রাজা ইয়াং : ইতিহাসের এক রহস্যময় চরিত্র
মোহাম্মদ আবদুল হাই
কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রাষ্ট্রের আবির্ভাবের আগে তা যে অনেকগুলো রূপ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলো এবং রাষ্ট্র যে প্রাচীন ব্যান্ডের (Band) বিবর্তিত রূপ তা অনেক ঐতিহাসিকই এড়িয়ে যান। আজকের সর্বব্যাপী ও বিস্তৃত যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তার আলোকেই তারা অতীতের রাষ্ট্রকে বিচার করতে চান। একটি অখ- ও ধারাবাহিক রাষ্ট্রের ইতিহাস তৈরির প্রচেষ্টা তাই ঘুরেফিরে তাদের মাঝে দেখা যায়। জৈন্তিয়া নামক প্রাচীন রাজ্যের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ রাজ্যের ইতিহাসের সন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই একেও অখ- রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই জৈন্তিয়া একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন অনেক জনপদের মতো এখানকার রাজনৈতিক ইতিহাসও অনেক সমৃদ্ধ এবং উর্বর। বস্তুগত অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রতœতাত্ত্বিকের অনেকেই নিশ্চিত করেছেন যে, প্রাচীন প্রস্তর যুগে এ জনপদে সৃজনশীল ও পরিপূর্ণ সভ্য মানুষের বসবাস ছিলো। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, সীমানার বিস্তৃতি কিংবা নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একথা নিশ্চিত যে, জৈন্তিয়া পাহাড় সিলেটের সমভূমি এবং ভারতের নওগাঁ জেলার একাংশ নিয়ে নিয়ে বিস্তৃত। প্রাচীনকালে অখণ্ড বা বিচ্ছিন্নভাবে এক দল দক্ষ মানুষের দ্বারা শাসিত হয়েছিলো এ জনপদ। কালের পরিক্রমায় এখানেও উত্থান-পতন ঘটেছে।
লিখিত ইতিহাসের সর্বত্র জৈন্তা রাজ্যের সরব উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো জৈন্তা রাজ্য বা এতদঞ্চলের ইতিহাস আলো-আঁধারিতে পূর্ণ। জৈন্তার ধারাবাহিক ইতিহাসের বাইরে দৃষ্টি রাখলে দেখা যায় এক সময় এ অঞ্চলে খাসিয়াদের অনেকগুলো রাজ্য ছিলো। যার অস্তিত্ব আজও কিংবদন্তীতে পাওয়া যায়। ‘ত্রিশ রাজা বারো দলইর দেশ’ কিংবা ‘বারো কুঠিরের দেশ’ নামে আজও জৈন্তার পরিচিতি স্থানীয়দের মাঝে। সে সময়কার ছোট ছোট রাজ্যগুলোর মধ্যে জৈন্তা মহারাম, নংখোলাও, চেরা মাইয়াং, খাইরেম, ভুওয়াল, শেল্লা, রামব্লাই, নংস্টেইন, হাদেম, মুকা, শিয়ার, মেরওয়েট, নংখাম, মালনিয়াংয়ের নাম ইতিহাস ঘাঁটলে খুঁজে মেলে। এদের মধ্যে মালনিয়াং রাজ্যটি খাসিয়াদের অতি প্রাচীন একটি রাজ্য।
হট্টনাথের পাঁচালির বিবরণ মতে, জৈন্তা পাহাড়ের কিছু অংশ নিয়ে রানী ঊর্মি একটি স্বাধীন রাজ্য গঠন করেন। উর্বরা নামে তার এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। তিব্বতের হটিক রাজ্যের যুবরাজ কৃষক তখন দেশ ভ্রমণে বের হন। জৈন্তা ভ্রমণের সময় উর্বরার সাথে তার দেখা হয়, ভালোবেসে ফেলেন উর্বরাকে। এবং তাদের বিয়েও হয়। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে একজন ছিলেন জয়ন্তক। জয়ন্তকের তিন ছেলে ও জয়ন্তী নামে এক মেয়ে ছিল। রাজা জয়ন্তক নিজপাট ও জৈন্তাপুরী রাজ পরগণা তার মেয়ে জয়ন্তীকে, জাফলং পরগণা তার বড় ছেলেকে, চারিকাটা পরগণা তার দ্বিতীয় ছেলেকে এবং ফালজুর পরগণা তার ছোট ছেলে ইয়াংকে দান করেন। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী পর্যটন কেন্দ্র লালাখালের ২ কিলোমিটার দূরে আজও ইয়াংয়ের রাজত্বের ভগ্নাবশেষের দেখা মেলে। ইয়াং রাজার টিলা নামে দুর্গম একটি টিলা কালের স্বাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
বাইলদাড়া গ্রামের অনতিদূরের ইয়াং রাজার টিলাকে প্রথম দর্শনে আর দশটি সাধারণ টিলার মতোই মনে হতে পারে। তবে কাছে গেলে যেনো অন্য এক পরিবেশ। নাম না জানা অনেক রকম গুল্মলতায় ঘেরা পুরো টিলাটিই। উঁচুনিচু খাড়া পথ চলে গেছে টিলার চূড়ার দিকে। টিলায় উঠার পথে ৪০০ মিটার উঁচুতে এককালে রাজার পুকুর নামে একটা পুকুরও ছিল। পুকুর না থাকলেও কিছুটা গর্তের মতো এখনও রয়েছে। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে টিলা থেকে নামার সিঁড়িটাও। কয়েক বছর আগেও টিলার পূর্বদিকে তৈরি পাকা সিঁড়িটি চোখে পড়তো। অনুসন্দিৎসু চোখ টিলার চূড়ার পশ্চিম দিকে এখন ইট সুরকির নিদর্শন খুঁজে পাবে। রাজা ইয়াংয়ের স্মৃতিচিহ্নগুলো মলিন হয়ে গেলেও স্থানীয়দের লোকমুখে ইয়াং রাজার গল্প আজও জীবন্ত। বংশ পরম্পরায় স্থানীয়রা সে গল্পগুলোকে আগলে রেখেছেন। ইয়াং রাজা তাদের কাছে এক রহস্যে ঘেরা চরিত্র হয়ে আছেন। স্থানীয় বয়স্কদের কথার সূত্র ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যায়, রাজা ইয়াং এক রহস্যময় চরিত্রের অধিকারী। ফালজুর রাজ্যের এ রাজা সমসাময়িক অন্যান্য রাজাদের চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম। রাজ্য পরিচালনায় তিনি ছিলেন একেবারেই উদাসীন। সপ্তাহের ২/৩ দিনই প্রাসাদের বাইরে কাটাতেন। স্বভাবতই তা রানীর মনে সন্দেহের উদ্রেক করতো। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রানী একদিন জিজ্ঞেসই করে বসলেন ইয়াংকে। রাজার কাছে জানতে চান, রাতে তিনি কোথায় যান। রাজা ইয়াংয়ের উত্তর ছিলো বেশ চমকপ্রদ। রানীকে কৌতুহলী হতে নিষেধ করে ইয়াং বললেন, বেশি কৌতুহলী হলে এক পক্ষের বিয়োগ কিংবা অপর পক্ষের পুনর্জন্ম হতে পারে। রাজার এ উত্তরে রানীর কৌতুহল তো দমলোই না বরং আরও বেড়ে গেলো। এক মধ্য রাতে রাজা যখন প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যান রানীও পিছু নেন তার। পাহাড় ছেড়ে নিচের দিকে নেমে চলেছেন রাজা ইয়াং, পিছু পিছু রানীও। একটি মসৃণ পাথর ডিঙিয়ে নিচের ঝর্ণার সামনে থামলেন রাজা। দূর থেকে রানী দেখলেন, রাজা তার শরীর থেকে নাড়িভূঁড়ি বের করে সেই ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে ধুয়ে নিচ্ছেন। এ দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলেন রানী। আতঙ্কে চিৎকার করে রাজাকে ডাকতে লাগলেন। সে চিৎকারে পিছন ফিরে তাকালেন রাজা। পেছনে রানীকে দাঁড়িয়ে থাকতে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন তিনি। রানীকে উদ্দেশ্য করে শাপ দেন, পাপিষ্ঠা! অভিশপ্ত হও। মুহূর্তেই রানী পরিণত হয়ে যান একটি পাখিতে। আর রাজা ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। কথিত আছে, এ পাখিটি এখনও বিশেষ সময়ে সেই স্থানে এসে মানুষের রূপ ধরে রাজা ইয়াংয়ের প্রতি তার ভালোবাসা জানায়। এ অঞ্চলের মানুষ অনেকেই তা বিশ্বাস করেন। আর তারা একটা বিশেষ পাখিকে সেই অভিশপ্ত রানী হিসেবেই চিহ্নিত করেন। তাদের বিশ্বাস, এ পাখি যার বাড়ির কাছাকাছি ডাকাডাকি করে তার অমঙ্গল হয়।
মিথ কিংবা কিংবদন্তী ইতিহাস নয়। তবে তা একেবারে উড়িয়েও কি দেওয়া যায়? উড়িয়ে কি দেওয়া যাবে ইয়াং রাজার টিলার অস্তিত্ব?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন