শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গল্প >> বিয়ে বিভ্রাট : হাসান আবাবিল

বিয়ে বিভ্রাট

হাসান আবাবিল

নীল আর্মস্ট্রং বা মাইকেল কলিন্সের চাঁদে যাবার অভিজ্ঞতা কেমন জানা নেই। তবে অচেনা কোনো জায়গায় প্রথমবার গেলে মনের মধ্যে একটা বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি হয়। চাঁদের নাম আঁকা শহরের পথে নতুন নতুন পথঘাট চিনে নেওয়ার আনন্দ আমার চন্দ্র বিজয়ের চেয়ে কম নয়। যাচ্ছি চাঁদপুর, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী হায়দারের বড় ভাইয়ের বিয়েতে।  
সকাল ছ’ টার বাসে চড়ে যাত্রা শুরুর পর বিকেল চারটায় ফেরি থেকে নেমে এলাম অচেনা অজানা এক বন্দরে। মানুষের ধাক্কায় আপনা আপনি ঘাট থেকে একটা পাকা রাস্তার মোড়ে চলে এলাম। ছোটোখাটো একটা মুদি দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি ছাতা মাথায় আমার দিকে এগিয়ে আসছে সুমন। সাথে আরো দুজন বন্ধু অথবা আত্মীয় হতে পারে। সুমন হায়দারের ছোট ভাই। শহরের স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। হায়দারের সাথে একই মেসে থাকে।
আগে কখনো হায়দারের বাড়িতে আমার আসা হয়নি, তবে কলেজের দু’বছরে ওর সাথে বন্ধুত্বটা বেশ জমে উঠেছে বলতে হয়। সুমনের সাথে হাঁটা পথে ওদের বাড়ির দিকে রওনা হই। মাটিফাটা রোদে একমাত্র ছাতাটা সুমনের সাথে ভাগাভাগি করে প্রায় মাইলখানেক পথ পাড়ি দিয়ে ওদের বাড়ি এসে পৌঁছালাম। বাড়িটা বেশ সুন্দর। মাটির দোতলা বাড়ি, চারিদিক ঘিরে বেশ কিছু মাটির হাঁড়ি আর বাঁশের ঝুড়ির মত কবুতরের বাসা ঝোলানো আছে। বাড়িতে ঢোকার আগেই কিছু নজরকাড়া কবুতরের ছবি আমার মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দি হয়ে পড়লো।
আমার থাকার জন্য দোতলায় একটা রুম দেওয়া হলো। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম বাড়ির পেছনে বড় একটা পুকুর। পানি কিছুটা সবুজ বর্ণের হলেও ঝাঁপিয়ে পড়ার লোভ হচ্ছিলো ভীষণ। বড় ভাইয়ের বিয়ের আর মাত্র দুদিন বাকি, হায়দারের ব্যস্ততার তাই শেষ নেই। এজন্য আমাকে বেশি সময় দিতে পারছে না সে। 
গায়ে হলুদের দিন সকাল থেকে হায়দারের কিছু আত্মীয় এসে উপস্থিত হয়েছেন। তারপরও বাড়িটাকে ঠিক বিয়েবাড়ি মনে হচ্ছিলো না। পুরো বাড়িতে হাতে গোনা ক’জন মানুষ, তাও কেমন চুপচাপ। ব্যাপার স্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। বিয়ের দিন সকালেও হায়দারদের বাড়িতে উৎসবের আমেজ পাওয়া যাচ্ছিলো না।  সকালে হায়দারের ভাইকে গোসল করানো হচ্ছিলো। বিশেষ মুহূর্তের স্মৃতি ধরে রাখতে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি ক্যামেরা নিয়ে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হায়দারের বড় ভাই ডান হাতটা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো সমানে গিলে ফেলছেন। আমার দিকে চোখ পড়তেই হাসতে লাগলো। আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না বিয়ে বাড়ির নীরবতার রহস্য। বুঝতে পারি হায়দারের ভাই শারীরিকভাবে একজন প্রতিবন্ধী। বিয়ে বাড়ির নীরবতার রহস্য বোধহয় এটাই। 

তিনটা গরুর গাড়িতে দশ-পনেরো জন বর যাত্রী ঘণ্টাখানেক পথ পাড়ি দিয়ে কনের বাড়িতে হাজির হলাম। বেশ খাতিরের সাথেই আমাদের বরণ করে নেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাশতা আর শরবতও হাজির। দুটো লুচি মিষ্টি পাকস্থলির দিকে ছুঁড়ে দিলাম। শরবতটা দেখে থমকে গেলাম। গোটা দশেক পিঁপড়া ভাসছে। পিঁপড়া খেলে নাকি ভালো সাঁতারু হওয়া যায়। আমি অবশ্য মোটামুটি বাঁচার মতো সাঁতার জানি। তাই শরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকলাম। তবে আমার জায়গায় মাইকেল ফেলপস হলে হয়তোবা খেয়েও ফেলতো। 
ভালই যাচ্ছিলো সব কিছু, তবে ঘটনাটা ঘটলো দুপুরে খাওয়ার সময়। কথা ছিলো খাওয়া দাওয়ার পর বিয়ে পড়ানো হবে। কনের বান্ধবী আর মামাতো-খালাতো বোনেরা বরের জন্য খাবার নিয়ে এলো। খাওয়ার পর বরের হাত ধুয়ে দুটো পয়সা খসানোই ওদের উদ্দেশ্য। বিপত্তি ঘটলো তখনই। হায়দারের ভাই ঠিকমত খেতে পারছেন না। ডান হাতটা কাঁপছে। ভাত লেগে যাচ্ছে গালে আর নাকে। এমন দৃশ্যে মেয়েদের দল তো হতভম্ব। মুহূর্তেই ঘটনাটা জানাজানি হয়ে মহা হুলস্থুল বেঁধে গেলো। বুঝতে পারি বর যে প্রতিবন্ধী সে কথা আগে কনে পক্ষকে জানানো হয়নি। তারা তো মহাখাপ্পা। এ ঘটনায় হায়দারের বাবাসহ বরপক্ষের লোকজনেরাও বিব্রত হয়ে পড়েছেন। কী করবেন তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। আমার ভয় হচ্ছিলো বড় ধরনের কোনো অঘটন না ঘটে। হায়দারের পরিবারের লোকজন ব্যাপারটা ঠিক করেননি। কিছু একটা যে ঘটবে তা নিশ্চিত। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য আমি একটু সরে পড়ি। প্রতিটি মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। বরপক্ষের সবাইকে একটা ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি বরযাত্রী নিয়ে আসা গরুর গাড়ি তিনটাও গরুসহ জব্দ করা হয়েছে। আমি নিজেকে আর ঝুঁকিমুক্ত মনে করতে পারছি না। এদিক ওদিক ঘুরতে থাকি। কনের অভিভাবক আর গ্রামের কিছু মুরুব্বি উঠোনেই জরুরি সভায় বসেছেন।
- সব শালারে বাইন্দা রাখো। খরচাপাতি সব পুষাইয়া দিবো, তারপর অন্য কথা। একজন মুরুব্বি বললেন।
- কিন্তু আমাগো মাইয়ার কী হইবো? কনের চাচার প্রশ্ন।
- বাবা হেগো গরুর গাড়ি তিনটা আটকাইয়া রাখা হইসে। একটা মেয়ে বললো। বয়স কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে হবে। লক্ষ্য করলাম মেয়েটার একটা চোখে সমস্যা আছে।
- আচ্ছা ভাই, মেয়েটা কে? ভিড়ের মধ্যে একজনকে প্রশ্ন করলাম।
- মাইয়ার চাচাতো বইন। জবাব আসে।
- মেয়েটার কি বিয়ে হয়েছে? আবার প্রশ্ন করলাম তাকে।
- নাহ...! কানা মাইয়া। অনেক টাকা যৌতুক চায়।
আমার মাথায় সাথে সাথে একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। বুদ্ধিটা কাজে লাগালে সমাধান একটা হলেও হতে পারে। সাহস করে মিটিংয়ের মাঝখানে গিয়ে বুক সোজা করে দাঁড়ালাম।
- আপনারা অনুমতি দিলে আমি কিছু বলতে চাই।
- তুমি ক্যাডা, কী কইবার চাও? কনের চাচার ধমকটা একটু ভারি হলেও আমার কথা শোনার আগ্রহ আছে বোঝা যাচ্ছে।
আমি আমতা আমতা করে বলি, আসলে আমি বরের ছোট ভাই হায়দারের বন্ধু, শহর থেকে এসেছি। আমি বলতে চাচ্ছি, বরপক্ষ কাজটা মোটেও ঠিক করেনি। কিন্তু বিষয়টা কি আপোসের মাধ্যমে শেষ করা যায় না। 
- তুমি মিয়া শহর থাইকা জজ ব্যারিস্টার আইছো নাকি, আপস করবা? তোমরা প্রতারণা  করছো। এর বিচার হওন লাগবো।  আঙুল উঁচিয়ে আমাকে শাসাতে লাগলেন একজন মাঝবয়সী লোক।
- দেখুন আমার কাছে একটা সমাধান আছে। যাতে আপনারা দু’ পক্ষই উপকৃত হবেন। তবে এজন্য আপাতত বরের ছোট ভাই আর বাবাকে ছাড়তে হবে। তাদের সাথে আমার পরামর্শ করা দরকার। আমার প্রস্তাব তারা কিছুতেই মানতে রাজি হচ্ছিলেন না। কম বয়সী কেউ কেউ তো আমাকে বেঁধে ফেলারও পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তবে অনেক অনুনয় বিনয়ের পর তাদের রাজি করাতে পারি।
আমি হায়দার ও তার বাবাকে আমার পরিকল্পনাটা খুলে বলি। তারাও রাজি হন। প্রস্তাবটা হায়দারের বাবাই তুলে ধরেন, দেখুন ভাই সাহেব, টাকা পয়সা যেমন আপনাদেরও খরচ হইছে, তেমনি আমগোও খরচ হইছে। একটু থেমে বলেন, ...তাছাড়া বিয়া না হইলে হেইডা মান সম্মানের ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইবো...
- না না এইডা হইতে পারে না। একটা প্রতিবন্ধীর লগে...। কনের চাচা ঝাঁজালো সুরে বলেন। 
- আমরা আসলে বলতে চাইছি যে বিয়েটা হবে, কিন্তু সেটা আপনাদের অন্য মেয়ের সাথে, মানে ওনার সাথে। কনের চাচাতো বোনের দিকে ইশারা করে একটা হাসি দিলাম আমি। 
- কোনো যৌতুকও দেওন লাগবো না। হায়দারের বাবা বললেন। তাছাড়া ছেলেরও তেমন কোনো সমস্যা নাই। শুধু ডান হাতে একটু ইয়ে আরকি।
কনের চাচা চুপচাপ বসে আছেন। মনে হয় বিষয়টা নিয়ে তিনি ভাবছেন। শেষমেষ একটু ইতস্তত করে বললেন, ঠিক আছে। মান-ইজ্জতের ব্যাপার যখন...। আমি রাজি। তার এ কথায় যেনো প্রাণ ফিরে পেলাম আমরা।
ছন্দপতন ঘটে কনের বাবার কান্না ভেজাস্বরে, কিন্তু আমার মাইয়ার কী হইবে? বউ সাইজা বইয়া রইছে মায় আমার। 
এ বিষয়টা নিয়ে তো ভাবা হয়নি। অপ্রস্তুত বোধ করেন সকলে।  
- এই মাইয়ারও বিয়া হইবো। ঘোষণা করলেন হায়দারের বাবা। আমরা সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি বলতে থাকলেন, আমার ছেলে হায়দারের লগে হের বিয়া হইবো। আল্লায় আমারে অনেক দিছে আমার কোনো দাবি নাই।
বাবার ঘোষণায় হায়দার হতভম্ব হয়ে পড়লেও বিয়ে বাড়িতে আনন্দের একটা ধুম পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে বাড়ির পরিবেশ আবার বদলে গেলো। বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হলো সবাইকে। অল্প সময়ের মধ্যে নতুন কনেকে সাজানো হলো। হায়দারকে পরানো হলো একটা নতুন পাঞ্জাবী। কাজী সাহেবকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। কারণ একটু দেরিতে হলেও জোড়া বিয়ে পড়িয়ে ডবল পয়সা পেতে যাচ্ছেন তিনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন