মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গল্প >> খাঁচা : আবদুল হাই মিনার

খাঁচা

আবদুল হাই মিনার

গরমপানির কাছাকাছি আসতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর।
জলপাইগুড়ির রাস্তাগুলো এদিকে ততো সুবিধের না। পাহাড়ের ঢালে আর টিলার কোলের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা উঁচু-নীচু রাস্তা। ঝাঁকুনিতে  গাড়ির  যেমন  জান  বেরিয়ে  যাওয়ার  জোগাড়,  তেমনি মানুষেরও। মাঝখানে কতোগুলো চা-বাগান পড়েছিল পথের মাঝে। অইটুকু পথে ওদের গাড়ি   যেন উড়ছিল। খুব ভালো লেগেছিল জায়গাটা পেরোতে। নিশ্চয় চা-বাগানের বাবু সাহেব আর শ্রমিকরা খুব যতœ-আত্তি করে সড়কগুলোর! ফেব্রুয়ারির এই ঝলমলে সকালে বুবুনরা যখন শিলিগুড়ির ঝুমরাতি থেকে রওনা দিয়েছিল বাতাসে তখনো হিমের ভাব মিলোয়নি। এদিককার লোকজন শীতকে বলে জাড়। তো, রাস্তায় জাড়ের একটুও কমতি ছিল না সকাল দশটা পর্যন্ত। শিরীষ-মেডেলা আর চাপালিশের গায়ে কুয়াশার চাদর লেপ্টে ছিল সিগারেটের ধোঁয়ার মত। বানর আর হনুমানের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো খেলছিল রাস্তÍার ওপর। কেমন দুষ্টু একেকটা! মানুষজন বা গাড়ি-ঘোড়াকে যেন তাদের মোটেই ভয় নেই। বরং বুবুন আর সোনমকে ভেঙাচ্ছিল তাচ্ছিল্যভরে। দুপুর গড়ানোর আগেই সব কিছু বদলে গেল। ওম ওম গরম বাতাস বইতে লাগল বনের মাথার ওপর দিয়ে। ছোট ছোট জঙ্গলি জন্তু-জানোয়ারের জায়গায় বুনো হাতি আর মোষের দেখা মিলতে লাগল পথের ধারের বনে আর নালা-ঝরণার কিনারগুলোয়। আরো কত দূর যাওয়ার পর পাতার ফাঁকে ফাঁকে লোকজনের বসতবাটিও চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। শন-ছাওয়া মাটির কুটির। গরু-ছাগল আর ভেড়া নিয়ে রাখালছেলে মাঠে বেরিয়েছে। লাল মাটির পথে মানুষের যাতায়াতও চোখে পড়ার মত। ছোট্টো একটি মেয়ে পাহাড়ের ঢালের টলটলে জলের ঝরণায় হাতমুখ ধুচ্ছে।
বুবুনের বাবা বললেন,- ‘এ’টা হল গিয়ে পশ্চিম দিনাজপুর। আধঘণ্টা আগে আমরা শিলিগুড়ি পেরিয়ে এসেছি। আর, ওই যে, ওই পূবদিকে দেখ, ফাঁসিদেয়া, ওটা বাংলাদেশ। ওই যে           বর্ডার!’
বুবুন আর সোনম গাড়ির কাঁচ নামিয়ে পূবের দিকে তাকাল। কতগুলো ঘর-বাড়ি দেখা গেল। আর সেগুনের বন। রাস্তাটা ধূলায় ধূলাক্কার!
মা বললেন,- ‘ওফ্, ধূলার জ্বালায় বাঁচি না! কাঁচ তোল্, আমার চোখ জ্বালা করছে।’
ওরা তাড়াতাড়ি কাঁচ উঠিয়ে নিল। বাংলাদেশ দেখা হল না ভাল করে।

দু’দিনের কড়ারে বাবাসহ বুবুনের মায়ের বাপের বাড়ি বিধাননগর যাচ্ছে ওরা। একদিন আগে ওরা ছিল দার্জিলিং। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে কার্সিয়ং পাংখাবাড়ি হয়ে শিলিগুড়ি এসে পৌঁছেছিল। রাত্রিবাস গার্গীকাকী আর সেজকাকুর জাঙ্গল-কাটেজে। রাত্তিরে মুগডালের খিঁচুড়ির সাথে হরিয়ালের রোস্ট, আর ভেড়ার মাংসের ভুনা দেয়া হয়েছিল খাবার টেবিলে। বুবুনের মা বললেন,- ‘ভেড়ার মাংস না ছাই, আসলে-’ তারপরই গার্গীকাকীর চোখ টেপায় চুপ করে গেছিলেন। বুবুন সোনমরা বুঝতে পেরেছিল আসলে হরিণের মাংসই খাওয়া হচ্ছে। আইনের মানুষ তাদের বাবাও আইন অমান্য করে আগ্রহভরে সেই মহার্ঘ মাংস খেয়ে চলেছিলেন।

একটু পরেই ওরা দেখে কী, রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে।
বুবুনদের গাড়ি আগে আগে চলছিল। পেছনে আসছিল ওদেরকে এস্কর্ট করে আসা পুলিশের পিকআপ ভ্যান।
গাড়ি বাঁয়ের সড়কে পড়তেই পেছন থেকে ড্রাইভারকে জানান হল ওটা সঠিক পথ নয়। ডানের সড়কে চল।
গাড়ি পিছিয়ে এসে আবার ডান দিকে চলতে লাগল।
কতদূর যাওয়ার পর এক অদ্ভুত দৃশ্য ওদের চোখে পড়ল।
সার বেঁধে একদল লোক কোথায় যেন চলেছে। অসংখ্য লোক।
মা বললেন,- ‘পিঁপড়ের সারি!’
‘সামনেই মেলা-টেলা আছে বোধহয়।’ বাবা বললেন।
কিন্তু আরো অনেকদুর আসার পরও কোন মেলা বা সভা সমাবেশের পাত্তা পাওয়া গেল না! লোকগুলো চলেছে তো চলেছেই, থামাথামির নাম নেই।
ওদের যেন বিরামহীন পথ-চলা!
ওরা কোথাও থামবে না, ওদের ক্লান্তি নেই। পৃথিবীটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখানে গিয়ে বুঝি ওদের পথ-চলা থামবে।
বাবা ভারি অবাক হয়েছেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে আছে।
মা বললেন,- ‘চলেছে কোথায় ওরা, আশ্চর্য তো!’
‘গাড়ি থামিয়ে একটু খোঁজ নেয়া যায় না?’ বুবুন বলল।
ড্রাইভার একটুকু ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাল। গাড়ি থামাবে কি না, তারই অনুমোদন- প্রতীক্ষা।
বাবা বললেন- ‘হ্যাঁ, গাড়ি থামাও। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস কর!’
জিজ্ঞেস করায় জানা গেল, চলেছে ওরা আব্বাস আদমের ডেরায়, খাঁচা দেখতে।
‘খাঁচা!’ বাবার চোখ কপালে উঠল।
মা বললেন- ‘খাঁচা দেখতে এ’ভাবে সার বেঁধে, পাগল নাকি! কিসের খাঁচা!’
কিন্তু লোকগুলো আর কিছুই বলছে না, জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে ছুটছে তারা আঙরাবাড়ির দিকে। সেখানেই আব্বাস আদমের ডেরা।
বাবা ড্রাইভারকে আরেকটু তথ্য-তালাবি করতে বললেন। ড্রাইভার অনিন্দ্য সুর আসামের গোয়ালপাড়ার মানুষ, এদিককার ধুর-ধার বোঝে ভাল। অনেক ঝুলাঝুলি করল লোকগুলোর সাথে, কিন্তু নূতন আর কোন তথ্য ওদের কাছ থেকে আদায় করতে পারল না।
‘আঙরাবাড়িটা কোথায় জানা যাক।’ বাবা বললেন। ‘কাছাকাছি হলে একটা চক্কর মেরে আসা যাবে। কি অদ্ভুত কা-, খাঁচা দেখতে মানুষ এ’ভাবে ছুটতে পারে ভাবা-ই যায় না!’
মাও চোখ কপালে তোলে বললেন,- ‘কি অশৈলী কা-!’
বুবুন আর সোনমের পোয়াবারো। মাঝপথে একটু থামা যাবে, হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খাওয়াও চলতে পারে। আরো কত মজা যে পথের মাঝে লুকিয়ে আছে কে জানে।
গাড়ি এবার চলল আঙরাবাড়ির পথে। মাত্র একটুখানি পথ। মিনিট দশেকের মাথায় গাড়িটা হড় হড় করে নেমে এলো একটা নাবাল মত জায়গায়।
সামনেই সারি সারি ঘর। বিরাট গাঁও। লোকজনে থিক থিক করছে। খাঁচা-দেখতে-আসা তামশগির জনতার ভিড়ে গ্রামটা নরক।
মা নাক সিঁটকে বললেন- ‘এম্মা, এ’ কোথায় নিয়ে এলে গো!’
বাবা কিছু না বলে গাড়ি থেকে নামলেন। তাঁর চোখেমুখে অঘোর বিস্ময়! বুবুন আর সোনমও নামল। ড্রাইভার অনিন্দ্য ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ওদের গাড়ির পেছনে ততক্ষণে পুলিশের পিকআপ ভ্যানখানাও এসে থেমেছে। তামশগীর জনতা পুলিশ দেখে একটু যেন ভয় পেয়েছে। তাদের হৈ-হল্লা থেমেছে।
গাঁয়ের পথে একটুখানি এগিয়ে যেতেই বেশ ফাঁকা একটি জায়গা চোখে পড়ল। সেই ফাঁকা জায়গা ঘিরে সার বেঁধে তামশগির মানুষের ভিড়। এখানে এই মানুষগুলো নিস্তব্ধ। চুপচাপ তারা অবাকবিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরী অর্ধসমাপ্ত বে-ধারা ধরনের বিশাল এক     খাঁচার দিকে। অন্তত শ’ চারেক হাত দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বেড় দিয়ে খাঁচাটা আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। মুরগির খাঁচা! আব্বাস আদম ও তার বউ-ছেলেমেয়েরা আড়াইমাস ধরে খাঁচাটা বানাচ্ছে।
আব্বাসের বউ, আর আব্বাস নিজে, আর, তার ছেলেমেয়েরা একটুকু খচ্চর। নোংরা থাকে, খাওয়া-দাওয়ারও বাছ-বিচার নেই। মোরগ পোষে। প্রথমে অল্প ক’টা মোরগ নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। দেশি মোরগ। পরে টার্কি সাওতি মোরগে ঘর ভরে গেল। এ’গুলোর স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে উঠল। পাড়ায় গ্রামে লোকজনের ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়তে লাগল মোরগগুলো। লোকজন অতিষ্ট হয়ে উঠল। পাড়া-পড়শির সব্জিবাগান, ফুলবাগান আর বসতঘরের ভেতরেও তাদের অবাধ যাতায়াত! উচিত ছিল আব্বাসের তাৎক্ষণিকভাবে মুরগির সংখ্যা কমিয়ে আনা! তা’ না করে হারামজাদা মুরগি আরো বাড়িয়ে চলল।
মুরগির উৎপাতে পড়শিরা বে-ক্বারার! এ’ নিয়ে হাজারো নালিশ-ফরিয়াদ আর কাজিয়া ফসাদ হয়ে গেছে আগে। সালিশ বসেছে শতবার। শেষে বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্তটা নিতে হল আব্বাসকে। একটা বিশাল খাঁচা বানাবে সে। সবগুলো মুরগিকে সেই খাঁচায় ভরে ফেলবে। খাঁচার ভেতরেই তাদের খাওয়া-দাওয়া, হাগু-মুতু, জন্ম-মৃত্যু চলবে।
হিসেবটা মাথায় রেখে ডিসেম্বরের এক বিষণœ সকালে বউকে সাথে নিয়ে খাঁচার কাজ শুরু করেছিল আব্বাস আদম। সেই খাঁচা এখন প্রায় তৈরী।

বুবুনের বাবা একটু দূরে দাঁড়িয়ে খাঁচা বানানো দেখছিলেন। ঠিক যে দেখছিলেন তা’ অবশ্যি নয়। তিনি তখন অন্যমনস্ক। আইডিয়াটা তাঁর মাথায় পিন ফোটাচ্ছে। সংখ্যায় বেড়ে গেলে এ’ভাবেই তো মুরগিগুলোকে খাঁচায় ভরে ফেলতে হয়। তা’ হলে?
চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলের এতটুকুন এক দেশ, তার জনসংখ্যা দেখ!
বুবুনের বাবা প্রতিবেশী বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবনায় বুঁদ হয়ে গেছেন তখন।
এই ঊনিশ শ’ নব্বুইতেই যদি বারো কোটি মানুষে ভরে যায় দেশ তা’হলে আরো পঁচিশ বছর পর কী হবে? বিশ কোটি! তাঁর মাথা ঝিম্ ঝিম্ করতে লাগল। ভয়ঙ্কর ! মহা ভয়ঙ্কর! ভারতের জন্য মোটেও ভাল খবর নয় এটি। এখন রোজদিনই শত শত বাংলাদেশি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ছে। পঁচিশ বছর পর অবস্থা কি দাঁড়াবে! যখন তাদের জনসংখ্যা বিশ কোটির ওপরে উঠবে?
আব্বাস আদমকে হাত ইশারায় ডাক দিলেন তিনি।
আদম ইতস্ততঃ করছিল, আসবে কি আসবে না। সময় নষ্ট করার সময় তার হাতে নেই। একজন অতি উৎসাহি তামশগির দৌড়ে গিয়ে তার কানে কানে কী বলল। আব্বাস যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হল। এক লাফে খাঁচা থেকে নেমে দৌড়ে বুবুনের বাবার কাছে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ালো।
বুবুনের বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের সরাষ্ট্র সচিব, সেটি ততোক্ষণে চাউর হয়ে গেছে। সবাই সমীহভরে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে।
‘খাঁচার পুরোটাই বন্ধ করে দেবে নাকি?’ আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘ওপরের দিকে একটুকু খোলা থাকবে।’ হাত কচলে জানালো আব্বাস।
‘বেঁচা-বিক্রির জন্য মুরগি ধরে আনতে অইটুকু খোলা রাখতে হয়।’
‘যদি উড়ে যায়?’
‘গেলে যাবে, তার আর চারা নেই, সাহেব।’
বুবুনের বাবা নির্নিমেষ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, শেষে ছোট্টো একটা শ্বাস     ফেললেন।
‘তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আব্বাস, অসংখ্য ধন্যবাদ।’ তিনি আব্বাসের হাত আঁকড়ে ধরলেন। তাঁর চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার চিহ্ন।
আব্বাস আদম হতবাক। এ’ ভদ্রলোক এ’ রকম করছেন কেন! সে তো তাঁর কোন উপকারই করেনি! বলল-
‘সাহেব, আমি তো আপনার কোন উপকারই করলাম না, তবে কেন ধন্যবাদ দিচ্ছেন?’
‘তুমি জানো না আব্বাস, শুধু আমার নয়, তুমি সারা ভারতের বিরাট উপকার করেছো, বিরাট উপকার, ওহ্- ’
তিনি উত্তেজিত স্বরে ড্রাইভার অনিন্দ্যকে গাড়ি ঘোরাতে বললেন।

গাড়ি বিধাননগরের দিকে চলছিল, বললেন,- ‘বিধাননগর নয়, বাগ-ডোগরা এয়ারপোর্ট। দু’ ঘন্টায় বাগ-ডোগরা পৌছাতে হবে। গরুঢ়ের ফ্লাইটটি তা’হলে ধরতে পারব।’

রাত্রেই দিল্লী পৌছে গেছিলেন বুবুনের বাবা।
জরুরী ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি মিটিং ডাকলেন তিনি।
বিশাল এক খাঁচা তৈরীর জন্যে এ’ মিটিং! বাংলাদেশের চারদিক ঘিরে কাঁটাতারের খাঁচা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন