শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গল্প >> হঠাৎ দেখা : সাঈম চৌধুরী

হঠাৎ দেখা

সাঈম চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ দেখা কবিতায় আটকে আছি অনেকদিন। সেই কবে পড়েছিলাম, মাথা থেকে যায় না সহজে। রেলে কিংবা বাসে কোথাও যাওয়ার সময়ে এদিক-ওদিক তাকাই। চেনা লোককে খুঁজি অচেনার গাম্ভীর্যে। কিন্তু এমন কাউকেই পাই না। আজকাল হারিয়ে যাওয়াটা যেনো অসম্ভব হয়েছে। কেউ হারিয়ে যায় না। হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে ওঠে, কিছুকাল না দেখা মানুষটি কীভাবে জানি নম্বর যোগাড় করে নেয়। ফেইসবুকে গেলেই চোখে পড়ে, দূরে চলে যাওয়া কোনো বন্ধুর আরেকবার বন্ধুত্বের নিমন্ত্রণ। সামাজিক যোগাযোগের সতেরো ইঞ্চির স্ক্রিনের পাতায় পাতায় ছবি, সেইসব ছবিতে কেউ আইফেল টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে এক মুখ হাসি নিয়ে জানান দেয়, ভালো আছে এবং সহায়-সম্পদে আছে। আবার কেউ কেউ তিন হাত লম্বা মন্তব্য লেখে বুঝিয়ে দেয়, কাজের ফাঁকেও আছে প্রচুর অবসর। মনে হয়, সুখে আছে সবাই আর সবচেয়ে বড় কথা এখন আর হারিয়ে যেতে কিংবা হারিয়ে দিতে কেউ রাজি হয় না। তবুও ট্রেনে চাপলে হঠাৎ দেখা কবিতার কথা খুব মনে হয়। এদিক-ওদিক তাকাই। আজকাল ট্রেন জার্নি একটু বেশিই হচ্ছে। মাসে এক দুইবার ঢাকা-সিলেট। বাসে যাই না। দুর্ঘটনার ভয়। প্রায় সময়ই ট্রেনে পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। কেমন আছেন, কেমন কাটছে এই ধরনের টুকটাক কথাবার্তা। রেলযাত্রা শেষ হলে এসব সাক্ষাতের কথা মনে থাকে না আর।
আজকের ট্রেনে অবশ্য হঠাৎ দেখা কবিতার কথা মনে ছিলো না একটুও। চিন্তা আটকে ছিলো পত্রিকার পাতার শব্দজটে। পঞ্চাশ টাকা বাড়তি দিয়ে ট্রেনের টিকেট কেটেছি। বলা হয়েছিলো, সিট নেই। কথাটা একদম মিথ্যা। ট্রেনে অনেকগুলো সিট খালি। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। আমার থেকে উল্টো দিকের দুই সিট দূরত্বে মুখোমুখি এক নারী বসে আছেন। বোরকায় পুরোটা মুখ ঢাকা। শুধু চোখ দুটি বেরিয়ে আছে। শব্দজটে আটকা থাকলেও বারবার মনে হতে থাকে, ঐ নারী আমাকেই দেখছেন। শুধু দেখছেন না, তীক্ষèভাবে তার মগজে যেনো আমাকে গেঁথে নিচ্ছেন। বোরকাতে বিভ্রান্তি আছে আমার। কেউ বোরকা পরে থাকলে তার বয়স আন্দাজ করা যায় না। হয়তো নানী, হয়তো চাচী, হয়তো পাশের বাসার খালাম্মা কিংবা সদ্য স্কুল শেষে কলেজে পা দেওয়া কোনো মেয়ে। দু-একবার তার চোখে তাকিয়েছি। চোখ ফেরাননি তিনি। একা মহিলা। সাথে কেউ নেই। ট্রেন ছাড়েনি তখনো। কমলাপুরে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। 
বোরকার আড়ালে থাকা চোখ দুটির পলকবিহীন পর্যবেক্ষণ আমাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে। তার চোখ চেনা কারো চোখের সাথে মেলে না। আমি শব্দজটে ফিরে যেতে চাই, তিন অক্ষরের একটা নদীর নামের সন্ধান করি, যার শুরুর শব্দটি ’ক’।
ট্রেনের হুইসেল বাজে। শেষ মুহূর্তের একজন যাত্রী দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের কামরার দরজা ধরে উঠে পড়েন। আশেপাশে কয়েকটি সিট খালি থাকা সত্ত্বেও তিনি আমার পাশের সিটটাই দখল করে নেন। ট্রেন চলতে শুরু করে। অনুভব করি, বোরকার আড়ালেই দুই চোখ তখনো আমাকে দেখছে। আমি স্থির করি, তার এই তাকানোকে উপেক্ষা করবো। কিছু সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করতে পারি। যখন ঘুমোবার কিংবা চোখ বন্ধ করার বন্দোবস্ত নিচ্ছি, তখনই হাত ইশারায় এবং বোরকার আড়ালের চোখ দিয়ে মহিলা আমাকে ডাকেন। হঠাৎ দেখা কবিতার একটা লাইন মাথায় আসে, ’মনে হল কম সাহস নয়।’
আমার সঙ্গে পাশের সহযাত্রীও বোরকা পরা নারীর ইশারাকে খেয়াল করেন। ফিসফিস করে জানতে চান, চেনা কেউ নাকি আপনার?
আমি মৃদুস্বরে বলি, চিনি বলে মনে হয় না।
সহযাত্রী তখন সাবধান করে দেন, বুঝলেন বিশ্বাস করবেন না, অজ্ঞান পার্টির লোক হতে পারে! কিছু খেতে দিলে খবরদার খাবেন না।
আমি হাসি। আমার সাধের হঠাৎ দেখার এমন মর্মান্তিক পরিণতির কথা শুনে না হেসে উপায় আছে!
সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। এভাবে যখন ডাকছেন, কে জানে, অতি চেনা কেউ হতে পারেন। বোরকা খুলে দিলেই হয়তো দেখবো তিনি আমার বাড়িওয়ালার স্ত্রী।
কাছে গিয়ে জানতে চাই, আমাকে ডাকছেন?
চোখের ইশারায় হ্যাঁ উত্তর দেন, তারপর বলেন, কিছু মনে করবেন না, আপনি অপু, তাই না?
চমকে উঠি। হ্যাঁ, অপুই আমি। তবে অনেক আগের অপু। পাঠশালার অপু, পাড়ার বন্ধুদের চেনা অপু। বয়স হয়েছে, পুরাতন অনেক কিছুই হারিয়েছি। হারিয়ে যাওয়া এসব অনেক কিছুর মতোই অপু নামটাও হারিয়ে গেছে কবে। এখন আমি সোহরাব হাসান। সোহরাব-রুস্তমের মতো পোশাকি নাম। পোশাকি পরিচয়। অপু বলে আজকাল খুব কম মানুষই আমাকে ডাকে। কেবলমাত্র অপু নাম উচ্চারণের কারণে বোরকা পড়া এই নারীকে হঠাৎ আমার আপনার একজন বলে মনে হয়। তার ওপাশের সিটটা খালি ছিলো। তাতে বসে পড়ি। উৎসাহ নিয়ে বলি, ঠিক ধরেছেন আমি অপু, বোরকার কারণে আপনাকে দেখা যাচ্ছে না, তাই চেনাও যাচ্ছে না।
বোরকা না থাকলেও হয়তো আপনি আমাকে চিনতেন না, আমি হাজেরা।
হাজেরা? বড় একটা অপরিচিত নাম। তবুও নামটা তার কাছ থেকে নেওয়া মাত্র মগজের সার্চ ইঞ্জিনে ফেলে দিয়ে সার্চ বাটনে টিপ দেই। মগজের সকল স্মৃতির ফোল্ডারগুলো খুঁেজ-পেতেও হাজেরা নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। শুধু তার নামের সাথে মিল আছে, এমন একটাই নামের সন্ধান পাই, সেটা হলো জয়নাল হাজারী!
চিনতে পারেননি, তাই না? চেনার কথাও না। পেছনের বেঞ্চের ছাত্রী ছিলাম, আপনার সাথে পাঠশালা স্কুলে পড়েছি। এবার মনে পড়ছে হাজেরা নামটি? বোরকার আড়ালে তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
আমার কেনো জানি বেশ ভালো লাগে! ভাবতে ভালো লাগে বোরকাঢাকা এই মেয়েটি আমার কবেকার সেই ফেলে আসা সময়ের সহপাঠী। হাজেরা নামের কোনো সহপাঠীর কথা আলাদা ভাবে  মনে পড়ে না। স্মৃতিগুলো বড় বদমাশ। তার যা ইচ্ছা সে নিয়ে যায়, যা ইচ্ছা রেখে যায়।
আমি হাজেরাকে বলি, স্যরি নামটা মনে রাখিনি।
হাজেরা বলে, মনে রাখা আর মনে পড়ার মাঝে অনেক তফাৎ। মনে রাখা শব্দ দুটির মাঝে যতেœর বিষয় আছে, মনে রাখা মানে হচ্ছে তাকে আপনি রেখে দিয়েছেন, আর মনে পড়া বিষয়টা খুব সহজ, যখন-তখন অনেক কিছুই মনে পড়ে যেতে পারে আবার নাও পড়তে পারে। সুতরাং আপনার বলা উচিত হাজেরা নামটা মনে পড়েনি।
বোরকার আড়ালে এমন বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে আমি মুগ্ধ হই। চেনা না চেনার জটিলতাকে এড়িয়ে যেতে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। হেসে হেসে বলি, সহপাঠীর সঙ্গে যতদিন পরই দেখা হোক না কেনো, সে কখনো আপনি হয়ে যায় না, সহপাঠী চিরকাল তুমি কিংবা তুই।
হাজেরা বোধহয় হাসে। তবে বোরকা তার হাসিকে আড়াল রাখে। আপনি থেকে তুমিতে যেতে একটুও দ্বিধা করে না হাজেরা। বলে, তোমাকে দেখেই আমি চিনে নিয়েছি। বয়স হয়েছে, কিন্তু মুখটা যেনো সেই পিচ্ছি অপুরই রয়ে গেছে।
তাই নাকি?
ঠিক তাই। আর জানো তোমার অনেক কথাই আমার মনে থেকে গেছে। খুব ভালো ছাত্র ছিলে তুমি। থ্রি থেকে যখন ফোরে উঠলে, এক নম্বর হওনি বলে কী সেই কান্না তোমার। বেশ মজা লেগেছিলো। আমি পেছনের বেঞ্চের ছাত্রী। সব সময় সাতচল্লিশ, আটচল্লিশ রোল নম্বর। এক না হলে যে কাঁদতে হয়, এটা কী যে হাস্যকর ছিলো আমার কাছে!
কথা বলতে বলতে হাসে হাজেরা। শব্দ করে বালিকার মতো হাসি। পাঠশালা স্কুলের মতো হাসি। আমি এই কিছু সময়ের মধ্যেই হাজেরাতে শতভাগ মুগ্ধ হয়ে আছি। প্রাইমারি স্কুলের চল্লিশ-পঞ্চাশ সহপাঠীর ফাঁক গলে কবে জানি সে আমার জগত থেকে উধাও হয়েছে, মনেই নেই তা। কিন্তু হাজেরা সবকিছু মনে করে বসে আছে। থ্রি থেকে ফোরে উঠার সময়ে এক নম্বর হতে না পারার আমার ছেলেমানুষি কষ্টের কথাও তার স্পষ্ট মনে আছে। হাজেরার কাছে আমি অন্যরকম ঋণী হয়ে যাই, তাকে মনে না রাখার দায়ে অপরাধী হয়ে যাই।
হাজেরার কথা থামে না। তাকে বোধহয় স্মৃতির রোগ পেয়ে বসেছে। জানতে চায় সে, মনে আছে তোমার, সেদিন এক নম্বর কে হয়েছিলো? আমার কিন্তু তার কথাও মনে আছে। তার নাম ছিলো লিপি।
হাজেরার কথায় দুপ করে আমার লিপির কথা মনে পড়ে। আহা! লিপির সঙ্গে যদি একবার দেখা হতো। হঠাৎ দেখার মতো দেখা। লিপি আমার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী। লিপি। আমার প্রথম ভালো লাগা। নিজের উপর রাগ হয়। এমন কি লিপিকেও আমি ভুলে বসে আছি! ফেইস বুক, মোবাইল ফোন কিছুতেই লিপিকে খুঁজিনি, কিছুতেই লিপিকে পাইনি।
আমি বলি, খুব মনে পড়ছে। চোখের সামনে সাদাকালো সিনেমার মতো প্রাইমারি স্কুলের মাঠ দেখছি। দুপুর হয়েছে। টিফিনের জন্য আধঘণ্টার ছুটি। দে দৌড়! মিনতি দিদি, মতিন স্যার, মনোয়ারা আপা, ছুটির ঘণ্টা, হাজেরা আমার বেশ ভালো লাগছে। তোমার সাথে দেখা হয়ে আমার বেশ ভালো লাগছে।
হাজেরা বলে, আমারও বেশ ভালো লাগছে। ভাগ্যিস আমি তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম, ভাগ্যিস তোমার বয়স হলেও মুখটা সেই পিচ্ছি অপুর রয়ে গেছে। কী করো আজকাল?
দশটা-পাঁচটা অফিস, সিলেটÑঢাকা-সিলেট। সংসার। ছোট একটা মেয়ে। ছুটি পেলে মেয়ে আর তার মাকে নিয়ে এখানে-ওখানে বেড়াতে যাওয়া। এই তো যাচ্ছে জীবন, তোমার কী খবর?
আমার প্রশ্নে নীরব হয়ে যায় হাজেরা, দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। কিছু সময় পর সে তার বলে, স্বামী বড় মাওলানা। বড় একটা মসজিদের ইমাম। কঠিন পর্দাপ্রথা। বাইরের কারো সাথে আলাপ করি না, আলাপ করা যায় না। এই যে, একা শ্রীমঙ্গল ফিরছি, বোধহয় দশ বছরে একা কোথাও বেরুলাম। স্বামী তাবলিগে ছিলেন। আমার মা অসুস্থ। বাধ্য হয়েই তিনি একা যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। যদি জানেন, ফেরার পথে আমি তোমার মতো একজনের সঙ্গে কথা বলে বলে এসেছি, তাহলে বেচারার হার্ট অ্যাটাক হবে। তাবলিগ শেষ করে তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন। শ্রীমঙ্গল পৌঁছলেই দেখতে পাবো আমাকে নিতে ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাওলানা সাহেব।
কথা শেষে পানসে হাসি হাসে হাজেরা। নিজের কষ্টকে প্রকাশ করতে কোনো ভণিতা করেনি সে। আমার কেনো জানি তার জন্যে অনেক খারাপ লাগে। মনে হয়, ভুল মানুষের বৃত্তে আটকা পড়ে আছে আমার এককালের শেষ বেঞ্চে বসা সহপাঠিনী।
আমার এইসব ভাবনার ফাঁকে এক ঝটকায় নিজের বিষণœতাকে ঝেড়ে ফেলে হাজেরা বলে, থাক মাওলানা সাহেবের কথা। এসো, যতোটা পথ যাবো আমরা পুরাতন সময়কে সঙ্গে নিয়ে যাই। লিপির কথা মনে আছে তোমার?
আবার পুরাতন সময়। আবার লিপি। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া নিয়ে আমার আর লিপির কী তীব্র প্রতিযোগিতা। স্কুলের সবাই এটি বেশ উপভোগ করতো। স্যার কিংবা আপা আমাদের মধ্যকার এই প্রতিযোগিতাকে আরো উসকে দিতে চাইতেন। এইসব প্রতিযোগিতার মাঝে কোথায় জানি দুজনের একটা ঐক্যও হয়েছিলো। বয়স কম বলে, সেই সখ্যতা আলাদাভাবে চোখে পড়েনি, প্রাইমারি স্কুলের শেষদিন প্রথমবারের মতো টের পেয়েছিলাম, আমরা একজন অন্যজনকে প্রবলভাবে ভালোবেসেছি। একটা ব্যাপার, কেউ জানে না। কেবল আমি আর লিপি তা জানি। স্কুলের শেষদিন কলঘরের পেছনে আমরা একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছি।
এরপর আরও দুই বছর লিপির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিলো। সে বালিকা স্কুলের ছাত্রী। আমি এইডেড স্কুলের ছাত্র। একই এলাকার বাসিন্দা। প্রায় সময়ই একসাথে-একপথে আমরা স্কুলে যেতাম। লিপিকে তখন আমি অনেক চিঠি লিখেছি। ছেলেমানুষী সব চিঠি। লিপিও যতœ করে চিঠির উত্তর দিতো। এসব চিঠিতে কখনো আমরা একজন অন্যজনকে বলিনি ভালোবাসি, কিংবা ভালোবাসা কাকে বলে সেটিও আমরা জানতাম না। কিন্তু গভীর মমতা নিয়ে আমরা অনেক অনেক চিঠি লেখেছি।
লিপির বাবার ছিলো সরকারি চাকরি। একদিন বদলির আদেশ আসে তার। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে। লিপির সঙ্গে আরেকটা গোপন ব্যাপার ছিলো আমার, কেউ জানে না সেটা। লিপিরা যেদিন আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যায়, সিলেট থেকে দিনাজপুর, তখন মনে হচ্ছিল, দিনাজপুর পৃথিবীর বাইরের একটা অঞ্চল। দিনাজপুরে যে যায় সে আর ফিরে আসে না কখনো। লিপি চলে যাওয়ার আগের দিন আমাকে তার প্রাইমারি স্কুলের ব্যাগটা দিয়ে যায়। ব্যাগটা দিতে লিপি আমাদের বাসায় এসেছে। আমার মায়ের সাথে কথা বলে। বাবার সাথে কথা বলে। তারপর আমার রুমে আসে। কথা বলতে পারে না সে। কেবল কান্না আসে। আমিও কাঁদি। তখন আমাদের মাঝে গোপন সেই ব্যাপারটা ঘটে। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি কারো গালে চুমু এঁকে দেই। লিপি তখন চোখ বন্ধ করে থাকে। আমি তখন আরেকটা বিষয় আবিস্কার করি, চোখ বন্ধ করে থাকলেও কান্না আটকে রাখা যায় না। কান্নার শক্তি এমনই তীব্রতর।
সেই লিপিকে আমি ভুলে গেছি। দিনাজপুর যাওয়ার পর প্রথম প্রথম চিঠি লেনদেন হতো। তারপর হয়তো লিপি নতুন বন্ধু পায়, আমারও বন্ধু ভুবন বিস্তৃত হয়। একসময় লিপি আর আমি আমরা দুজনে পুরাতন স্মৃতি হয়ে যাই।
আজ হাজেরা আমাকে আবার লিপির কাছে নিয়ে যায়। জীবনে এই প্রথমবার আমি নিজের বাইরে অন্য একজন এই হাজেরাকেই বলি, জানো হাজেরা আমি লিপিকে খুব ভালোবাসতাম।
হাজেরার চোখ তখন ছলছল করে ওঠে। কাঁদছে নাকি মেয়ে? কী হলো হাজেরা, উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করি।
হাজেরা বলে, লিপির খবর জানো?
না-তো। ওরা দিনাজপুর যাওয়ার পর আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি।
আমার কথা শেষ হয় না, তার আগেই হাজেরা বলে, লিপি আর নেই। দশ বছর আগেই মারা গেছে সে।
হঠাৎ ট্রেন তীব্র ব্রেক কষে। কেউ একজন ড্রাইভারকে গালি দিয়ে উঠে। একটা বাচ্চা কাঁদে। এই ব্রেক, এই গালি, এই কান্না কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। আমার শরীর হিমশীতল হয়ে আসে। ট্রেনের সিটের সঙ্গে যেনো তীব্রভাবে আটকা পড়ে পা। হাজেরা আমার কাছে লিপিকে নিয়ে এসেছিলো, হাজেরা আমার কাছ থেকে লিপিকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। যে লিপি অনেক আগেই আমার জগত থেকে গত হয়েছে, তার গত হওয়ার সংবাদে সবকিছু ছাড়িয়ে লিপি যেনো সবচেয়ে বড় বর্তমান হয়ে দাঁড়ায়।
আমি কিছু বলতে পারি না। টের পাই, এটা এমন এক ধরনের শোক যার কোনো ভাষা নেই। হাজেরা আমাকে সময় দেয়। শোক সহ্য করার সময়। কিছু সময় তাই সে নীরব থাকে।
ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। হাজেরা আবার কথা বলে। যথারীতি লিপির কথা। সে বলে, সবার সঙ্গে যোগাযোগ না হলেও লিপির সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। ও দিনাজপুর চলে গেলেও চিঠি লিখতাম আমরা। তারপর একসময় তার বাবা আবার বদলি হয়ে শ্রীমঙ্গল আসেন। আমার বাবাও তখন শ্রীমঙ্গলের চা-বাগানে চাকুরি করেন। একদিন অবাক হয়ে আবিস্কার করি, লিপি আমার প্রতিবেশী। সেই থেকে লিপি ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
আমি বলি, হাজেরা লিপির কথা থাকুক। আমরা অন্য কথা বলি।
হাজেরা বলে, না আমরা লিপির কথা বলবো। আজ এই ট্রেনে তোমার আর আমার সাথে আরো একটা মানুষ আছে। সে লিপি। চমৎকার সেই মেয়েটির কথা এখন আর কেউ বলে না। সবাই ভুলে গেছে। এসো আমরা আজ লিপির গল্পগুলো বলে যাই। জানো, তার একটা স্বপ্ন ছিলো, একদিন বড় ডাক্তার হবে। আমাকে বলতো, জানিস হাজেরা, এই যে চা-বাগান, এখানকার কত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, আমি যদি ডাক্তার হতে পারি, এদের জন্য কিছু করবো।
হাজেরাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বলি, মনে আছে হাজেরা লিপির একটা লাল জামা ছিলো। স্কুলে যেদিন বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান হতো সেদিন সে ঐ জামাটা পড়ে আসতো। একদিন কি হলো জানো, আমার বলপয়েন্ট কলমটা কালি ছেড়ে দিয়েছিলো, ঐদিন লাল জামাটা পড়ে এসেছিলো লিপি। আমি কী করলাম, বল পয়েন্টের কালি তার লাল জামায় লাগিয়ে দিলাম। এরপর টানা এক সপ্তাহ লিপি আমার সাথে কথা বলেনি।
হাজেরা বলে, লিপি শ্রীমঙ্গল আসার পর তোমার গল্প করতো। তোমরা নাকি একজন অন্যজনকে চিঠি লিখতে?
হ্যাঁ। কেনো জানি না হঠাৎ করেই চিঠি লেখা বাদ দিয়েছিলাম দুজনে।
হাজেরা বলে, কী লিখতে তুমি চিঠিতে?
আমি বলি, চিঠি যে লিখে মনে রাখার দায় তার নেই, চিঠি যে পায় মনে রাখতে হলে সেই রাখে। লিপি গেছে, যাওয়ার সময় আমার চিঠিগুলোও সঙ্গে নিয়ে গেছে।
আর লিপি যে চিঠিগুলো লিখতো তোমাকে, মনে আছে সেইসব চিঠির কথা, জানতে চায় হাজেরা।
আমি বলি, কিছু তার মনে আছে, কিছু তার ভুলে গেছি। একটা বিষয় মনে আছে, প্রতিটি চিঠির শুরুতে চমৎকার সম্মোধন করতো লিপি, চিঠি শুরু হতো প্রিয় বান্ধব সম্বোধনে। আর আমি প্রতিটি চিঠির শুরুতে লিখতাম, লিপির শুরুতে ভালোবাসা নিবে।
হাজেরা বলে, লিপির কথা সব সময় আমার কেনো বিশেষভাবে মনে পড়ে, জানো?
কেনো, বিশেষ কোনো কারণ আছে নাকি?
হ্যাঁ। আমার যেদিন বিয়ে হলো সেদিন সকালেই লিপির মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে অনেক কেঁদেছি। সবাই বলে কনের কান্না। আমি শুধু জানি প্রিয় বন্ধু লিপির জন্য কাঁদছি।
কী হয়েছিলো লিপির, জানতে চাই আমি।
হাজেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, জানি না। তবে মনে আছে, শেষ দিকে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলো সে। তার বাবা মারা গেলেন। পরিবারের জমানো সঞ্চয় ছিলো খুব কম। মাও প্রায় সময় অসুস্থ থাকতেন। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ালো মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হতো। এসব কারণে লেখাপড়াও আর হয়নি তার। যে মেয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিলো, মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরই পড়া ছাড়তে হয় তার। হাজেরা বলে, লিপি তার জীবনের শেষ সময়ে ছিলো বড় বেশি হতাশ। সবকিছুই যেনো তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। আসলে কখনো কখনো আমার মনে হয়, মরে গিয়েই বেঁচে গেছে লিপি।
হাজেরা যখন লিপির গল্প বলে তখন আমি হাফপ্যান্ট পড়া লিপিকে দেখি, স্কুলের মাঠে দৌড়ছে সে। দৌড়ছে লিপি, আমার প্রিয় সহপাঠী লিপি, আমার প্রথম প্রেম, আমার প্রথম ভালো লাগা। দৌড়তে দৌড়তে এ কোথায় চলে গেলি তুই বন্ধু, এভাবে কি যেতে হয়?
আমার হঠাৎ মনে পড়ে, আসলে হঠাৎ দেখা কবিতার দীর্ঘদিন আটকে থেকে আমি আসলে নিজের অজান্তে লিপির জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। একদিন তার সাথে আমার ট্রেনে দেখা হবে, এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানাবে কাছে আসতে। তারপর বসবো এক বেঞ্চিতে। নানা কথার ফাঁকে সে বলবে, ‘কিছু মনে কোরো না, সময় কোথা সময় নষ্ট করবার। আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই; দূরে যাবে তুমি, দেখা হবে না আর কোনোদিনই। তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে, শুনবো তোমার মুখে।’ তারপর জানতে চাইবে, আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি?’
হাজেরা যেনো আরো কী কী বলে। আমি তার কিছু শুনি না। তারপর সে বলে, এই অপু, কী হলো?
ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। হাজেরাকে বলি, লিপিকে আমি ভুলে ছিলাম, কিন্তু সে বেঁচে ছিলো, আমার ভুলে যাওয়ার মধ্যে সে চিরকালই বেঁচে থাকতো, অথচ আজ তাকে মনে করিয়ে দিলে তুমি, আর মনে করিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরের মতো চিরকালের জন্য তাকে মৃত করে দিলে। আর কখনো ট্রেনে তাকে দেখবো বলে অপেক্ষায় থাকবো না। হঠাৎ দেখা কবিতাটা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে?
হাজেরা জানতে চায়, তুমি বুঝি তাকে খুঁজতে?
আমি বলি, চেতনায় নয় অবচেতনে আমি আসলে বহুদিন থেকে লিপিকে খুঁজছিলাম। হাজেরাকে বলি, শোনো হাজেরা দৈবক্রমে যদি তোমার সাথে দেখা হলো, দৈবক্রমে যদি তোমার আমার যাত্রায় লিপিও সঙ্গী হলো, তবে শোনো তোমার কাছে কিছুই গোপন করবো না। জীবনে প্রথম জড়িয়ে ধরেছিলাম তাকে। জীবনে প্রথম বিয়োগের কান্না আমি তার জন্য কেঁদেছি।
হাজেরা বলে, মরে যাওয়ার পর কী হয় আমি জানি না, কিন্তু আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে, লিপি নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও বসে তোমার কথা শুনছে। লিপি নিশ্চয়ই অনেক অনেক খুশি হচ্ছে।
লিপি নিয়ে আমাদের কথাবার্তা এতটুকুই হয়। পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাপথে হাজেরা আরো নানাভাবে লিপিকে নিয়ে আসতে চায়। আমি উপেক্ষা করি। এক সময় সেটা ধরতে পারে সে। আমাদের গল্পগুলো তখন ছেলেবেলার অন্য গল্পগুলোর সন্ধান করে। এক সময় একই এলাকায় থাকতাম আমরা। তাই এলাকার মানুষগুলোর কথাও গল্পে আসে। পারাবত ট্রেনের ’চ’ নম্বর বগিটির অন্য যাত্রীরা হয়তো ভাবে, আমরা দুজন মাঝবয়েসি মানুষ তাদের সঙ্গী। কিন্তু আমরা জানি, কামরার এই দুইটি সিটের দুই বাসিন্দা পুরোটা পথ পাঠশালা স্কুলের বয়েসি হয়ে পার করেছি। আমাদের ঘোরলাগা চোখ ছিয়াশির ক্যালেন্ডারে আটকে আছে।
গল্পে গল্পে ট্রেন এক সময় শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি পৌঁছে। বোরকার আড়ালে আমি হাজেরার বেদনাহত দুইটি চোখ দেখি। ট্রেন যখন একদম শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি তখন প্রচ- সাহসী এক প্রস্তাব করে বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা হাজেরা। সে বলে, কিছু মনে করো না, অপু, আমার খুব ইচ্ছা করছে একবার ছেলেবেলাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি। তুমি কি তোমার হাতটা একটু বাড়িয়ে দেবে?
ট্রেনের আর কোনো যাত্রী দেখলো কি না কে জানে, আমি হাত বাড়িয়ে দেই। আমার হাত ধরে হু হু করে কাঁদে হাজেরা।
তারপর ট্রেন ঠিকই শ্রীমঙ্গলে থামে। ছোট দুটি ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় হাজেরা। কোনো বিদায় সম্ভাষণ নয়, আবার দেখা হওয়ার আশাবাদ নয়, বোরকা পড়া অচেনা মহিলা হিসেবেই ট্রেন থেকে নামে হাজেরা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, অনেক মানুষের ভিড়ে হাজেরা যেভাবে বলেছিলো, ঠিক সেভাবেই ছাতা হাতে এক মাওলানাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। উদ্বিগ্ন চোখে ট্রেনের কামরার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। এক সময় হাজেরা গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। আমি গভীরভাবে প্রত্যাশা করি, হাজেরা চোখ ফিরে তাকাবে। হাজেরা তাকায় না। ট্রেনের হুইসেল বাজে। ট্রেন ছেড়ে দেয়। স্টেশনে অনেক মানুষ। আমি হাজেরার দিকে তাকিয়ে থাকি। হাজেরা চোখ ফেরাও, একবার চোখ ফেরাও হাজেরা। ট্রেন চলে যাচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দেই। ট্রেন ছুটছে। তখনই, ঠিক তখনই মুখ ঘুরিয়ে তাকায় হাজেরা। মানুষের ভিড়। আমি কিছু দেখি না। আমি হাজেরার চোখ দেখতে চাই। বোরকার আড়ালে তীক্ষè আর গল্পভরা দুই চোখ। দেখা হয়ে উঠে না আর। স্টেশন আর স্টেশনের মানুষগুলো একসময় ছোট হয়ে আসে।
সিলেট পৌঁছতে আরো ঘণ্টা দেড়েকের যাত্রা। ক্লান্ত অবসন্ন বোধ করি। চোখ বন্ধ করে দেই। হাজেরার চোখ দুটি দেখি। মেয়েটার জন্য প্রবল মায়া হয়। একসময় তন্দ্রামতো আসে। তন্দ্রাতেও পাঠশালা। মতিন স্যারের ক্লাস। রোল কল করছেন স্যার। সোহরাব হাসান অপু, হাজির স্যার। রাহাত খান রাছি, উপস্থিত। নাসিমা বেগম বাবলী, উপস্থিত। মোজাম্মিল হোসেন মোরশেদ, উত্তর নেই। রুবিনা খান লিনা, প্রেজেন্ট স্যার, হাজেরা বেগম লিপি, উপস্থিত।
ভীষণ চমকে উঠি, এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে যায়। এত বোকা আমি, এত বিস্মৃতিপ্রবণ! মনে পড়েছে, এই তো স্পষ্ট মনে পড়েছে, লিপির অন্য নাম হাজেরা বেগম। বোরকা আমাকে বোকা বানিয়ে গেছে। লিপি আমাকে বোকা বানিয়ে গেছে। হাজেরা আমাকে বোকা বানিয়ে গেছে। হাজেরা পরিচয়ে শ্রীমঙ্গলে যে মেয়েটি নেমে গেলো সেই তবে মরে যাওয়া লিপি ছিলো। মনে পড়ে এই কিছু সময় আগের কথোপকথন। লিপির অনেক স্বপ্ন ছিলো। লিপি ডাক্তার হতে চেয়েছিলো, লিপি চা-বাগানের দরিদ্র মানুষগুলোর সেবা করতে চেয়েছিলো। স্টেশনে লিপির জন্য ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো তার মাওলানা স্বামী, নাহ লিপির জন্য নয়, হাজেরার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো তার স্বামী।
আবার হঠাৎ দেখা কবিতার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে একটা লাইন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন