পাখির গল্প পশুর গল্প
শাহ ইয়াসিন বাহাদুর
এক কালের রূপবান যাত্রাপালার দুর্দান্ত সুন্দরী হরমুজা বেগমের ছিপছিপে কোমরের বাঁকের মতো পূবের যে সড়কটা বর্ষায় নৌকার তলানির ঘষায় একটু ঢালু হয়ে এক পাশে আধা শুকনো বিস্মৃত ধানী জমি আর এক পাশে কলমির ঝোপ ধরে ধরে চলে গেছে শিশুর জিভের মত টলটলে জলের খালের শেষ মাথায়, এর ওপারেই বসন্তপুরের সাদেক মিয়ার বাড়ির নর্দমায় একটি চামড়া ছাড়ানো ফ্যাকাশে গরুর লাশ কখন ভেসে ভেসে এসে থেমে গেছে দুর্গন্ধ ছড়াবার আগ পর্যন্ত কেউ টের পায়নি।
বসন্তপুরের উত্তরে দূরে শ্মশানঘাটে বহু পোড়ার সাক্ষী এক প্রাচীন বটগাছের পাতালতা ঘেঁষে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা বয়েসি কিছু শকুন, যেমন তারা ঝড় আসার আগে এলোমেলো উড়তে থাকে।
সেদিন একটি শকুন শ্মশানের ছাদের কার্নিশে এসে বসতেই সবগুলো শকুন উড়ে দৌড়ে মাটিতে বসে গেলো যেনো প্যারাসুটের হাওয়া ছাড়াতে ভূমিতে নেমেই একটু দৌড়ে নিলো কিছু আকাশচারী।
তখন পূবের আকাশ লাল শেষ করে আরও ফর্সা ছড়াচ্ছে জলে। আর দক্ষিণ থেকে এক দমকা শীতল বাতাস শ্মশানের বটগাছটিকে নাড়া দিতেই একটি শকুন চেচিয়ে উঠলো : ভাইসব, একটু চুপচাপ বসুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মুরুব্বির বক্তব্য আমরা শুনতে পাব। বলেই মুরুব্বি শকুনটির দিকে দৃষ্টি ছেড়ে দিল। আর সব শকুনও অপেক্ষার চোখে তাকায়।
তখন নদী থেকে আরেকবার বাতাস এসে সবাইকে স্পর্শ করলে মুরুব্বি শকুন চোখ মেলে চায় আর ডানা দুটি ছড়িয়ে আবার গুটিয়ে বলতে শুরু করে : ভাইসব, তোমরা কেমন আছ?
সমস্বরে উত্তর আসে : ভালো নেই, আমরা ভালো নেই।
: ভাইসব, আমি জানি তোমরা ভালো নেই। এ যুগে আমাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে, তা আবার ভালো থাকা! আমরা বহুকাল এ অঞ্চলের বড় বড় গাছ আর হাওরের রাজা ছিলাম। এখন যতো দিন যায় আমাদের সংখ্যা কমছেই অথচ আমরা এই পৃথিবীর কতই না কাজে লাগি। পৃথিবীর পঁচাগলা খেয়ে আমরাই তো পরিচ্ছন্নতার ভারসাম্য রক্ষা করি। আমরা কারো বোঝা হয়েছি, একথা বলতে পারবে কেউ?
পিছন থেকে একটি শকুন তাড়া দেয় : কী কইবেন জলদি কন, পেটে বড় খিদা।
: ভাইসব, পৃথিবীতে অনেক আকাশচারী পাখি আছে কিন্তু আমরা অন্যদের থেকে বড়। উপরওয়ালা আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি দিয়েছেন। ঐ যে বিশাল আকাশ এর কোথাও রঙ বদলালে আমরা টের পাই আজ বৃষ্টি হবে কিনা, বৃষ্টিতে শিল পড়বে কিনা, ঝড় হবে কিনা...
: কিন্তু আসল কথাটাই তো বলছেন না।
: ভাইসব, তোমরা কি জানো, প্রতিটি প্রাণীরই ইহকাল পরকাল আছে?
: আপনি কি পরকালের কথা বলে আমাদের ভেতরে ভয় দিয়ে আমাদের শক্ত করতে চাইছেন?
: ভাইসব, কথাগুলো আমার মন দিয়ে শোনো। আমাদের অনেক সুনাম আছে, আছে জাতিগত ঐতিহ্য। প্রাচীন মিশরের হায়ারোগ্লিফিক্সে আমাদের ছবি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। অথচ এদেশে লোকে আমাদের কত কীই না বলে। শকুনী মামা, শকুন চোখ, ভিটেয় শকুন, আফসোস! তবু বন্ধুরা, আমাদের ঐতিহ্যের কথা ভেবেই তোমাদের সামনে একটি প্রস্তাব পেশ করতে চাই।
পেছন থেকে চিৎকার আসে : বলুন, কী প্রস্তাব, তাড়াতাড়ি বলুন।
: ভাইসব, আমরা যে দায় নিয়ে দিন কাটাচ্ছি- একদিন তা শোধরাবার সময়ও আর থাকবে না। এখনই সুয়োগ দায়মুক্ত হবার। দায়মুক্তির পরম আনন্দ নিয়ে মুক্ত আকাশে দিনের পর দিন না খেয়ে কাটিয়ে দিলেও শান্তি পাবো। উত্তরসূরির অভিশাপ থেকে আমরা হবো মুক্ত।
এমন সময় আকাশ দাপিয়ে দুটি শকুন এসে চড়কির মতো চক্কর দিতে শুরু করলে ছলছল চোখে সবাই তাকাতেই একটি আনন্দ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে ‘বসন্তপুরের সাদেক মিয়ার নর্দমায় রিজিক মিলাইছে খোদা। চল যাই, দলবল নিয়া যাই’।
এ সংবাদে সবার বাঁকা ঠোঁট নড়িনড়ি করে তবু প্রবীণ মুরুব্বি কাউকে উঠতে না দিয়ে আবার বলতে শুরু করে : ভাইসব, আমরা যে দেশের আলো বাতাসে বড় হচ্ছি সে দেশের একটা করুণ ইতিহাস আছে জানো?
