শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গল্প >> দেখে শেখা : নীহারুল ইসলাম

দেখে শেখা

নীহারুল ইসলাম

আসুর কথামতো গোদাগাড়ির ঘাটে উঠেই তোয়েব আলি যে লোকের সঙ্গ পেয়েছিল, সেই লোকটা তাকে যেখানে নিয়ে এল সেটা একটা কানাগলি। লোকটাকে নিয়ে প্রথম থেকেই তোয়েব আলির শঙ্কা ছিলই, এতক্ষণে মনে ভয় ধরল। সে যেতে চেয়েছিল রাজশাহী ইউনিভারসিটি। যেখানে একজন গল্পকার থাকেন। যার সঙ্গে তার দেখা করা খুব জরুরি। কিন্তু এই লোকটা তাকে কানাগলির ভেতর দিয়ে কোথায় যে নিয়ে যাচ্ছে! সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মাথা কাজ করছে না। 
অনেক খোঁজ-খবরের পর হাসান সাহেবের ঠিকানা পেয়ে খানিকটা উত্তেজনার বশেই তোয়েব আলি গতকাল সন্ধ্যায় আসুর কাছে গেছিল। আসু তার স্কুল-জীবনের বন্ধু। যদিও মাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়েনি। রোজগারের ধান্ধায় কাসিমের ঘাটে লেগে গেছিল। এখনও কাসিমের ঘাটেই থাকে। চাল-ডাল, গরু-ছাগল-মুরগি, মানুষ, ...আরও কত কী যে এপার-ওপার করে তার হিসাব নেই। সেই আসুর কাছে গিয়ে সে বলেছিল, ‘ভাই রাজশাহী যাবো। তুই একটু ব্যবস্থা করে দে।’ 
আসু ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু এ কেমন ব্যবস্থা? লোকটা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কানাগলির ভেতর কোনও ইউনিভারসিটি থাকে নাকি? তোয়েব আলি নিশ্চুপ থেকে লোকটাকে আর অনুসরণ করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন ভাই? আমি যে ইউনিভারসিটি যেতে চাই। 
লোকটি যেমন হাঁটছিল তেমনি হেঁটে যেতে যেতে বলল, বেশি কথা কইবেন না। চুপচাপ চলে আইসেন আমার পিছু পিছু। কেমন যেন হুকুমের সুর। তোয়েব আলির ভয় আরও বেড়ে গেল। গোদাগাড়ির ঘাটে নৌকা থেকে নেমে এত ভয় পায়নি সে। আসু বলে দিয়েছিল,  ‘ঘাটের ওপরে চায়ের দোকানে বসে থাকবে আমার লোক। তোর কোনো চিন্তা নাই। তুই যেখান যেখান ঘুরবি, যার সঙ্গে ইচ্ছে দেখা করবি, লোকটা তোর সঙ্গেই থাকবে। তোর কাজ হয়ে গেলে তোকে আবার গোদাগাড়ির ঘাটে নিয়ে এসে নৌকায় উঠিয়ে দেবে।’ 
আসুর কথামতো ঘাটের ওপর একটা চায়ের দোকানেই লোকটাকে পেয়েছিল সে। নাকি লোকটাই তাকে পেয়েছিল? দোকানের বাইরের দিকের একটা বেঞ্চে বসেছিল অদ্ভুত ভঙ্গিতে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে টিভি দেখছিল। কিন্তু তাকে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছিল। এতক্ষণ যেন টিভিতেই পদ্মা পেরিয়ে তাকে আসতে দেখছিল। তেমন ঘোর নিয়েই এগিয়ে এসে বলেছিল, আপনি কি আছমহম্মদ ভায়ের দোছত্ লাগেন? ইন্ডিয়া থিক্যা আইছত্যাসেন? আপনার নাম তোয়েব আলি? আপনার কি ভারছিটি যাওয়ান লাগবো? হাছান ছাহেবের ছঙ্গ ছাক্ষাৎ করান লাগবো?
তোয়েব আলি দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে বলেছিল, জী। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি আমাকে চিনলেন কী করে? আর এত সব জানলেনইবা কী করে? 
- ইন্ডিয়ানরে দ্যাখলেই আমরা চিনতে পারি। তাছাড়া আছমহম্মদভাই আমারে সব কইয়া পাঠাইসে। আইছেন ভাই। এহ্যানে দাঁড়াইয়া কাম নাই, আমার ছঙ্গ ধরেন। 
তোয়েব আলি লোকটার সঙ্গ ধরেছিল। খানিকটা হাঁটা পথ। তারপর প্রায় আধ ঘণ্টা কিংবা চল্লিশ মিনিট বাস-জার্নি করে রাজশাহী বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিকসা করে যে জায়গাটায় লোকটা তাকে নিয়ে নামল, সেখানে একটা সিনেমা হল আছে। নাম ‘অলকা’। যার গা গেঁষে এই কানাগলি! 

দুই
কানাগলি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত লোকটা তাকে যেখানে নিয়ে এল সেটা একটা বস্তি। তোয়েব আলির অন্তত তাই মনে হল। সে তাদের গ্রামের পাশেই গোলাপনগর বস্তি দেখেছে। বাঁশের খলপার টাটির ঘর। ওপরে করোগেটেড-টিনের ছাউনি। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেকগুলি একই রকমের ঘর। অনেক পরিবার। কাচ্চাবাচ্চা পিলপিল করছে। তাদের ডিঙিয়ে-মাড়িয়ে লোকটার পিছু পিছু একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তোয়েব আলি। ঘরের ভেতরটা আবছা, কেমন এলোমেলো সব! অগোছালো! সেই রকম একটা ঘরে তাকে এনে লোকটা বলল, বহেন ভাই! একটুখানি জিরান ল্যান। ছরবত খান। তারপর ভারছিটি যাওয়ান লাগবো। আপনার চিন্তার কারণ নাই। আমি আছি। আছমহম্মদ ভায়ের দোছত্ আপনি। তার মানে আমারও দোছত্। মুনে করেন এই বাড়ি আপনার নিজের বাড়ি। লোকটা যত সহজে এবং যেভাবে কথাগুলি বলল, তোয়েব আলির মাথায় কিছু ঢুকল না। কোথায় বসবে তাও বুঝতে পারল না। খালি দেখল একজন মহিলা বড় ফুল তোলা কাঁচের গেলাসে সরবত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। তাকে বলছে, ল্যান ভাই - ধরেন। সরবত খান। সেই কুন পোঁহাতে বেরহ্যালছেন। ঘাটায় খাবার তো দূর পানিও জুটেনি বোধায়। লয় ভাই? 
মহিলা নিশ্চয় লোকটার বউ! তোয়েব আলি অনুমান করে। কিন্তু বুঝতে পারে না একজন মহিলা অপরিচিত এক পরপুরুষের সামনে এত স্বচ্ছন্দ হয় কী করে? যদিও সে মহিলার হাত থেকে সরবতের গেলাসটা হাতে নেয়। মহিলার কথার উত্তরে বলে, জী না। 
ইতিমধ্যে মহিলাকে ঘিরে ধরেছে এক গ-া কাচ্চাবাচ্চা। তারা কিলবিল করতে করতে বলছে, মা সরবত খাবো। মা সরবত দে না গে! ও মা! জোর পিয়াস লেগ্যাছে। 
এই দৃশ্য দেখে তোয়েব আলির হাতের গেলাস হাতেই থেকে যায়। মুখে তুলতে পারে না। 
অথচ বাচ্চাদের দিকে খেয়াল নেই মহিলার। মেহমানকে নিয়েই সে ব্যস্ত। মেহমানের দেশে তার বাপের বাড়ি। বর্ডার পেরিয়ে বহুদিন সে বাপের বাড়ি যেতে পারে না। সে কথা মেহমানকে শোনাতে চায়। তার বাপ-মা কেমন আছে, জানতে চায়। কিন্তু মেহমান সরবতের গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে যে! বসতেও জায়গা দেয়নি। হঠাৎ খেয়াল হতেই শরমে ছিঃ! ছিঃ! বলে উঠে মহিলা। তারপর ছুটে যায় ঘরের বাইরে। মেহমানকে বসতে দেবার জন্য কিছু একটা আনতে বোধহয়। 
লোকটা এতক্ষণ ঘরে ছিল না, কথা বলতে বলতে কখন বেরিয়েছিল খেয়াল করেনি। এখন করল। আবার ঘরে ঢুকে লোকটা প্রচ- ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘরের এক কোনায় একটা কাঠের আলমারি থেকে কী বের করতে করতে বলছে, জলদি করেন ভাই। ভারছিটির ক্লাছ শুরুর আগেই গিয়ে আপনার হাছান ছাহেবেরে ধরতি হবে। নাকি খুব দরের মানুষ। ছময়ের দাম বুঝে। আমি খোঁজ-খবর নি আইলাম। আপনি জলদি ছরবতটা খাইয়া ল্যান। 
এবার আর সরবতের গেলাস হাতে ধরে থাকতে পারে না তোয়েব আলি। পিপাসা তার লেগেই আছে। ধূ ধূ চরে বালির ওপর প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটা চাট্টিখানি কথা নয়। তবু সে হেঁটে এসেছে। হাসান সাহেবের টানে এসেছে। হাসান সাহেবের লেখা একটা গল্প, ‘শকুন‘ পড়ে সে যেমন অভিভূত হয়েছে, অবাকও কম হয়নি! একজন গল্পকার, যিনি বাস করেন বরেন্দ্রভূমিতে। অথচ বাগড়ি পেরিয়ে তিনি গল্প লিখছেন রাঢ়বাংলার পটভূমিতে! আবার এমন একটা গল্প যা বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা সম্ভব নয়। তোয়েব আলির এমনই মনে হয়েছে। কারণ ‘শকুন’ গল্পের চরিত্রগুলির একটা চরিত্র সে নিজেই। পড়াশুনার পাশাপাশি রাখাালি করেছে। রাখাল বালকদের সঙ্গে অমন শকুন সে কত মেরেছে! যখন মামার বাড়িতে থাকত। শুধু তাই না, তার মামার গ্রামের রাখাল বালকেরা যে ভাষায় কথা বলে, ‘শকুন’ গল্পের চরিত্ররাও সেই ভাষায় কথা বলছে। অথচ ভাষার চরিত্র হচ্ছে প্রতি দশ কিলোমিটার অন্তর অন্তর বদলে যাওয়া। তাহলে এটা কী করে সম্ভব? 
এই সব কারণেই বিনা পাসপোর্টে বন্ধু আসুর সহায়তায় সে ছুটে এসেছে এই বিদেশ-বিভূঁয়ে। যে দেশটায় আবার গণতন্ত্র নেই, সামরিক শাসকের অধীন। বিপদ-আপদের তোয়াক্কা করেনি তোয়েব আলি। যদিও একটু আগে গাইড লোকটার ভাবভঙ্গি দেখে তার মনে ভয় ধরেছিল। এখন কিন্তু সে অনেকটাই স্বাভাবিক। এখন খালি তার ভাবনা কতক্ষণে সে ইউনিভারসিটি পৌঁছবে! হাসান সাহেবের সঙ্গে তার কতক্ষণে সাক্ষাত হবে! ভাবতে ভাবতে ফুল তোলা বড় কাঁচের গেলাসটা মুখে লাগিয়ে চোঁ চোঁ টানে একবারেই শেষ করে ফেলল। গেলাসটা নিচে নামিয়ে রেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে বলল, চলেন ভাই। যাই তাহলে এবার! 
- হ্যাঁ ভাই। চলেন যাই। 

তিন
ঘর থেকে বেরিয়ে তোয়েব আলির চোখ পড়ে দরজার বাঁ-দিকে একটা পরিত্যক্ত জায়গায়। ইটের প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীর কোথাও এক ফুট দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তার মধ্যেখানে একটা অবহেলিত শিবলিঙ্গ। পাশেই একটা বেলগাছ দাঁড়িয়ে। জায়গাটাকে ছায়া করে আছে। তোয়েব আলির হঠাৎ-ই মনে হয়, এখনও লোকটার নাম জানা হয়নি। বুরবক কাহেকা! মনে মনে নিজেই নিজেকে গাল পেড়ে তোয়েব আলি লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, ভাই আপনার নাম?
লোকটা কানাগলি পেরোতে পেরোতে বলে, আছুভাই আমার নাম বলে নাই আপনাকে? 
বলেছিল কী? হয়ত বলেছিল। তাড়াহুড়ো আর উত্তেজনায় খেয়াল করেনি। তবু তোয়েব আলি মনে করতে চেষ্টা করে। কিন্তু মনে করতে পারে না।
লোকটা তাই দেখে বলে, না বলে ঠিক কামটায় করত্যাসে। 
- কেন? তোয়েব আলি জিজ্ঞেস করে। 
- আমার নাম শুনলে ভয় পাইয়া হয়ত আপনি আছতেনই না। 
- কেন, আপনার নামে কী আছে যে আমি ভয় পেতাম? 
-কিসু তো আসেই। না হইলি মানুষে আমারে ভয় পায় ক্যান? লোকটার চোখমুখে অহঙ্কার ফুটে ওঠে। 

চার
কানাগলি থেকে বেরিয়ে ততক্ষণে ওরা বড় রাস্তায় উঠেছে। লোকটা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হয়ত রিকসা খুঁজছে। হ্যাঁ, ঠিক তাই। একটা খালি রিকসা যেতে দেখে লোকটা হাঁক ছাড়ল, এ্যই রিকছা রহছ! 
রিকসাওয়ালা তার হাঁক শুনে রিকসা ঘুরিয়ে নিয়ে এল ওদের কাছেই। লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, কোনে যাইবেন জালুভাই? ছঙ্গে মেহেমান দেখত্যাসি। ইন্ডিয়া থেক্যা আইত্যাসে বুঝি? কে লাগে? ভাবীজানের ভাই নাকি? 
- বকবক করত্যাসিছ ক্যান? ভারছিটির গেটে সাইড়া আসবি চল। তার আগে নিউমার্কেটের পেসনটায় চল তো একবার। নিজামে নাছতা খাওয়ান লাগব। ধমকের স্বরে বলল লোকটা। তোয়েব আলি এতক্ষণে লোকটার নাম জানল। জালু। রিকসাওয়ালা সেই নামেই তো ডাকল। নামটা তো বেশ ভালো। জলিল কিংবা জালালুদ্দিন। সংক্ষেপে জালু হয়েছে নিশ্চয়। তাহলে লোকটা কেন বলল যে, নাম শুনে ভয় পান যদি! 
যদিও ব্যাপারটা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবে না সে। ততক্ষণে রিকসাটা ছুটতে শুরু করেছে বড় রাস্তা ধরে। দু’জন পূর্ণ-শরীরের মানুষকে হাড্ডিসার রিকসাওয়ালা ছোঁড়া কীভাবে যে অমন ছুটিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তোয়েব আলি বুঝতে পারছে না। আশপাশ দিয়ে নামী-দামী মোটরগাড়ি ছুটছে। রাস্তার দু’ধারের বাড়ি-ঘর গুলিও বেশ। চর হেঁটে পদ্মা পেরিয়ে এত কাছে এমন একটা শহর বিরাজ করছে, তা তার কল্পনাতেও ছিল না। ভাগ্যিস ‘শকুন’ গল্পটা পড়েছিল!
পাঁচ
কিছুক্ষণেই রিকসাটা এসে দাঁড়ায় এমন এক জায়গায়। সেখানে না আছে নিউমার্কেট না আছে বাজার। আছে বলতে রাস্তার ধারে নয়নজুলির ওপর গোটা গোটা বাঁশের পাটাতন। তার ওপর সার সার খলপার টাটির ঝুপড়ি ঘর। ওই ঘরগুলি আবার এক-একটা হোটেল। কোনোটার নাম আমিনা। কোনোটার নাম মহল। কোনটার নাম কোহিনূর! জালু লোকটা বলল, নামেন ভাই একটু নাছতা কর‌্যা যাওয়ান ভালো। আপনার হাছান ছাহেব আপনাকে কতক্ষণে সাড়ব না সাড়ব! খাওয়ার কথা কইব, না কইব। তার ঠিক নাই। এই আমাদের আমিনা-নিজাম হোটেল আছে। বাঢ়িয়া খানা মিলবে। গেলেই মালুম পাইবেন।
লোকটা তাকে বাড়িতে এক গেলাস সরবত খাইয়ে হোটেলে এনে নাস্তা খাওয়াবে। তোয়েব আলি ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে কূল- কিনারা পাচ্ছে না। রিকসা থেকে নেমে বেবাক দাঁড়িয়ে আছে। 
লোকটা ততক্ষণে ওই সব হোটেলগুলির একটিতে ঢুকে পড়েছে। বাইরে আলকাতরা দিয়ে লেখা ‘নিজাম হোটেল’। তোয়েব আলিও পিছু পিছু গিয়ে ঢুকল সেখানে। মোটা মোটা গোটা বাঁশের পাটাতনের ওপর গজাল গেঁথে বেঞ্চ-হাই বেঞ্চ আটকানো। তাতে বসে অনেকেই খাচ্ছে। হোটেলকর্মী, খরিদ্দারদের হাঁটাচলায় পাটাতন একটু-আধটু দুলছে। কারও কোনওরকম ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ খেতে ব্যস্ত, কেউ খাওয়াতে ব্যস্ত। অথচ তোয়েব আলির ভয় করছে। বাঁশের পাটাতনের নিচেই বিশাল খাল। খালে কাদা-জল সমান সমান। সেই কাদা-জলে অসংখ্য কাক আর কুকুরে দাপাদাপি। কোনও কারণে পাটাতন ভেঙে পড়লে আর দেখতে হবে না। কাক-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে। ইতিমধ্যে খানা পরিবেশিত হয়েছে তার সামনে। সে খেয়াল করেনি। লোকটা তাকে খেয়াল করাল, খেয়ে ল্যান ভাই। ঠা-া মারলে আর খাইতে পারবেন না। লোকটার কথায় তোয়েব আলি দেখল চিনামাটির বড় বড় দু’টি প্লেট। একটাতে তন্দুরি। আর একটাতে পায়চা। পায়চা দেখে তোয়েব আলির চোখ কপালে উঠার জোগাড়। গরুর গোটা ঠ্যাং সাজিয়ে দিয়েছে যেন চিনামাটির প্লেটে! সত্যিই বাঢ়িয়া খানা। কিন্তু পায়চার হাড় এত বড় বড় কেন? কীভাবে খাবে? এতবড় হাড় মুখে লাগিয়ে মজ্জা টানা যায় নাকি? হঠাৎ তোয়েব আলির মনে পড়ে যায় মাকে। আব্বাকে। ছোটবেলায় মা যখন আব্বার সঙ্গে ইদের নামাজ কিংবা জুম্মার নামাজ পড়তে পাঠাত। তার যেতে ইচ্ছে করত না। আব্বাও চাইত না সে যাক। বলত, ‘এতটুকু বাচ্চা নামাজের কী জানে যে নামাজ পড়বে?’ 
মা তখন বলত, ‘জানে না বলে কি জানতে হবে না?’ 
‘কীভাবে জানবে? আমার সঙ্গে গেলেই জানা হয়ে যাবে?’ আব্বা জিজ্ঞেস করত। 
মা জোর দিয়ে বলত, ‘আলবত জানা হবে।’ 
‘কীভাবে?’ 
‘কেন, তোমার সঙ্গে নামাজে দাঁড়াবে। তুমি যা করবে, ও তাই করবে। বাচ্চারা তো দেখে-শুনেই বড় হয়।’ 
আব্বা বলেছিল, ‘বাহঃ বেশ তো বুদ্ধি তোমার!’ 
আব্বা সেদিন মাকে রসিকতা করলেও মায়ের সে দিনের সেই বুদ্ধিকে আজ কাজে লাগায় তোয়েব আলি। তার পাশে বসা লোকটা। যার নাম জালু। এই বিদেশ-বিভূঁয়ে যে তার গাইড! সেই লোকটা কী ভাবে পায়চা খাচ্ছে? সে দেখবে। 

ছয়
তোয়েব আলি ভালো করে দেখছে। লোকটা বাঁ-হাতটা পায়চার প্লেটের ওপর ধরে ডান হাতে পায়চার মোটা হাড়টা শক্ত করে ধরে ডান হাতের কবজি বাঁ-হাতের কবজিতে বাড়ি মারছে। আজব ব্যাপার ওতেই ওই মোটা হাড়টার ভেতর থেকে মজ্জা খসে খসে পড়ছে চিনা মাটির প্লেটে। গল্পকারের খোঁজে এসে গল্পের খোঁজ পাচ্ছে তোয়েব আলি। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। তার আনন্দে নিচের খালের কাদা-জলে অগুনতি কুকুর লটাপটি খাচ্ছে। কাকগুলি হোটেলের নিচের বদ্ধ হাওয়ায় মুক্ত হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ওদের সবার উল্লাস ভেসে আসছে তার কানে। একই সঙ্গে মায়ের আঁচল ধরে বস্তির কাচ্চাবাচ্চাদের কান্না শুনতে পাচ্ছে সে। ‘মা খেতে দে না গে মা! এ-মা! পেট জ্বলে যেছে যে গে মা!’ লোকটার ঘরের দরজার পাশে পরিত্যক্ত শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গের মাথায় বসন্ত বাতাসে পাশের বেলগাছ থেকে একটা-দু’টো বেল পাতা খসে খসে পড়ছে। তোয়েব আলির চোখে সেই দৃশ্যও ভেসে উঠছে। তোয়েব আলি শুনে শিখছে। দেখে শিখছে। তোয়েব আলি বড় হচ্ছে। 
তোয়েব আলির মা কবরে শুয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে।
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 

মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন