বিচ্ছেদ
ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত
রাত ন’টা বাজে প্রায়। নভেম্বরের শেষ, ক’দিন ধরে রাতের দিকে ঠাণ্ডাটা বেশ ভালোই পড়ছে। তার মধ্যে অসময়ের বৃষ্টি, সেই সন্ধ্যে থেকে ঝিরঝির করে পড়েই চলেছে একঘেঁয়েভাবে। অফিস থেকে বেরোতে আজ বেশ রাত হয়ে গেলো। শীতকালে এমনিতেই রাস্তাঘাট যেনো একটু তাড়াতাড়িই ফাঁকা হয়ে যায়, তার ওপর এই বৃষ্টি। বন্ধ দোকানের সরু শেডটার নিচে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য ওয়েট করতে করতে হাতঘড়ির দিকে তাকালো রুমি। বাবাইয়ের জ্বরটা আজ বিকেল থেকে আবার বেড়েছে, একটু আগেই ফোন করে জানাল মা। ভালো লাগছে না, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। একদিকে অফিসে কাজের চাপ, অন্যদিকে সংসারের হাজারটা ঝক্কি, তার ওপর ক’দিন ধরে দুপুরের পর থেকে বাবাইয়ের একটা ঘুসঘুসে জ্বর আসছে। মন-মেজাজ একদম ভালো নেই রুমির। ২০ মিনিট ধরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একটাও বাসের দেখা নেই, ট্যাক্সিও নেই একটাও। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো রুমি। হঠাৎ করে একটা গাড়ি এসে সামনে দাঁড়াতে চমকে তাকালো। পরিচিত একটা মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে, অনেক অনেক দিন পরে, ‘উঠে এসো রুমি, নামিয়ে দিচ্ছি।’ অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠে রুমি বলে ফেললো, ‘থ্যাঙ্কস, এখুনি বাস চলে আসবে।’ পরিচিত মুখটা কিছুক্ষণের জন্য নীরব, রুমির দৃঢ়তায় কিছুটা থমকে গেলো হয়তো। পরক্ষণেই গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো গোটা শরীরটা। ফুটপাথে উঠে এসে সটান রুমির সামনে, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে, জায়গাটাও ভালো না, আমি তো ওদিকেই যাচ্ছি। উঠে এসো, নামিয়ে দিচ্ছি।’ এবার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত রুমি। এতো সহজ একটা প্রস্তাবে মুখের ওপর ‘না’ বলতে কেমন যেনো অসুবিধা হলো। সম্পর্ক না থাকলেও অর্ক পূর্বপরিচিত তো বটে, আর কোনো তিক্ততাও তো অবশিষ্ট নেই এখন। এখান থেকে বাড়ি যেতে বড়জোর আধ ঘণ্টা, একদিন একসাথে এইটুকু রাস্তা যাওয়া যেতেই পারে। অর্ক বোধহয় টের পেয়ে গেছে রুমির মনের দোলাচল, সেটা কাটানোর জন্যই আবার বলে উঠলো, ‘প্লিজ উঠে এসো।’ আর না করার অবকাশ পেলো না রুমি, অর্ক গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে উঠে বসলো রুমি, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো আবার।
একটা একটা করে ক্রসিং পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। রাস্তা আজ বেশ ফাঁকা। হাতঘড়ির দিকে তাকালো রুমি, ৯.১৫ বাজে, আর ২০ মিনিট মতো লাগবে বোধহয়। গাড়ির ভেতরটা ভালো করে দেখলো রুমি, আগের সেই স্যান্ট্রোটাই, কভারগুলো শুধু পাল্টানো হয়েছে, বাকি সব আগের মতোই আছে। ওরা দু’জন একসাথেই তো নিয়ে এসেছিলো গাড়িটা, সেদিন রাতে বাবাইকে নিয়ে বাইরে খাওয়াদাওয়া করে ‘সেলিব্রেট’ করা হয়েছিলো দিনটা। হঠাৎ করে এতোদিন পরে দিনটা মনে পড়ার কোনো মানেই হয় না। তবু, অনেক কিছুই তো নিয়মের বাইরেও হয়ে যায় অনেক সময়ে।
অর্কই প্রথম কথা বললো,‘কেমন আছো?’
-‘এই চলে যাচ্ছে। তোমার খবর কী।’
-‘খারাপ কী, ভালোই আছি। বাবাই কেমন আছে?’
একটু ভেবে নিলো রুমি, বাবাইয়ের জ্বরের খবরটা জানাবে কি? না! কী দরকার। কী করবে জেনে! ছেলের জন্য উতলা হওয়ার মতো বাবা তো অর্ক কোনোকালেই ছিলো না। ছোট উত্তর দিলো রুমি, ‘ভালোই আছে।’
আবার নৈঃশব্দ। গাড়ির চার দেওয়ালের ঘেরাটোপের মধ্যে এই নৈঃশব্দ বড়ই অস্বস্তিকর। তার চেয়ে সাধারণ কথাবার্তা চলতে থাকলে সময়টা একটু তাড়াতাড়ি কাটে। রুমিই কথা বললো আবার, ‘এখনও ওই ফ্ল্যাটেই আছো, না কি পাল্টেছো?’
‘নাহ, ওখানেই তো আছি, দেখি বাইরে যাওয়ার কথা চলছে। যদি যেতে হয় তাহলে এখানকার পাট উঠিয়ে একেবারেই চলে যাব।’
-‘কোথায়?’
-‘দিল্লি।’
-‘তোমার মা’কেও নিয়ে যাবে তাহলে।’ ‘তোমার মা’ কথাটা বলেই বড্ড কানে লাগলো রুমির নিজেরই। একটা সম্পর্কের সাথে অন্য সম্পর্কগুলোও কি এভাবে শেষ হয়ে যায়! এও কি কখনও সম্ভব! তাড়াতাড়ি বলে উঠলো রুমি, -‘মা কেমন আছেন?’
অর্ক কোনো কথা বলছে না দেখে ফিরে তাকালো রুমি।
-‘মা আর নেই রুমি।’
কথাটা ঠিক বোধগম্য হলো না রুমির। একইভাবে তাকিয়ে রইলো অর্কর দিকে। অর্ক আবার বললো, ‘সেপ্টেম্বর মাসে। হার্টের অবস্থা ভালো ছিলো না তো এমনিতেই, তার ওপর অনিয়ম তো করতোই।’
এবার বোধহয় কথাটা কান পেরিয়ে মাথার স্নায়ু অবধি পৌঁছলো, সাথে সাথে অবশ হয়ে এলো সারা শরীর। এলোমেলো কিছু স্মৃতি ভিড় করে এলো ক্রমশ। নিঃসঙ্গ মানুষটা বড় বেশি নির্ভর করে ফেলেছিলো রুমির ওপর। রুমির জীবনেও কি মানুষটার গুরুত্ব কম ছিলো! পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে সেই মানুষটাই তো ছিলো রুমির সব থেকে কাছের। অথচ, ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর গত দু’ বছরে একবারের জন্যও তো রুমি ওনার সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কষ্ট আর নিজের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে। এতোদিন পর একটা চাপা কষ্ট অনুভুত হলো চলে যাওয়া মানুষটার জন্য। অজান্তেই চোখ ভিজে এলো, ভেজা গলায় বললো রুমি, -‘একটা খবর দিলে না!’ অর্ক কিছুটা অপ্রস্তুত। -‘না, মানে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি রুমি। তোমাকে খবর দেওয়া উচিত ছিলো নিশ্চয়ই।’ কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত, এই মুহূর্তে সেই হিসাব মেলাতে পারলো না রুমি। এতোদিন ধরে মানুষটাকে ভুলে থাকাটা কি উচিত ছিলো রুমির! নাকি, এতোদিন পরে গলার কাছে জমে থাকা কষ্টের ডেলাটা উপড়ে ফেলতে না পারাটা উচিত! সব কিছু কেমন যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো রুমি। বন্ধ চোখেও অনুভব করলো রুমি, অর্কর দৃষ্টি ওর শরীর ছুঁয়ে আছে। কষ্টের মধ্যেও একটা হালকা সুখানুভুতি টের পেলো রুমি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। চোখ খুলে দৃষ্টি স্থির জানলার বাইরে। সহজভাবে জিজ্ঞেস করলো, -‘কবে যাচ্ছো দিল্লি?’
-‘বোধহয় মার্চ-এপ্রিল নাগাদ। এখনো ঠিক হয়নি কিছু।’
-‘আগের অফিসেই আছো?’
-‘হ্যাঁ, ওখানেই।’
টুকটাক কথাবার্তার মধ্যেই গাড়ি পৌছে গেলো গলির মুখটায়। নেমে দাঁড়ালো রুমি, জানলায় কিছুটা ঝুঁকে বললো-‘অনেক ধন্যবাদ, আজ ফিরতে সত্যি খুব অসুবিধা হতো।’
-‘মা তোমার কথা প্রায়ই বলতেন রুমি।’
-‘হ্যাঁ, উনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন।’
কিছুক্ষণের নিঃশব্দ উপস্থিতি। রুমিই আবার বললো, -‘চলি তাহলে।’
-‘হ্যাঁ, এসো।’
ফিরে দাঁড়ালো রুমি। অন্ধকার গলিপথে পা বাড়াতেই আবার পিছুটান, -‘রুমি!’
সারা শরীর কেঁপে উঠলো মুহূর্তের জন্য। এই গলার স্বরটা বড় বেশি চেনা রুমির। স্থির চোখে তাকালো রুমি, অর্ক তাকিয়ে আছে রুমির দিকে, কেমন অসহায় একটা দৃষ্টি যেনো। নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুটা জোর দিয়েই বললো রুমি, -‘ভালো থেকো।’
অন্ধকার গলিপথে মিশে যেতে যেতে বারবার পিছিয়ে পড়ছিলো রুমি দু’বছর আগের ফেলে আসা সময়ের কাছে। তবু, গলিপথটা শেষ করে বাড়ির গেটের সামনে আসতেই হলো, আবার প্রবেশ করতে হলো বর্তমানে।
বাবাইকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে মা। জ্বরটা আগের থেকে একটু কম। রুমি বাথরুম থেকে ঘুরে এলে একসাথে খেতে বসলো দু’জনে। আজকের ঘটনাটা বলবে ভেবেও আর বলা হয়ে উঠলো না। কী দরকার শুধু শুধু পুরোনো কথা টেনে আনার। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে এলো রুমি, ছেলে ঘুমুচ্ছে অঘোরে। গায়ের চাদরটা ভালো করে টেনে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। শীতের রাত বড় বেশি নিস্তব্ধ। পাশের বাড়ি থেকে এগারোটার ঘণ্টাধ্বনি কানে এলো। আবার নিঃশব্দ চারিদিক। আজকের দিনটা শেষ হতে আর এক ঘণ্টা বাকি। কাল থেকে আবার সেই রুটিনমাফিক একঘেঁয়ে চলমানতা। টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসছে ক্রমশ। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনের নানান সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার অনুভুতি যেনো নতুন করে স্পর্শ করে যাচ্ছে মনকে। প্রায় ভুলে যাওয়া দিনগুলো আবার ফিরে আসছে নতুনভাবে, অবাক হয়ে ভাবলো রুমি, স্মৃতিগুলোতে তো মরচে ধরেনি এতোটুকুও। অথচ, গত দু’বছরে কী আপ্রাণ চেষ্টা করেছে রুমি সবকিছু ভুলে থাকার।
ভুলে তো ছিলোই সবকিছু। অথচ, আজকের এই একটা দিন যেনো এক লহমায় সব ভুলে যাওয়াগুলোকেই ভুলিয়ে দিলো। অর্কর সাথে দেখা হওয়াটাই কি ভুল ছিলো তবে! নাকি, গত দু’ বছরের বেঁচে থাকাটাই ভুল! আবার সব কিছু ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে। অর্ক যদি দিল্লি চলে যায়, তবে হয়তো আর কোনোদিনও দেখাই হবে না রুমির সাথে। একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা জমাট বেঁধে আছে মনে। দু’বছর পরে হঠাৎ এই মন খারাপ তো নভেম্বরের এই অসময় বৃষ্টির মতোই অপ্রত্যাশিত। অসময়ে ভুল মানুষের সাথে দেখা হওয়ারও তো প্রয়োজন ছিলো না কোনো। আবার দোলাচল। কোনটা অসময়! সাত বছর আগের সময়টা, নাকি আজকের দিনটা! আর, কোন মানুষটা ভুল! দু’বছর আগের চলে যাওয়া মানুষটা, নাকি আজকের নিরব অসহায়তা!
রাত বেড়ে চলেছে, সাথে প্রকৃতির শীতলতাও। শাল গায়ে জড়িয়েও বেশ ঠাণ্ডা লাগছে রুমির। বারান্দার দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো বাবাই-এর পাশে। মনটা আজ বড় অস্থির। একগাদা টুকরো টুকরো স্মৃতি ভিড় করে আসছে চোখের সামনে। গত দু’টো বছরকে পিছনে ফেলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তারও আগের পাঁচটা বছর, অথবা, আরও অনেক অনেক আগের সেই কলেজ জীবনের দিনগুলো, অর্কর সাথে প্রথম আলাপের দিনটা বা প্রথম আত্মসমর্পণ! কোনো স্মৃতিই যে অমলিন হয়নি এতোটুকু। কাগজের একটা সই কি সত্যিই বদলে দিতে পারে একটা গোটা সম্পর্ক, অথবা, দুটো মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েনকে! অবাক হয়ে দেখলো রুমি, ঠিক ভুলের সমস্ত হিসেব তছনছ করে দিয়ে তার চোখের সামনে একমাত্র সত্য হয়ে রয়েছে আজকের সেই অসহায় দৃষ্টিটাই।
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন