শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গল্প >> জলের মাঝে রোদ : অপু চৌধুরী

জলের মাঝে রোদ

অপু চৌধুরী

এক.
মিতা আপার বিয়ের চার মাস পার হয়ে গেছে। নানা কাজের ব্যস্ততায় আমার যাওয়া হয়নি। আজ সকালে তার সিলেটের বাসার কলিং বেল চাপ দেই। একটি মেয়ে দরজা খুলে দেয়।
- মিতা আপু বাসায় আছেন? আমি বলি।
- আছেন। আপনি কোথা থেকে এসেছেন, মেয়েটি বললো।
- হবিগঞ্জ থেকে। আমার নাম আকাশ। মিতা আপুকে বললেই চিনবে।
- আপনি ভিতরে এসে বসেন, খালাম্মাকে ডেকে দিচ্ছি। আমি ড্রইংরুমে প্রবেশ করি। সুন্দর করে সাজানো। মুগ্ধ হয়ে দেখছি। পাশের রূম থেকে ভেসে আসা মিতা আপার কণ্ঠে মুগ্ধতার জাল ছিঁড়ে, এই আকাশ, ভেতরে চলে আয়।
বেডরূমে গিয়ে বেতের মোড়াতে বসি। এখনো বিছানা ছাড়েননি মিতা আপা। শুয়ে শুয়েই আমার দিকে তাকান। হাসেন, মাদকতাময় সেই হাসি, কেমন আছিস রে। কবে সিলেট এলি?
- ভালো আছি। গতকাল এসেছিলাম, তোমার সাথে দেখা করবো বলেই থাকলাম। 
- ভালো করেছিস। আজ এখানে থাকবি। অনেক কথা জমে আছে। 
- ঠিক আছে মিতা আপু, থাকবো সারাদিন তোমার সাথেই। 
- সেদিন কোন একটা পত্রিকায় তোর একটা গল্প পড়লাম। এখন আর কবিতা লিখিস না?
- খুব একটা লেখা হয় না। ঠাট্টার সুরে বলি, তোমার বিয়ের পর বিরহে ছেড়ে দিয়েছি বলতে পারো। যদি পরকীয়া করতে রাজি হও তবে হয়তো আবার শুরু করবো। 
ঘর ফাটিয়ে হাসেন মিতা আপা। হাসি থামলে বলেন, তুই এখনও সেই আগের মতোই আছিস। এবার পাল্টা রসিকতা করেন মিতা আপু, মাহবুবকে তো চিনিস না। ওর বউয়ের সাথে কেউ প্রেম করলে একেবারে খুন করে ফেলবে। এবার আমি হাসি ঘর ফাটিয়ে। 
- মাহবুব ভাই কোথায়? আমি বলি। 
- ব্যবসার কাজে আজ ভোরে ঢাকায় গেছে।
ইতোমধ্যে বিছানা ছেড়েছেন মিতা আপা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে এলোমেলো চুল ঠিক করে নেন। রাতের পোশাক পরা মিতা আপাকে শাদা পরীর মতো সুন্দর লাগছিলো। আমি মুগ্ধ হয়ে মিতা আপার দিকে তাকিয়ে আছি।
- কীরে এমন করে তাকিয়ে কী দেখছিস। মিতা আপা বলে। 
- তুমি আরো সুন্দর হয়েছো মিতা আপু। আমি বলি। ইচ্ছে হচ্ছে তোমার সাথে প্রেম করি। আমার এই কথা শুনে মিতা আপা হাসেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে এসে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেন। আমাকে আরো ঘনিষ্ঠ করে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তার সুগঠিত বুক আমার শরীরে চাপ দেয়। আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। তার শরীরের মিষ্টি গন্ধে আমার মন মাতাল হয়ে পড়ে। মিতা আপা কিছুক্ষণ পর আমার দেহটাকে তার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে দেন। হতভম্ব আমি মিতা আপার মুখের দিকে তাকাই। মিতা আপা হা-হা করে হাসেন। 
- আকাশ, তোর সাথে একটু মজা করলাম। তুই সত্যিই আমাকে ভালোবাসিস। তোর কোনো মতলব থাকলে তোকে জড়িয়ে ধরেই আমি টের পেতাম। 
- আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি কী সব পাগলামি শুরু করে দিয়েছিলে। 
হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েন মিতা আপা, তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। একসাথে নাস্তা করবো। 

দুই.
অনেক দিন পর মিতা আপার হাতের রান্না খেলাম। সাতকরা আর মাংস ভুনা খুব ভাল রাঁধেন তিনি। মিতা আপার বেডরুমে বসে আবারো দুজনের আড্ডা জমে উঠে। মিতা আপা যেনো কথার ডালি নিয়ে বসেছেন। একসময় আমি তারেক ভাইয়ের কথা বলতেই ছন্দপতন ঘটে। মিতা আপা নীরব থাকেন। আমি বুঝতে পারি না বিরক্ত হলেন কিনা। আবার কথার সূতো ধরি, সুমি আপা সেদিন বলছিলেন...
কথা কেড়ে নেন মিতা আপা, সুমি কী বলেছে তোকে। 
- বলেছে তুমি নাকি তারেক ভাইকে কোনোাদিনই ভালোবাসোনি। ভালোবাসলে তারেক ভাইকেই বিয়ে করতে। তুমি নাকি প্র্যাকটিক্যাল, তারেক ভাই তোমার শখ মিটাতে পারবে না বুঝতে পেরেই হুট করে মাহবুব ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়েছো। 
- সুমির দোষ নেই রে। নিজের কলেজের সহপাঠীর পক্ষ নেন মিতা আপা। বাইরে থেকে যে কেউই এমনটি ভাববে। 
- কী এমন হয়েছিলো মিতা আপু। আমার কণ্ঠে আগ্রহ।
- কী হবে আর এসব শোনে? মিতা আপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। কিছুটা সময় নীরবেই কাটে আমাদের। 
- বলো না মিতা আপু। নীরবতা ভাঙি আমি।
-  তোকে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। মিতা আপা ফিরে যান পেছনে। তুই তো জানিস বাবা আমাদের লন্ডনে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছিলেন। সব প্রায় গুছিয়েও এনেছিলেন। হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেলেন তিনি। লাশটাও দেশে আসেনি। আমাদের লন্ডন যাবার স্বপ্নেরও ইতি ঘটে। জীবন বাঁচাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন মা। পরিবারের বড় মেয়ে আমাকে নিয়ে মার যতো চিন্তা। বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। এমনই এক সময়ে ছুটে গিয়েছিলাম তারেকের কাছে। কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে মিতা আপার। ধরা গলায় বলেন, থাক আকাশ, এসব পুরনো দিনের কথা শুনে আর কী হবে।
- বলো না মিতা আপু। আমি জেদ ছাড়ি না। 
- লাক্কাতুরা চা বাগানে দেখা করি আমরা। আবার বলতে শুরু করেন মিতা আপা। বাগানের মাঝে আমি আর তারেক পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসেছিলাম। আমার হাতটা তারেকের মুঠোয়। আমি তাকে পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করে বিয়ে করতে বলি। আমার মনে হলো হঠাৎ যেনো তারেকের মুঠো আলগা হয়ে গেলো। তারেক তখন কী বলেছিলো জানিস? হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে বসেন মিতা আপা। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলতে থাকেন, তারেক বললো, ওর খালাতো বোনের সাথে ওর মা নাকি বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছেন। কিছুতেই নাকি এড়ানো যাবে না। শুনে আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। তারেক নানা কথায় সান্ত¦না দিতে থাকে। এক ফাঁকে জানা হয় তারেকের খালাতো বোনটি লন্ডনপ্রবাসী। বুঝে নিই আমি আসল কারণ। চোখ মুছে উঠে পড়ি। সেদিনই তারেকের সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিলো, শেষ দেখাও। থামেন মিতা আপা, তার চোখ জল ছলছলে। তবে যেনো তার মাঝেও রোদ দেখি আমি। যে রোদ এখন তার ঘরভরে খেলা করছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন