ক্রীড়নক
মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী
কিছু কিছু দিন আসে মনে হয় সবকিছু সমুজ্জ্বল এবং আশাতীত। প্রকল্প অনুমোদন ও কার্যক্রম চালু করার চিঠি পাবার পর ড. মোফাখখার চৌধুরীর কাছে আজকের দিনটিকে তাই-ই মনে হলো। মনে হলো অনন্য এবং সুখকর। গত কয়েক মাস ধরে দাতা সংস্থার ফরমাশ অনুযায়ী প্রকল্প তৈরি ও বাজেট প্রণয়নের কাজটি যথেষ্ট ভোগান্তি দিয়েছে। ওদের চাহিদা পূরণ করতে গেলে কন্ট্রাক্ট নেওয়ার কোনো মানেই দাঁড়ায় না। অনেক ঘষামাজা করে, অলৌকিক খরচের খাত বাড়িয়ে, প্রশাসনিক খরচ কমিয়ে ও ফিল্ড অপারেশনের খরচ বাড়িয়ে একটি লাভজনক প্রকল্প তৈরি এবং তা পাঁচ বছরের জন্য দাতা সংস্থার অনুমোদন লাভ করার অর্থই হলো-অর্থাগমের একটি নিশ্চিত পথ তৈরি হওয়া। তাছাড়া স্ত্রী সেলিমাকে প্রকল্পের পূর্ণ তদারকির দায়িত্বশীল পদে বসানোর ব্যাপারে দাতাগোষ্ঠী সম্মত হওয়ায় অর্থ সমাগমের পথ আরো সুগম হয়েছে।
পরিকল্পনামাফিক অর্থ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হওয়ায় আজ রাতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন ড. চৌধুরী। এতে উপস্থিত থাকার কথা তার সংগঠন ’ভাবমূর্তি’র মতোই কন্ট্রাক্ট পাওয়া ’সুকৃতি’ ও ’সমতা’র কর্ণধার মুরশিদ সানোয়ার এবং শফিক আহমেদের। ভাবমূর্তি কার্যালয়েই অনুষ্ঠানটি হবে। আয়োজনের পুরো দায়িত্ব পড়েছে মাহতাবের ঘাড়ে। মাহতাব সেলিমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য এক বিশ্বস্ত কর্মচারী। সে অ্যাকাউন্টস, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে সবকিছু দেখাশোনা করে। কিন্তু তার আগে ড. চৌধুরীকে আরেকটি বিশেষ সভায় যেতে হবে বিকেল পাঁচটায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপকে তিনি নামমাত্র সম্মানীতে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান পোভার্টি এন্ড স্ল্যাম ডুয়েলার্স শীর্ষক গবেষণা কর্মের উপাত্ত সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করেছেন। স্যারের প্রজেক্টে কাজ করলে পরীক্ষায় সহজে সাপোর্ট পাওয়া যাবে-এই আশাতেই সম্মানীর ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রাণান্ত শ্রম দিচ্ছে। ড. চৌধুরী যে বিষয়টি বুঝেন না তা নয়, বরং প্রকল্পের টাকা বাঁচাতেই জেনেশুনেই তিনি তার শিক্ষার্থীদের এ দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু মুখে বলছেন, শিক্ষার্থীদের খ-কালীন একটা কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন।
বিকেলে প্রকল্পের রিভিউ মিটিংয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে ড. চৌধুরী ডাক দিলেন সেলিমাকে, শোনো, আমি বেরুচ্ছি।
- একটু দাঁড়াও, সেলিমা অন্য ঘর থেকে সাড়া দিয়ে ধীর পায়ে এ ঘরে আসেন। তোমাকে না বলেছি কখনো কোথাও ঠিক সময়ে যাবে না? লোকজনকে অপেক্ষা করতে দাও, তোমাকে নিয়ে গল্প ছড়াতে দাও। এতে তুমি ওদের মনের মধ্যে গেঁথে যাবে।
- তা এখন তুমি আমাকে কোনো বড়শিতে গাঁথতে চাইছো? হালকা রসিকতার সুরে বলেন ড. চৌধুরী
- পাগল! হেসে মুখোমুখি দাঁড়ান সেলিমা, তোমায় গাঁথার কি আর বাকি আছে?
- সে আমি প্রতি পলে অনুভব করি, ড. চৌধুরী আয়নার দিকে ফিরে ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবির কলারটা ঠিক করে নেন।
- তবে ‘লেসুগিরি’টা বন্ধ করলে তুমি আমার পুরোপুরি হও। নিজের দিকে ড. চৌধুরীকে ঘুরিয়ে নিয়ে সেলিমা গলায় অভিমান ফোটান।
- কী যে বলো না! ড. চৌধুরী হালকা গলায় বলেন, তোমার এখনও সন্দেহ বাতিকটা গেলো না।
- সে কী আর সাধে চৌধুরী সাহেব। সেলিমা চোখে চোখ রাখেন, আমার চেয়ে কেউ তোমাকে বেশি চেনে না।
- তা জানি। কথার ফাঁকে মানিব্যাগটা খুলে হাঁ হয়ে যান ড. চৌধুরী, এ কী! সব টাকা যে সরিয়ে রাখলে?
- দিনকাল যা হয়েছে, বেশি টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরার অনেক বিপদ, সেলিমা হাসেন, তাছাড়া...
- তাছাড়া কী? ড. চৌধুরীর সুরে মেজাজটা জাগার পথে।
হাসেন সেলিমা, প্রিয় ছাত্রীদের নিয়ে না আবার চায়নিজে চলে যাও...
- আসলে তোমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার, ড. চৌধুরী গলায় আলতো ঝাঁজ ফোটাতে গিয়েও থেমে যান। কারণ তার জানা আছে সেলিমাকে খুঁচিয়ে কিছুই করা যাবে না। সেলিমা এবং তাদের পুরো পরিবারের সাপোর্ট না থাকলে আজকের ড. চৌধুরীকে শুধুমাত্র ভার্সিটির একজন লেকচারারই হয়ে থাকতে হতো। বুদ্ধিজীবী, সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেওয়া সম্ভব হতো না। নিজেকে সামলে নিয়ে ড. চৌধুরী মন গলানো হাসি ফোটান ঠোঁটে, তুমি একটুও বদলালে না।
- ঠিক আছে বদলাইনি, সেলিমা দরোজার কাছে এগিয়ে আসেন। কাল সকাল এগারোটায় কিন্তু স্কুলে ইন্টারভিউ নিতে হবে।
- তাই তো! ড. চৌধুরীকে একটু চিন্তিত দেখায়। আজ ভার্সিটি গেলাম না কন্ট্রাক্ট সই করার জন্য, কালও যাবো না?
- সিক কল করে দেবে, সরল সমাধান দেন সেলিমা।
- কিন্তু এতে ক্যারিয়ারের সমস্যা হয়, তুমি বোঝো না?
- তোমার ভার্সিটির ক্যারিয়ারে এ যাবত কোনো সমস্যা হয়েছে?
- না, তা হয়নি, সেলিমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কথা গিলে ফেলেন ড. চৌধুরী। তিনি জানেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থাকা সেলিমার আত্মীয় স্বজনের বদৌলতে বছরে ছয় মাস ক্লাস না নিয়েও দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেন। বরং প্রতি বছর প্রমোশন পেয়ে ভিসির চেয়ারের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
- ঠিক আছে, আমি এখন আসি। ড. চৌধুরী বিদায় নিয়ে গাড়ি বারান্দায় নেমে আসেন।
ড্রাইভার শুকুর মিয়া দরোজা খুলে দাঁড়ালে ড. চৌধুরী ঝপাৎ করে গাড়িতে ঢুকে ফোঁস করে দম ফেলেন। শুকুর মিয়া ফিরে তাকালে কপট গাম্ভীর্য এনে বলেন, চলো।
আত্মমগ্ন হয়ে গেলেন ড. মোফখখার চৌধুরী। মনে মনে বেশ বিরক্তই। সেলিমার বাড়াবাড়িটা অনেক সময় দুঃসহ মনে হয়। গাইডেন্স আর সাপোর্ট করছে বলে কি একেবারে মাথা কিনে নিয়েছে? আরে বাবা, আমি তো সংসারটা ঠিক রেখেছি, না কি? আমাকে হাজারো মানুষের সাথে মিশতে হয়, সংস্পর্শে যেতে হয়। কাজের স্বার্থে মেয়েদেরও খাতির করতে হয়, এজন্য এতো কথা শুনানো কেনো? রাগে স্ত্রীকে কল্পনা করে মুঠি পাকিয়ে কিল মারেন সামনের সিটে।
মৃদু শব্দ হওয়ায় শুকুর মিয়া গাড়ির গতি কমিয়ে ঘাড় কাত করে, স্যার কিছু বললেন?
- না। সেলিমার ঝাল ড্রাইভারের উপর মেটান ড. চৌধুরী, সামনে তাকাও।
- স্যার গেটের সামনে জটলা, শুকুর মিয়া একটু কাঁপাস্বরে বললো।
- তুমি যাও। ও নিয়ে ভাবতে হবে না। কিন্তু গাড়ি গেটের সামনে এলে টের পেলেন, বিষয়টি ভাবারই। জটলাটা ‘ভাবমূর্তি’কে ঘিরে। তিনি পালের গোদা সায়মুনকে চিনতে পারলেন। সে ওসমান গণি কলেজের ভিপি এবং এলাকার দাপুটে ছাত্রনেতা, থুক্কু, সন্ত্রাসী। যার সাথে ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতাদের আছে গভীর সম্পর্ক। ওদের ধমক দিয়ে কোনো কাজ হবে না বুঝতে পেরে তিনি ইশারায় সায়মুনকে ডাকলেন।
- কী হয়েছে সায়মুন? গাড়ির কাচ নামিয়ে ড. চৌধুরী মুখ বাড়ালেন।
- আমরা নতুন ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্যে কিছু হেল্প চেয়েছি স্যার, কিন্তু আপনার ম্যানেজার মাহতাব সাহেব ছেলেদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। সায়মুন প্রতিবাদী গলায় বলে, আমরা এর বিচার চাই।
- মাহতাব ভুল করেছে। ড. চৌধুরী নিজের চিরাচরিত ধুরন্ধর চাল প্রয়োগ করেন, ঠিক আছে। রাত ন’টার দিকে তুমি এসো, আমি অফিসে থাকবো।
- ঠিক আছে স্যার। সায়মুন ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হাঁক দেয়, অ্যাই চল সবাই, স্যার আমাদের ব্যাপারটা দেখবেন।
শুকুর মিয়া গাড়িটা ভেতরে নিয়ে দরোজার মুখে দাঁড়ায়। স্যার আমি কি অপেক্ষা করবো?
- না, তুমি বাসায় চলে যাও, ড. চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে পাঞ্জাবিটা টান করেন, ম্যাডাম তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
- ক’টার দিকে আসবো স্যার?
- ন’টার দিকে এসো।
- আমার ছেলেকে সাড়ে আটটায় ডাক্তারের কাছে নিতে হবে স্যার। শুকুর মিয়া করুণ সুরে বলে।
- কাল নিয়ো। ড. চৌধুরী কনফারেন্স রুমের দিকে পা বাড়ান।
- আজকের এ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি দশ দিন আগে স্যার। শুকুর মিয়া কাতর গলায় বলে।
- তাহলে আরও দশ দিন পরে নিয়ো। ভাবলেশহীন মুখে জবাব দেন ড. চৌধুরী।
- ছেলেটার ভীষণ অসুখ স্যার। শুকুর মিয়ার কণ্ঠে অনুনয়ের সুর।
- তা আমি কী করতে পারি শুকুর? ড. চৌধুরীর গলায় উষ্মা, চাকরি করতে হলে এসব বাহানা বাদ দিতে হবে। শুকুর মিয়াকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে তিনি ঢুকে গেলেন কনফারেন্স রুমে।
স্লামালেকুম স্যার! শুকুর মিয়ার কাতরতা ছাপিয়ে কনফারেন্স রুম থেকে সমবেত কন্ঠ আছড়ে পড়ে বাইরে।
- বসো বসো, নিজের চেয়ারে বসতে বসতে ড. চৌধুরী বললেন। তারপর উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে দু’জন অনুপস্থিত।
- না স্যার, ফাহিম নামের সিনিয়র ক্লাশের ছাত্র এবং প্রকল্পের সহকারী টিম লিডার বলে, জুঁই আর সোহেল এখনো ফিল্ডে, এসে পড়বে।
- ট্যাবুলেশনের কাজ কি কালকে শুরু করতে পারবে? ফাহিমের দিকে তাকান ড. চৌধুরী।
- সমস্যা আছে স্যার... ফাহিম আমতা আমতা করে।
- আবার সমস্যা? ভ্রু কুঁচকালেন ড. চৌধুরী।
- ঝর্ণাপাড়া, মাতারবাড়ি রেল বস্তি, ভাসমান কলোনি আর হারিস কলোনির বাসিন্দারা আমাদের তথ্য দিচ্ছে না।
- কারণ কী? প্যাডে নাম ক’টি লিখে চোখ তুলে তাকান তিনি।
- ওরা বলে, বিদেশীদের কাছে ওদের খবর বেচে আমরা টাকা নেবো, ওদের কী লাভ? তানভির নামের বেঁটেখাটো ছাত্রটি বলে।
- হুঁ, বস্তির লোকগুলোও দেখি সেয়ানা হয়ে গেছে। চিন্তিতমুখে বলেন ড. চৌধুরী। তা, তোমরা কী বলেছো?
- বলেছি, ফাহিম বলে, তাদের উন্নয়নের জন্যই এসব তথ্যের প্রয়োজন। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হয়তো আমরা নিজেরাও প্রকল্প নিতে পারি আবার সরকারকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্যে সুপারিশ করতে পারি।
- ভালোই বলেছো। ড. চৌধুরী মাথা নিচু করে লিখতে থাকেন, আর কিছু?
- আসলে স্যার বস্তিগুলোতে বিভিন্ন পার্টির ক্যাডাররা আড্ডা গেঁড়েছে, দরোজার মুখ থেকে জুঁইয়ের গলা ভেসে আসে। এ প্রকল্পের লিডার সে।
- আরে জুঁই, এসো, ড. চৌধুরীর চোখেমুখে আলো ঝলকায়, ভাবছিলাম, এতক্ষণ কী করছো ফিল্ডে।
- সরকারি দলের এক নেতাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, ঘর্মাক্ত কপালে লেপটে থাকা চুল সরিয়ে তন্বী জুঁই বলে, কোনো লাভ হলো না।
- কেনো? জুঁইয়ের রোদে পোড়া ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে জানতে চাইলেন ড. চৌধুরী।
- ওরা চাঁদা চাইছে, জুঁই শাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে সপ্রতিভ গলায় বলে।
- তাই? কন্ঠে একটু বিস্ময় ফোটান ড. চৌধুরী, তোমরাই বলো, এদেশের গরিব মানুষদের উন্নতি কী করে হবে? ঠিক আছে। উঠে দাঁড়ান তিনি, তোমরা চা-নাস্তা খাও, আর একাউন্টস থেকে টাকা নিয়ে যেও। আর হ্যাঁ, জুঁই, তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে, ওপরে এসো।
ড. চৌধুরী ভেতরের আগুন চাপা দিয়ে ওপরে ভাবমূর্তি অফিসে চলে আসেন।
- ওদের নাস্তা দিতে বলো। মাহতাবকে বললেন, আর পাঁচ শ’ করে টাকা দিয়ে দাও।
- জী স্যার, মাহতাব দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। ভাবে, পোয়াতি বউটা পথের দিকে তাকিয়ে আছে। না জানি আর কতো দেরি হবে।
- ভাউচারে সাইন নিতে ভুল করো না যেনো। নিজের কক্ষে ঢুকার আগে মুখ ফিরিয়ে বললেন ড. চৌধুরী।
- ঠিক আছে স্যার, মাহতাব নিরস মুখে বলে।
ড. চৌধুরী চেয়ারে বসতেই সেলিমার ফোন এলো।
- শুনছো?
- বলো।
- পিডি হিসেবে আমি একজনকে ঠিক করেছি।
- কাকে?
- তুমি হয়তো চিনবে, সেলিমা একটু বিরতি দিয়ে বলে, অ্যাকশন এইডের প্রজেক্টে কনসালটেন্টের কাজ করেছে, আগে ড্যানিশ প্রজেক্টে ছিলো, আদনান শহীদ।
- নাম শুনেছি বোধহয়।
- আমি তাকে আজকের মিটিংয়ে আসতে বলেছি।
- কেনো?
- অন্যরা সবাই পিডি নিয়ে বসবে, আর তুমি বসবে একা? সেলিমা স্বামীর বোকামিতে ক্ষুণœ হন।
- ওরা পিডি নিয়ে আসবে সেতো আমি জানতাম না, ড. চৌধুরী একটু অবাক কন্ঠে বলেন।
- ওরা চিন্তার দিক থেকে তোমার চেয়ে এডভান্স, সেলিমা হাসে, আমি না থাকলে তুমি যে কোথায় হারিয়ে যেতে এখনো বুঝতে পারছো না?
- পারছি না মানে? ড. চৌধুরী গলায় কৌতুক ফোটান, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
- কথাটা কি ঠিক বললে? বিষণœতা ফোটে সেলিমার গলায়, হাড়ে হাড়ে...
- স্যরি! ড. চৌধুরী জিভ কাটার ভঙ্গি করেন, তা আদনান আসবে তো?
- আসবে। আমি কথা বলেছি।
- ঠিক আছে, জুয়েল কোথায়?
- পড়তে বসেছে।
- নীরদ?
- সারা ঘরে খেলছে।
- আচ্ছা রাখি।
সেলিমার ম্যানেজিং ক্ষমতার প্রশংসা করতে হয়, সিগারেট ধরিয়ে জানালার বাইরে তাকালেন ড. চৌধুরী। বরাবরই সেলিমা আগ বাড়িয়ে সংসার ও সংসারের বাইরের সমস্যার সমাধান করে দেয়। এ জন্যে ওর ওপর এতো নির্ভরতা। তবে ফোনটা পাওয়ার পর ড. চৌধুরীর মনটা একটু খারাপ হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিলো জুঁইকে পিডির পোস্টে নিয়োগ দেয়ার। মাত্র মাস তিনেক বাকি ফাইনালের। মেয়েটি যেমন চৌকস তেমনি অপরূপা। অনেক দিন ধরেই তার নানা প্রকল্পে কাজ করছে সে। সে সুবাদে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। তবে সেলিমা সেটা পছন্দ করে না। সে কখনো কাউকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে দিতে চায় না। ড. চৌধুরীর ভাবনার জাল ছিঁড়ে জুঁই, আসবো স্যার।
- এসো, বসো। সিগারেট নিভিয়ে সোজা হয়ে বসেন ড. চৌধুরী, তোমার কথাই ভাবছিলাম।
- মিথ্যে বলছেন। চেয়ারে বসে মৃদু হাসে জুঁই, আপনি আছেন হিসেব নিয়ে।
- কীসের হিসেব? অবাক হলেন নব্য বুদ্ধিজীবী ড. মোফাখখার চৌধুরী।
- এই, কোন প্রকল্পে কতো লাভ হবে, সামনে আসা ঝামেলাগুলো কাকে দিয়ে মেটাবেন, কোনটা মাইনাস আর কোনটা প্লাস করবেন, এসব আর কী। জুঁই ঝরঝরে গলায় বললো।
- সব ঠিকই ধরেছো। তবে একটি বাদ পড়েছে।
- কোনটা আবার বাদ দিলাম?
- নিজেকে।
- মানে?
- মানে আমি তোমাকে নিয়েও ভাবছিলাম--।
- আমাকে নিয়ে? কপট বিস্ময় প্রকাশ করে জুঁই। যদিও সে জানে ড. চৌধুরী ভেতরে ভেতরে তাকে অনেক দিন ধরে পটাতে চাইছেন। লোকটাকে ওর খারাপ লাগে না। বয়েস একটু বেশি কিন্তু যেমন তীক্ষèধার তেমনি ধুরন্ধর ও সুঠাম পুরুষ। উনি যে তাকে চান সেটি জুঁই অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। তবে সেও ড. চৌধুরীকে খেলিয়ে নিতে চায়।
- হ্যাঁ, তোমাকে নিয়ে। ড. চৌধুরী যেনো একটু বেসামাল হলেন, তোমাকে আমার ভালো লাগে।
- সে আমার সৌভাগ্য। জুঁইয়ের গলায় মেকি কৃতজ্ঞতার সুর। যেনো হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলে, স্যার আমাকে একটু যেতে হবে, কাজ ছিলো।
- ঠিক আছে যাও। কিছুটা ক্ষুণœ হলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করেন না ড. চৌধুরী। তা আবার কবে দেখা হচ্ছে? প্রজেক্টের ব্যাপারে জরুরি আলাপ ছিলো।
- কাল ফ্যাকাল্টিতে দেখা হবে, স্যার। ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ে জুঁই।
জুঁই বেরিয়ে যেতেই ড. চৌধুরীর মনে পড়লো কাল স্কুলের টিচার নিয়োগের ইন্টারভিউ নিতে হবে। সেলিমার নিজের স্কুল। অথচ জুঁইয়ের সাথেও দেখা করার কথা দিয়েছেন। ফন্দি আঁটেন ড. চৌধুরী। মোবাইলে সেলিমার নাম্বারে ফোন করেন।
- কী হলো আবার? ভেসে আসে সেলিমার বিরক্ত কণ্ঠস্বর।
- কাল ইন্টারভিউ’র টাইম পেছাতে হবে।
- কেনো? সেলিমার গলায় বিরক্তির সুর বাড়ে আরও।
- এই মাত্র ভিসি স্যার ফোন করলেন। মিথ্যে বলেন ড. চৌধুরী, কাল সকাল ন’টায় জরুরি মিটিং আছে, যেতেই হবে।
- এতো শর্ট নোটিশে কেউ মিটিং ডাকে? অবিশ্বাসী কন্ঠে বলে সেলিমা, ঠিক আছে, তোমাকে একটার মধ্যে চলে আসতে হবে।
- ভেরি গুড। উৎফুল্ল হন ড. চৌধুরী, সকালটা তোমার আর দ্বিতীয় পর্ব আমার। ফোন রেখে হুঁস করে দম ছাড়েন ড. চৌধুরী। তারুণ্যের বুক খোলা জামায় ফুরফুরে বাতাস অনুভব করেন তিনি। মনে পড়ে আরেকটা কাজ বাকি আছে। সায়মুনদের ব্যাপারটা সামাল দিতে হবে। আবার বস্তিগুলোতে যে উৎপাত দেখা দিয়েছে তাও থামাতে হবে। একমাত্র মেয়র ছাড়া কেউ তাকে সিরিয়াসলি নেবে না। কারণ মেয়র জানেন কীভাবে, কাদের টেকনিক্যাল বুদ্ধিতে তিনি নগরপিতা হয়েছেন। তিনি মেয়র নাজিমুদ্দিন চৌধুরীকে ফোন করলেন।
- কী খবর ডক্টর সাহেব, অপর প্রান্ত থেকে মেয়র দরাজ গলায় বললেন, সব ভালো তো?
- হ্যাঁ। তা আপনি কেমন আছেন?
- চলছে কোনো রকম, নগরপিতা কি আর শান্তিতে থাকতে পারে? হা হা করে হাসেন মেয়র, সমাজসেবা-বুঝলেন না, জনসেবা।
- আমার কিন্তু একটু সমস্যা হচ্ছে। ভণিতায় না গিয়ে সরাসরিই বলেন ড. চৌধুরী।
- কী সমস্যা?
ড. চৌধুরী সায়মুন আর বস্তির ক্যাডারদের চাঁদার বিষয়টি খুলে বললেন।
- আমি দেখছি, মেয়র আশ্বাসের গলায় বললেন, আপনি আপনার কাজ করে যান।
- আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
- নিশ্চিন্তে থাকুন।
বুকটা অনেক হালকা হয়ে গেলো ড. চৌধুরীর। ভাবেন, উপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে এ ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক একেবারে অপরিহার্য। এমন সম্পর্ক তৈরি করার জন্য তিনি সময় ও অর্থ তো কম ব্যয় করেননি। অফিসের ফোনটা বেজে উঠলে চিন্তার জাল কাটে।
- হ্যালো?
- স্যার আমি সায়মুন।
- কিছু বলবে?
- আমি আজ আসতে পারছি না স্যার।
- ঠিক আছে, কাল এসো। মনে মনে হাসেন ড. চৌধুরী
- না স্যার, সায়মুন ক্ষুণ্ন গলায় বলে, আপনি মেয়র সাহেবের কানে এসব কথা না দিলেও পারতেন। সে ফোন রেখে দিলো।
অফিসে ড. চৌধুরীর আসলে তেমন কিছু করার নেই, চেয়ারে দোল খাওয়া ছাড়া। গেস্টদের অপেক্ষায় থেকে করছিলেনও তাই। আর তার ভাবনার জালে ঘোরাফেরা করছিলো জুঁই। এমন সময় দরোজায় নক হয়।
- আসতে পারি?
- কে? চোখ তুলে তাকান ড. চৌধুরী। দরোজায় একটি বছর পঁয়তাল্লিশের মুখ। চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা, নাকের নিচে ভারিক্কি গোঁফ।
- আমি আদনান শহীদ। আগন্তুকের কাছ থেকে জবাব আসে।
- আরে এসো, বসো। উৎফুল্ল ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন ড. চৌধুরী, কেমন আছো?
- ভালো। ঈষৎ ক্ষীণ এবং ক্ষুণœ গলায় বলে আদনান। ’তুমি’ সম্বোধনে সে অস্বস্তিবোধ করে।
- তুমি কি আগামী সপ্তাহে জয়েন করছো? জানতে চান ড. চৌধুরী।
- আমি তো এখনো টার্মস এন্ড কন্ডিশন কিছুই জানি না। আদনান সপ্রতিভ গলায় বলে।
- তুমি তো অনেক অর্গানাইজেশনে কাজ করেছো। ড. চৌধুরী দু’ আঙুলে পেপারওয়েট নাচালেন, সিমিলারই হবে।
- রিটেন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আদনান খর চোখে ড. চৌধুরীকে দেখে।
- রিটেন তুমি পরশু পেয়ে যাবে, চেয়ারে হেলান দেন ড. চৌধুরী। তবে হিডেন কিছু কন্ডিশন থাকবে, দ্যাট মিনস উইদাউট ডক্যুমেন্ট...
- বুঝলাম না। আদনান তার চাকুরি জীবনে এমন শর্ত আগে আর পায়নি।
- মানে হলো, নাম্বার ওয়ান, তোমাকে আমাদের, মানে ভাবমূর্তির হয়ে কাজ করতে হবে, ড. চৌধুরী একটু থামলেন। যদিও তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দাতারা অনুমোদন করবে।
উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে আদনান।
- সেকেন্ড, তোমার বেতনের টেন পার্সেন্ট নগদে প্রতিমাসে ভাবমূর্তিকে দিতে হবে। ড. চৌধুরী আদনানের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন, সেলিমা চৌধুরীকে তা দেবে।
- এমন শর্ত আজ পর্যন্ত শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। আদনান নাখোশ গলায় বলে, যেটা আপনারা দেবেন সেটা বাড়িয়ে না দিলে আমাকে ভাবতে হবে।
- কী যে বলো আদনান। ড. চৌধুরী কপট ভঙ্গিতে হাসেন। পিডির পে-স্কেল ডোনারদের হাতে, সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। তবে বিভিন্নভাবে তা পুষিয়ে দেয়া হবে।
- যেমন?
- ফিল্ড ট্রিপ, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, হেড অফিস ভিজিট, কনভেন্স ইত্যাদি আর কী!
- দারুণ বিজনেস তো! আদনান গোঁফ নাচিয়ে হাসে।
এমন সময় ইন্টারকম বেজে উঠলো। মাহতাবের গলা, স্যার গেস্টরা এসে গেছেন।
কনফারেন্স রুমে বসতে দাও, ড. চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে আদনানের দিকে তাকালেন, তুমি ডিগনিটি নিয়ে পজিশন হোল্ড করবে, তার বিনিময়ে কিছু স্যাক্রিফাইস তো করতে হবে।
- আপনি কি করেন? আদনান উঠে দাঁড়ায়।
- সে কি আর বলতে! ড. চৌধুরী ম্লান হাসেন। যা বলেছি তা তুমি-আমি আর সেলিমা ছাড়া কেউ কখনও জানবে না, মনে থাকবে তো?
- চেষ্টা করবো।
কনফারেন্স রূমে ঢুকতেই মুরশিদ সানোয়ার ও শফিক আহমেদ হৈ হৈ করে উঠলেন। কংগ্রাটস ড. চৌধুরী, কংগ্রাটস।
- আপনাদেরকেও কংগ্রাচুলেশন জানাচ্ছি। সবার সাথে হাত মিলিয়ে ড. চৌধুরী চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
- আরে আদনান, আপনি? ’সমতা’র পিডি রূপলা খন্দকার আদনানকে দেখে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে।
- তুমি চেনো ওকে? শফিক আহমেদ ভ্রু কোঁচকালেন।
আপনি চেনেন না দেখে আমি অবাক হলাম, রূপলা গড়গড় করে বলে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তো আদনান সাহেব তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন।
শফিক আহমেদ ও মুরশিদ সানোয়ার দুজনেই আদনান শহীদের সাথে হাত মেলান। রূপলা খন্দকার ছাড়াও কনফারেন্স রূমে আরো একজন মহিলা আছেন। মুরশিদ সানোয়ারের পাশে বসা মহিলাটি সুকৃতির পিডি। হাসি বিনিময় করেন আদনানের সাথে।
- আদনান শহীদ আমাদের নতুন পিডি। ড. চৌধুরী ইশারায় আদনানকে বসতে বলেন। ...তো শেষমেষ সবকিছু ভালোয় ভালোয় হলো কি বলেন?
- আপনি যদি ওদিন কুমিল্লা বার্ডে জ্বালাময়ী বক্তৃতা না দিতেন, মুরশিদ সানোয়ার মুখে রাখা পান এক পাশ থেকে আরেক পাশে সরান একটা বাজে শব্দ করে। মনে হয় না প্রজেক্ট আমরা পেতাম।
- আরে মুরশিদ ভুলে গেলে, শফিক আহমেদের খুঁতখুঁতে চোখ চশমার নীচে কৌতুক ছড়ায়, চৌধুরী বরাবরই জ্বালাময় ছিলো। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কি সে কম জ্বালা ছড়িয়েছে?
- চিম্বুক পাহাড়ের পিকনিক আর কক্সবাজারের সমুদ্র স্নানের সেই জ্বালা তো এখনো অনেকের মনে জ্বলছে। মুরশিদ বাঁকা চোখে রূপলার দিকে তাকালেন।
রূপলার মুখটা মুহূর্তে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। সে আড়চোখে আদনানকে দেখলো। আদনানের ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটে আছে, অর্থাৎ সে মজা পাচ্ছে। এ সময় ড. চৌধুরীর সেলফোন বেজে ওঠে।
- আমি আসছি না। সেলিমার গলা থমথমে।
কী হলো?
নীরদ পড়ে গিয়ে হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে ফেলেছে।
ডাক্তারের কাছে নেবে?
তা লাগবে না, সেলিমা আশ্বস্ত করেন।
ঠিক আছে।
ফোন বন্ধ করে ড. চৌধুরী সবার দিকে তাকান, ছোট ছেলে পড়ে গিয়ে সামান্য ব্যথা পেয়েছে। তা যা হোক। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন, আমাদের তিনটি সংগঠন একই ডোনারের প্রজেক্ট পেয়েছি সেটি আনন্দের সংবাদ। কিন্তু আমরা যদি ভুলে যাই যে, ডোনাররা এখনো সেই ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি নিয়ে চলছে তাহলে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হবে। এই একটি প্রজেক্টের জন্য আমরা বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারি না।
- তাহলে আমরা অ্যাট লিস্ট কোয়ার্টারলি কো-অর্ডিনেশন মিটিংয়ের আয়োজন করি। শফিক আহমেদ তাকালেন মুরশিদের দিকে।
- সেটা ভালো হয়। মুরশিদ সায় দেন।
- আরেকটি বিষয়, ড. চৌধুরী সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে ডোনারদের কিছু জানাবো না।
- কারেক্ট। সমস্বরে বলেন সুকৃতি আর সমতার সভাপতিদ্বয়।
এরপর পুরো আলোচনা তিন সভাপতির কৌতুক, মশকরা আর খুনসুটিতে ডুবে যায়। আদনান অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আমাকে একটু যেতে হবে।
- যাবে? ড. চৌধুরীর পুলকমাখা মুখে কালো ছাপ পড়ে, ঠিক আছে। তবে সকাল ন’টায় এসে পড়ো।
আদনান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়েন।
- তোমার সিলেকশন ঠিক হয়েছো তো চৌধুরী? আদনান বেরিয়ে যেতেই চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন শফিক আহমেদ, আমি ওকে চিনি। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না।
- সেলিমার সিলেকশন। ড. চৌধুরী হাসি ফুটানোর চেষ্টা করেন, তবে চিন্তার কিছু নেই, ওরও ব্যাপটাইস্ট হতে দেরি হবে না।
- বুঝলাম না। শফিক আহমেদ চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ড. চৌধুরীর দিকে।
- বুঝলে না! ড. চৌধুরী বুঝানোর ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, আমরাও তো সমাজ বদলের আন্দোলন করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়-রাজপথ কাঁপিয়েছি, তাই না?
- তো! ভুরু নাচিয়ে আবারও প্রশ্ন করেন শফিক আহমেদ।
- আর এখন কী করছি? পাল্টা প্রশ্ন করেন ড. চৌধুরী।
হাসি ফুটে ওঠে শফিক আহমেদের চোখেমুখে। ড. চৌধুরীর ইঙ্গিত এখন তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন।
- আদনানের এখন সংসার হয়েছে। বলে চলেন ড. চৌধুরী। বাচ্চা-কাচ্চা আছে, পারিবারিক অবস্থাও সুবিধের না। সুতরাং সেও আমাদের দলে ভিড়ে যাবে। ড. চৌধুরী ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফোটালেন, অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া তাকেও গিলে খাবে, ব্যাপটাইস্ট হতেই হবে।
- দারুণ! শফিক আহমেদ তোষামোদি গলায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
- এই না হলে কি আর বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়? মুরশিদ প্রশস্তি করেন।
আবার শুরু হয় তিন সভাপতির মশকরা আর খুনসুটি। আড়ালে চলে যায় তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ‘নিবেদিতপ্রাণ’ তিনটি সংগঠনের সকল প্রতিশ্রুতি।
সবাই বেরিয়ে গেলে ড. চৌধুরী গাড়িতে উঠে শুকুর মিয়াকে বললেন, ক্লাবে চলো।
শুকুর মিয়া জানে ক্লাবে যাওয়ার মানে, চৌধুরী সাহেব গলায় পানি ঢালবেন। সে বিক্ষুব্ধ মনে গাড়ি চালায়। স্যারের আজকের আচরণ তাকে খুব দুঃখ দিয়েছে। ছেলেটার এমন অসুখ, অথচ স্যার তার সাথে দুর্ব্যবহার করলেন। আবেগে তার চোখ ভিজে ওঠে।
- কী শুকুর, মন খারাপ? ড. চৌধুরী হালকাস্বরে প্রশ্ন করে পাঁচ শ’ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলেন, এটা রাখো।
ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে আপন মনে গজগজ করে শুকুর, টাকা দিয়ে এরা সব কিনতে চায়, মানুষকে মানুষই মনে করে না।
ড. চৌধুরী ফোনটা বন্ধ করে ভাবেন, গলাটা ভিজিয়ে জুঁইয়ের কাছে যাবো। ওদের বাড়িতে তিনি আরও বারকয়েক গিয়েছেন। ওর বাবা কড়া মানুষ; কিন্তু ভার্সিটির দাপুটে প্রফেসরকে দেখলে একেবারে বিনম্র হয়ে যান। হয়তো তাকে দেখে জুঁই খুশি হবে না বরং রেগে যাবে। তবে মুখে কিছু বলবে না। চাই কি হাসিও ঝুলিয়ে রাখতে পারে।
ক্লাব থেকে বিশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এলেন ড. চৌধুরী। এমনটা সহজে করেন না। ক্লাবে ঢুকলে কমপক্ষে ঘণ্টা দুই তো থাকেনই। আজ দ্রুত তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে শুকুর বিস্মিত হয়। সে তাকিয়ে দেখে স্যারের চোখে আলতো রঙের ছায়া।
- বাসায় যাবো স্যার? শুকুর জানতে চায়।
- না, সুগন্ধায় চলো।
- সুগন্ধায়? শুকুর মনে মনে পুনরুচ্চারণ করে, মানে জুঁইদের বাসায়। এই এক রোগে পেয়ে বসেছে ড. চৌধুরীকে। মেয়েটার পিছু লেগেছেন বছর দুয়েক ধরে। কড়া আর ধার দেয়া তলোয়ারের মতো জুঁইকে আজও বশে আনতে পারেননি। শুকুর জানে জুঁই যেদিন বাগে আসবে তার পরদিন ড. চৌধুরী তার খোঁজও নেবেন না। এমন অনেক খেলা সে দেখেছে গত দশ বছরে। ম্যাডাম সব জানেন, রাশও টানতে চান, কিন্তু পেরে ওঠেন না। সে মনে মনে গালি দেয়, হারামজাদা!
- কিছু বলছো?
- না স্যার।
গাড়ি ছোটে সুগন্ধার দিকে, জুঁইয়ের খোঁজে।
পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন