নিম সম্পর্ক
কৃষ্ণেদু পালিত
ইচ্ছে নেই তবু যেতে হবে। এর আগে প্রতিবারই একটা না একটা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে। এবার আর সম্ভব নয়। জয়ন্তর কাছে কোনো আপত্তি ধোপে টিকবে না। ওর এক বন্ধু নিউ আলিপুরে থাকে, সে খবরটা এনেছে। আমেরিকা থেকে দিন সাতেকের জন্যে একজন বিখ্যাত গাইনোকলজিস্ট আসছেন কলকাতায়। ভদ্রলোকের নাম টি.এন. ভেলেংকার। প্রবাসী ভারতীয়। ইচ্ছে হলে মউলকে একবার দেখিয়ে নিতে পারে। .
শোনা অবধি অন্ধকার দেখছে মউল। চোখের সামনে সমস্ত দৃশ্য বন বন করে ঘুরছে। একটু একটু করে লোপ পাচ্ছে চেতনা আর একটা অভিশপ্ত দুপুর ভয়ঙ্কর হাঁ নিয়ে ছুটে আসছে তার দিকে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য, ধীর পায়ে পথ ভাঙছে এক কিশোরী, স্কুল থেকে ফিরছে সে। রোগা, লম্বা, ধবধবে শাদা পায়ের রং। চোখ দুটো খুব বড় বড় আর ব্যক্তিত্বপূর্ণ। ক্লাস নাইনে উঠে সদ্য শাড়ি ধরেছে। শাদা জমির উপর নীল পাড়, নীল ব্লাউজ। রাস্তা সংক্ষেপের জন্যে ডান দিকের একটা গলি ধরলো মেয়েটি। জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরমে চারদিক নির্জন। মেয়েটি আপন মনে হাঁটছিলো। হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে মূর্তিমান তিন শয়তান আচমকা মেয়েটির মুখ চেপে ধরে। এদিকটায় সারাদিন লোকজন প্রায় আসে না বললেই চলে। একটা মিলের পেছন ভাগ। কারখানার যত নোংরা আর বর্জ্য পদার্থ এখানে ফেলা হয়, তবু একটু সুুযোগ পেতেই মেয়েটি চিৎকার করার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে ভারি একটা হাত, যার দু’ আঙুলের ফাঁকে কালো জড়ুল, ডান ভ্রুর মাঝখান বরাবর কাটা দাগ - মেয়েটির মুখ চেপে ধরে।
ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া ছিলো। ঠিক সাড়ে ছ’ টায় জাগিয়ে দিলো। সাড়ে সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলো মউল। শাদার উপর বুটি দেওয়া শান্তিপুরী তাঁত পরেছে আজ। ঘাড়ের নিচে আলতো একটা খোঁপা। মুখে হালকা পাফের পরশ। নো কসমেটিক্স। ঠোঁটে সামান্য রঙ পর্যন্ত না। সাজগোজের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই অনীহা মউলের। বিশেষ করে অ্যাকসিডেন্টের পর। তারপর তো বাবা কলকাতার পাট উঠিয়ে দিলেন। মান সম্মান, মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে থানা-পুলিশ করেননি। পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে এসেছেন।
মাস দুই পরের ঘটনা। তল পেটে চিনচিনে ব্যথাটা প্রথম টের পায়। তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তখনকার মতো পেইন কিলার খেয়ে নিতো। যন্ত্রণাটা মাঝে মধ্যেই হতো। একদিন মাঝরাতে মরণাপণ্ন অবস্থা। তখন শ্রাবণ যায় যায়। ঝড় জল বৃষ্টি... সেই রাতেই হসপিটালে ভর্তি করা হলো। সিরিয়াস কন্ডিশন। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি। প্রায় তিন মাস ধরে ফিটাস ফেলোপিওন টিউবের মধ্যে গ্রো করে আছে। তারপর রাপচার্ড। অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটি রক্তে ভরে গেছে। জীবন বাঁচাতে ফেলোপিয়ান টিউব কেটে বাদ দিতে হলো। সমস্ত জীবনের মতো মউল হারালো নারীর সাধারণ সত্তা।
ডাক্তারবাবু বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, আর কোনো ভয় নেই, তবে সাময়িক একটু ডিপ্রেশন হতে পারে। চেষ্টা করবেন ওর মনটা সবসময় ভালো রাখতে।
পরিবর্তে বাবা নিজেই ভেঙে পড়লেন। ভেঙে পড়লো মা। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবনায় শোকে মূহ্যমান দুটি প্রাণী। সামান্য ডিপ্রেশন হলেও তখন অতোটা বোঝেনি মউল। বুঝেছে ক্রমশ, যত বড় হয়েছে। তাকে ঘিরে মা-বাবার কোমল পরিবেশ রূঢ় হয়েছে ধীরে ধীরে।
বিয়ে করবে না মনস্থির করেছিলো। দেখতে খারাপ নয়। লম্বায় চওড়ায় যে কোনো বাঙালি মেয়ের কাছে ঈর্ষণীয়। পাত্রীর বাজারে যথেষ্ট কদর। দেখতে এসে কেউ কখনও অপছন্দ করেনি। শিক্ষিত, সুশ্রী, গৃহকর্মে নিপুণা। সুুপাত্র কেনার মতো বাবার পর্যাপ্ত টাকাও আছে। আর পেটের দাগ? যা হোক একটা বলে চালিয়ে দিতে পারতো। তারপর?
মউল বিয়ে করবে না, একে একে সমস্ত পাত্রপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছে। যতোই বুঝান মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন। নিজের জীবনের অভিশাপ, জেনেশুনে অন্যের ওপর চাপাবে না। চাকরির চেষ্টা করছিলো। হয়তো পেয়েও যেতো। হঠাৎ জয়ন্তর আবির্ভাবে সব চিন্তা-ভাবনা উলটো-পালটা হয়ে গেলো।
বিয়েতে মত দিলো সে।
মিনিট কুড়ি ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার পর ডা. ভেলেংকার মউলকে বাইরে ওয়েটিং রুমে বসতে বললেন। জয়ন্ত চেম্বারে। যা বলার তাকেই বলবেন।
ওয়েটিং রুমে বসে ভিতরে ভিতরে ভাঙছিলো মউল। এরকম একটা আশঙ্কা জয়ন্তকে মনে ধরার পর থেকে ছিলো। বিয়ের পর থেকেই মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। তবু...।
মউল ঘামছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু আর ভয়ঙ্কর সেই দুপুর একটু একটু করে থাবা বাড়াচ্ছে। যন্ত্রণা। তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা। উরু বেয়ে রক্তের স্রোত। বুকের জামা ছেঁড়া। সদ্য প্রস্ফুটিত বুকে হিংস্র নখের আঁচড়। গালে নীল ক্ষত। যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলো, পাতলা ঠোঁট চিরে জমাট রক্ত। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো সে।
এসব কথা জয়ন্তকে আজও বলা হয়নি। চেষ্টা করেছে, পারেনি। একটু একটু করে গত পাঁচ বছরে অনেকটাই ভালোবেসে ফেলেছে জয়ন্তকে। মানুষটাকে তাই আঘাত দিতে চায়নি।
একটু পরেই জয়ন্ত বেরিয়ে আসে। গম্ভীর। মি. ভেলেংকারের সাথে কী হয়েছে সেই জানে। মউলের সাথে একটাও কথা বললো না। এমনকি ফিরেও তাকালো না। সোজা গিয়ে ফিয়াটে চাপলো। পেছন পেছন মউল। ভয়ে মুখ শাদা। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে। মনে মনে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। এমন একটা দিনের ‘অপেক্ষা’ তো দীর্ঘদিনের!
রাস্তায় একটা কথাও বললো না জয়ন্ত। মউলকে বাড়ির সামনে নামিয়ে গাড়ি ব্যাক করল। কোথায় গেলো কিছু বলে গেলো না। ফিরলো রাত করে। মত্ত অবস্থায়। এমনিতে মদ খায় না, মাঝে মধ্যে এক আধ পেগ খেলেও ধরার মতো কিছু নয়। আজ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। দরজা খুলতেই ভিতরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ধরে তুলতে যাচ্ছিলো মউল, বাধা দিল।
- ডোন্ট টাচ মি। আ-উ-ট। আই সে গেট আউট। নষ্টা, কুচরিত্রা মেয়েমানুষ ...
- কী বলছ তুমি !
- ঠিকই বলছি। জয়ন্ত টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। রাগে চোখ জ্বলছে। বলে, অস্বীকার করতে পারবে, বিয়ের আগে তোমার প্রেগনান্সি আসেনি? পাপের মূল্য দিতে টিউব কেটে বাদ দিতে হয়নি?
মউলের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। কথা বলতে পারে না। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। দু’ মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর শান্ত অথচ রূঢ়স্বরে উচ্চারণ করে, আই ওয়াজ রেপ্ড। রেপ্ড বাই থ্রি এভিলস, হোয়েন আই ওয়াজ থার্টিন। কথা বলতে বলতে হাঁপায় সে। নিশ্বাসে আগুন ছোটে। মুহূর্ত চুপ থাকার পর আবার বলে, তেরো বছর আগে। এই অঞ্চলের এক গলিতে।
জয়ন্ত চমকে ওঠে। নেশাটা টাল খায়। সামলে নিয়ে মউলের হাত চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, জেনেশুনে কেনো আমার জীবনটা নষ্ট করলে। কোন অধিকারে ! হো-য়া-ই? হোয়াই ইউ হেল মাই লাইফ?
এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মউল। জয়ন্তর কাছ থেকে এতোটা আশা করেনি। ভেবেছিলো বিয়ের এতো বছর বাদে ভালোবাসা অনেক দৃঢ় হয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে...। ক্রুদ্ধ সাপিনীর মতো ফুঁসে উঠলো। দু’ চোখ ঘৃণা আর ক্ষোভের জ্বলন্ত অঙ্গার। এতোদিনে সেই মুহূর্ত এসেছে।
- প্রশ্নটা আমিও তোমাকে করতে পারি।
- তার মানে !
জয়ন্ত’র পেটের মধ্যে একটা রাবারের বল ড্রপ খেয়ে গলায় আটকে যায়। ভয়ে কাগজশাদা মুখ। গলার স্বর ভাঙা।
মউল তখনও হাঁপাচ্ছে। কোনো উত্তর দিলো না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শ্বাস নিলো। কিছুটা সময় নিয়ে হাড় হিম করা ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে উচ্চারণ করলো, একটা অসহায় মেয়ের পক্ষে প্রতিশোধ নেওয়ার এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।
- কী বলতে চাও তুমি? জয়ন্ত’র গলায় আটকে থাকা বলে প্রবল অস্বস্তি। ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
- ভদ্রলোক সেজে যতই সাধু হও, দু’ আঙুলের ফাঁকে কালো জড়ুল আর ভ্রুর কাটা দাগ দেখে প্রথম দিনই তোমাকে চিনেছিলাম ...
এক ঝটকায় গলায় আটকে থাকা বলটা সরে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় পেটের ভিতর মোচড় মারে। মেঝে ভাসিয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেলে জয়ন্ত। সন্ধ্যায় গেলা দামি মদ আর চীনা খাবারের কিছুই এখন আর আলাদাভাবে চেনা যায় না।
উত্তর চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন