ঘাসফুলের নাকফুল
মোহছেনা পারভীন
হুঁকোয় একটা টান দিয়ে চেঁচিয়ে মেয়েকে ডাক দেয় নেকবর। কইরে, কই গেলি রুকি হুক্কায় কয়ডা কয়লা চুলা থাইকা আইনা দে দেহি। হুক্কায় টান দিয়া মজা পাইতেছি না। রুকি বাপের হুঁকোর জন্য কয়েক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা চুলা থেকে নিয়ে কলকিতে ভরে ফুঁ দিতে থাকে। নেকবর মেয়েকে বারণ করে জোরে ফুঁ দিতে, আগুন ছিটকে মুখে কাপড়ে লাগতে পারে।
মা মরা মেয়ে রুকি। জন্মের দু’ মাসের মাথাতেই মাকে হারায়। মা মরা মেয়েটিকে আগলে রেখেছিলেন দাদীই। তিন বছরের মাথায় মারা যান দাদীও। সেই থেকে রুকির বাপ-মা সবই নেকবর। নেকবর ধনী গেরস্তের বাড়ির ধানকাটা, ধানের বীজ বোনা, ধানের চারা রোপনের কাজ করে। যখন ফসলের ভরা মৌসুম তখন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে নেকবর। রুকিকে নিয়ে তখন মুশকিলে পড়ে যেতো, ছোট্ট মেয়েকে একলা ঘরে রেখে আসতে পারতো না। খেতের আইলে বসিয়ে ধান কাটতো।
শ্যামলা বরণ মেয়েটির বয়স সবে ষোলো পেরিয়েছে। গাঁয়ের মেয়ে ষোলোতেই অনেক বড় হয়ে যায়। অনেক কিছু বুঝতে শেখে। মা নেই, সংসারের সব কাজ তাই রুকিকেই সামাল দিতে হয়। গ্রামের মেয়েদের সাথে খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়ির মাঝেও তাকে বাপের জন্য রাঁধতে হয়। ঘর গুছিয়ে রাখতে হয়। রুকিরও নিজেকে বড় ভাবতে ভালো লাগে। এখন ও শাড়ি পরে।
রুকির একটা নাকফুলের ভীষণ শখ। নাকে পরলে কী সুন্দর লাগে। পাশের বাড়ির চাচির কাছে বলেছিলও সে কথা। চাচি হেসে বলেছিলো, বিয়ে হোক তখন পরতে পাবি। লজ্জা পেলেও বিয়ের কথায় আলাদা একটা শিহরণ অনুভব করে রুকি। খেলতে খেলতে নিজের সংসারের একটা স্বপ্নও এরই মাঝেই তৈরি হয়ে আছে তার হৃদয়ে। মাঝে মাঝে বিয়ের প্রস্তাবও আসে রুকির।
পুকুরঘাটে পানি আনতে গেলে রুকির চোখ আটকে যায় ঘাসফুলে। পুকুরের পারে ঘন ঘাস কার্পেটের মত ছেয়ে আছে। তার মাঝে ঘাসফুলগুলো যেনো একেকটা নাকফুল। পরম মমতায় ঘাসের কার্পেটে হাত বুলায় রুকি। একটি ফুল ছিঁড়ে নাকে পরে। মনে হয় নিজেরও একটা সংসার আছে। লজ্জা খেলা করে রুকির চোখেমুখে। নাক থেকে হঠাৎই খুলে পড়ে যায় ঘাসফুল। মনে পড়ে চাচির কথা। চাচি বলেছিলা, সতী নারীর প্রধান চিহ্নই হলো নাকফুল। সতী নারীর নাক থেকে স্বামীর দেওয়া নাকফুল কখনওই খুলে পড়ে না। চমকে ওঠে রুকি। আবার আরেকটি ফুল ছিঁড়ে জিহবার পানি দিয়ে ভিজিয়ে নাকে পরে। এবার নাকে আটকে আছে ঘাসফুলের নাকফুল। মুখে হাসি ফোটে রুকির। পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকায়। পানির ভেতরে নিজেকে দেখে। অন্যরকম লাগে। ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে নাকফুলের দিকে।
পশ্চিম পাড়ার এক বুড়ি ভিক্ষা করতে আসে রুকিদের গ্রামে। সবাই তাকে বগির মা ডাকে। ছোট থেকেই রুকিকে দেখছে সে। মায়া লাগে মেয়েটির জন্য। বাপের উপকার হয় এই ভেবে বগির মা তার গ্রামের এক ছেলের সাথে রুকির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। ছেলের নাম নুরু মিয়া। রিকশা চালায়। বাবা নেই। আছেন শুধু বৃদ্ধা মা। ছোট্ট সংসারে মেয়ে সুখী হবে ভেবেই রুকির বাপও প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করে। ছেলের পক্ষও রুকিকে দেখে খুব পছন্দ করে। তাদের কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। বৃদ্ধা শাশুড়ির সেবা করবে এটাই ছেলে পক্ষের চাওয়া।
পঞ্জিকা দেখে একটি ভালো দিনে বিয়ে হয় রুকির। সন্ধ্যার আগেই শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে যায় রুকি। গ্রামের মানুষ নতুন বৌকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমায় নুরু মিয়ার বাড়িতে। খুব সুন্দর লাগছিলো রুকিকে। বিশেষ করে নাকে চান্দি রূপার নাকফুলে বেশ মানিয়েছে নতুন বৌকে। সবার দৃষ্টি নাকফুলের দিকে। নুরু মিয়া দিয়েছে এই নাকফুল।
পূর্ণিমা রাত। বালিকা বধূর সারা শরীরে ভরা জোছনার ঢেউ। মনে হচ্ছে বিয়ের শাড়িতে বাড়তি কারুকাজ। লম্বা ঘোমটা টেনে চোখ বুজে বসে থাকতে থাকতে রুকি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই বুঝতে পারেনি। সকালে মোরগের ডাকে তার ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠে একটি ঝাড়– নিয়ে নেমে পড়ে উঠান ঝাড়– দিতে। আশপাশের অল্প বয়সের মেয়েরা রুকির উঠান ঝাড়– দেওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য ভিড় জমায়। কত ভোরে নতুন বউ ঘুম থেকে উঠেছে সেটি দেখার জন্য বয়স্ক মহিলারাও নুরু মিয়ার বাড়িতে আসে। এই দলে ছিলো বগির মাও। বগির মায়ের চোখেই প্রথম ধরা পড়ে বিষয়টি। নাকফুল নেই নতুন বৌয়ের নাকে। বগির মা রুকিকে জিজ্ঞাসা করে, এই পোড়ামুখী তোর নাকফুল কই? নাক স্পর্শ করে নাকফুলের অস্তিত্ব না পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় রুকি। পাগলের মতো উঠোনজুড়ে ধুলোবালি ময়লা-আর্বজনার মাঝে খুঁজতে থাকে নাকফুল। ততক্ষণে পুরো গ্রামের বৌ-ঝিদের মাঝে খবর হয়ে যায় নতুন বউয়ের নাকের ফুল হারিয়ে যাওয়ার কথা।
গ্রামের লোকের ধারণা বিয়ের রাতে নাকফুল হারিয়ে যাওয়া অশুভ লক্ষণ। অমঙ্গল হয় স্বামীর। ছেলের আশু অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন নুরুর মা। মায়ের কান্না শুনে ঘুম ভাঙে নুরুর। বাইরে এসে সব কিছু জানতে পেরে নাকফুল খুঁজতে থাকে নুরুও। ঘরের ভেতর এলোমেলো বিছানায় খুঁজে পায় নাকফুল। সবাই আশ্বস্ত হয়। তবুও কথা থামে না বৌ-ঝিদের। রুকিকে ইঙ্গিত করে নানা কথায় শুনায়। রুকির কা-জ্ঞানহীনতার কোনো তুলনা খুঁজে পায় না তারা। লজ্জায় অপমানে বারান্দার খুঁটি ধরে মূর্তির মতো নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে রুকি। নুরু তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরে।
সুখে-দুখে রুকির দিন কেটে যাচ্ছিলো এক রকম। হঠাৎ বাড়ি থেকে নুরুর রিকশাটা চুরি হয়ে যায়। রুজি রোজগারের একমাত্র অবলম্বন রিকশাটি চুরি হয়ে যাওয়ায় সকলেরই যেনো মাথায় হাত পড়ে। রুকিও ভীষণ ভাবনায় পড়ে। কীভাবে চলবে সংসার! শাশুড়ির চিৎকারে রুকির ভাবনার জাল ছিঁড়ে। রুকির শাশুড়ি চিৎকার করে বলতে থাকে, এই পোড়াকপালী যেইদিন আমার বাড়িতে আইছে হেইদিন থাইকাই আমার অমঙ্গল শুরু হইছে। আভাগীর বেটি পরথম দিনই যখন নাকফুল হারাইছে হেই দিনই বুঝবার পারছি এই মাইয়া আমার সংসার ধ্বংস করতে আইছে। নুরুরও মনে হলো মা ঠিকই বলছে। এতোদিন তার রিকশা চুরি হয়নি। এখন কেনো চুরি হবে! মনে মনে রুকির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই খেপার মতো ঘরে ঢুকে রুকিকে টেনে হিঁচড়ে উঠোনে এনে বুকে পিঠে কিল দিতে শুরু করে নুরু। অসহায় রুকি বাবা গো-মাগো বলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। রুকির কান্নায় নুরুর কোনো ভাবান্তর হয় না। সে চিৎকার করে বলতে থাকে। অলক্ষ্মীর মাইয়া তোর লাইগা আমার রিকশা গেছে তুই এহন তোর বাপের কাছ থাইকা আমার রিকশা আইনা দিবি।
স্বামীর সংসারে রুকির এখন আর কোনো মূল্য নেই। রিকশা হারানোর পর থেকে নুরু মিয়া যেনো পাল্টে গেছে। কথায় কথায় রুকির দোষ ধরে। বাপের কাছ থেকে রিকশা এনে দেওয়ার জন্য প্রায়ই রুকিকে নির্যাতন করে করে সে। একটু ছুতো পেলে শাশুড়িও ছেড়ে কথা কন না। রুকি নীরবে সব হজম করে। জানে তার বাপের সামর্থ নেই রিকশা এনে দেওয়ার। তাই নীরবে সয়ে যেতেই হবে।
এক রাতে ক্লান্ত রুকি ঘুমিয়ে আছে। চুপিচুপি ঘরে ঢোকে নুরু। আস্তে করে রুকির নাকফুলটি খুলে নেয়। টের পায় না রুকি। পরদিন সকালে নুরু এক গ্লাস পানি চায় রুকির কাছে। যন্ত্রের মতো নুরুকে পানি এনে দেয় রুকি। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আচমকা নুরু বলে উঠে, তোর নাক ফুল কই? উত্তরে রুকি বলে, ক্যান নাকেই তো আছে।
ঝাঁঝিয়ে উঠে নুরু, নাকে থাকলে কি জিগাই? কী করছোছ ক’?
নুরুর ঝাঁঝালো কণ্ঠে ভয় পেয়ে নাকে হাত দেয় রুকি। টের পায় নাকের ফুল নেই। হয়তো নিচে পড়ে গেছে, তাকায় মেঝের দিকে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই গ্লাসের পানি রুকির চোখেমুখে ছুঁড়ে মারে নুুরু। নে তোর পানি তুই খা। আমি তোর হাতে কিছুই খামু না। তুই অলক্ষুণে। তোর শ্বাসেও বিষ। এই বিষে আমার মরণ হইবো। যা আমার ঘর থাইকা বাইর হ। এই বলে নুরু রুকিকে লাথি দিতে থাকে। টেনে হিঁচড়ে তাকে বের করে দেয় ঘরের বাইরে।
ক্লান্ত দেহে রুকি ফিরে আসে নিজের গ্রামে। মেয়ের চেহারা দেখে যা বুঝার বুঝে নেয় নেকবর। স্বামীর সাথে ঝগড়া হয়েছে হয়তো। মেয়েকে কিছুই বলে না নেকবর। বুঝতে পারে এখন কথা বললে মেয়েটির কষ্টই শুধু বাড়বে। ভাবে দুয়েক দিন যাক, নিজেই দিয়ে আসবে মেয়েকে।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙে নেকবরের। মেয়েকে ডাকতে চায় না, ভাবে ক্লান্ত মেয়েটা একটু বিশ্রাম নিক। চোখ পড়ে পুকুর পাড়ে। এতো ভোরে পুকরপারে জটলা দেখে অবাক হয়। এগিয়ে যায় নেকবর। ভিড় ঠেলে সামনে এগোয় সে। পুকুরে চোখ পড়তেই স্তব্ধ হয়ে যায় নেকবর। পানিতে ভাসছে তার আদরের মেয়ে রুকি, নিষ্প্রাণ। মুখ ঢেকে আছে পারে থাকা ঘাসফুলে। ঝাপসা হয়ে আসে নেকবরের চোখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন