিতে জ্বলে যাওয়া পোহাতু-
ভূষণ তো খুঁজবেই  চতুরদর্শী রাত


আবারও শিবথানে ফল নামার মহালীলায় লালায়িত ভূষণÑ পোহাতুর বেইচ্ছয়া স্বপ্নবিভোর।

কবিতা >> স্বপ্নমাখা জোনাক রাতের উল্লাস : সেলিম রেজা

স্বপ্নমাখা জোনাক রাতের উল্লাস

সেলিম রেজা

কত শত বার হত্যা করতে চেয়েছি বেপরোয়া বয়সটাকে
নিজেকে শুধরে নেবার চরম সিন্ধান্তে নিভু নিভু পিদিম
ভাবনার চুনকামে অন্ধকার অতল থেতলানো মগজ
মুখোশের ভেতর মুখোশ; রঙ বদলানো লুকোচুরি খেলায়
জ্যামিতিক সময় হামাগুড়ি দিয়ে আড়াল হয় মাধবকুণ্ডে;
দশহাত ঘোমটা টানে অপ্সরী মেঘ
স্বপ্নমাখা জোনাক রাতের উল্লাসে আগন্তুক
বিশ্বাসে বিশ্বাস হারিয়ে হেঁটে চলে তামাবিল
মিথ্যের গোলক ধাঁধাঁয় অক্টোপাসের মত
শুষে নেয় রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিন
চোখের পাতায় বিন্দু বিন্দু জল
ভীষণ যন্ত্রণায় ঠিকানাবিহীন দেউরিঘর;
কোমরে স্বপ্নদোষের তাবিজ, শূন্য হাতে মৃত নদীর পার-
একটি পালক নিয়ে সুতোকাটা রাতের পরী 
ওড়ে শুধু ওড়ে রূপবতী হয়ে
প্রাণোৎসর্গ করে যায় যৌথশ্রমে গড়া
স্বপ্নীল বসত ভিটায়।
কুয়েত সিটি, কুয়েত

কবিতা >> তৃতীয় মাত্রা : আহমদ আফরোজ

তৃতীয় মাত্রা

আহমদ আফরোজ

জলের প্রযত্নে লিখে রাখি ধূসর দুরন্তপনা
অবলা বৈঠা মুঠোভরা রোদসমেত নিয়ে যা আমায় 
সকরুণ আর্তির কাছে।
খোলসের গান নয় ধাবমান শাঁসের আকুতি
পরাণের হৈ চৈ খৈ ভাজা কড়াইয়ের মতো
হে সূর্য, বহু অন্ধকার চোখের জন্য 
তোমার প্রতিনিধি করো
মানুষ যদি আলো হতে বঞ্চিত হয়
তবে তোমার মহিমা কোথায়?
হেঁটে হেঁটে এতো দূর এসেও আরো দূর খুঁজি
কাছে না থাকার দুঃখ জন্মেনি এতোটা দূরত্বের মাঝে
প্রাণের চেয়ে শিল্পের সৌন্দর্য বেশি নয়-প্রকৃতির যশ
অবলীলায় মহাকাশ ছুঁয়ে গেলেও
কারো দাবি নেই ছুঁয়েছে হৃদয়ের অন্ত
হে আকাশ, তোমার বিশালতার সঙ্গী করো

পীড়িত হাড়ের অন্য আকাশ; বাতাসে ছড়ানো আত্মদহন।

কবিতা >> ভূতো কিংবা হৃত তৃষ্ণা : জিল্লুর রাহমান জয়

ভূতো কিংবা হৃত তৃষ্ণা

জিল্লুর রাহমান জয়

কানামাছি ভোঁ ভোঁ আর সাপলুডু ভূতুড়েরা
তখুনি সরেছে বটে, অথচ সারেনি মোটে 
বউ বউ খেলার খায়েশ
উদাস দুপুর বেলা ঝরোঝরো বৃষ্টিতে
তখনও চাপতো ঘাড়ে যক্ষের ভূত এসে
হিমালয় কৈলাসগিরি ঘুরিনি-ফিরিনি আমি
অথচ ঘুরে ও ফিরে সেই তো খেলি কানামাছি, বউচি।

তারা দূরে নিয়ে গেছে কেউ, কেউ কেউ হাত ধরে-টরে
দেখিয়েছে পথ, অথবা আমিও কাউকে বা...
কারো কারো আঁচলের গিঁটে আমারই গিয়েছে এঁটে
এতগুলো অবসর অবসন্ন দুপুর
গোঁ ধরা গোঁয়ার্তুমিতে কখন কী করেছি না-কি
ওসবে আজও মনে খিল ধরে হাসি পায়, 
কখনও জানলা ধরে বালিশে মুখটি গুঁজে
বিস্তর জলধারা গড়িয়েছি একাধারে;
কারো কারো জন্য তো এইমত দিত মনোনাড়া

ওইসব পুরনো দিন আজকাল দ্বারে এসে ঘুরপাক খায়,
তবু দরজা দেখেনি ঠুকে- 'ওখানে কে আছে গো,
কে আছ ভিতরে?' ডেকে গেলে অন্তত একবার
ঢেকে তো দেব না কোনও ঐন্দ্রজালিকে! 
এই একটু পলকে দেখে তৃপ্তির সুখে ভেসে 
আয়ুষ্মান হই আরও বড়জোর দুটো দিন
এ নেশা ঘুচালে তবে নিশ্চিত ছেড়ে যাবে বুকে ব্যথা চিনচিন

বউ বউ ক্রীড়নক; ভূতো কিংবা হৃত তৃষ্ণা।

কবিতা >> শূন্যতা : হামিদা রহমান

শূন্যতা

হামিদা রহমান

আমাকে টেনে রাখছে শূন্যতা। অবিকল দু’হাত ধরে, আমার সমস্ত সত্তায় যখন ভর করে; সে বিশ্বস্ত হাতে আরও চেপে ধরে, গ্রাস করে সমস্ত কিছু। আহার, নিদ্রা নাই। সে আমার কানে ফিসফিস করে বলে- আপন কথা।
ট্যাপের জলে সেও ঝলঝল করে, জলরঙ মাখি। রাতের রঙ ফিকে হয়ে আসে। সূক্ষ্ম তারতম্যের স্তরে-স্তরে প্র্রলোভিত করে। আকাশের নীল রঙ লীন হয়ে আসে। মোহ জটিলতা ঘুরপাক খায়।

লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

কবিতা >> ইতিহাসগত পার্থক্য : ফয়সল অভি

ইতিহাসগত পার্থক্য

ফয়সল অভি

আমার জন্মের দু’মাস আগে মা নানার বাড়ি গিয়েছিল, তার মায়ের আলিঙ্গনে একজন গর্ভবতী প্রসব করলো আজান। আজান মানে আহ্বান, দলে দলে লোক আসলো।
হাতে হাতে জমলো মাটি. গড়ে তোলা হলো স্নেহ। আর ফলবতী ফসল কাটা হলো উৎসবে। সে সময় আনন্দের সংবাদ ছড়াতো সবার কানে কানে এবং মুখে মুখে হাসি আর পানের গন্ধে হতো নাতির মুখ দেখা। আমি বুঝেছি আরো পরে; তখন কোনো আশ্রম ছিল না সবাই লাঙ্গলের আর্দশে বেশ মানবিক।

ঠিক তার সাতাশ বছর পর...। শহরের সবচেয়ে উঁচু স্পিড ব্রেকার সামনে তার চেয়ে আরো আধুনিক সাদা বেডে জন্ম হলো আমার রক্তে প্রথম সূত্রপাত..... আমি হলাম বাবা। কী আশ্চর্য! সর্বোচ্চ স্বরের আজানটা এখানে আহবান হলো না। আগত সময়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ব্যাংকে খোলা হলো একটা একাউন্ট, সাথে আশ্রম থেকে আনা হলো বৃদ্ধ মাকে। কারণ এ সময়ে শিশুটির মা ও বাবা দুজনই কর্মজীবী। কর্মের দায় বয়ে বেড়াতে হবে অগোছালো মাটিকে। কিন্তু কেউ জানে না সেই মাটির বুকে কোনো এক প্রৌঢ় বৃদ্ধা আঙুলের স্রোতে নিয়তই রোপণ করে যায় অতীত। বড় হতে হতে নতুন হয় প্রাপ্তবয়স্ক জেনে যায় নগরের সকল ধারা। একসময় পরিণত নাগরিক আর দিন শেষে অনুভূতির বিষাদগ্রস্ত ভোর। তাই সে কলমের কালি গিলে গিলে জ্ঞানী হয়েছিল তারপর জ্ঞান বিক্রি করে বেঁচে থাকে আর শহরে শহরে নতুন নতুন আশ্রম উদ্বোধন হয়। সাদা মনের মানুষের তালিকা ক্রমশঃ আরো বড় হয়।

অবশেষে আমি আশ্রম থেকে লিখছি, শেষ হতে হতে একদিন সব নিঃশেষ হয়ে যাবে অতঃপর আদম ও হাওয়া থেকে আবার নতুন ইতিহাস। হয়ত এটার নাম ঈশ্বরচক্র যা বরাবরই অখণ্ড।

কবিতা >> সীসা : প্রণব আচার্য্য

সীসা

প্রণব আচার্য্য

আমরা পেয়ে গেছি হরিণের খুর- মড়ক লাগা
মাছিদের গুঞ্জন; ঢাকার আকাশে
আজ অনেক ধোঁয়া, দু’জনে মিলে হয়ে আছি
পালকের নরোম শ্বাস। গাছেদের পাতা থেকে
মুছে গ্যাছে সেই কবে বসন্তের দাগ-
অজস্র বেগুনী আলো আর ট্রাফিক হলুদ রিরংসায়
না, এটা প্রাচীন নাটকের একরৈখিক বিন্যাস নয়
এ শহরের সবকটি ইটে লেগে আছে কসমোপলিটন ধূলো
ভুলে গ্যাছো; ভুলে গ্যাছো এই শহরে ধূলো উড়িয়ে
বেজেছিলো ঘন অশ্বখুরধ্বনি- আমরা এসেছি
সেদিনই তো- সীসার মতো ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে রোদ

কবিতা >> বিধ্বস্ত নীলিমা : শফিউল আজম

বিধ্বস্ত নীলিমা

শফিউল আজম


আহারে স্বদেশ আমার-
কলমির বন নেই আর, আছে ঝাউবন
তাও বুকের মাঝখান দিয়ে পাথুরে সড়ক
ইলেকট্রিক ব্যাটে মশকীর সশব্দ মড়ক।
লোহার উপর বউ-পেটানোর ভঙ্গিমায় হাতুড়ি চালাচ্ছে বেধরক।
উদ্ধত স্তন তবু, স্তনে স্তনে পর-পুরুষের দাঁত
দেশের শরীর ভুলে যায় সমস্ত আঘাত
রাতে চর্বি, দিনে-দুপুরেও তাই, এ শহর ভুলে গেছে হা-ভাত।
আকাশেও ফাটল ধরেছে, ডাকতো নীলিমা এককালের কবিরা
মাথার উপর নীলিমা নেই আর, রাতের সড়কেই শুধু
ঘুরে-ফিরে সহস্র নীলিমারা।

কবিতা >> বইমেলা ২০১৪ : রবিউল মানিক

বইমেলা ২০১৪

রবিউল মানিক

কড়ুই গাছের নীচে বাঁধানো চত্বর
রঙিন মুখোশ পরা বন্ধুরা আসছে
সদৃশ্য হাত প্রেমিকার বাহুলগ্ন; সূর্যপুষ্প হলুদ,উজ্জ্বল সূর্যাধার
কোন প্রান্তর জ্বলছে
ফিদা হুসেনের তুলি, প্যাস্টেল, স্প্যাচুলা
জন্মের পেছনে জন্ম

আমার প্রেমিকা নেই...  শৈশবে একটা নদী ছিল
আর একজন দেবী
সব সমর্পণ সমুদ্রের দিকে ফেলে
অবশেষে মরা খাল
দখলের মহোৎসবে কাটা পড়ে গেছে কাশবন
অস্তগামী চাঁদের তলায় সেই দেবী, তার এলোচুল
ঠোঁটের বাঁকানো হাসি, চিকন কোমর, সাদা পেট...

শান বাঁধানো চত্বরে ঠোঙা ভর্তি বাদাম দু’ হাতে
জনস্রোত ভাঙে একে ওকে ডাক দিই
যুগযুগান্তে প্রত্যেক মুখে খুঁজি : সূর্যোদয়, সূর্যাস্তসকল, কবি, চিত্রকর

নিজের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের ঘৃণা
সারি সারি অন্ধকার, একরোখা স্বপ্ন
এক বজ্রপাত থেকে আরেক বজ্রপাতের মধ্য মুকুল ঝরছে

সৌরভে উন্মাদ মানুষ ছুটছে

কবিতা >> স্রোত ও রাতের বৃক্ষ : আবু মকসুদ

স্রোত ও রাতের বৃক্ষ

আবু মকসুদ

(আহমদ ময়েজ পৃথিবীর পৃষ্ঠায় হেঁটে চলা এক দুর্দান্ত পুরুষ)

গাছ মরেছে ভেবে মাড়িয়ে গেলে প্রবল তৃষ্ণায়, নদীজলের নিমিত্ত শিল্প দাঁড়িয়ে যায় তিমিরহরণে। নিরভিমান চাঁদ শরীরে লাগিয়ে, কাদামাটি বিভক্ত স্রোতেরা গড়ে দিতে চাইছে অজস্র উপকূল। রোদের আড়ত ছেড়ে বারান্দার সীমারেখা ধরে, আছন্ন আপন স্মৃতি পুড়ছে চোখের আরামে। প্রত্ন মধ্যযুগেও পাখি-ঘুম শেষে মানুষ পাড়ি দিতো গন্তব্যের ঢেউ-পাশায়, এই হেতু মিথ্যা নয়, যন্ত্র-সভ্যতায় ভালোবাসা ছুঁয়ে দেখে না চিতার হৃদয়। অপরূপ ভবিতব্য নির্মাণের দায়ে গাছের মৃতদেহ মেনে নেয় সময়ের স্খলন। তবু আলোর সলতেটি আগলে প্রত্ন মানুষ ক্লান্ত সূর্যকে পূজে অত্যুজ্জ্বল সকালের প্রত্যাশায়। 
নেই কোনো মঙ্গল পূর্বাভাস, প্রত্ন মানুষেরা যাপিত জীবনে শস্য আকুলতায় করে যায় মৃত্তিকা কর্ষণ। খড়মাটি দিয়ে গড়া মানুষটি সময়ের স্নায়ুর চাপে কখনো হয়ে উঠে উচ্চাকাক্সক্ষী ভেড়া, নিয়তির ছোবলে সে মূর্ছা গেলে অন্তর্গত বেদনার ধ্বনির মতো নেমে আসে অনিবার্য রাত। এমন রাতে মানুষ করে না নিশুতি-বিলাস। 
জলের স্রোতে মানুষ ভাসায় ঈশ্বর, এ এক মজার খেলা, এমন খেলায় এখন মানুষকেও পারদর্শী হতে হবে।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য

কবিতা >> গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ : ফকির ইলিয়াস

গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ

ফকির ইলিয়াস

তন্দ্রা টানেলে এসে এই রূপ অন্য গতি পায়। মূর্ছনায়
নত হয় প্রতিবেশী বেহালা বাদক। আলগে মনের মায়া
জলছবি পরখ করে, আর ব্যঞ্জন বেদনা নিয়ে সমুদ্রের
নিরিখে হারায়। যেতে হবে বহুদূর। বিশদ বনান্তরে যে
পথিক রেখে গেছে ছাপ, তার ছায়া মাড়িয়ে এই অভিবাসী
নদীদের গান শুনে রপ্ত করে নিতে হবে, না জানা বিকেলের
অভিভাষণ। যারা ঢেউসূত্র শিখে উজানের বিনম্র পাথরে
রেখেছিল হাত। বৈঠাডোরে নিজেদের ভবিষ্যৎ জাগিয়ে
রেখে ঠিক তোমার মতোই লিখেছিল চিঠি, 'খুব ভালো
আছি।’ জীবনেরই ভালো থাকা হয়। আর মৃত চাঁদ শুধুই
বিরহ ছড়ায়, গুহায়। গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ।
ভোর হবে, এই সত্য অনির্বাণ জেনে তুমিও হাত রাখো
আমার হাতে।

তুমিতো সমুদ্র তাই, নাবিক আমি, চন্দনা ঘোষ
নারীর বৃত্তে আঁকা পরাগের, অবনত প্রথম পুরুষ।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

কবিতা >> কাতকুঁজো বীর্যবল বোলতা সহবাস : মোহাম্মদ আমজাদ আলী

কাতকুঁজো বীর্যবল বোলতা সহবাস

মোহাম্মদ আমজাদ আলী

গাছ
সীম গাছ
নিম গাছ তাল গাছ
ডাল গাছ লাউ গাছ ঝাউ গাছ
কুলগাছ ফুল গাছ গুল গাছ মূলা গাছ কলা
গাছ গাছ গাছ পাতা পাতা ঢেংপাতা শ্যান পাতা ধান পাতা
মান পাতা চিরতা ত্রিফলা আমলা বহেড়া হরিতকী তিরিতিকি
গাছ গাছ পাতা পাতা নাচে নাচে ঢেউ নাচে ধেই নাচে তাক্ধিনাধিন
আর বিপত্তির দেয়াল ভেঙে আবারো ফিরে যাবার প্রবল তৃষ্ণা সেই গাছ
 বৃক্ষের নিচে যার সবটুকু চিহ্নিত স্মৃতিস্বপ্ন অতীতেই গেছে মুছে আপন দৃষ্টি
ছিঁড়ে ছুটে যাওয়া চোখের পলক মহাকাশ জাপটে ধরে হাঁটা পথে শক্তির উৎস
সূর্যের সাথে কিছুক্ষণ অন্তে কোত্থেকে উড়ে আসা গাঙচিলের ধবল বীর্যবর
অর্চনাকাতর প্রজ্ঞার গভীরে গোষ পাখিদের বিনোদবুদ্ধিতে মুহূর্তে সঙ্গমরত
হাঁসা হাঁসির গম্ভীর সুখ ভোগের চুলচেরা বিচার বিশ্লে ষণ আত্মস্থ অন্তে কাকের
সঙ্গীতে এমন জলজ্যান্ত বিশুদ্ধ সহবাসের শখ-সৌন্দর্যই আলাদা রকমের
নির্ভাবনায় ভুলিয়ে দেয় আকাশ স্বপ্ন দেখার ভয় এমন সময় কার গোলায়
কার ধান কার পেটে কার বীর্যের চিরন্তন পাঁচন জীবন বিচ্ছিন্ন যেনো এই মেঘলা
অমাচ্ছন্ন রাত হেলতে হেলতে গভীর সমুদ্রে নিভে গেলে নিভু আলোর
মিছিল জেগে থাকে অথৈ থৈ থৈ ঘুর্ণি জীবন প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ কীর্তি প্রেম
অন্তরাত্মায় যার চিরন্তন বসবাস একতারা সুরেলা বাউল ভেসে যাওয়া দূর থেকে
আনন্দ বেদনার রঙ্গন সভ্যতা পরস্পরের রক্ত চিবিয়ে কৃষকের ঝাপসা
দু’ চোখ খুঁজেই পায় না কৃষাণীর তন্বি-তলপেট নরম গরম স্তনযুগল যন্ত্রণায়
কুঁজো লিঙ্গ হেলে আসে রাত-বাতের পেট স্মৃতি শক্তি শিশির-দুর্বার স্নেহ গন্ধ
স্পর্শে চোখের ভূঁড়িনাচা স্পর্ধার পালাবহর জল কেটে কেটে বিরান থেকে বিস্ময় আলো টুকরোরা
দীর্ঘশ্বাসে গাণিতিক গুহ্যগর্তে চৈতী হওয়ার সাথে দ্বন্দ্ব মাতালে মেধার জরায়ু জে্যঁওঠা বাঁশের
মতো জটযুদ্ধে পৃথিবী ডুবে গেলে এক ঠায় দাঁড়ানো পেট আর ক্ষুধা দীর্ঘস্বপ্নে অশ্রুর হাড়ভাঙা
শ্রম কাত হতে হতে বিস্ফারিত ককটেল চোখ উদ্বেলিত কামনার হরেক রমণে বিশ্বাস নিঃশ্বাসে
ওজনের বাটখারা ডুবিয়ে দিলে ভরতদের ক্ষুধা আর্তি ঘাম রক্ত মৃত্যু লাশ গলিত দুর্গন্ধ
কুকুর শেয়াল শকুনের অধিকার আর রাহেলাদের ধর্ষিতা পতিতা শোনিত বিক্ষত
ভয়ঙ্কর ভাঙচুর রক্তহাত মেদমগজ যোগাযোগ যোগ্যতা দক্ষতা উন্নয়ন অগ্রগতি
ইত্যাদি প্রভৃতি আর্তি কাতর শশ্মান মিনতি দগদগ চিতার আর আত্মহুতি কবরের
মাটি মাথার ছাদে পেরেক রোদ্দুর আশপাশ ফুটন্ত বৃক্ষের শব্দ কখনো শুকনো শালিকের
ঘ্রাণ দাহমান পাখিদের আর্ত বেদনায় মোহময় আণবিকে দিকে দিকে বুকের
দিব্যদিশা পতঙ্গের দীর্ঘবহরে কে ভাসায় কার অশ্রু ভেলা ভঙ্গুর সভ্যতার ভেলকিজ্ঞানে
কানের পিকক চিন্তা বীর্যের নতজানু দৌড় ফসিল কামনার কর্কশ করতালি
সুখকর সঙ্গমে বিষকাঠুলার সহায়তা সামনে হাহাকারের হর্ষধ্বনি
সবার অলক্ষ্যে ভৌতিক অন্ধকার বিজ্ঞতার বাহারে রঙিন
অন্তরাত্মায় ঘোর ক্লান্ত নিসর্গ পৃষ্ঠ প্রদর্শনের অবর্ণ
সমন্বয় সিঁড়ি টুকরো টুকরো মৃত্যু ক্ষোভে ভ্রষ্টা পৃথিবী
আমার অন্তর জুড়ে উদ্যত লাশের কিরিচ খঞ্জর
উচ্ছৃঙ্খখল প্রবাহের মতো আক্রান্ত ক্রোধভরা
শুয়োরেরা কীভাবে তাড়িত হবে
কিংবা কে যাবে দানব দূর্গে উদ্বৃত্ত সাহসে
চোদ্দ পুরুষের ভিটে আর
পৈত্রিক প্রাণ কাফনের গভীরে ভাঁজ।

কবিতা >> ডানা : লতিফুল ইসলাম শিবলী

ডানা

লতিফুল ইসলাম শিবলী

উড়ে বেড়ানো ছাড়া 
তোমার কাছ থেকে কিছুই শিখলাম না পাখি।
তোমার সহিষ্ণু মৌনতা
ধ্যানমগ্নতা
    বেপরোয়া নির্ভরতা যদি শিখে নিতে পারতাম
তবে নিশ্চিত আমার নাম হতো ‘পাহাড়’

নিপুণ বুননে যদি শিখে নিতাম
বাসা বানানোর কৌশল
তবে কি ঝড়ো বাতাসে তছনছ হই বারংবার -

এত কিছু থাকতে কেন যে তোমার কাছ থেকে 
চেয়ে নিলাম ডানা

শূন্যে ওড়ার সাধ মেটাতে 
শূন্য হয়ে গেলাম।

কবিতা >> আলোছায়া : আবদুল বাসিত মোহাম্মদ

আলোছায়া

আবদুল বাসিত মোহাম্মদ

একটু আদর, একটু সোহাগ
আয়ু বাড়ায়; বিজ্ঞানীরা বলেন -
ভালোবাসা নাকি পরশপাথর!
কিংবা চুম্বকখ-, টানে নিজস্ব খেয়ালে
বুকে বুক, হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট
পাখিদের মতো...
সাকিদের মতো...
নদ-নদীর মতো...
নিউটনের সূত্রে আজো পৃথিবী হাঁটে দৌড়ায়।

আমার কাছে তুমি লোহা; চুম্বকখণ্ড এক 
টানা টানা চোখে, পিঠে আর বুকে অনন্যা
ললনার ঘায় আমি আহত, নিহতের আর কতো দেরি?

সোহাগে সোহাগে একদিন ভেসে যাবে লাশ
সলিল সমাধির পথে, এমন খবর...
কতো আর কানে মানবে বলো?

তুলি হাতে শিল্পী আর
কলম হাতে কবি
এমনই পটুয়া আঁকে নানান ছবি।

কবিতা >> ফ্যাটুলের জন্য আরেকটি : মলয় রায়চৌধুরী

ফ্যাটুলের জন্য আরেকটি

মলয় রায়চৌধুরী


আমি যেটুকু জানি
যে-ছন্দে ফ্যাটুল ধোঁয়ার ঢঙে নাচতে-নাচতে ক্ষয়ে-ক্ষয়ে ক্ষুদ্র হবার মজা লুটছেন
শিশুর আঁকা মুখের মানুষদের জুলুসে নিজের মিথ্যা নিজে শোনার আনন্দে
বুঝতে পারলেন যে পূর্বপুরুষ নেই বটে তবু তো উত্তরাধিকার বর্তেছে
তাহলে এতরকম পাখি আকাশে ওড়ে তবু হাওয়ায় কেন দাগ পড়ে না

আমি যেটুকু জানি
চটকল মজুরের মাথায় ফেঁসোর ঝিকমিকে রোদের জ্যোতি নিয়ে ফ্যাটুল
বালিশ-নাভি প্রেমিকার অনুবাদের অযোগ্য জবাবদিহি কী করে বুঝবেন বলো
মগজে এত বেশি জিভ নড়ছিল যে পোড়ামাটির বোরখা-পরা অতীতে
গুনে দেখছিলেন মিশর-গ্রিক-সিন্ধু-অ্যাজটেক সভ্যতায় কজন কবি টিকলো

আমি যেটুকু জানি
ফ্যাটুল গেলে যাঁদের বাড়ি অভিশাপমুক্ত হয় তাঁদের ওরাংওটাং স্বরলিপি
প্রত্নতাত্ত্বিকের হাড়ের তৈরি ওঝার ফুঁককাঠি দেখে নিজেই গাইতে থাকে
ও হো হো সবার মুখে ভ্রুকুটি ফুটিয়ে তুলতে ওস্তাদ ওই বদমেজাজি ঝিনচাক
প্রথমে জামা তারপর প্যান্টুল তারপর হাত-পা আর মাথা খুলে ফেলে দিলেন

মুম্বাই, ভারত

অণুগল্প >> অলিভিয়া কিংবা সুতোকাটা ঘুড়ির গল্প : শিবলী শাহেদ

অলিভিয়া কিংবা সুতোকাটা ঘুড়ির গল্প

শিবলী শাহেদ

সে চলে গেছে। অবশ্য একদিন সে চলে যাবে - এই সত্য জেনেই আমি তার কাছে গিয়েছিলাম। সঁপে দিয়েছিলাম নিজেকে। প্রথম প্রথম সে আমাকে গ্রহণ করতে চাইতো না, দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতো। আমি ফিরে যেতাম না। দরজার ওপাশে নৈঃশব্দ্যের বিষাদলিপি নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতাম। একসময় দরজা খুলে যায়। সে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই দরজা বন্ধ হয়নি একমুহূর্তের জন্যও।
এরপর শুরু হলো কালের নতুন প্রবাহ। আমি দেখলাম প্রেমের স্বরূপ। যদিও একটা পিছুটান তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো, তবুও প্রেমের আপাত জৌলুশে সে আর পেছনে তাকাতে চাইতো না।

আমার মনে আছে সেই সব ধুলো-উৎসবের সন্ধ্যায় সে আমার কানে কানে বলতো - ‘তোমাকে পেয়েছি ,আমার তো আর কোনো আফসোস নাই।’ বুঝতাম তার নিঃশ্বাসের উত্তাপে আমার অন্তরাত্মা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কত রিকশা আর মিছিলের পাশ কাটিয়ে আমরা হেঁটেছি, হাত ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি! কথা বলেছি শব্দে, বাক্যে, কথা বলেছি নীরবতায়। তারপর একদিন সেই সময়টা চলেই এলো। হ্যাঁ, যে সময়টাকে আমি ভয় পেতাম,আবার অবচেতন ভাবে যে সময়ের অপেক্ষায় থাকতাম। এই অপেক্ষা কষ্টের, যাতনার। ডাক্তাররা যে সময়টুকু বেঁধে দিয়েছিলেন তা ইতোমধ্যেই পার হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে অলিভিয়া (শুনেছি কোনো এক নায়িকার নামে শখ করে এই নাম রেখেছিলেন তার বাবা) অনেক শুকিয়ে গেছে, চোখ দুটো ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি তাকে দেখতে গেলেই কোনোরকমে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতো। পৃথিবীতে কত অলৌকিক ঘটনাই না ঘটে! আমি একটা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু হায়, তেমন কিছুই ঘটেনি। হাজারো বাক্য, শহুরে রিকশার শব্দ, মায়া আর সাইলেন্সকে পেছনে ফেলে অলিভিয়া চলে যায়... সেই থেকে শুরু হলো আমার চেতন-দহনের কাল ....

আজকের বিকেলের এই আলোটা একেবারে নরম একটা আমেজ নিয়ে আসছে মনে। নিজেকে হালকা লাগে। যেন পালকের মতো - ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে শরীর। এমন পালক-সম শরীর নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম - উদ্দেশ্যহীন। অদূরেই একটা মাঠ। সেখানে একদল কিশোর ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়ি দিয়ে কাটাকুটি খেলছে। আমি ঘুড়িগুলোকে লক্ষ করি। হঠাৎ একটা ঘুড়ি কেটে যায়। সটকে পড়ে নিজ জায়গা থেকে। তারপর নিজেকে সঁপে দেয় হাওয়ায়। যেন-বা নিজের ওপর আর কোনো দায়ভার নেই - হাওয়া তাকে যেখানে নিয়ে যায় যাক। সুতোকাটা ঘুড়ির কোনো পিছুটান নেই। নিজেকে সুতোকাটা ঘুড়িটার মত মনে হয়। সময় কি থেমে গেছে? নাকি আমি নিজেই... অলিভিয়া, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো সূর্যটা কেমন স্থির? যেনো ঘাসের ওপর ঘাপটি মেরে একচিলতে রোদ হয়ে এখনো জমাট বেঁধে আছে....

স্বাগত রচনা >> হাত পাতি পতঙ্গের কাছে : সাঈদ চৌধুরী টিপু

হাত পাতি পতঙ্গের কাছে

সাঈদ চৌধুরী টিপু

প্রতিদিনই সূর্য ওঠে। পূবের আকাশ রাঙিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। যেখানেই খোলা জানালা-অবারিত আলো ঢুকে পড়ে সেখানে। তবে সে আলো হৃদয়ের গহীনে টেনে নিজেকে রাঙাতে পারি আমরা ক’ জন? আলোকে নিজের করে নিতে পারি না বলেই হয়তো এতো আলোর মাঝেও আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা আঁধার কাটে না।

২.
অফুরান আলোর মাঝে নিজেরা যদি চোখ বুজে থাকি তবে সূর্যের দোষ কোথায়। নিজেকে পুড়িয়ে সূর্যের আলো বিতরণও তাই আমাদের জন্য বৃথা হয়ে যায়। আলো ছাড়া আমাদের চলেও না। তবুও আলোর প্রতি কেনো আমাদের এতো অনাগ্রহ! কেনো আমরা নিজেরা আলো হতে চাই না! কেনো আমাদের আলোয় চারপাশ আলোময় করে তুলতে পারি না?

৩.
সৃষ্টির সেরা হয়েও আমরা প্রাণভরে আলোকে ভালোবাসতে পারি না। অথচ ক্ষুদ্র পতঙ্গেরও আলোর প্রতি কী অপার ভালোবাসা। নিজেকে পুড়িয়ে হলেও তারা আলো পেতে চায়, আলো হতে চায়। আলোর প্রতি পতঙ্গের এমন ভালোবাসা দেখে হিংসে হয়। আহা! যদি পতঙ্গ হতে পেতাম। আলোকে প্রাণভরে ভালোবাসতে পারতাম! একবার না হয় পতঙ্গের কাছেই হাত পাতি। আলোর প্রতি ভালোবাসা ধার নিয়ে আলো হই, আলোকিত করি চারপাশ। 

৪.
ইতিহাস স্বাক্ষী, আমরা আলোকিত হলে সে আলোয় সূর্যও হার  মানে।

প্রবন্ধ >> রাজা ইয়াং : ইতিহাসের এক রহস্যময় চরিত্র : মোহাম্মদ আবদুল হাই

রাজা ইয়াং : ইতিহাসের এক রহস্যময় চরিত্র

মোহাম্মদ আবদুল হাই

কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রাষ্ট্রের আবির্ভাবের আগে তা যে অনেকগুলো রূপ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলো এবং রাষ্ট্র যে প্রাচীন ব্যান্ডের (Band)  বিবর্তিত রূপ তা অনেক ঐতিহাসিকই এড়িয়ে যান। আজকের সর্বব্যাপী ও বিস্তৃত যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তার আলোকেই তারা অতীতের রাষ্ট্রকে বিচার করতে চান। একটি অখ- ও ধারাবাহিক রাষ্ট্রের ইতিহাস তৈরির প্রচেষ্টা তাই ঘুরেফিরে তাদের মাঝে দেখা যায়। জৈন্তিয়া নামক প্রাচীন রাজ্যের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ রাজ্যের ইতিহাসের সন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই একেও অখ- রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 
অস্বীকার করার উপায় নেই জৈন্তিয়া একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন অনেক জনপদের মতো এখানকার রাজনৈতিক ইতিহাসও অনেক সমৃদ্ধ এবং উর্বর। বস্তুগত অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রতœতাত্ত্বিকের অনেকেই নিশ্চিত করেছেন যে, প্রাচীন প্রস্তর যুগে এ জনপদে সৃজনশীল ও পরিপূর্ণ সভ্য মানুষের বসবাস ছিলো। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, সীমানার বিস্তৃতি কিংবা নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একথা নিশ্চিত যে, জৈন্তিয়া পাহাড় সিলেটের সমভূমি এবং ভারতের নওগাঁ জেলার একাংশ নিয়ে নিয়ে বিস্তৃত। প্রাচীনকালে অখণ্ড বা বিচ্ছিন্নভাবে এক দল দক্ষ মানুষের দ্বারা শাসিত হয়েছিলো এ জনপদ। কালের পরিক্রমায় এখানেও উত্থান-পতন ঘটেছে। 
লিখিত ইতিহাসের সর্বত্র জৈন্তা রাজ্যের সরব উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো জৈন্তা রাজ্য বা এতদঞ্চলের ইতিহাস আলো-আঁধারিতে পূর্ণ। জৈন্তার ধারাবাহিক ইতিহাসের বাইরে দৃষ্টি রাখলে দেখা যায় এক সময় এ অঞ্চলে খাসিয়াদের অনেকগুলো রাজ্য ছিলো। যার অস্তিত্ব আজও কিংবদন্তীতে পাওয়া যায়। ‘ত্রিশ রাজা বারো দলইর দেশ’ কিংবা ‘বারো কুঠিরের দেশ’ নামে আজও জৈন্তার পরিচিতি স্থানীয়দের মাঝে। সে সময়কার ছোট ছোট রাজ্যগুলোর মধ্যে জৈন্তা মহারাম, নংখোলাও, চেরা মাইয়াং, খাইরেম, ভুওয়াল, শেল্লা, রামব্লাই, নংস্টেইন, হাদেম, মুকা, শিয়ার, মেরওয়েট, নংখাম, মালনিয়াংয়ের নাম ইতিহাস ঘাঁটলে খুঁজে মেলে। এদের মধ্যে মালনিয়াং রাজ্যটি খাসিয়াদের অতি প্রাচীন একটি রাজ্য।
হট্টনাথের পাঁচালির বিবরণ মতে, জৈন্তা পাহাড়ের কিছু অংশ নিয়ে রানী ঊর্মি একটি স্বাধীন রাজ্য গঠন করেন। উর্বরা নামে তার এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। তিব্বতের হটিক রাজ্যের যুবরাজ কৃষক তখন দেশ ভ্রমণে বের হন। জৈন্তা ভ্রমণের সময় উর্বরার সাথে তার দেখা হয়, ভালোবেসে ফেলেন উর্বরাকে। এবং তাদের বিয়েও হয়। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে একজন ছিলেন জয়ন্তক। জয়ন্তকের তিন ছেলে ও জয়ন্তী নামে এক মেয়ে ছিল। রাজা জয়ন্তক নিজপাট ও জৈন্তাপুরী রাজ পরগণা তার মেয়ে জয়ন্তীকে, জাফলং পরগণা তার বড় ছেলেকে, চারিকাটা পরগণা তার দ্বিতীয় ছেলেকে এবং ফালজুর পরগণা তার ছোট ছেলে ইয়াংকে দান করেন। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী পর্যটন কেন্দ্র লালাখালের ২ কিলোমিটার দূরে আজও ইয়াংয়ের রাজত্বের ভগ্নাবশেষের দেখা মেলে। ইয়াং রাজার টিলা নামে দুর্গম একটি টিলা কালের স্বাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। 
বাইলদাড়া গ্রামের অনতিদূরের ইয়াং রাজার টিলাকে প্রথম দর্শনে আর দশটি সাধারণ টিলার মতোই মনে হতে পারে। তবে কাছে গেলে যেনো অন্য এক পরিবেশ। নাম না জানা অনেক রকম গুল্মলতায় ঘেরা পুরো টিলাটিই। উঁচুনিচু খাড়া পথ চলে গেছে টিলার চূড়ার দিকে। টিলায় উঠার পথে ৪০০ মিটার উঁচুতে এককালে রাজার পুকুর নামে একটা পুকুরও ছিল। পুকুর না থাকলেও কিছুটা গর্তের মতো এখনও রয়েছে। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে টিলা থেকে নামার সিঁড়িটাও। কয়েক বছর আগেও টিলার পূর্বদিকে তৈরি পাকা সিঁড়িটি চোখে পড়তো। অনুসন্দিৎসু চোখ টিলার চূড়ার পশ্চিম দিকে এখন ইট সুরকির নিদর্শন খুঁজে পাবে। রাজা ইয়াংয়ের স্মৃতিচিহ্নগুলো মলিন হয়ে গেলেও স্থানীয়দের লোকমুখে ইয়াং রাজার গল্প আজও জীবন্ত। বংশ পরম্পরায় স্থানীয়রা সে গল্পগুলোকে আগলে রেখেছেন। ইয়াং রাজা তাদের কাছে এক রহস্যে ঘেরা চরিত্র হয়ে আছেন। স্থানীয় বয়স্কদের কথার সূত্র ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যায়, রাজা ইয়াং এক রহস্যময় চরিত্রের অধিকারী। ফালজুর রাজ্যের এ রাজা সমসাময়িক অন্যান্য রাজাদের চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম। রাজ্য পরিচালনায় তিনি ছিলেন একেবারেই উদাসীন। সপ্তাহের ২/৩ দিনই প্রাসাদের বাইরে কাটাতেন। স্বভাবতই তা রানীর মনে সন্দেহের উদ্রেক করতো। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রানী একদিন জিজ্ঞেসই করে বসলেন ইয়াংকে। রাজার কাছে জানতে চান, রাতে তিনি কোথায় যান। রাজা ইয়াংয়ের উত্তর ছিলো বেশ চমকপ্রদ। রানীকে কৌতুহলী হতে নিষেধ করে ইয়াং বললেন, বেশি কৌতুহলী হলে এক পক্ষের বিয়োগ কিংবা অপর পক্ষের পুনর্জন্ম হতে পারে। রাজার এ উত্তরে রানীর কৌতুহল তো দমলোই না বরং আরও বেড়ে গেলো। এক মধ্য রাতে রাজা যখন প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যান রানীও পিছু নেন তার। পাহাড় ছেড়ে নিচের দিকে নেমে চলেছেন রাজা ইয়াং, পিছু পিছু রানীও। একটি মসৃণ পাথর ডিঙিয়ে নিচের ঝর্ণার সামনে থামলেন রাজা। দূর থেকে রানী দেখলেন, রাজা তার শরীর থেকে নাড়িভূঁড়ি বের করে সেই ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে ধুয়ে নিচ্ছেন। এ দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলেন রানী। আতঙ্কে চিৎকার করে রাজাকে ডাকতে লাগলেন। সে চিৎকারে পিছন ফিরে তাকালেন রাজা। পেছনে রানীকে দাঁড়িয়ে থাকতে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন তিনি। রানীকে উদ্দেশ্য করে শাপ দেন, পাপিষ্ঠা! অভিশপ্ত হও। মুহূর্তেই রানী পরিণত হয়ে যান একটি পাখিতে। আর রাজা ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। কথিত আছে, এ পাখিটি এখনও বিশেষ সময়ে সেই স্থানে এসে মানুষের রূপ ধরে রাজা ইয়াংয়ের প্রতি তার ভালোবাসা জানায়। এ অঞ্চলের মানুষ অনেকেই তা বিশ্বাস করেন। আর তারা একটা বিশেষ পাখিকে সেই অভিশপ্ত রানী হিসেবেই চিহ্নিত করেন। তাদের বিশ্বাস, এ পাখি যার বাড়ির কাছাকাছি ডাকাডাকি করে তার অমঙ্গল হয়। 
মিথ কিংবা কিংবদন্তী ইতিহাস নয়। তবে তা একেবারে উড়িয়েও কি দেওয়া যায়? উড়িয়ে কি দেওয়া যাবে ইয়াং রাজার টিলার অস্তিত্ব?

প্রবন্ধ >> কাজী ইমদাদুল হকের সাংবাদিকতা : সৌমিত্র দেব

কাজী ইমদাদুল হকের সাংবাদিকতা

সৌমিত্র দেব

কালজয়ী কথাশিল্পী কাজী ইমদাদুল হক লেখক হিসেবে যশস্বী হয়েছিলেন। শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন কর্মবীর। তবে তিনি যে একজন সাংবাদিক ছিলেন, যুক্ত ছিলেন সাময়িকী সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে সে ব্যাপারটি কিছুটা কম আলোচিত। এই লেখায় সেই বিষয়েই কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার জীবনীকার মোহাম্মদ আবদুল কাইউম বলেছেন; ‘কাজী ইমদাদুল হক মুসলমানদের মধ্যে প্রথম শিক্ষক ও শিক্ষা বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের গৌরব অর্জন করেন। শিক্ষক পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন যে, সমাজ ও সাহিত্যের সেবায় সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।’
বাংলা ১৩২৭ সালের বৈশাখ (ইংরেজি ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে) প্রথম প্রকাশিত হয় শিক্ষক পত্রিকাটি। মাসিক এই পত্রিকা চলেছে তিন বছর। সম্পাদক হিসেবে তিনি তাতে তার নিজের যে সকল রচনা পত্রস্থ করেন তাতে রয়েছে শিক্ষা বিকিরণ বিষয়ে তার ঔৎসুক্য ও উদ্ভাবনার সুনিপুণ পরিচয়। পত্রিকাটি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার আগে জেনে নেই সাংবাদিকতা কী। সব সাময়িকীর সম্পাদককেই সাংবাদিক বলা যায় কি না। এমনিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানবীয় যোগাযোগকেই সাধারণত সাংবাদিকতা বলা হয়। অক্সফোর্ড অভিধানে বলা হয়েছে একটি সরকারি সাময়িকী সম্পাদনা ও লেখার মাধ্যমে যিনি জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনিই সাংবাদিক। আক্ষরিক অর্থে এ কথা মেনে নিলে কাজী ইমদাদুল হককে সাংবাদিক বলা যায় না। কারণ তিনি সরকারি সাময়িকী সম্পাদনা করেননি। অথবা সম্পাদনা বা লেখার মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহও করতেন না। তবে ইংরেজি জার্নাল শব্দের মানে কোনো কিছু প্রকাশ করা। এর অর্থ দিনপঞ্জি। আর ইজম অর্থ অনুশীলন বা চর্চা। এ অর্থে জার্নালিজম বা সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় দিনপঞ্জি অনুশীলন। সেক্ষেত্রে কাজী ইমদাদুল হককে হতে হয় স্বাধীন এবং স্বাধীনচেতা। সেই গুণটি তার ছিলো। নিরপেক্ষতা সাংবাদিকতার আদর্শ। তিনি সেই গুণটিও রপ্ত করে নিতে পেরেছিলেন। সমাজই সংবাদক্ষেত্রকে সমর্থন জুগিয়ে থাকে। সেজন্য সমাজের প্রতি সংবাদপত্রের দায়িত্ব রয়েছে। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে কাজী ইমদাদুল হক সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন। কাজী ইমদাদুল হক পেশায় ছিলেন শিক্ষক। নেশায় ছিলেন লেখক। নেশা আর পেশা দুটিকেই এক বিন্দুতে মিলিয়ে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা। সে কারণে তার সাংবাদিকতা বুঝতে হলে শিক্ষা দর্শনকেও বুঝতে হবে।
কর্মজীবনে তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না। শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কলেজের অধ্যাপক, স্কুল পরিদর্শক, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে সে সময়কার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাবোধের আলোকে এবং নবীন প্রজন্মের প্রতি মমত্ব বোধের প্রভাবে তিনি শিক্ষাদান কার্যক্রমে বেশ কিছু অসঙ্গতি ও ত্রুটি লক্ষ্য করেছিলেন। ১৯১৯ সালে ঢাকায় বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট এন্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন স্থাপিত হলে কাজী ইমদাদুল হক এর প্রথম সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। সে সময় তিনি যে কয়টি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে দুটোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনিসহ সে সময়কার শিক্ষাবিদদের একাংশ মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অন্য অংশ এর বিরোধিতা করেন। কারণ তাঁদের বিশ্বাস ছিলো শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলে শিক্ষার মান ক্ষুণœ হবে। এই বিরোধিতার ফলে সমস্ত উদ্দেশ্য প- হয়ে যেতে পারে ভেবে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। প্রাথমিক অবস্থায় ইতিহাস, ভুগোল এই বিষয়গুলোর উত্তর বাংলায় লেখার ব্যাপারে শিক্ষার্থীকে পছন্দ করার অধিকার দেয়ার কথা বলেন। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হয় এবং তার জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী আনোয়ারুল হক ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ইতিহাস বিষয়টির উত্তর বাংলায় লেখার সুযোগ পান।
তার বিশ্বাস ছিলো ভাষা শিখতে হলে আনন্দঘন স্বচ্ছন্দ সাহিত্য পাঠের উপকরণ প্রয়োজন। সে কারণে মাধ্যমিক স্তরের বাংলা সাহিত্যের সংকলনে প্রকাশিত কবিতাগুলো তার কাছে ছাত্রদের জন্য সহায়ক মনে হয়নি। এর বদলে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ্য করে নিয়েছিলেন। তার এই সৃজনশীল শিক্ষা দর্শনটিই ‘শিক্ষক’ পত্রিকা প্রকাশের পটভূমি রচনা করেছিলো । শিক্ষক সাময়িকীর মধ্যে শিক্ষা বিষয়ক রচনার পাশাপাশি কিছু কিছু সংবাদও প্রকাশিত হত। এর ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। মুদ্রণ মাধ্যম বলতে আমরা সংবাদপত্র, বই-পুস্তক, লিফলেট প্রভৃতিকেই বুঝি। তবে সংবাদপত্রের সঙ্গে সমাজের যোগ খুবই নিবিড়। সংবাদপত্রের দর্পণেই প্রতিফলিত হয় সমাজচিত্র। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে গেলে ঐ সময়ের সংবাদপত্রই আমাদের তুলে নিতে হয়।
সে আমলে সংবাদপত্র তো বটেই, মুসলমান সমাজে ভালো সাহিত্য পত্রিকারও অভাব ছিলো। কাজী ইমদাদুল হক তার শিক্ষা দর্শন, সমাজচিন্তা এবং সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অনেকদিন ধরেই একটা সাময়িকী প্রকাশের কথা ভাবছিলেন। তিনি জানতেন গণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ও শিল্প সাহিত্যের গুরুত্ব অনেক। সে কারণে কয়েকজন তরুণ যখন ১৩১০ বাংলার বৈশাখ মাসে ‘নবনূর’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন, তখন কাজী ইমদাদুল হক তাদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন। এর প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ আসাদ। তিনি পত্রিকাটির প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে পত্রিকা প্রকাশে উৎসাহদাতা হিসেবে কাজী ইমদাদুল হকের নাম উল্লেখ করেন। নবনূরের সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ এমদাদ আলী। তিনি কাজী ইমদাদুল হক ও নবনূর প্রসঙ্গে বলেন, ‘নবনূর চারি বৎসর চলিয়াছিল। এই চারি বৎসর কাজী সাহেব নবনূরকে যে সাহায্য করিয়াছিলেন তাহার পরিমাণ করা যায় না। কেবল প্রবন্ধ দিয়া নহে, নবনূর যাহাতে বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর মাসিকপত্রে পরিণত হইতে পারে, সকল সম্ভাবিত উপায়ে তিনি তাহার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। নবনূরের নিয়মিত প্রচারের মূলে তাহার ব্যক্তিগত প্রভাব কম কাজ করে নাই।’
নবনূর প্রকাশে কাজী ইমদাদুল হকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু’ রকম অবদানই ছিলো। মূলত এমদাদ আলী নবনূর পত্রিকার সম্পাদক হলেও বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বর্ষ ৮ম, ৯ম ও ১০ম সংখ্যার সম্পাদক হিসেবে ইমদাদুল হকের নাম রয়েছে। নবনূর পত্রিকার প্রথম ৩৩টি সংখ্যায় কাজী ইমদাদুল হকের ২৫টি রচনা প্রকাশিত হয়।
১৯১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতির উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিলেন কাজী ইমদাদুল হক। সমিতির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ নামে। সেখানে কাজী ইমদাদুল হকের চারটি রচনা প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি প্রকাশ করেন ‘শিক্ষক’। শিক্ষা বিষয়ক এই মাসিক পত্রিকা তিন বছর প্রকাশিত হয়েছিলো।
‘শিক্ষক’ এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিলো ৪০। দাম তিন টাকা। পত্রিকার ১ম বর্ষ ১২টি সংখ্যার (বৈশাখ-চৈত্র ১৩২৭) প্রকাশক ছিলেন কলকাতা স্টুডেন্টস লাইব্রেরীর ব্রজেন্দ্রমোহন দত্ত। তিনি ওই পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। পরবর্তীকালে কাজী ইমদাদুল হক ঢাকায় বদলি হয়ে চলে এলেও দু বছর ধরে সেটির প্রকাশনা অব্যহত রেখেছিলেন। পরে শারীরিক অসুস্থতার জন্য কাগজটি চালিয়ে যাওয়া আর তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্পাদক হিসেবে এই পত্রিকার তিনি ১৩২৭ বাংলায় বৈশাখে ৪টি, জ্যৈষ্ঠে ২টি, আশ্বিনে ১টি ও কার্তিকে ১টি. ১৩২৮ বাংলায় বৈশাখে ২টি ও ১৩২৯ বাংলায় বৈশাখে ১টি লেখা প্রকাশ করেন। সেগুলো হলো শিক্ষক, নীরব পাঠ, নীরব পাঠ-২, কল্পনা ও ভাব প্রকাশ শক্তির অনুশীলন, শিশুদের করিবার কিছু, জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, চারি হাজার বৎসর পূর্বেকার নারী বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি শিক্ষার নতুন প্রস্তাব, বিনয় ও কাজের কথা শিরোনামে চারটি প্রবন্ধ।
এই মহৎ উদ্দেশ্যে ‘শিক্ষক’ পত্রিকায় আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষা-ব্যবস্থা বিষয়ে প্রবন্ধ, তথ্য ও সংবাদ, নতুন চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। কাজী ইমদাদুল হকের অনেক রচনা ‘শিক্ষক’ পত্রিকার প্রথম খণ্ডে (১৩২৭) স্থান পায়। প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত তার রচনাবলী : অঙ্কের খেলা; আবহাওয়ার নিক্তি; চার হাজার বৎসর পূর্বেকার নারী বিশ্ববিদ্যালয়; ৬ দু গুণ দশ; ছবির ধাঁধাঁ; ছবির সাহায্যে অঙ্ক;  জাপানে শিক্ষা-ব্যবস্থা; টেলিগ্রাম পাঠ; তথ্য-চয়ন; দৃষ্টান্তের প্রভাব; নীরব পাঠ; নূতন খেলা; পরীক্ষার প্রশ্ন; পৃথিবীর গম ফসল; পাটীগণিতের ঠকান প্রশ্ন; পাটীগণিতের দৈনন্দিন ব্যবহার; বর্ষার দিনে খেলা; বড় বড় সংখ্যার ধারণা; বিদ্যালয় পরিদর্শন; বিবিধ; ভাল ছেলে; ভূগোলের খেলা; মজার অঙ্ক; যোগের নামতার একটি খেলা; রহস্য; শিশুদিগের স্বপ্ন; শিক্ষক; শিক্ষক সমিতি; সংযোগ চিহ্নের মূল্য; স্বচ্ছ কাগজে অঙ্কিত ম্যাপের ব্যবহার; সু ও কু (গল্প)।
মূলত, শিক্ষকরাই পত্রিকার লেখক হলেও সে সময়ের অনেক বিখ্যাত লেখকের রচনায় ‘শিক্ষক’ পত্রিকা সমৃদ্ধ ছিলো। প্রথম খণ্ডের লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন -কুমুদরঞ্জন মল্লিক (আবৃত্তি ও তন্ময়তা, শিক্ষকদের বেতন), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (অদল-বদল, ইতিহাস-প্রসঙ্গ), তরিকুল আলম (আমাদের শিক্ষাসমস্যা), জলধর সেন (দুকুড়ি সাত)। জলধর সেনের শিশুতোষ উপন্যাস ‘সোনার বাংলা’ মাঘ (১৩২৭) সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়।
দ্বিতীয় বর্ষে (১৩২৮) তৃতীয় বর্ষে (১৩২৯) ‘শিক্ষক’ পত্রিকার প্রকাশক ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন নিশিকান্ত সেন। দ্বিতীয় বর্ষের ‘শিক্ষক’ পত্রিকায় কাজী ইমদাদুল হকের মাত্র দুটি রচনা প্রকাশিত হয়- ‘কল্পনা ও ভাবপ্রকাশ-শক্তির অনুশীলন’ এবং ‘শিশুদের করিবার কিছু’। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে রয়েছেন- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘ধর-পড়া, নাটিকা), দীনেশ চন্দ্র সেন (বঙ্গের পুরান সাহিত্য), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (মান বড় না প্রাণ বড়, মনিবের মানরক্ষা), কুমুদরঞ্জন মল্লিক (শিক্ষার বিঘ্ন) প্রমুখ।
১৩২৯ সালে ‘শিক্ষক’ পত্রিকা তৃতীয় বর্ষে পদাপর্ণ করে। এই তৃতীয় বর্ষে কাজী ইমদাদুল হকের একটিমাত্র লেখা মুদ্রিত- কৃষি শিক্ষার নূতন প্রস্তাব। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জলধর সেন (ছেলেদের কি করি?), পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় (দৈত্যের বাগান), অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ (ঋষি ও কুকুরের গল্প, শৃগাল ও ব্যাঘ্র) এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাদশাদের পড়াশুনা ও বিদ্যানুরাগ)।