সামনের একটি শকুনের কাছ থেকে উত্তর আসে : মুরুব্বি, যা বলার তাড়াতাড়ি বলেন। না খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি বটে কিন্তু খাবারের গন্ধ নাকে এলে আর পারি না।
: ভাইসব, আমি এখনই শেষ করবো। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সে দেশের করুণ ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আমরা চরম নির্দয় ও স্বার্থপর প্রাণীর পরিচয় দিয়েছি। আজ আমি তার ব্যাখ্যা দেবো। ঐ যে দেখো, দূরের উত্তাল মেঘনার শাদা শাদা ঢেউ, সে পাড় ভাঙে তবু তার কোনো কলঙ্ক নেই! এই যে পলেস্তারা খসানো শ্মশান, এর পাশ দিয়ে কতজন হেঁটে যায় আর ভৌতিক ভয়ে দৌড়োয় তবু তারও কোনো কলঙ্ক নেই! কিন্তু আমরা, ঐতিহ্যবাহী উপকারী শকুনেরা কেনো একটি মহাকলঙ্ক নিয়ে নিঃশেষ হবো?
: যেখানে মানুষ আমাদের অভিশপ্ত মনে করে সেখানে আমাদের দায়টা কিসের?
: অভিশাপ ভাইসব, অভিশাপ। সবই অভিশাপের ফল। তোমরা জানো, একাত্তরে এ দেশে একটা কেয়ামত হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদাররা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। ছেলে বুড়ো জোয়ান শিশু যুবতী সবাইকে ওরা কষ্ট দিয়ে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আর বন্ধুগণ, আমরা, এই উপকারী শকুনেরা সেইসব মানুষের মৃতদেহ ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছি। এমনকি এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মহাপবিত্র রক্তাক্ত দেহও!
মুরুব্বি শকুন এবার একটু চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করে। চোখ দুটো যেনো ছলোছলো। হঠাৎ খেয়াল হয়, এটি কান্নার সময় নয়। আরও অনেক কাজ তার জমে আছে। তখন ডানা দুটোয় একটা ঝাপটা দিয়ে বলতে শুরু করে : কিন্তু এবার আমাদের হুঁশ হয়েছে। আমি মনে করি, আমরা তখন ভুল করেছিলাম। আর সে ভুলের জন্য দেশের সরকারের কাছে ক্ষমা চাইবো। মহামান্য সরকার যেন শকুন সম্প্রদায়ের না বুঝা ভুলের ক্ষমা মঞ্জুর করেন। তোমরা কী বলো?
তখন আচমকা সামনে থেকে কিছু শব্দ সমস্বরে উচ্চারিত হয়ে আকাশ কাঁপিয়ে দিলো : অবশ্যই-অবশ্যই, আমরা দায়মুক্ত হতে চাই।
মুরুব্বির বুক থেকে এবার দীর্ঘদিনের পাষাণ নেমে যায়।
: তবে চলো, আজ থেকে আমরা আমাদের কাজ শুরু দেবো। সে কাজের উদ্বোধন হবে একটি চমৎকার ঘৃণা দিয়ে। আর তা হলো, সাদেক মিয়ার বাড়ির নর্দমার খাবার আমরা স্পর্শ করবো না। কারণ সে একজন যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরে এদেশের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি করেছে সে। একজন যুদ্ধাপরাধীর বাড়ির সীমানায় আমরা আর কিছুতেই খানাখাদ্য খাবো না। তা যত উপাদেয়ই হোক কিংবা যত ক্ষুধার্তই থাকি না কেনো আমরা।
মুরুব্বির কথার পর আবার শকুনের সমস্বরে আকাশ কাঁপে : ঠিক ঠিক ঠিক।
তখন বাতাসের পরতে পরতে কী এক মধুর মমতায় এক পাল শকুন ডানা ছড়িয়ে দিলে শো শো শব্দে খাল পেরিয়ে বসন্তপুর, তার পরে বিস্তৃত ধানী জমি আর শাদা সিঁথি পরা স্বাস্থ্যবান সড়ক তার পাশের কলমি ফুলকে জাগিয়ে দিলে খালের বুকে ছোট ছোট ঢেউ ওঠে। আর কুসুম গরম আলো ঠোঁটে নিয়ে হেঁটে-দৌড়ে-উড়াল দিয়ে আকাশের গভীরে শকুনগুলো বিমানের মত উড়ে গেলে সবুজ ঘাসের উপর কয়েকটি কৃষ্ণপালক খসে পড়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন