কাজী ইমদাদুল হকের সাংবাদিকতা
সৌমিত্র দেব
কালজয়ী কথাশিল্পী কাজী ইমদাদুল হক লেখক হিসেবে যশস্বী হয়েছিলেন। শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন কর্মবীর। তবে তিনি যে একজন সাংবাদিক ছিলেন, যুক্ত ছিলেন সাময়িকী সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে সে ব্যাপারটি কিছুটা কম আলোচিত। এই লেখায় সেই বিষয়েই কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার জীবনীকার মোহাম্মদ আবদুল কাইউম বলেছেন; ‘কাজী ইমদাদুল হক মুসলমানদের মধ্যে প্রথম শিক্ষক ও শিক্ষা বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের গৌরব অর্জন করেন। শিক্ষক পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন যে, সমাজ ও সাহিত্যের সেবায় সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।’
বাংলা ১৩২৭ সালের বৈশাখ (ইংরেজি ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে) প্রথম প্রকাশিত হয় শিক্ষক পত্রিকাটি। মাসিক এই পত্রিকা চলেছে তিন বছর। সম্পাদক হিসেবে তিনি তাতে তার নিজের যে সকল রচনা পত্রস্থ করেন তাতে রয়েছে শিক্ষা বিকিরণ বিষয়ে তার ঔৎসুক্য ও উদ্ভাবনার সুনিপুণ পরিচয়। পত্রিকাটি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার আগে জেনে নেই সাংবাদিকতা কী। সব সাময়িকীর সম্পাদককেই সাংবাদিক বলা যায় কি না। এমনিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানবীয় যোগাযোগকেই সাধারণত সাংবাদিকতা বলা হয়। অক্সফোর্ড অভিধানে বলা হয়েছে একটি সরকারি সাময়িকী সম্পাদনা ও লেখার মাধ্যমে যিনি জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনিই সাংবাদিক। আক্ষরিক অর্থে এ কথা মেনে নিলে কাজী ইমদাদুল হককে সাংবাদিক বলা যায় না। কারণ তিনি সরকারি সাময়িকী সম্পাদনা করেননি। অথবা সম্পাদনা বা লেখার মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহও করতেন না। তবে ইংরেজি জার্নাল শব্দের মানে কোনো কিছু প্রকাশ করা। এর অর্থ দিনপঞ্জি। আর ইজম অর্থ অনুশীলন বা চর্চা। এ অর্থে জার্নালিজম বা সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় দিনপঞ্জি অনুশীলন। সেক্ষেত্রে কাজী ইমদাদুল হককে হতে হয় স্বাধীন এবং স্বাধীনচেতা। সেই গুণটি তার ছিলো। নিরপেক্ষতা সাংবাদিকতার আদর্শ। তিনি সেই গুণটিও রপ্ত করে নিতে পেরেছিলেন। সমাজই সংবাদক্ষেত্রকে সমর্থন জুগিয়ে থাকে। সেজন্য সমাজের প্রতি সংবাদপত্রের দায়িত্ব রয়েছে। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে কাজী ইমদাদুল হক সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন। কাজী ইমদাদুল হক পেশায় ছিলেন শিক্ষক। নেশায় ছিলেন লেখক। নেশা আর পেশা দুটিকেই এক বিন্দুতে মিলিয়ে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা। সে কারণে তার সাংবাদিকতা বুঝতে হলে শিক্ষা দর্শনকেও বুঝতে হবে।
কর্মজীবনে তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না। শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কলেজের অধ্যাপক, স্কুল পরিদর্শক, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে সে সময়কার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাবোধের আলোকে এবং নবীন প্রজন্মের প্রতি মমত্ব বোধের প্রভাবে তিনি শিক্ষাদান কার্যক্রমে বেশ কিছু অসঙ্গতি ও ত্রুটি লক্ষ্য করেছিলেন। ১৯১৯ সালে ঢাকায় বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট এন্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন স্থাপিত হলে কাজী ইমদাদুল হক এর প্রথম সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। সে সময় তিনি যে কয়টি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে দুটোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনিসহ সে সময়কার শিক্ষাবিদদের একাংশ মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অন্য অংশ এর বিরোধিতা করেন। কারণ তাঁদের বিশ্বাস ছিলো শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলে শিক্ষার মান ক্ষুণœ হবে। এই বিরোধিতার ফলে সমস্ত উদ্দেশ্য প- হয়ে যেতে পারে ভেবে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। প্রাথমিক অবস্থায় ইতিহাস, ভুগোল এই বিষয়গুলোর উত্তর বাংলায় লেখার ব্যাপারে শিক্ষার্থীকে পছন্দ করার অধিকার দেয়ার কথা বলেন। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হয় এবং তার জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী আনোয়ারুল হক ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ইতিহাস বিষয়টির উত্তর বাংলায় লেখার সুযোগ পান।
তার বিশ্বাস ছিলো ভাষা শিখতে হলে আনন্দঘন স্বচ্ছন্দ সাহিত্য পাঠের উপকরণ প্রয়োজন। সে কারণে মাধ্যমিক স্তরের বাংলা সাহিত্যের সংকলনে প্রকাশিত কবিতাগুলো তার কাছে ছাত্রদের জন্য সহায়ক মনে হয়নি। এর বদলে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ্য করে নিয়েছিলেন। তার এই সৃজনশীল শিক্ষা দর্শনটিই ‘শিক্ষক’ পত্রিকা প্রকাশের পটভূমি রচনা করেছিলো । শিক্ষক সাময়িকীর মধ্যে শিক্ষা বিষয়ক রচনার পাশাপাশি কিছু কিছু সংবাদও প্রকাশিত হত। এর ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। মুদ্রণ মাধ্যম বলতে আমরা সংবাদপত্র, বই-পুস্তক, লিফলেট প্রভৃতিকেই বুঝি। তবে সংবাদপত্রের সঙ্গে সমাজের যোগ খুবই নিবিড়। সংবাদপত্রের দর্পণেই প্রতিফলিত হয় সমাজচিত্র। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে গেলে ঐ সময়ের সংবাদপত্রই আমাদের তুলে নিতে হয়।
সে আমলে সংবাদপত্র তো বটেই, মুসলমান সমাজে ভালো সাহিত্য পত্রিকারও অভাব ছিলো। কাজী ইমদাদুল হক তার শিক্ষা দর্শন, সমাজচিন্তা এবং সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অনেকদিন ধরেই একটা সাময়িকী প্রকাশের কথা ভাবছিলেন। তিনি জানতেন গণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ও শিল্প সাহিত্যের গুরুত্ব অনেক। সে কারণে কয়েকজন তরুণ যখন ১৩১০ বাংলার বৈশাখ মাসে ‘নবনূর’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন, তখন কাজী ইমদাদুল হক তাদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন। এর প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ আসাদ। তিনি পত্রিকাটির প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে পত্রিকা প্রকাশে উৎসাহদাতা হিসেবে কাজী ইমদাদুল হকের নাম উল্লেখ করেন। নবনূরের সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ এমদাদ আলী। তিনি কাজী ইমদাদুল হক ও নবনূর প্রসঙ্গে বলেন, ‘নবনূর চারি বৎসর চলিয়াছিল। এই চারি বৎসর কাজী সাহেব নবনূরকে যে সাহায্য করিয়াছিলেন তাহার পরিমাণ করা যায় না। কেবল প্রবন্ধ দিয়া নহে, নবনূর যাহাতে বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর মাসিকপত্রে পরিণত হইতে পারে, সকল সম্ভাবিত উপায়ে তিনি তাহার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। নবনূরের নিয়মিত প্রচারের মূলে তাহার ব্যক্তিগত প্রভাব কম কাজ করে নাই।’
নবনূর প্রকাশে কাজী ইমদাদুল হকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু’ রকম অবদানই ছিলো। মূলত এমদাদ আলী নবনূর পত্রিকার সম্পাদক হলেও বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বর্ষ ৮ম, ৯ম ও ১০ম সংখ্যার সম্পাদক হিসেবে ইমদাদুল হকের নাম রয়েছে। নবনূর পত্রিকার প্রথম ৩৩টি সংখ্যায় কাজী ইমদাদুল হকের ২৫টি রচনা প্রকাশিত হয়।
১৯১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতির উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিলেন কাজী ইমদাদুল হক। সমিতির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ নামে। সেখানে কাজী ইমদাদুল হকের চারটি রচনা প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি প্রকাশ করেন ‘শিক্ষক’। শিক্ষা বিষয়ক এই মাসিক পত্রিকা তিন বছর প্রকাশিত হয়েছিলো।
‘শিক্ষক’ এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিলো ৪০। দাম তিন টাকা। পত্রিকার ১ম বর্ষ ১২টি সংখ্যার (বৈশাখ-চৈত্র ১৩২৭) প্রকাশক ছিলেন কলকাতা স্টুডেন্টস লাইব্রেরীর ব্রজেন্দ্রমোহন দত্ত। তিনি ওই পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। পরবর্তীকালে কাজী ইমদাদুল হক ঢাকায় বদলি হয়ে চলে এলেও দু বছর ধরে সেটির প্রকাশনা অব্যহত রেখেছিলেন। পরে শারীরিক অসুস্থতার জন্য কাগজটি চালিয়ে যাওয়া আর তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্পাদক হিসেবে এই পত্রিকার তিনি ১৩২৭ বাংলায় বৈশাখে ৪টি, জ্যৈষ্ঠে ২টি, আশ্বিনে ১টি ও কার্তিকে ১টি. ১৩২৮ বাংলায় বৈশাখে ২টি ও ১৩২৯ বাংলায় বৈশাখে ১টি লেখা প্রকাশ করেন। সেগুলো হলো শিক্ষক, নীরব পাঠ, নীরব পাঠ-২, কল্পনা ও ভাব প্রকাশ শক্তির অনুশীলন, শিশুদের করিবার কিছু, জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, চারি হাজার বৎসর পূর্বেকার নারী বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি শিক্ষার নতুন প্রস্তাব, বিনয় ও কাজের কথা শিরোনামে চারটি প্রবন্ধ।
এই মহৎ উদ্দেশ্যে ‘শিক্ষক’ পত্রিকায় আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষা-ব্যবস্থা বিষয়ে প্রবন্ধ, তথ্য ও সংবাদ, নতুন চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। কাজী ইমদাদুল হকের অনেক রচনা ‘শিক্ষক’ পত্রিকার প্রথম খণ্ডে (১৩২৭) স্থান পায়। প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত তার রচনাবলী : অঙ্কের খেলা; আবহাওয়ার নিক্তি; চার হাজার বৎসর পূর্বেকার নারী বিশ্ববিদ্যালয়; ৬ দু গুণ দশ; ছবির ধাঁধাঁ; ছবির সাহায্যে অঙ্ক; জাপানে শিক্ষা-ব্যবস্থা; টেলিগ্রাম পাঠ; তথ্য-চয়ন; দৃষ্টান্তের প্রভাব; নীরব পাঠ; নূতন খেলা; পরীক্ষার প্রশ্ন; পৃথিবীর গম ফসল; পাটীগণিতের ঠকান প্রশ্ন; পাটীগণিতের দৈনন্দিন ব্যবহার; বর্ষার দিনে খেলা; বড় বড় সংখ্যার ধারণা; বিদ্যালয় পরিদর্শন; বিবিধ; ভাল ছেলে; ভূগোলের খেলা; মজার অঙ্ক; যোগের নামতার একটি খেলা; রহস্য; শিশুদিগের স্বপ্ন; শিক্ষক; শিক্ষক সমিতি; সংযোগ চিহ্নের মূল্য; স্বচ্ছ কাগজে অঙ্কিত ম্যাপের ব্যবহার; সু ও কু (গল্প)।
মূলত, শিক্ষকরাই পত্রিকার লেখক হলেও সে সময়ের অনেক বিখ্যাত লেখকের রচনায় ‘শিক্ষক’ পত্রিকা সমৃদ্ধ ছিলো। প্রথম খণ্ডের লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন -কুমুদরঞ্জন মল্লিক (আবৃত্তি ও তন্ময়তা, শিক্ষকদের বেতন), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (অদল-বদল, ইতিহাস-প্রসঙ্গ), তরিকুল আলম (আমাদের শিক্ষাসমস্যা), জলধর সেন (দুকুড়ি সাত)। জলধর সেনের শিশুতোষ উপন্যাস ‘সোনার বাংলা’ মাঘ (১৩২৭) সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়।
দ্বিতীয় বর্ষে (১৩২৮) তৃতীয় বর্ষে (১৩২৯) ‘শিক্ষক’ পত্রিকার প্রকাশক ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন নিশিকান্ত সেন। দ্বিতীয় বর্ষের ‘শিক্ষক’ পত্রিকায় কাজী ইমদাদুল হকের মাত্র দুটি রচনা প্রকাশিত হয়- ‘কল্পনা ও ভাবপ্রকাশ-শক্তির অনুশীলন’ এবং ‘শিশুদের করিবার কিছু’। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে রয়েছেন- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘ধর-পড়া, নাটিকা), দীনেশ চন্দ্র সেন (বঙ্গের পুরান সাহিত্য), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (মান বড় না প্রাণ বড়, মনিবের মানরক্ষা), কুমুদরঞ্জন মল্লিক (শিক্ষার বিঘ্ন) প্রমুখ।
১৩২৯ সালে ‘শিক্ষক’ পত্রিকা তৃতীয় বর্ষে পদাপর্ণ করে। এই তৃতীয় বর্ষে কাজী ইমদাদুল হকের একটিমাত্র লেখা মুদ্রিত- কৃষি শিক্ষার নূতন প্রস্তাব। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জলধর সেন (ছেলেদের কি করি?), পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় (দৈত্যের বাগান), অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ (ঋষি ও কুকুরের গল্প, শৃগাল ও ব্যাঘ্র) এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাদশাদের পড়াশুনা ও বিদ্যানুরাগ)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন