বিনাশ
অনন্ত নিগার
রাতের নিকষ চাদরে ঢাকা রহস্যপূর্ণ আকাশটা জিজ্ঞাসায় পরিপূর্ণ বলে হয়তো রাতের আকাশে সাধারণের মনোযোগ তুলনামূলক কম। যারা আকাশ গবেষণায় নিয়োজিত, তাদের জন্য এটা পেশা, তবে শখের বশে নিয়মিত পর্যবেক্ষণকারীদের সংখ্যা কম, অন্তত এদেশের জন্য এটা অধিকতর সত্য। তবে আকাশ পর্যবেক্ষণ আশিকের পেশা নয়, অভ্যাস কিংবা শখ বলা যায়। কলেজে ছাত্রাবস্থায় খালি চোখে, পুরোপুরি খালিও নয়, ভারি লেন্সের চশমা চোখে রাতের বেলা খুব মনোযোগ দিয়ে তিনতলার নিজের রুম থেকে জানালা দিয়ে, কখনও ছাদে ওঠে গভীর মনোযোগ দিয়ে মিটমিটে তারা, চাঁদের সাবালক হওয়া কিংবা পুনরায় শৈশবে উল্টোপথে হাঁটা, চন্দ্রগ্রহণ, এমনকি ঘুটঘুটে কালো অমাবস্যা, সবই সে দেখতো গভীর মনোযোগ দিয়ে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে অতিকায় মহাবিশ্বে পৃথিবীর নগণ্য অবস্থান এবং প্রতিটি বস্তুপি- গতিশীল এ তথ্য উদ্ঘাটন করেছিলেনÑ এ ঐতিহাসিক সত্য জানার পর থেকে একটা টেলিস্কোপের পোকা সারাক্ষণ তার মাথায় গিজগিজ করতো। তবে বেশি দিন নয়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই পরিবারের সাহায্য ছাড়াই নিজের টিউশনির টাকায় একটা মাঝারি সাইজের টেলিস্কোপ কিনতে সক্ষম হয়েছিলো। এরপর টানা প্রায় একমাস নিয়মিত, অতঃপর অনিয়মিতভাবে চলে আসছে রাতের বেলা টেলিস্কোপ নিয়ে অনন্ত আকাশের সাথে চুটিয়ে প্রেমের ভাব বিনিময়। আশিকের এই নিরন্তর আকাশ ভাবনা আরো প্রজ্জ্বলিত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের মাস্টার্সে এসে প্রফেসর শামসুলের অধীনে থিসিস শুরু করার পরে। বর্তমানে আশিকের অ্যাসিস্ট্যান্স ইনিই এবং এই ভদ্রলোক ‘বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা’য় গবেষক হিসেবে নিয়োজিত এবং আশিকের বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। এই জ্যোতির্বিদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে তার সখ্যতা আছে বিধায় ভদ্রলোকের কাছ থেকে আকাশ পর্যবেক্ষণের খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতির ব্যকহার ও কলাকৌশল জেনে আশিকের ভাবনা আরো সজীব হয়েছিলো। নিউক্লিয়ার সায়েন্সের উপর থিসিস করছে আশিক। তবে ভবিষ্যতে তার পথ বদলানোর ইচ্ছে, যেহেতু মত বদলেছে। সে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর ডিগ্রি নেবে। বাংলাদেশে এ পেশার মানুষ সংখ্যায় নগণ্য। আসলে এদেশে ক্ষেত্র কম, তাই এদের সংখ্যাও কম।
নিচে যখন এসে বেডরুমে ঢুকলো সে ততোক্ষণে রাত সবে সোয়া নয়টা। আইফোনটা হাতে নিয়ে সোশ্যাল সাইটের স্ট্যাটাসে ছোট্ট একটা মন্তব্য করলো ‘আজ উল্লেখযোগ্য কিছু চোখে পড়েনি, শুধু পূব আকাশে একটা তারা খসে পড়তে দেখেছি।’ লেখা শেষে নোটিফিকেশনে দেখলো একটা নতুন মেসেজ। খুলে দেখলো প্রফেসর শামসুলের। দু’লাইনের অর্থবহ বার্তা ‘কফি টাইম রাত ১০.০০ টা। তোমার নতুন পা-ুলিপি পড়া শেষ।
দশ মিনিটের মাথায় একটা উইন্ডব্রেকার গায়ে চাপিয়ে রাস্তায় নামলো আশিক। গন্তব্য প্রফেসর শামসুলের বাসা। খুব বেশি দূরে নয়, এখান থেকে দক্ষিণে, প্রায় বিশ মিনিটের হাঁটা পথ। খুব দ্রুত তার দেওয়া পা-ুলিপি পড়া শেষ দেখে মোটেও অবাক হয়নি আশিক। প্রফেসরের অভ্যাসগত প্রায় সব ব্যাপার সম্পর্কেই সে অবগত। এক ঘণ্টার মতোও সময় পেলে ভদ্রলোক ছোটোখাটো একটা বই শেষ করে ফেলতে পারবেন। দ্রুত পড়লেও মগজ এতো প্রখর যে উনি প্রয়োজনের সময় তা তাৎক্ষণিক উগরে দিতে পারেন। মানুষের মস্তিষ্ক নামক জৈব কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্যটাই এরকম, যতো বেশি ওটা পরিশ্রম করে, ততো বেশি ওটা সজীব ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে।
‘হুঁম!’ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাইফোকাল লেন্সের চশমার উপর দিয়ে আশিকের দিকে একবার তাকালেন প্রফেসর। এ মুহূর্তে প্রফেসরের স্টাডিরুমে বসে আছে সে। ঢোলা জিন্সের সাথে একটি ব্রাউন রঙের সোয়েটার পড়ে আছেন প্রফেসর। পায়ে একজোড়া স্লিপার। মাথার উষ্কোখুষ্কো লম্বা চুল আর হালকা দাড়ি-গোঁফ তার চরিত্রের সাথে বেশ মানানসই। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রলোক এখানে একা থাকেন। স্ত্রী আর এক ছেলে থাকে দেশের বাইরে, আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ছুটি কাটাতে বছরে একবার আসেন বাংলাদেশে। আবার প্রফেসরও সময় পেলে ছুটি নিয়ে ওখানটায় ঘুরে আসেন। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করার সময় তার স্ত্রীর সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো। তারপর মাস দু’য়েকের মাথায় বিয়ে সম্পন্ন করে একসময় ওখানকার স্থায়ী নাগরিকত্ব পান প্রফেসর। কিন্তু ডিগ্রি নেওয়ার পরে কর্মক্ষেত্র হিসেবে নিজের দেশটাকেই বেছে নেন তিনি।
‘ভালো হয়েছে। তোমার এ বইটাও কিশোর উপযোগী। ছাপানো যায়। মাস দুয়েকের মধ্যে ই-বুক আকারে, পরে হার্ড কপি বের করবো।’
আশিক গত কয়েকদিন আগে ‘মজার সমস্যা-২’ নামের মৌল পদার্থবিদ্যার কিছু মজার কুইজ নিয়ে যে পা-ুলিপি তৈরি করেছিলো, সেটাই বর্তমানে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। এর এক বছর আগে আশিকের লেখা ‘মজার সমস্যা-১’ নামক বইটিও প্রকাশিত হয়েছিলো প্রফেসরেরই পৃষ্ঠপোষকতায়।
‘তোমার এই লেখায় কিশোরদের জন্য একটি তথ্য সংযোজন করেছো যে, সব কণার যেমন বিপরীত কণা রয়েছে, তেমনি সব কিছুরই বিপরীত অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ বিপরীত পৃথিবী, বিপরীত মানুষ ইত্যাদি। এটাকে একটা হাইপোথিসিস বলা যায় যা অনেক বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন। পারতপক্ষে আমরা আদৌ এরকম কোনো বস্তুর বিপরীত অস্তিত্ব মহাজগতে খুঁজে পাবো কিনা জানি না।’
‘জানি স্যার। তবে আমার ব্যক্তিগত ধারণা এমনটা থাকতে পারে।’
‘থাকতে পারে এটা সত্যি। বিজ্ঞানী হকিংসও স্বীকার করেছেন তার একটি বইতে। তবে সব কিছুরই সমান সংখ্যক অস্তিত্ব রয়েছে এমনটা নয়। মহাবিশ্বে কোয়ার্কের সমান সংখ্যক বিপরীত কণা রয়েছে তা নয়। বলা যায় বিপরীত অস্তিত্ব রয়েছে তবে সমান সংখ্যক নয়। তবে এটা সর্বজনবিদিত যে, মহাবিশ্বের মোট শক্তি হিসাব করলে অর্থাৎ শক্তি এবং বিপরীত শক্তি মিলে মোট ফলাফল হবে শূন্য। এজন্যই বিজ্ঞানীরা বলেন প্রায় শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি। যদিও আমরা এখনও সঠিক জানি না শূন্য থেকে কোনো কিছুর উৎপত্তি হয় কীভাবে কিংবা মহাবিশ্ব উৎপত্তির আদি কারণ কী?’
কয়েক সেকেন্ড নীরবে কফিতে লাগাতার চুমুক দিল আশিক। তারপর ভুরু কুঁচকে প্রফেসরের চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, আপনি কি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী?’
‘হ্যাঁ’। নির্দ্বিধায় জবাব দিলেন প্রফেসর শামসুল।
গলা একটু খাঁকারি দিল আশিক। তারপর সহজাত আগ্রহ নিয়ে কিছুটা সামনে ঝুঁকে জানতে চাইলো, ‘আমি কি স্যার এ ব্যাপারে আপনার নিজস্ব চিন্তাধারাটা একটু জানতে পারি?’
কয়েক সেকেন্ড প্রফেসর নীরবে কী যেনো ভাবলেন, যেনো কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছেন। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার গভীর থেকে। তারপর আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, ‘ঈশ্বর এখন পর্যন্ত প্রমাণিত কিংবা অপ্রমাণিত সত্তা নয় যে মানুষ তার সম্পর্কে এখনই চূড়ান্তভাবে কোনো ঘোষণা দিয়ে বসবে। আদৌ সে সময় আসবে কিনা সেটা এখনও চিন্তার আওতাধীন। আসলে সত্যি কথাটা হলো আমাদের পোষা কতিপয় জন্তু যেমন আমাদের কখনও তাদের কাঠখোট্টা যুক্তি দিয়ে পুরোপুরি মাপতে পারবে না, অনেকটা সে রকম মানবীয় যুক্তি দিয়ে মানুষও সম্ভবতঃ ঈশ্বরকে পুরোপুরি জানতে পারবে না এবং এটাই হলো সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার মূল তফাৎ। একটু আগে আমি বলেছি মহাবিশ্বের মোট শক্তির হিসাব নিলে দেখা যায় ফলাফল শূন্য। প্রায় শূন্যতা থেকে স্থান, কাল, সময় অর্থাৎ মিনকাউস্কি জগৎ তৈরি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে ‘শূন্যতা আসলে কী? শূন্যতা থেকে কোনো কিছু যদি সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে পরম শূন্যতা বলে কি কিছু আছে?’ মহাবিশ্বের উৎপত্তির আদি কারণ শূন্যতা হতে পারে না বরং মহাবিশ্বের জন্ম থেকে অর্থাৎ প্রায় তেরো শ’ সত্তর কোটি বছর আগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত গোটা মহাবিশ্বটা এমনভাবে আবর্তিত-বিবর্তিত হয়েছে যেনো পৃথিবী নামক নগণ্য গ্রহে মানুষের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়। একটি অতি ক্ষুদ্র পরমাণু থেকে শুরু করে পুরো ব্রহ্মা- এতো নিখুঁতভাবে গাণিতিক হিসাব মেনে চলে যে, সহজেই অনুধাবন করা যায় এটি নিয়মতান্ত্রিক অর্থাৎ প্রায় অসীম সংখ্যক নিয়ম দ্বারা এ পুরো মহাবিশ্ব শৃঙ্খলিত। বলতে পারো যে, মহাবিশ্বটা বিবর্তিত হতে হতে দৈবক্রমে আজকের রূপ পেয়ে গেছে। তার মানে এখানে ‘দৈবক্রমে’ মানে একটা ‘Chance’ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি মহাবিশ্বের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত যা ঘটছে সব কিছুর আড়ালে রয়েছে এক মহাশক্তির অদৃশ্য ইশারা। প্রকৃতি জড় পদার্থ হয়ে থাকলে ‘এটি অচেতন হয়েও আস্তে আস্তে শৃঙ্খলিত হয়েছে’ এ তত্ত্ব বেশি যুক্তিপূর্ণ নাকি একটি ‘সচেতন সত্তা অনন্তকাল ছিলো কিংবা নিজ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং তার দ্বারা বিং ব্যাং থেকে আজ অবধি সব সংঘটিত হয়েছে’ এটি বেশি যুক্তিপূর্ণ? অচেতন হয়ে জন্মানো প্রকৃতি যদি নিজ থেকে সচেতন হতে পারে, তাহলে স্রষ্টা কেনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজে অস্তিত্ববান হতে পারবেন না কিংবা অনন্তকাল থেকে বিদ্যমান থেকে সচেতন হতে পারবেন না? সেজন্য আমি কোনো ‘Chance’-এ বিশ্বাসী নই, নিশ্চিত অস্তিত্বে বিশ্বাসী।’ একটু থামলেন প্রফেসর। তারপর আবার সংযোজন করলেন, ‘আমি এটাও বিশ্বাস করি ¯্রষ্টা সব কিছু শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং শূন্যতায়ই একসময় সব কিছুর বিলুপ্তি ঘটাবেন কিন্তু অবশিষ্ট থাকবে শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্ব।’
কথাগুলো কয়েক সেকেন্ড নীরবে মনের গহীনে ওলট-পালট করে দেখলো আশিক। আবার প্রশ্ন করলো, ‘ধর্ম কিংবা প্রার্থনার ব্যাপারে আপনার মত কী?’
‘প্রার্থনা হচ্ছে ঈশ্বরকে উপলব্ধি কিংবা অনুধাবন করার একটি প্রক্রিয়া। আর ধর্ম হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া শেখার এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার কায়দা-কানুন সংবলিত বিষয়। পুরো মহাবিশ্ব যদি নিয়মতান্ত্রিক হয়, তাহলে মানুষের জীবনটাও কি নিয়মতান্ত্রিক হওয়া উচিত নয় ?’
‘হুঁ’ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল আশিক। এরপর জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি যদি প্রশ্ন করি যে, স্রষ্টাকে কে তৈরি করলো, এর জবাবে আপনি কী বলবেন?’
‘শোনো, বিজ্ঞানের কিছু কিছু ব্যাপার আছে যার পুরোপরি ব্যাখ্যা দেয়া যায় না কিন্তু মেনে নিতে হয়। এগুলোকে বলা হয় স্বীকার্য। যেমন- গ্যাসীয় তত্ত্বের স্বীকার্যসমূহ। ঈশ্বরের সৃষ্টির ব্যাপারে একই কথা আমি বলবো অর্থাৎ তোমাকে মেনে নিতে হবে তিনি ছিলেন, তিনি থাকবেন। তার কোনো শুরু ছিলো না, শেষও থাকবে না। পবিত্র কোরআনের একটি বাণী এ প্রসঙ্গে আমি বলতে পারি, সেটা হলো ‘তিনি আদি ও অন্ত, প্রকাশ্য ও গুপ্ত এবং তিনি সর্ব বিষয়ে অবহিত।’ স্রষ্টার সমস্ত পরিচয় রয়েছে এই একটিমাত্র লাইনে এবং স্রষ্টাকে নিয়ে এর চেয়ে আধ্যাত্মিক কোনো কথা এ পুরো ব্রহ্মাণ্ডে সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই। স্রষ্টা আর সমস্ত সৃষ্টিকে মুহূর্তে আলাদা করে দিয়েছে এই একটিমাত্র লাইন। এখানেই স্রষ্টার সাথে রয়েছে সৃষ্টির মূল তফাৎ।’
‘হুঁ’ নীরবে মাথা ঝাঁকালো আশিক। তারপর ফোঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ফের যখন আশিক রাস্তায় নামলো তখন রাত প্রায় সোয়া এগারোটা। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। কুয়াশা ঘন হয়ে যাওয়াতে চারপাশটা ঘোলাটে দেখাচ্ছে। কত হতে পারে তাপমাত্রা? আবহাওয়ার সংবাদটা শোনা হয়নি আজ। বোধ হয় চৌদ্দ-পনেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। উইন্ড-ব্রেকারের হুড মাথায় চাপিয়ে, সাইড পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে লাগলো সে। প্রফেসর বলেছেন সব কিছুর সমান সংখ্যক বিপরীত অস্তিত্ব থাকবে এমন কোনো কথা নেই। তবে যদি থেকেই থাকে কিংবা নাই থাকে, মহাবিশ্বের মৌলিক কণা বা মৌলিক বলের সমষ্টি শূন্য হলে এটা বলা যায় যে, কেবল ঈশ্বর ব্যতিরেকে সব কিছুই লয়শীল। কেবল ঈশ্বরই অবশিষ্ট এবং শাশ্বত থাকবেন। তবে আশিক ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না। তার কেনো জানি সন্দেহ হয় যে, না! সব কিছু ধ্বংস হতে পারে না। কিংবা ঈশ্বর থাকলে যদি তিনি সৃষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে তিনিও শাশ্বত নন, অবশ্যই লয়শীল হবেন। হয়তো তারও সমাপ্তি থাকবে। তবে তার সর্বদা এটাই মনে হয় যে, শূন্যতা থেকে গোটা মহাবিশ্ব নয়, ঈশ্বরের সত্তাও আবির্ভূত হয়েছে, যা হয়তো একদিন লয়প্রাপ্ত হবে। তবে বিপরীত অস্তিত্ব যদি সব কিছুর থেকেই থাকে, তদুপরি স্রষ্টার বিপরীত সত্তা না থাকারই কথা। কারণ, স্ষ্টার সর্বত্র বিরাজমান; অনন্ত স্থানব্যাপী রয়েছে তার অস্তিত্ব। সুতরাং ঈশ্বরের বিপরীত সত্তা থেকে থাকলে তাকেও অনন্ত স্থান জুড়ে থাকতে হবে। এবং এটা একটা অবুঝ শিশুও বুঝতে সক্ষম হবে যে, ঈশ্বর এবং বিপরীত ঈশ্বর একই স্থানে পরস্পরের সংস্পর্শে থাকলে দু’জনেই ধ্বংস হয়ে যেতেন কিংবা উল্টোভাবে বলা যায় , তাদের এ মহাবিশ্বে আবির্ভাবই সম্ভব হতো না।
জটিল এবং দুর্বোধ্য! সব কিছুই ভয়ঙ্কর জটিল! এই প্রকৃতি, এই মহাবিশ্ব এতো তথ্য এবং রহস্যে পরিপূর্ণ যে, স্বয়ং স্রষ্টা ছাড়া তাকে তার মতো করে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। এই ঈশ্বর, এই ব্রহ্মাণ্ড কিংবা স্থান ভেদে মানুষের মধ্যকার নিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজ কাঠামো’এ সবই যেমন আশিকের কাছে দুর্বোধ্য, কুটিল মনে হয়। তেমনি সব কিছু নিয়েই সে সংশয়বাদী। রবিঠাকুরের শেষ বয়সে লেখা সেই কবিতার ক’টা ছত্র মনে পড়ে তার ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনা জালে/ হে ছলনাময়ী!/মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে/ সরল জীবনে!’ আনমনে স্মিত হাসলো আশিক। মেন রোডের ফুটপাত ধরে আসছিলো এতোক্ষণ। এবার হাতের ডানে মোড় নিয়ে তাড়াতাড়ি যাবার জন্য নির্জন গলিতে ঢুকলো। রাস্তাটা বেশি সুবিধার নয়। এই ভাঙাচোরা লম্বা গলিতে মোটের উপর তিনটি ল্যাম্পপোস্ট। ল্যাম্পপোস্টের আলোকে ঘিরে ধরে আছে ঝাঁক ঝাঁক নিশিপোকা।
বাড়ি আর বেশি দূরে নয়, সামনের ব্লকটা পেরোলেই সামান্য এগিয়ে হাতের ডানদিকে তার বাসা। দু’ নাম্বার ল্যাম্পপোস্টটা যখন অতিক্রম করছিলো, হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি দেখে থমকে দাঁড়ালো আশিক। তার মতো গায়ে দেওয়া উইন্ড-ব্রেকারের হুড মাথায় ফেলে রাখায় ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না মানুষটাকে। কেমন জানি এক অচেনা আশঙ্কায় বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার। দুরুদুরু বুকে গুটিগুটি পায়ে আরেকটু সামনে এগুলো আশিক। ঠিক এই সময়, প্রায় একই সঙ্গে দু’জনে হুড ফেলে মাথা উন্মোচন করলো। যা দেখলো আশিক, তাতে সে জায়গায় জমে গেলো। প্রথমে বুঝতে পারল না এটা বাস্তব না কল্পনা, নাকি তার দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। কিন্তু নিজের শরীরে সজোরে চিমটি কেটে তার অবিশ্বাস ভরা চোখ দু’টোকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য হলো। কখন যে তার চোয়াল দুটো ঝুলে পড়েছে টেরও পায়নি। সংবিৎ ফিরে পেলো আগুন্তুকের কথায়।
‘অবাক হয়ো না আশিক। ভয়ও পেয়ো না। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করো!’
কিন্তু কীভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখবে আশিক? স্েম্মাহিতের মতো হাঁ করে সে দেখছে। তারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই মতো হুবহু আরেক আশিক! এও কি সম্ভব?
‘বিচলিত হবার মতো কোনো কারণ নেই আশিক। আমি বিপরীত পৃথিবী থেকে এসেছি এবং প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে তোমাদের এই গ্রহে নেমেছি।’
আশিকের এই সময় হঠাৎ মনে পড়ল আজ রাতের আকাশে একটা তারা খসে পড়তে দেখেছিলো। তার মানে ওটা তারা ছিলো না। ওটা কি তবে স্পেশশিপ ছিলো!
‘হাঁ আশিক, আমি বিপরীত পৃথিবী থেকে আসা তোমার বিপরীত সত্তা! বিপরীত আশিক আমি!’
বিস্ময়ের চরমে যেনো পৌঁছে গেছে আশিক। মুখে তার রা-ও যোগাচ্ছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এক দলা মাংসপি-ের মতো অনড়, জড় পদার্থে পরিণত হয়ে গেছে সে।
‘কী ব্যাপার?’এবার যেনো খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ পেলো বিপরীত সত্তার কথায়। ‘তুমি কি ভূত নাকি দেও-দানো দেখছো? মুখে কথা যোগাচ্ছে না কেনো? এই সামান্য ব্যাপার বুঝতে তোমার এতো সময় ব্যয় হচ্ছে? তুমি তো আমারই প্রতিরূপ, তাই না? সুতরাং আমার জানা মতে, তুমি অসাধারণ মেধাবী একজন মানুষ! কারণ, একই ধারণা আমি নিজের সম্পর্কে পোষণ করি।’
বিপরীত সত্তা! বিপরীত আশিক! তার মানে ও তার বিপরীত কণা দ্বারা সৃষ্ট? কথাটা ভাবতেই রাজ্যের পুলক যেনো মুহূর্তে তাকে উদ্বেলিত করে তুললো। এবার খানিকটা নিজেকে সামলে নিয়ে কোনো রকমে উচ্চারণ করলো, ‘...মানে ত্-তুমি আমার বি-ব্বিপরীত সত্তা?’
‘হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ আছে? বিশ্বাস করার জন্য তোমার সজাগ ইন্দ্রিয়গুলোই কি যথেষ্ট নয়?’
যথেষ্ট বটে! তবুও আশিকের হতবিহব্বল ভাবটা পুরোপুরি যায়নি। একই রূপ, একই আকৃতি, একই রকম বাচনভঙ্গি, একই গলার স্বর! অবিশ্বাস্য! এও সম্ভব? খাতা-কলমে কিংবা তাত্ত্বিকভাবে আমরা কতো সহজেই সব বড় বড় হিসেব-নিকেশ মেনে নেই, সেটা যতোই অবিশ্বাস্য হোক। কিন্তু বাস্তবে এর ভগ্নাংশ পরিমাণেরও সম্মুখীন হলে মানুষের স্বাভাবিক বোধটুকুও অনায়াসে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে- ব্যাপারটা এই প্রথম অনুধাবনে সক্ষম হলো আশিক। একটু আগে যা সে প্রফেসরের সাথে আলাপ করেছে, এখন তাই সে মেনে নিতে পারছে না।
‘তুমি ...কোথা থেকে এসেছো? সত্যি করে বলো তুমি কে? ’ আবারও রাজ্যের দ্বিধা ঝরে পড়ল আশিকের কন্ঠ থেকে।
লম্বা করে শ্বাস টেনে বুকটা ভরে নিল বিপরীত আশিক। তারপর বললো, ‘আমি বিপরীত পৃথিবী থেকে আসা তোমার বিপরীত সত্তা। তোমার মনে যে রকম জিজ্ঞাসা ছিলো বিপরীত অস্তিত্ব বলে কিছু আছে কি না, কয়েক বছর ধরে আমার মনেও সে জিজ্ঞাসা খেলা করছিলো এবং তাই আমি আমার পৃথিবী থেকে একটা শীপ নিয়ে মহাশূন্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম এই সত্যটা যাচাইয়ের জন্য। যদিও আমাদের পৃথিবীর বিজ্ঞানীগণ তোমাদের অস্তিত্ব ও অবস্থান সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত। তাদের সাহায্য নিয়েই আমি এ মহাজাগতিক সফরে বেরিয়েছি এবং তাদের জন্য আমার এ যাত্রাটি পরীক্ষামূলক ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়কারী হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। এবার কি কিছুটা বোঝা গেছে?’
‘হ্যাঁ। তারপর?’ ছোট্ট করে ঢোক গিললো আশিক।
‘তারপর আর কী? তোমার অবস্থান জেনে নিয়েই আমি এখানে নেমেছি। আমার কাছে এমন একটা যন্ত্র আছে যা আমার বিপরীত কণা দ্বারা সৃষ্ট সত্তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম। এ যন্ত্রটির নাম ‘এন্টি-পার্টিকল ডিটেকটর’। প্রক্রিয়াটা এরকম- তোমার আর আমার ভর সমান হওয়ার কারণে আমার সমপরিমাণ বিপরীত কণার অবস্থান জানার জন্য আমার সমস্ত দৈহিক উপাত্ত এ যন্ত্রে ইনপুট করতে হবে সম্ভাব্য গ্রহে ল্যান্ড করার পর। আর সত্যিই যদি আমার সমপরিমাণ ভরের বিপরীত ভর এ গ্রহে থেকে থাকে তাহলে সংযুক্ত রাডার তোমার অবস্থান বরাবর দিক নির্দেশনা দেবে। আর এ প্রক্রিয়ার কারণেই আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’
নিস্পলক হয়ে এতোক্ষণ হাঁ করে বক্তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আশিক। মনের আড়াল থেকে এখন কিছুটা কুয়াশা কেটে গেছে তার। নিজেকে এতোক্ষণে বেশ খানিকটা সামলে নিয়ে এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কিন্তু তোমার উদ্দেশ্যটা কী? কী চাও তুমি আমার কাছে?’
‘সহজ কথায় কৌতূহল নিবারণ।’ দু’ হাত খানিকটা পাশ মেলে বললো বিপরীত আশিক। ‘তোমার মনে ঈশ্বরকে নিয়ে যেরূপ সন্দেহ আছে, আমার ক্ষেত্রেও তাই। তোমার ধারণা মহাবিশ্বের সব কিছুই একসময় বিনাশপ্রাপ্ত হবে। তবে ঈশ্বর থাকলে তার বেলায় হয়তো এই বিনাশ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আমাদের দু’জনের ধারণা ঈশ্বর যদি অবিনশ্বর হন, তাহলে আমরাও সবাই অবিনশ্বর থাকব অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও আমাদের দেহ মাটিতে মিশে অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হবে কিন্তু মোট বস্তুকণা বা শক্তি অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ আমাদের রূপ পাল্টাবে কিন্তু আমরা অবিনশ্বর থাকব। হতে পারে ঈশ্বর নামক শাশ্বত, চিরন্তন কোনো সত্তা নেই। কিন্তু আমরা একে অপরকে স্পর্শ করার পর যদি সত্যিই আমরা শূন্যে লুপ্ত হয়ে যাই, তখন শুধু একটি ব্যাপারই অবলীলায় প্রমাণিত হবে যে, মহাবিশ্বের সব কিছুই একদিন শূন্যে বিলীন হবে, শুধু ঈশ্বর ব্যতিরেকে। কারণ, একই মহাবিশ্বে পরস্পর সংস্পর্শে থাকা দুই বিপরীত সত্তার ঈশ্বর বিদ্যমান থাকা সম্ভব নয়। ঈশ্বর অবশিষ্ট থাকবেন চিরন্তন সত্য হয়ে!’
এতোক্ষণে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে যেমন আশিক পুলকিত হলো, তেমনি নিখাদ বিস্ময়ে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে গেলো। অতঃপর সামনে মূর্তিমান চূড়ান্ত বাস্তবতাকে গ্রহণ করে এবার সে বললো, ‘তুমি যা বলেছো, তা হুবহু আমার মনের কথা। আমিও চাচ্ছিলাম আমার বিপরীত সত্তার দেখা কোনোদিন পেলে আমি তাকে স্পর্শ করে দেখে পরীক্ষা করে নেবো আমরা বিলুপ্ত হই কিনা। আমার ধারণা যদিও এরকম কোনো কিছু নাও হতে পারে, তারপরও...’ কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাল আশিককে।
‘তারপরও?’
‘তারপরও আমরা তো নিশ্চিত নই। তাই তোমাকে স্পর্শ করার আগে আমার অ্যাসিস্ট্যান্স স্যার এবং আমার ডিপার্টমেন্টের সায়েন্স ফোরামকে পুরো ঘটনার বিবরণ জানিয়ে দু’টো মেসেজ পাঠিয়ে তারপর তোমাকে স্পর্শ করবো। আমি নিখোঁজ হয়ে গেলে অন্তঃত পুরো দেশবাসী ঘটনাটার জন্য কাউকে দায়ী করতে পারবে না। ওকে?’
‘ওকে।’
পাগলের মতো নিজের পাজেরো গাড়ি ড্রাইভিং করছেন প্রফেসর শামসুল। আশিকের মেসেজ পেয়েছেন বড় জোড় মিনিট পাঁচেক হবে। মেসেজটি পাবার পর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে রাস্তায় নেমেছেন। যেকোনো মূল্যে আশিককে ঠেকাতে চান তিনি। অন্যথায় এতো মেধাবী একজন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, যে কিনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, এ দেশের জন্য, এমনকি হতে পারে গোটা বিশ্বের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনা-সে অনায়াসে শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। আসন্ন বাস্তবতা তিনি ঠেকাতে পারবেন কিনা জানেন না। সমস্যাটা হলো ছেলেটা আজন্ম কৌতূহলী ও জ্ঞানপিপাসু। সে তার কাক্সিক্ষত জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণে একবার সচেষ্ট হলে তাকে দমন করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রফেসর জানেন তিনি দু’ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতে পারবেন। কিন্তু বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা পেয়ে বসেছে তাকে। দু’ মিনিট তার কাছে এখন এক অনতিক্রম্য মহাকাল বলে মনে হচ্ছে। এক সেকেন্ড, দু’ সেকেন্ড করে সময় যাচ্ছে আর প্রফেসর গাড়ি নিয়ে নিরন্তর চলেছেন সামনে, সামনে, আরো সামনে...
তিনদিন পরের ঘটনা। দেশের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী ও প্রগতিশীল সব ব্যক্তিত্ব, সবাই কম্পিউটারে প্রফেসর শামসুলের ব্লগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। প্রফেসরের গত তিনদিন যাবত লিখে আসা চলমান ব্লগ পড়ার জন্য সবার এই হুড়োহুড়ি। তিনদিন আগে আশিক নামের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষার্থীর অলৌকিকভাবে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার ঘটনার বিশদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ তিনি বিশ্লেষণমূলক যে লেখা লিখে চলেছেন পুরো পৃথিবীর জন্যই এটা অত্যন্ত চমকপ্রদ। প্রত্যক্ষদর্শী যারা দূর থেকে ঘটনাটি দেখেছিলো, তাদের ভাষ্যমতে একই রকম দুই যুবক পরস্পর করমর্দন করামাত্রই বিরাট এক আলোর ঝলকে মিলিয়ে গিয়েছিলো। অতঃপর ঘন্টাখানেকের মধ্যে সাধারণ মানুষ কিংবা পুলিশের যে জটলা তৈরি হয়েছিলো, তারা সবাই মিলে আঁতিপাঁতি করে পুরো জায়গাটা খোঁজার পরও সামান্যতম কোনো চিহ্ন বা তাদের অস্তিত্বের কোনো নিদর্শন পায়নি। প্রফেসর শামসুল ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি এ ঘটনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণসহ ব্যাখ্যা দেন সাংবাদিকদের সামনে এবং ঐদিন রাত থেকেই তিনি ‘অস্তিত্বের বিনাশ’ শিরোনামধারী একটি ব্লগ লিখতে শুরু করেন তার নিজস্ব ব্লগে। এবং এ ব্লগটি নিয়েই গত কয়দিন যাবত মেতে আছে তরুণ-তরুণী, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক। মেতে আছে গোটা দেশ।
চতুর্থ দিন। প্রফেসর শামসুল তার নোটবুক সামনে নিয়ে বিষণ্ন মুখে তাঁর নিজ বারান্দায় বসে ছিলেন। ‘অস্তিত্বের বিনাশ’ নামক ধারাবাহিক ব্লগ লেখাটা মোটামুটি শেষ করলেন। শেষ লেখাটাতে তিনি আশিকের সাথে তার ব্যক্তিগত সখ্যতা, তার কিছু স্মৃতি ও তার মেধার নিদর্শন হিসেবে কয়েকটি ছোটোখাটো ঘটনা উল্লেখ করে ইতি টানার পর্যায়ে চলে এলেন। এমনকি শেষ যেদিন রাত্রে আশিকের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়েছিলো, সেদিন তাদের মধ্যে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো, তারও একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী উপস্থাপন করলেন। লেখা শেষ করে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রফেসরের ভেতরের গভীর থেকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ, নীরব হয়ে নিজের লেখা ব্লগের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর চোখ তুলে দুপুরের পরিষ্কার নীল অনাড়ম্বর আকাশের দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড এরকম নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলেন। অনেক উঁচুতে, আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে বিরাট এক ঈগল। বিশাল ডানা মেলে বিরাট ব্যাসের একেকটা চক্কর কেটে বেড়াচ্ছে পাখিটা। দৃশ্যটা দেখলে মুহূর্তে মনটা কেমন উদাসীন হয়ে যায়। বড় অদ্ভুত এই সৃষ্টিলীলা! আজ যা আছে, কাল তা থাকবে না’ এই নীতির ছন্দে নিয়ত ছন্দিত হচ্ছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিবৈচিত্র্য। হয়তো একটা কিছু কিংবা কোনো একক সত্তা রয়েছেন, যিনি এই নীতির বাইরে অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন, তিনি থাকবেন।
মাথা নামিয়ে নিজের লেখা ব্লগের দিকে আরো এক পলক তাকালেন প্রফেসর শামসুল। তারপর আস্তে আস্তে তার ব্লগের শেষ অনুচ্ছেদটা লিখলেন ‘...এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছু একই রকম থাকবে না, রূপ পাল্টাবে কিংবা বিনাশপ্রাপ্ত হবে। সব, সব কিছুর জন্যই এ নীতি প্রযোজ্য। এ নীতি বহির্ভূত শুধু একজনই। যিনি ছিলেন, থাকবেন।...’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন